সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

তুলা : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
২৬ অক্টোবর ২০২১ ০১:৩৯

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ০০:২৬

 

"তুলা শিমুল তুলা, বালিশের তুলা, কোলবালিশের তুলা, তুলা, শিমুল তুলা.... "- অপরিচিত হাঁকের ধরন নাকি অন্যকিছু - তমা এগিয়ে যায় বারান্দায়। যে লোকটি হাঁক দিচ্ছে তার বয়স বড়জোর পঁচিশ টচিশ হবে, ঠিক তার পিছনে বস্তা ভর্তি তুলা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরেক জন, প্রথম জনের সমবয়সী, তবে কৃশকায়। পিছনের জনের চোখে মুখে একরাশ বিষন্নতা। তুলার বোঝাটা বহন করা তার জন্য কি খুব কষ্টকর হচ্ছে! তুলার আর ওজন কত ভাবতেই ছোট বেলার এক অঙ্কের কথা মনে পড়ে গেল তমার।সেবার অঙ্ক পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞানের একটা প্রশ্ন এসেছিল, এক কেজি লোহার ওজন বেশী নাকি এক কেজি তুলার? ছোট ছিল, উত্তরটাও ভুল হয়েছিল। পরীক্ষা শেষে বাসায় এসে সব পেরেছি ভাব নিয়ে সারাদিন দুষ্টুমি আর খেলে কাটিয়েছিল তমা। সন্ধ্যায় মা যখন প্রশ্নপত্র নিয়ে বসলেন তখন তমার উত্তর শুনে খুব হেসেছিলেন মা, কিন্তু সঠিক উত্তরটা বলে দেননি। তমা যদিও প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছিল কিন্তু সঠিক উত্তরটা কি হবে আর কেন তার দেয়া উত্তরটি সঠিক হয়নি তা বের করার চেষ্টায় ভাবনা চালিয়েছিলো আরও কয়েকদিন। সে যে কি ভাবনা! খেলতে গিয়ে ভাবছে, খেতে বসে ভাবছে, গোসলে গিয়ে ভাবছে, ভাবতে ভাবতে লম্বা সময় বালতির পানির দিকে তাকিয়ে কাটাচ্ছে। অবশেষে যখন উত্তরটা পেল, খাবার ঘর লাগোয়া বারান্দার পাশে যে পেঁপে গাছটা ছিল, তমার মাথা বরাবর উঁচু, তার পাতার আড়ালে দেয়ালের উপর চক দিয়ে কারন টা ব্যাখ্যা সহ লিখে রাখল। মাঝে মধ্যেই তমা চুপিচুপি গিয়ে পাতা সরিয়ে পড়ে নিত কারনটা আর নিজেকে "ব্রেভো কলম্বাস" বলে মিটিমিটি আপনমনে হাসত। তমার মনে হত সেই কেবল উত্তরটা জানে, আর তা হবে নাই বা কেন, তমার মনে আছে বন্ধু রুনুকে একদিন টিফিনের সময় জিজ্ঞেস করেছিল প্রশ্নটা, রুনু পারেনি। ঠিক তখনই বল পায়ে মিজান দৌড়ে যাচ্ছিল সামনে থেকে যেই রুনু, মিজানকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করল, মিজান "সর, কি সব প্রশ্ন করিস!" বলে ঠোঁট উল্টে পালিয়েছিল…

