সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির বড়দিন উদযাপনের সেকাল-একাল : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:৪৫

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০১:০২

 

"উৎসব মানে এক মিলনের মেলা,
কিছু দেওয়া,কিছু নেওয়া,জীবনের খেলা।"

উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির উৎসবের শেষ নেই।আসলে উৎসব আনন্দের উৎসভূমি। উৎসব দূরকে নিকট করে, অপরকে আপন করে।মুক্তমনা বাঙালির সংস্কৃতি হল ধর্ম যার যার,উৎসব সবার। উৎসব সব দেশে সবকালেই সমানভাবেই প্রাসঙ্গিক। বাঙালির ঘরে ঘরে, বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে। আর এই পার্বণ বা উত্‍সব মানেই নতুন আনন্দে গা ভাসিয়ে দেওয়া। সময়ের হাত ধরেই বছরের শেষে পালিত হতে যাচ্ছে বড়দিন। কলকাতার আলেন পার্কে উদ্বোধন করবেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ।

বিশ্বজুড়ে পালিত হয় যে ক্রিসমাস, বাংলা ভাষায় তার পরিচয় বড়দিনের উৎসব। বড়দিন হল খ্রিস্ট ধর্মের মানুষদের শ্রেষ্ঠ উৎসব। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে পালিত বড়োদিনের দিনের এই উৎসব আজ জাতীয় উৎসবের মর্যাদা লাভ করেছে।কলকাতার পার্ক স্ট্রিট নতুন করে সেজে উঠছে। আট থেকে আশির স্বপ্নপূরণের আদর্শ পরিবেশ ও ঠিকানা কলকাতার বড়দিনের উৎসব।ইতিমধ্যেই উৎসবের আমেজ অনুভূত হচ্ছে।
মাত্র কয়েক দিন বাদে বড়দিন। এখন থেকেই রাজ্য জুড়ে পুরোদস্তুর উত্‍সবের মেজাজ। সেজে উঠেছে গির্জা। মোমের আলোয়, ক্যারলের সুরে তৈরি হচ্ছে এক অন্য পৃথিবী। আলোর ঝরনাধারায় ভাসছে কলকাতা শহর, বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিট চত্বরসহ দ্বিতীয় হুগলি সেতু, হাওড়া ব্রিজ, গঙ্গার দুইতীর জুড়েই আলোর মালায় সেজে উঠেছে।

কলকাতা থেকে জেলা, সর্বত্র শীতের আমেজ গায়ে মেখে উদযাপনের মনোমুগ্ধকর ছবি। শনিবার উইকেন্ডের রাতেই পথে নেমে পড়বে প্রতিবছরের মতোই অসংখ্য মানুষ। পার্ক স্ট্রিটে জনস্রোত, শান্তা টুপিতে সেলফি অবিরাম। বয়সের বাঁধ ভেঙে ব্যান্ডেল চার্চ, শ্রীরামপুর চার্চ, নিউটন, বিধাননগর, সল্টলেক, কৃষ্ণনগরের মানুষ নেমে পড়বেন রাস্তায়। সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে বড়দিনের প্রার্থনায় অংশ নেবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে উৎসব হলো মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

যে কোন উৎসব মানুষকে জীবনের ইঁদুরদৌড়ের চূড়ান্ত ব্যস্ততা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে দেয়। উৎসব যে ধরনেরই হোক না কেন প্রত্যেকটি উৎসবের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন প্রত্যেক উৎসবে মানুষ প্রতিদিনকার কেজো জীবনের ব্যস্ততা দূরে সরিয়ে রেখে আনন্দে মেতে ওঠে।সমস্ত ভেদাভেদের সীমান্তরেখা মুছে যায়। মানুষের মন রঙিন হয়ে ওঠে । সম্প্রীতির অমল বন্ধন প্রসারিত হয়।করোনার আবহেও গত বছর সেই ভাবে পালিত হয়নি বাঙালির প্রাণের উৎসব বড়দিন।গত দু’বছর বড়দিন উদযাপনের সুযোগ থেকে বাঙালি বঞ্চিত হয়েছিল।

