সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

পরমান্ন ও পরমপুরুষ : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৪১

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১১:৫৬

 

নৈরঞ্জনা নদীর জলে গাভী মোষের গা ধুইয়ে দিচ্ছিল পূর্ণা। গোশালায় ঢোকানোর আগে তাদের প্রত্যহ সে ভালো করে পরিস্কার করিয়ে আনে। সব সারতে সারতে বিকেল নেমে আসে। নদীর ধারের অরণ্যের পশ্চিম প্রান্তে চলে আসেন সূর্যদেব। কলতান মুখর পাখপাখালিরা কুলায় ফিরে আসে। পূর্ণা তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগায় অবোধ জীবগুলিকে নিয়ে। সুজাতা মা তাকে বারংবার শুনিয়েছেন সেই সর্তকবাণী, সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই যেন সে গোরু মহিষাদি নিয়ে গৃহে ফিরে আসে। সুজাতা মায়ের সে বড়ই প্রিয়। দশবৎসর আগে এই নদীর ধারের অরণ্যে বনদেবতার পুজা দিয়ে ফেরার সময়ে বনপথের উপর ফেলে যাওয়া শিশুটিকে বুকে করে এনে বড়ো করেছেন সুজাতা। পূর্ণাও চোখে হারায় তার সুজাতা মাকে। দ্রুত পা চালাচ্ছিল সে। তাদের এই সেনানী গ্রামটি বড়ই সুন্দর। গ্রামের প্রান্তে এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে নৈরঞ্জনা নদীটি। নদীর পাশে শাল, তমাল, পিয়াল, বট, অশ্বথ গাছের ঘন জঙ্গল। জঙ্গল আর নদীর মাঝখান দিয়ে সরু লাল মেঠো পথ তাদের গ্রামের অভিমুখে চলে গেছে। এই অপরাহ্নে নদীর দিক থেকে মনজুড়ানো বাতাস এসে পরিবেশটি আরো মধুর করেছে। মেঠো পথ দিয়ে কয়েকজন কৃষক বধূ মাথায় ঘাসের বোঝা, কাঁখে শিশু নিয়ে হেঁটে চলেছে। দ্রুত জঙ্গলটি পার হয়ে আসার সময় পূর্ণা একবার পিছন ফিরে তাকাল বনের দিকে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে এক দীর্ঘদেহী দেবোপম পুরুষ বনের ভিতরে ঢুকে গেলেন। কে ইনি? ইনিই কি বনদেবতা? তার কিশোরী মনে অনেক কৌতূহল খেলে যায়। কিন্তু না, এখন গৃহে ফিরতে হবে। গৃহে ফিরে সুজাতা মাকে জানাতে হবে সব। অবশ্য তাদের এই সেনানী গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত অরণ্যে অনেক সময়ই যোগী, তপস্বীরা আসেন। গহন বনে, গুহায়, বৃক্ষতলে তপস্যায় নিমগ্ন থাকেন। কদাচিৎ অরণ্য থেকে বেরিয়ে নদীতীরে আসেন| গ্রামবাসীরা প্রায় প্রত্যেকেই যে যেমন পারে, কিছু ফলমূল রেখে যায় বনের বৃক্ষতলে। হয়তো তেমন ই কোনো একজন তপস্বী হবেন।
কিশোরী মনে কোনো কিছুই বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। লাফাতে লাফাতে গৃহপ্রাঙ্গনে ঢুকে গোয়ালে গরু মহিষদের বাঁধছিল পূর্ণা। আওয়াজ পেয়ে ঘুমন্ত শিশুপুত্রকে সযত্নে বিছানায় শুইয়ে প্রাঙ্গনে নেমে এলেন সুজাতা। সেনানী গ্রামের বণিক নন্দিকের স্ত্রী। আজ তার অনেক ব্যস্ততা। কাল প্রভাতে বনদেবতার পুজা দেবেন। বহুদিন তারা নি:সন্তান ছিলেন। বনদেবতার কাছে মানত করার পর পুত্রলাভ হয়েছে। আগামীকাল প্রাতে পূর্ণাকে নিয়ে তিনি দেবতার পুজা দিতে যাবেন। পূজার উপাচার গুছিয়ে রাখতে হবে, তৈরী করতে হবে পরমান্ন। স্বামী নন্দিকের গৃহে অসংখ্য গাভী মহিষ। এদের মধ্যে একহাজার গাভী নির্বাচন করে তাদের কয়েকদিন ধরে মধু মিশ্রিত খড় খাওয়ানো হয়েছে। সেই একহাজার গাভীর মধ্যে উত্তম দুগ্ধপ্রদানকারী ৫০০টি গাভীকে বেছে নেওয়া হলো। তারপর ৫০০টি থেকে ২৫০টি গাভী। এইভাবে সে বেছে নিয়েছে সর্বোৎকৃষ্ট ৮টি গাভীকে যাদের দুগ্ধ দিয়ে বনদেবতার জন্য পরমান্ন তৈরী হবে। যে দেবতা পূরণ করেছেন তাদের পুত্রলাভের আকাঙ্খা, তাঁকে অমৃত-সম পরমান্ন নিবেদন করে সে খুশি রাখতে চায়। কাল প্রাতে সেই পরমান্ন প্রস্তুত করে, অন্যান্য পুজা উপচার নিয়ে সে যাবে মানত পূরণ করতে। কিন্তু তার আগে প্রত্যুষে ভৃত্যদের দিয়ে বটবৃক্ষের চারিপাশ্বর্স্থ ঝোপঝাড় পরিস্কার করতে হবে।
গোয়ালে গরু মহিষ বেঁধে পূর্ণা সুজাতার কাছে এসে বলল "মা, আজ আসার পথে অরণ্যের ভিতরে এক দীর্ঘদেহী দেবপুরুষকে দেখলাম। উনিই কি তোমার পূজিত বনদেবতা?"
"হতেও পারে। সুজাতা দুই হাত জড়ো করে বনদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। কিন্তু পূর্ণা আজ তুমি এতো বিলম্ব করে গৃহে ফিরলে? আঁধার তো ঘনিয়ে এসেছে।"
"কি করবো মা। মহিষগুলি যে নদীর জল ছেড়ে উঠতেই চায় না।"
"কাল প্রভাতে তুমি আমার সাথে যাবে পুজা দিতে| কাল আর কোথাও যেতে হবে না।"
"ঠিক আছে মা" পূর্ণা সম্মতি জানিতে একছুটে ঘুমন্ত ভাইয়ের পাশে চলে গেল। কিন্তু একটু আগে বলা তার কথাগুলো ভেসে বেড়াতে লাগলো সুজাতার অন্তরে। সন্ধ্যার অন্ধকারে দেবপ্রতিম যে পুরুষটিকে পূর্ণা দেখেছে, তিনি কি বনদেবতা? এই উরুবিল্ব অরণ্যের বনদেবতা খুবই জাগ্রত। বিবাহের পূর্বে সুজাতা মানত করেছিল বনদেবতা যেন তাকে যথার্থ জীবনসঙ্গী দেন। বনদেবতার অনুগ্রহে সে লাভ করেছে তার স্বামী নন্দিক কে। সে যথার্থই সুখী নন্দিককে পেয়ে। এরপর দীর্ঘদিন পূর্ণাকে নিজের হাতে লালন করার পর তার নিজের একটি পুত্রসন্তানের সাধ ছিল। বনদেবতার কাছে সে আকুল প্রার্থনা জানিয়ে এসেছিল পুত্রসন্তান লাভের জন্য। করুণাময় বনদেবতা তার অভীষ্ট পূর্ণ করেছেন। সে করজোড়ে প্রণাম জানালো বনদেবতাকে। কাল প্রভাতেই সে যাবে মানত পূরণের পুজা দিতে।