"তুলা শিমুল তুলা....তুলা" হাঁকে মুহুর্তের জন্য বর্তমানে ফিরে এসে আবার ছোটবেলার ভাবনায় ডুবে যায় তমা। তখন শীতকালে ধুনটেরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে হাঁক দিত, "এই লেপ তোষক, জাজিম... এই লেপ তোষক..."। একবার তমাদের বাসার বারান্দায় বসে ধুনটেরা কাজ করছিল। পুরানেো লেপ ভেঙ্গে নতুন লেপ তৈরী হবে। তমার খুব ইচ্ছে ছিল ওদের সামনে বসে কাজটা দেখবে। বাইরের রান্না ঘড়ে সেদিন মুড়ি ভাজছিল মিনতি মাসি, তার কাছ থেকে একবাটি সদ্য ভাজা মুড়ি আর দাদীর ঘড়ে খাটের তলায় রাখা তালের পাটালী গুড়ের হাড়ি থেকে একটুকরো গুড় নিয়ে যেইনা বারান্দায় পা বাড়িয়েছে অমনি কোথা থেকে মা এসে খপ করে হাত ধরে টানতে টানতে ভিতরের ঘরে নিয়ে এল। সেদিন মা এমন মজার, রোমাঞ্চকর একটা কাজ সামনে বসে তমাকে দেখতে তো দেয়ই নি, উল্টো ঘরে তুলা উড়ে আসবে এই ছুঁতোয় সারাদিন দরজা জানালা ব্ন্ধ করে রেখেছিল। তুলা কাঁটার সেই অপার্থিব শব্দে সারাদিন তমার মন অস্হির হয়ে ছিল। পরে লেপের খোলে তুলা ভরা হয়ে গেলে তমা অনুমতি পেয়েছিল জানালার পর্দা সরিয়ে একটু দেখার। জানলার শিকের মধ্যে পা ঢুকিয়ে বসে তমা দেখেছিল খোলের মধ্যে তুলা ভরা হয়ে গেলে কিভাবে কাঠের লম্বা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সব জায়গায় তুলা সমান করে দেয়া হয়। তারপর সুঁইয়ে সুতো গেঁথে লেপের মাঝ বরাবর একটা পদ্ম আর তার চার পাশে তিনটা করে পাতার ডিজাইন ফুঁটিয়ে তোলা হলেই কাজ শেষ।কি খুশী কি খুশী আজ নতুন লেপ গাঁয়ে দিয়ে ঘুমানো যাবে এই ভেবে তমা তাড়াতাড়ি বিকেলের খেলা কোনোমতে শেষ করে পুকুর ঘাট থেকে হাত পা ধুয়ে যখন বারান্দায় টুলের উপর বসে গামছা দিয়ে হাত পা মুছছিল তখন জামাল চাচা এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে, "চাচীআম্মা ভ্যান লইয়া আইছি" বলে দাদীকে ডাক দিল। দাদী তখন মা' কে নিয়ে ফুপুর বাড়িতে পাঠানোর জন্য টিন ভর্তি মুড়ি, চিড়ার নাড়ু, নারকেলের সন্দেশ সাজিয়ে দিলেন জামাল চাচাকে।
তমা ভুলেও ভাবতে পারেনি নতুন বানানো লেপটাও ঐদিন ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ভ্যানে লেপটা উঠানো হলে তমা চুপি চুপি গিয়ে একটু হাত বুলিয়ে এসেছিল লেপটার গায়ে, আহা কি নরম! খুব কষ্ট পেয়েছিল সেদিন তমা, কেঁদেছিলও অনেক্ষন,যদিও তা কেউ দেখেনি। সেদিন বাবা বাড়িতে ছিলেননা; মা আর দাদী, তমার বড় বোন লাজু আপা, তমা আর তার ভাইকে দেখভালের দায়িত্ব নুরির মা'কে বুঝিয়ে দিয়ে সন্ধ্যের মাগরিবের নামাজ পড়ে মাহ্ফিল শুনতে গিয়েছিল। কয়েকদিন ধরেই শহরে মাইকিং হচ্ছিল "এক বিরাট মাহফিল, এক বিরাট মাহফিল, প্রিয় শহরবাসী আগামী রবিবার সন্ধ্যা সাত ঘটিকা হইতে ইদগাহ ময়দানে এক বিরাট মাহফিলের আয়োজন করা হইয়াছে... বিরাট মাহফিলের আয়োজন করা হইয়াছে...উক্ত মাহফিলে ওয়াজ করিবেন হযরতে মাওলানা .... আপনারা উক্ত মাহফিলে যোগদান করে দো'জাহানের অশেষ নেকী হাসিল করুন..." , না হুজুরের নাম টা মনে নেই তমার। তবে মনে আছে মা আর দাদী চলে গেলে নুরির মা লাজু আপার সাথে লুডু নিয়ে বসেছিল, তমাকেও ওরা ডেকেছিল কিন্তু তমার তখন মন ছিলোনা খেলায় । তবে সেদিন মা বিছানার তোষক রোদে দিয়েছিল। গরম বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে তোষকের ওমে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিল মনে নেই . . .।