পৃথিবীর বেশিরভাগ উৎসবের সঙ্গে কোন না কোন ধর্মের সংযোগ থাকলেও বলা হয় ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সবার। কারণ আনন্দের যেমন কোন ধর্ম নেই, তাই উৎসব উদযাপনেরও কোন ধর্ম হয়না।

পৃথিবীতে এমন বেশ কিছু উৎসব রয়েছে যে গুলির উদযাপনকালে সমগ্র বিশ্বজুড়ে মানুষ জাতি-ধর্ম ভুলে একই দিনে একই সাথে অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। খ্রিস্টান ধর্মের উৎসব বড়দিন এ ক্ষেত্রে অন্যতম। প্রতিবছর ২৫শে ডিসেম্বর বিশ্ব জুড়ে এই দিনটি পালন করা হয়। প্রাচ্য দেশগুলিতে এই দিনটি বড়দিন নামে পরিচিত হলেও পাশ্চাত্যে এটি ক্রিসমাস নামে পরিচিত।


বড়দিনের সোনালি ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়,ভারতবর্ষে প্রথম ক্রিসমাস পালন করা হয় ১৬৬৮ সালে। জব চার্ণক প্রথম বড়দিন পালন শুরু করেছিলেন বলে শোনা যায়। সূর্যের উত্তরায়ণ শেষ হয়ে শুরু হয় দক্ষিণায়ন। এদিন থেকে বেলা একটু একটু করে বড় হয়। সেই সঙ্গে শীতের প্রকোপও কমতে শুরু করে। এছাড়াও বিশ্বাস এই দিনেই যাবতীয় দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছিল বিশ্ব। যে কারণে সবাই একে অপরকে উপহার দিয়ে আনন্দের সঙ্গে দিনটি পালন করেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পালন করা হলেও ব্যতিক্রম রাশিয়া, জর্জিয়া, মিশর, আর্মেনিয়া। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ৭ জানুয়ারি এখানে বড়দিন পালন করা হয়। প্রায় ২০০০ বছর আগে পৃথিবীর মানুষকে মুক্তি ও কল্যাণের পথ দেখিয়েছিলেন যিশু। বড়দিনে তাই খ্রিসমাস ক্যারল, মোমবাতি, উপহারে তাঁকেই স্মরণ করে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা।

সাধারণভাবে খ্রিস্টান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিশ্বাস করে এই দিনেই ঈশ্বরপুত্র যীশু খ্রীষ্টের জন্ম হয়েছিল। এই উপলক্ষেই প্রতি বছর ২৫শে ডিসেম্বর তারিখটিকে যীশুর জন্ম জয়ন্তী হিসেবে পালন করা হয়। তবে এখনো যিশুখ্রিস্টের ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস এই দিনে যীশু খ্রীষ্ট মাতা মেরির গর্ভে প্রবেশ করেছিলেন।

এই দিনটির ঠিক নয় মাস পরে আসলে যিশুখ্রিস্টের জন্ম হয়। তারা এই দিনটিকে যিশুখ্রিস্টের পৃথিবীতে আগমনের দিন হিসেবে উদযাপন করার পক্ষপাতী। আবার অনেকে ২৫শে ডিসেম্বর তারিখকে নিতান্তই একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসবের দিন বলে মনে করেন। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব যাই হোক না কেন পৃথিবী জুড়ে এই দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয় এবং খ্রিস্ট ধর্মের মানুষ এই দিন থেকে শুরু করে ১২ দিন ব্যাপী ক্রিসমাসটাইড উৎসব পালন করে।
২৫শে ডিসেম্বর দিনটি বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত হবার পিছনে রয়েছে এই নামগুলির শব্দগত ব্যুৎপত্তি। সাধারণভাবে ইংরেজিতে ক্রিসমাস বা খ্রিস্টমাস শব্দটির উৎপত্তি ‘খ্রিষ্টের মাস’ শব্দবন্ধ থেকে।
এইখানে মাস বলতে অর্থ হিসেবে উৎসব বোঝানো হয়। এর আদিমতম ইংরেজি হলো Cristes mæsse. আবার অন্যদিকে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় ‘X’ হলো ‘Christ’ শব্দের প্রথম অক্ষর। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে খ্রিস্ট শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ বোঝাতে ‘X’ অক্ষরটি ব্যবহৃত হতে থাকে। সেই থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই দিনটি ‘এক্স মাস’ নামেও পরিচিতি পায়।

