সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

আদর্শ সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থা : সাজিব চৌধুরী


প্রকাশিত:
৬ অক্টোবর ২০২১ ২৩:৩২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:২৩

ছবিঃ সাজিব চৌধুরী

 

শিক্ষা ও সংস্কৃতি একটা জাতির মৌলিক চালিকাশক্তি। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে, সংস্কৃতি জাতির দর্পণস্বরূপ। সংস্কৃতির দর্পণে একটু চোখ দিলেই একটা জাতির ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর সব ধরনের বিষয় দেখে নেয়া যায়।
আমরা জানি, একটা রাষ্ট্রে নানান ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যেমন, সামাজিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক সংস্কৃতি, ধর্মীয় সংস্কৃতি, বিচারিক সংস্কৃতি ইত্যাদি। একটা জাতি কতটা উন্নত তা নির্ভর করে ওই জাতির সংস্কৃতির বুনন কতটা মজবুত ও যুক্তিসঙ্গত তার উপর। দুর্বল, যুক্তিহীন ও অস্বচ্ছ সংস্কৃতি কখনও একটা জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, আমরা যা তা-ই আমাদের সংস্কৃতি। এই কথাটির মাধ্যমেও বোঝা যায়, সংস্কৃতির মাঝে জাতির সবকিছু খুঁজে পাওয়া যায়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করে কোনোভাবেই কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না।
আমরা কি সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করতে পারি? না, সংস্কৃতিকে আমরা কখনও রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারি না। সংস্কৃতি যেমন ধীরেধীরে গড়ে ওঠে, তেমনটি সংস্কৃতির পরিবর্তনও করা যায় বা হয়ে থাকে ধীরেধীরে। সংস্কৃতির পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বে না-চাইলেও সংস্কৃতি কমবেশি পরিবর্তন হবেই। আমাদের লক্ষ রাখার বিষয় হলো, এই পরিবর্তন কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক। যদি এই পরিবর্তন ইতিবাচক হয়ে থাকে এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর হয়, তা আমরা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারি। যদি তা নেতিবাচক হয়ে থাকে, কীভাবে তা ইতিবাচক করা যায় এবং কীভাবে এমন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায় সেই বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এছাড়া, আমাদের আরও লক্ষ রাখা উচিৎ, কীভাবে গেঁড়েবসা অপসংস্কৃতিকে ধীরেধীরে ছেঁটে ফেলা যায়।
এমনকিছু ফাঁদপাতা অপসংস্কৃতি আছে যা একটা জাতির মাঝে বাসা বেঁধে জাতিকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এইসব ভাইরাস জাতের অপসংস্কৃতিসমূহের কারণে জাতি হয়ে যায় দ্বিধাবিভক্ত ও বিশৃঙ্খল, মানুষে-মানুষে দেখা দেয় দাঙ্গাহাঙ্গামা। জাতি চিন্তা ও মননে বিশ্রিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার, কিছু সংস্কৃতি গড়ে ওঠে গড্ডলিকা প্রবাহে বা অন্ধ অনুকরণে। গড্ডলিকা প্রবাহে সৃষ্ট সংস্কৃতিকে আমরা কখনও যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখি না। বরং কেউ যুক্তি দিতে চাইলে অনুভূতির কথা বলে তাকে বিভিন্নভাবে দমিয়ে দেই। অনেকসময় এই ধরনের সংস্কৃতি সত্যের আবরণে মিথ্যার বেসাতি করে। এই জাতীয় সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে গড়ে ওঠে বিভিন্ন রকমের প্রতারণামূলক ব্যবসা। একটা গোষ্ঠী মানুষের সরলতা ও মূর্খতাকে কাজে লাগিয়ে নানান ধরনের ফায়দা লুটে নেয়। যেকোন দুর্বল ও ভিত্তিহীন সংস্কৃতি অসৎ ও সুবিধাবাদীদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। তারা চায়, এই ধরনের সংস্কৃতি যুগযুগ ধরে টিকে থাকুক। কোনো সংস্কৃতি একবার ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা গেলে তা সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করা খুব কঠিন হয়ে যায়। একপর্যায়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই মনে করে ওই সংস্কৃতি তাদের জন্য অপরিহার্য।
জাতি হিসাবে সৌখিন হতে চাইলে, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সংস্কৃতিসমূহের ভাল দিক, মন্দ দিক বা আদৌ কোন দিক আছে কিনা, সেসব বিষয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। যে সকল সংস্কৃতির শুধু মন্দ দিক আছে, সে সকল সংস্কৃতি নিশ্চিতভাবে ছেঁটে ফেলা উচিৎ। যে সকল সংস্কৃতির মধ্যে ভাল-মন্দ মিশ্রিত আছে, সে সকল সংস্কৃতির মন্দ দিক কীভাবে সংস্কার করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। অন্যদিকে, যে সকল সংস্কৃতির মধ্যে ভাল-মন্দ কিছুই নেই, সে সকল সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমে জাতি তার মূল্যবান সময় নষ্ট করে। এর মাধ্যমে অনেকসময় একটা জাতির বড় একটি অংশ অলস ও শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ে। এই ধরনের সংস্কৃতিও কৌশলে ধীরেধীরে মুছে দিতে হবে জাতির রক্তমজ্জা থেকে। আমরা যদি বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তিনির্ভর সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তার জন্য ব্যাপক মাসুল দিতে হবে।