তমা বারান্দায় এসে গ্রীল ধরে দাঁড়ায়, সেই সাথে তার ভাবনার গতি এক তীর থেকে অন্য তীরে মোড় নেয়। নিজের কাছেই প্রশ্ন করে তমা, আচ্ছা সব মেয়েদেরই কি বাবার বাড়ি থেকে লেপ, বিছানা, বালিশ দিতে হয় তাদের শ্বশুর বাড়িতে? তমাকে ও তো দিয়েছিল। লেপের কথা মনে হতেই তমার মনে পড়ে এক শীতের রাতের কথা, সালটা মনে নেই। সেবার শীত পড়েছিল খুব। তমার ছেলে ধ্রুব তখন বেশ ছোট। তমার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া লেপটা ডাবল সাইজের, তাও তিন জন মিলে গায়ে দেয়া যাচ্ছিল না, একপাশ থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে হাড়ে কাঁপন ধরাচ্ছিল। তমার স্বামী তার মাকে গিয়ে বলল,
- আম্মা আব্বার লেপটা উপরে উঠানো আছেনা?
-হ আছে। কেন? লেপ দিয়া কি হইব?
- ঐটা নামাই। একলেপে হয়না
- ঐডা নামানো যাইবো না।
- কেন? কি হইছে
- ঐডা রীতার বিয়ার জন্য রাখছি। খবরদার হাত দিবিনা। লেপ লাগবে বানাইয়া ল... অমন ছুডু লেপ মাইয়ারে দিছে ক্যা, মাইয়ার পোলাপান হইব হেইডা জানতো না...

শেষ কথা গুলো একটু উঁচু আর ঝাঁঝের সাথে হচ্ছিল আর সেটা যে তমাকে শুনানোর জন্য তা তমা বেশ বুঝতে পেরেছিল। তমা চুপচাপ অপেক্ষা করছিলো তার স্বামীর ভূমিকা কি হয় তা দেখার জন্য….।

তমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই হয়তো লোকটি একটু জোড়ে হাঁক দেয়, "তুলা শিমুল তুলা....তুলা.... আপা লাগবো, নিবেন আপা? ভালো তুলা।" তমা মাথা নেড়ে না বলে। লোকটা আবার বলে, "আপা কিইনা ঘরে রাইখা দেন, তুলা নষ্ট হইবনা, আপা, বালিশে ভইরেন, ভাল শিমুল তুলা আপা"। লোকটাকে না বলে তমা ঘরের ভিতরে এসে মোবাইলটা হাতে নেয়। ফেসবুকে ঢুকে একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় তমার, শিমুল তুলার বালিশ মাত্র পাঁচশ টাকা, নকল প্রমান করতে পারলে দশহাজার টাকা নগদ পুরস্কার । তমার হাসি পায়, আজকাল বালিশও অনলাইনে বিক্রি হয়! বিছানায় একটু গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে হয় তমার। কিন্তু আজ মাথার বালিশটা কেমন যেন নেতানো লাগছে, আর একটু তুলা ভরলে ঠিক হত মনে হয়, তমা ভাবে। তমার তুলা ওয়ালা লোকটার কথা মনে হয়, "আপা বালিশে ভইরেন, ভাল শিমুল তুলা আপা... "। তমা বারান্দা থেকে রাস্তায় উঁকি দেয়, নাহ লোকটা চলেই গেছে। অগত্যা ফেসবুকে বালিশের পেইজটাতে গিয়ে অনলাইনে একটা সবুজ আরেকটা বেগুনী দুটো বালিশের অর্ডার করে আকাশের দিকে তাকায়। বারে একটু আগেওতো রোদ ছিল, এরমধ্যেই মেঘে ঢেকে গেল চারদিক! ঘন ছাই বর্নের আকাশে এখনো কিছু সাদা তুলোর মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে; কাছে কোথাও বজ্রপাত হল, একঝাঁক উড়তে থাকা পায়রা ভয় পেয়ে বেসামাল।তবে তমার চোখে আজ নতুন বালিশের স্বপ্ন, মাথার পিছনে তুলো মাখা আবেগময় স্মৃতি আর মনের গভীরে সেই সুরেলা হাঁক, "তুলা, শিমুল তুলা, বালিশের তুলা, কোলবালিশের তুলা..."

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top