অন্যদিকে বাংলায় এই দিনটিকে ‘বড়দিন’ বলার কারণ হিসেবে আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে ২৩শে ডিসেম্বর তারিখ থেকে দিন ক্রমশ বড় এবং রাত ছোট হতে আরম্ভ করে। অন্যদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জনৈক অধ্যাপক বলেছিলেন মর্যাদার দিক থেকে বড় হওয়ার কারণে এই দিনটিকে বড়দিন বলা হয়ে। এছাড়াও আর ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা আছে।

ইতিহাস কিংবা শব্দগত ব্যুৎপত্তি যাই হোক না কেন কোনো উৎসবের প্রকৃত প্রাণ লুকিয়ে থাকে সেই উৎসবটির উদযাপনের মধ্যে। বিশ্বজুড়ে ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে দিনটির ব্যাপক ভাবে উদযাপন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এইদিন নানা অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে।

কোথাও মহাসমারোহে পালন করা হয় যীশুর জন্মোৎসব, আবার কোথাও বা নানা জাঁকজমকপূর্ণ কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। বিশ্বজুড়ে সকল গির্জা গুলিকে অতি সুন্দর সাজে সাজিয়ে তোলা হয়। কোথায় আবার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মীয়-পরিজন এর মধ্যে চলে উপহার দেওয়া নেওয়া। মানুষ এই দিনে যিশুখ্রিস্টের জন্ম দিবস উপলক্ষে কেক কাটে; ভোজসভার আয়োজন হয় পাশ্চাত্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়।

বিশ্বজুড়ে বড়দিনের প্রচলিত সাধারণ সংস্কারগুলির সঙ্গে লোকাচার জড়িত হয়ে এই দিনটি উদযাপন এর মধ্যে বৈচিত্র্য এনে দেয়। এই বৈচিত্রের কারনেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বড়দিন উদযাপনের ধরনগুলিও ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন ক্যাথলিক দেশগুলিতে বড়দিনের আগের দিন ধর্মীয় শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

আবার অন্যান্য দেশগুলিতে সান্তাক্লজ এবং অন্যান্য প্রমোদমূলক চরিত্রগুলিকে নিয়ে মূলত ধর্মনিরপেক্ষ শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়ে থাকে। কোন কোন দেশ যেমন বড়দিন উপলক্ষে পরস্পরের মধ্যে উপহার বিনিময় করে, তেমনি কোন দেশ আবার উপহার বিনিময়ের জন্য ৬ই ডিসেম্বর কিংবা ৬ই জানুয়ারিকে বেছে নেয়। বিশ্বজুড়ে আয়োজিত হওয়া ভোজসভা গুলির চরিত্রের ক্ষেত্রেও পার্থক্য দেখা যায়।

কোথাও ভোট সভা উপলক্ষে পরিবেশিত হয় ১২ রকমের মাছ; কোন কোন দেশে আবার ভোজসভায় উপলক্ষে পরিবেশন করা হয় আলু, শাকসবজি, সসেজ, পুডিং ও ফ্রুট কেক। ফিলিপিন্সে আবার ক্রিসমাস উপলক্ষে আয়োজিত পথসভায় প্রধান খাদ্য হলো হ্যাম। তবে ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে তৈরি বিশেষ ধরনের চকলেট সারা পৃথিবী জুড়েই সকল মানুষের প্রিয় খাদ্য।

ভারতীয় উপমহাদেশে পালিত হওয়া বড়দিনের একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র চরিত্র রয়েছে। সুদীর্ঘকাল ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকার কারণে দেশের শহরাঞ্চলে বড়দিন পালন উপলক্ষে ব্রিটিশ আদব-কায়দাগুলিই অধিক মাত্রায় প্রচলিত। ব্রিটিশদের মতন এই দিনে এ দেশেও ফ্রুট কেক খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। তাছাড়া জাতি-ধর্ম ভুলে এই দিন ভারতের মানুষ সেজে গুজে রাস্তায় বেরোয়।