তাহলে, আমরা কীভাবে আমাদের সংস্কৃতিকে যৌক্তিক ও বাস্তবতার নিরিখে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি? আমি মনেকরি, তার জন্য প্রকৃত জ্ঞানচর্চার বিকল্প নেই। জ্ঞানের সাথে সম্পর্ক আছে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার। শিক্ষা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে; অন্যদিকে সংস্কৃতি মানুষের চেতনাকে প্রভাবিত করে। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির সাথে শিক্ষা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই, প্রকৃত শিক্ষাই দিতে পারে প্রকৃত সংস্কৃতির আদর্শ কাঠামো। এ লক্ষ্যে, আমাদের উচিৎ শিক্ষার বিষয়সমূহ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে এবং বুঝতে পারে, প্রকৃতঅর্থে আমাদের সংস্কৃতি কেমন হওয়া উচিৎ। প্রকৃত জ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতিই আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে উন্নতির স্বর্ণশিখরে। এই বিজ্ঞানের যুগে বসে আমরা যদি এখনও অপবিজ্ঞান ও অপশিক্ষা চর্চা করি, তাহলে, জাতির ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে ঠেকবে আমার বোধগম্য নয়। আমাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবমুখি শিক্ষাব্যবস্থা। বিষয় ও ক্ষেত্র অনুযায়ী আদর্শ সংস্কৃতি কেমন হওয়া উচিৎ তার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে যৌক্তিক মানদণ্ড। এই মানদণ্ডের ভিত্তিতে সাজাতে হবে পাঠ্যপুস্তক। অযৌক্তিক আবেগনির্ভর সংস্কৃতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায় সে বিষয়ে বোদ্ধামহলকে হতে হবে তৎপর এবং তাঁদের দূরদর্শী ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান দিয়ে করতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। আমরা যদি সাময়িকভাবে নানাবিধ সুবিধালাভের আশায়, জাতিকে অযৌক্তিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেই, আমরা ক্রমাগত উন্নত বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়ব।
আরেকটি বিষয়, সত্যকে ধারণ ও লালন করা। আমরা অনেকসময় সত্যকে জেনেবুঝেও মিথ্যার মায়াজাল থেকে বেরোতে পারি না। আমি মনেকরি, সত্য যতোই তেতো হোক, আমাদের উচিৎ সত্যকে ধারণ করা। এই বিষয়ে কোনো সমঝোতা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু, দেখা যায় সত্য সবসময় বাধাপ্রাপ্ত হয়। মিথ্যা যতটা প্রচার ও প্রসার লাভ করে, সত্য ততটা পায় না। তার অন্যতম কারণ হতে পারে, মানুষের অজ্ঞতা। পৃথিবীতে অজ্ঞের দল সবসময় ভারি ছিল, এখনও আছে। সেই অজ্ঞদের কাছে যুগেযুগে প্রাণ দিতে হয়েছে সমাজের জ্ঞানী মানুষদেরকে। তাদের ভয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। হাজার বাধা অতিক্রম করেই পৃথিবী এই পর্যায়ে এসেছে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে মিথ্যাকে মোকাবেলা করতেই হবে।
মিথ্যা, অবাস্তব, কল্পনানির্ভর শিক্ষা ও সংস্কৃতি কখনও জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এই ধরনের শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে কখনও দীর্ঘমেয়াদী সুফল আশা করা যায় না। মিথ্যাকে যতটা উপকারী বলে মনে হয়, বাস্তবে তার অনেকগুন বেশি একটা জাতিকে ভেতরে-ভেতরে ধ্বংস করে দেয়। যখন আমরা বিষয়টি টের পাই, তা এতবেশি দেরি হয়ে যায় যে আমরা চাইলেও সেই অবস্থায় অগ্রগামী বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না।
এক্ষেত্রে, উপর্যুক্ত বিষয়গুলো অনুধাবন করে রাষ্ট্রকে নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারকে গ্রহণ করতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের জন্য নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। একইসাথে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে কার্যকরী গবেষণাকেন্দ্র। সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে নির্লোভ সরকারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা এই ধরনের বিষয়গুলোকে ধাপেধাপে সমাধান করতে পারি।
আমাদেরকে অন্ধদর্শন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আদর্শ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সাহসিকতার-সাথে অপ্রমাণিত ও অযাচাইকৃত বিষয়াদি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। অন্যথায়, এসব বিষয়গুলো আমাদের সংস্কৃতিতে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো চেপে বসবে। ঘাপটিমেরে বসে থাকা বিভিন্ন অপসংস্কৃতি যতদিন জাতির রক্তমাংস থেকে পরিশোধন করা হবে না, ততদিন আমাদেরকে নানাভাবে ভুগতে হবে। মনে রাখতে হবে, অন্ধের মতো চললে উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।



সাজিব চৌধুরী
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top