শহরাঞ্চলে রাস্তাগুলি সেজে ওঠে অভূতপূর্ব সব আলোকসজ্জায়। শহরতলী তো বটেই, এমনকি গ্রাম থেকেও বহু মানুষ এই উদযাপন দেখার জন্য শহরে পাড়ি জমায়। এছাড়া ভারতীয় যেসব উপজাতির মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল তারা এই দিনটিকে তাদের ঈশ্বরের জন্মদিন বলে পালন করে। অত্যন্ত দরিদ্র এই সকল মানুষ সাধারণ ঘরে তৈরি খাবার দিয়ে এই দিনটি উদযাপন করে থাকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড়দিন উদযাপনে বিভিন্ন উপজাতীয় সংস্কৃতির ছোঁয়াও লক্ষ্য করা যায়।

বড়দিনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে স্যান্টাক্লজ-এর নাম। ছোটদের কাছে উপহার পৌঁছে দেওয়ার প্রবাদ নিয়ে এই ব্যক্তিত্ব বড়দিন উদযাপনে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অনেকের মতে স্যান্টাক্লজ নামটি ডাচ সিন্টারক্লাস নামের অপভ্রংশ, যার সাধারণ অর্থ হলো সেন্ট নিকোলাস। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে তুরস্কের মীরার বিশপ সেন্ট নিকোলাস শিশুদেরকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন।

তিনি প্রতিনিয়ত তার অঞ্চলের শিশুদের পোশাক আশাক, পড়াশোনা এবং স্বাস্থ্য সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতেন। এই খোঁজখবরের দ্বারা শিশুটির মূল্যমান যাচাই করে তিনি নির্ধারণ করতেন সেই শিশু পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কিনা। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিশপ সেন্ট নিকোলাস এর নাম নেদারল্যান্ডে পরিচিতি লাভ করে এবং দক্ষিণ ইউরোপে তার নামে উপহার আদান-প্রদানের ঐতিহ্য চালু হয়ে যায়। যদিও আধুনিক যুগে স্যান্টাক্লজ-এর ঐতিহ্যের এই জনপ্রিয়তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সর্বাধিক।

অন্য সকল উৎসবের মতই বড়দিন পালনেরও একটি বিশেষ সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী পালিত হওয়া এই উৎসবে সর্বস্তরের মানুষের যোগদানের ফলে মানুষে মানুষে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়।

মানুষ তার প্রতিদিনকার ব্যস্ততা ভুলে একদিন সমষ্টিগত এই আনন্দ উৎসবে অংশ নেওয়ার ফলে আদপে সমগ্র সমাজের সার্বিক মানসিক চরিত্রে নবশক্তিবিধান হয়। তাছাড়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নিচু সকল ভেদাভেদ ভুলে একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নেওয়ার ফলে সমাজে পারস্পারিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়।

সামাজিক গুরুত্ব-এর পাশাপাশি ক্রিসমাস বা বড়দিন উদযাপনের বিশেষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির দুর্গাপূজা কে কেন্দ্র করে যেমন লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ নিজেদের জীবন ও জীবিকা নির্ধারণ করে, তেমনি বড়দিন বা ক্রিসমাস পালনের উপর নির্ভর করেও বিশ্বের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ধারিত হয়।

এই দিন উপলক্ষে পৃথিবীর সকল পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেনাবেচার পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মানুষ বড়দিন উপলক্ষে ঘর সাজানোর দ্রব্য এবং উপহার সামগ্রী এবং উপহার সামগ্রী কেনে বলে এই সময়ের পূর্বে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন সামগ্রী বাজারে আসে।

একটি সমীক্ষায় জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড়দিনের আগে আগেই বাজারের আসন্ন ভিড় সামলানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে কর্মী নিয়োগ করা হয়। এছাড়া বড়দিনের শুভেচ্ছা প্রেরণের কার্ড তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কাগজের কারখানাতেও কর্মী নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

বড়দিন পালনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে যেমন আনন্দের বাতাবরণ সৃষ্টি হয় তেমনি এক সময় বড়দিন পালন সম্পর্কেও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সংস্কারবাদী খ্রিস্টানরা বড়দিন পালনকে পাপ বলে মনে করতেন। তাদের মতে এই দিনটির সাথে যিশুখ্রিস্টের জন্মের কোন সম্পর্ক নেই।

এই ধরনের মতবাদের অনুসারী দেশ গুলিতে এক সময় বড়দিনের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি ইংল্যান্ডেও ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বড়দিন পালন নিষিদ্ধ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একদল সংস্কারবাদী ক্রিসমাস উৎসব পালনকে ধর্মবিরোধী পাপাচার বলে মনে করত। তবে উৎসবের আনন্দে এর কাছে সকল ফতোয়া ম্লান হয়ে যায়। একইভাবে সময়ের সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে বড়দিন পালনের ক্ষেত্রেও সকল নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।

বড়দিন বিশ্বজুড়ে আনন্দ উদযাপনের ক্ষেত্রে প্রকৃতই খুব বড় একটি দিন। ধর্মগতভাবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এই দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কিন্তু বড়দিন উদযাপন শুধুমাত্র খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদ ভুলে সকল মানুষ এই দিনটির উদযাপনে অংশগ্রহণ করে। সুদূর অতীতে যীশু খ্রীষ্ট সকল মানুষের মধ্যে প্রেম ও ভালোবাসার যে বাণী প্রচার করতে চেয়ে ছিলেন বড়দিন উদযাপনের মধ্য দিয়ে যিশুখ্রিস্টের সেই স্বপ্নই সার্থকভাবে রূপায়িত হয়।

কলকাতার পার্ক স্ট্রিট চত্বরে বড়দিনের উৎসবের সোনালি ইতিহাস:

পলাশি ও বক্সার যুদ্ধ জিতে ব্রিটিশ শাসন ভারতে তাদের জায়গা মজবুত করল। তার পর মন দিল রাজধানী কলকাতার বুকে ক্রিসমাস পালনে। সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস স্যর এলাইজ়া ইম্পে, এখন যেখানে পার্ক স্ট্রিট, সেখানে তৈরি করালেন একটা ‘ডিয়ার পার্ক’, যাতে বল্‌গা হরিণে টানা স্লেজ গাড়ি চড়ে সান্টা ক্লজ় সোজা সেই পার্কেই ল্যান্ড করতে পারেন। এখন সেই পার্কও নেই, হরিণও নেই, কিন্তু লোকের বিশ্বাস, মাঝরাতে সান্টা পার্ক স্ট্রিটে অবশ্যই আসবেন! ২০১১ সাল থেকে ‘কলকাতা ক্রিসমাস ফেস্টিভাল’ নামে চিহ্নিত এই উৎসব জনসমাগমের দিক থেকে সমগ্র পূর্ব ভারতে সবচেয়ে বড়। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার হাজার হাজার মানুষ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন।

উনিশ শতকের শুরুতে কলকাতায় ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। ১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট জনস চার্চে তাদের উপাসনার স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না। ফলে কলকাতার পঞ্চম বিশপ, ড্যানিয়েল উইলসনের উদ্যোগে ১৮৩৯ সালে তৈরি হল সেন্ট ক্যাথিড্রাল চার্চ, যাতে ৮০০-১০০০ মানুষ একত্রে উপাসনা করতে পারে। ব্রিটিশ ভারতের এই ঐতিহ্যমণ্ডিত চার্চে ক্রিসমাস মিডনাইট মাসে অংশ নিয়ে ক্যারলে এখনও গলা মেলান হাজার হাজার মানুষ।

বাঙালির বড়দিন মানেই শীত-শীত আমেজে সপরিবার ময়দান কিংবা চিড়িয়াখানা। আর কেক না খেলে বড়দিনের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না। দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখার মতোই পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের আলোকসজ্জা দেখতে যাওয়া তো আছেই। বড়দিনের সাবেকি আমেজটা আজও রয়ে গেছে শহরের অ্যাংলো-পাড়া বো ব্যারাকে।

শেষকথা:


সূচি থেকে নানান অনুষ্ঠান বাদ পড়লেও ২০২০-কে বিদায় জানাতে প্রস্তুত কলকাতার পার্ক স্ট্রিট। প্রতি বছর পার্কে যে খাবারের স্টল থাকে এই বছর ততটা হয়তো থাকবে না। করোনার স্বাস্থ্য বিধি মেনেই পালিত হবে বড়দিন। আলোক মালায় ইতিমধ্যেই সেজে উঠেছে তিলোত্তমা কলকাতা।

বছর শেষের উৎসবে গোটা বিশ্বের সঙ্গে মাতোয়ারা হয় শহর কলকাতাও। পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের আগের সন্ধে থেকেই উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। রাত ১২টায় গির্জায় গির্জায় বেজে ওঠে ঘণ্টাধ্বনি। শুরু হয় প্রার্থনা। রাতে গির্জায় গির্জায় এই হাজির হন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষজন।
কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের সঙ্গে মেতে ওঠে বো ব্যারাক, হেলেন পার্ক। কিন্তু এবার প্রতি বছরের সেই চেনা ছবি কিছুটা হলেও ম্লান হবেই। উধাও হতে পারে পার্ক স্ট্রিটের এতদিনের রেকর্ড ভিড়।সেই সঙ্গেই উধাও হতে পারে কেকের দোকানে লম্বা লাইন।
কয়েকদিন আগেই দেখলাম পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁগুলির চরম ব্যস্ততা। খুব বেশি না হলেও মানুষের স্রোতও শুরু হয়ে গেছে। দুর্গাপুজোর পর কোনও রাস্তায় এমন ভিড় এ শহরে আর হয়না। সেই ছবিও গত বছরের মতোই এবার করোনার কোপে বেমালুম উধাও হবে কিনা? লাখ টাকার প্রশ্ন!
পার্ক স্ট্রিটে উৎসবের সূচনা এবার করেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। নিজেও গির্জায় হাজির হন বড়দিনের আগের সন্ধেয়। আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে পার্ক স্ট্রিট

কলকাতার বড়দিন এখন যত না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি করে এক অসাম্প্রদায়িক মিলনদিন। চিনা বুড়ো ক্রিসমাস ট্রি বিক্রি করছে মুসলমান ছেলেকে— এমন দৃশ্য কলকাতার পরতে পরতে প্রাণের মতো মিশে আছে। অনুশোচনায় আত্মশুদ্ধি, আত্মসমীক্ষা ও নম্র নিরহঙ্কার— এই সনাতন হিন্দু ভাবধারার সঙ্গে খ্রিস্টীয় জীবনবোধের মিল আছে। যাকে কেন্দ্র করে এই বড়দিন, তিনি মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার ক্রুশ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, বলেছিলেন—“তোমরাই জগতের আলো... তোমার অন্তর্জ্যোতি প্রজ্বলিত কর, যাতে অপরে তোমার সৎ কর্মগুলি দেখতে পায় ও এইভাবে তোমার স্বর্গস্থ পিতাকে গৌরবান্বিত কর।” (ম্যাথিউ ৫, ১৪-১৬)। উৎসবের জোয়ারে ভেসে গিয়ে তাঁর দেখানো রাস্তা যেন আমরা ভুলে না যাই।
প্রকৃতিগতভাবে একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, একাধিক অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মহাসমারোহে বড়দিন উৎসব পালন করে।এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসবের আয়োজনে প্রাক-খ্রিষ্টীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ভাবনার সমাবেশও দেখা যায়। উপহার প্রদান, সংগীত, বড়দিনের কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ, এবং বড়দিনের বৃক্ষ, আলোকসজ্জা, মালা, মিসলটো, যিশুর জন্মদৃশ্য, এবং হলি সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে বড়দিন উৎসব উদ্‌যাপনের অঙ্গ। কোনো কোনো দেশে ফাদার খ্রিষ্টমাস (উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডে সান্টাক্লজ) কর্তৃক ছোটোদের জন্য বড়দিনে উপহার আনার উপকথাটি বেশ জনপ্রিয়।
উপহার প্রদানের রীতিটিসহ বড়দিন উৎসবের নানা অনুষঙ্গ খ্রিষ্টান ও অ-খ্রিষ্টানদের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসব উপলক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বিশেষ মরসুম চলে। বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দিনের অর্থনৈতিক প্রভাবটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে দেখে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশে বড়দিন একটি রাষ্ট্রীয় ছুুটি থাকে।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
প্রাবন্ধিক, রম্যরচনা, ফিচার, অণুগল্প ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top