দুইঃ
তিনি চেতনা হারিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সত্যজ্ঞান লাভের জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অনাহারে, নিদ্রাবিহীন অবস্থায় কঠোর তপস্যায় তাঁর শরীর শুস্ক, জীর্ণ হয়ে গেছে। রাজপরিবারের সন্তান তিনি। বিত্ত, বিলাস আর বৈভবে দিন কাটাতে কাটাতে হঠাৎ একদিন পথ পরিক্রমায় বৃদ্ধ, অশক্ত, অসুস্থ ও মৃত ব্যক্তিদের জীবনে প্রথমবার দর্শন করে বিমূঢ হয়ে গেছিলেন| সারথি ছন্দক তাঁকে জানালো রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু প্রতিটি জীবনে অবশ্যম্ভাবী। সুখের ঘোর থেকে যেন সহসা জেগে উঠল সিদ্ধার্থের হৃদয়| জীবনের অন্তিম পরিণতি যদি মৃত্যু হয় তবে জীবনের উদ্দেশ্য কি? কেনই বা এত কষ্ট, দু:খ, হাহাকার মানব জীবনে? এর থেকে পরিত্রাণ কি ভাবে পাওয়া যাবে? এই তীব্র অনুসন্ধিৎসার কাছে রাজবিলাস, ধন, বৈভব তুচ্ছা হয়ে গেল। স্ত্রী, সদ্যোজাত পুত্র, রাজপরিবার সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে সেই চিরন্তন সত্যের সন্ধানে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কত স্থান। শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন কত যোগীর। কেউই তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছে পাঁচজন শিষ্য যাদের বিশ্বাস কঠোরতম তপস্যার মাধ্যমে সিদ্ধার্থ এই সত্য সন্ধান করতে পারবেন। ঘুরতে ঘুরতে সবাই মিলে তারা নৈরঞ্জনা নদীতীরে উরুবিল্ব অরণ্যে এসেছেন। সিদ্ধার্থ আবার তপস্যারত হয়েছেন। সুতীব্র হিম, দগ্ধ গ্রীষ্মতাপ, ঝড়জলবৃষ্টি, অনাহারে আত্মপীড়নে তাঁর অনিন্দ্যকান্তি শরীর শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গেছে। যেন একটি মৃতপ্রায় বৃক্ষ। শিষ্যরা দেখল যে তিনি এত দুর্বল হয়ে গেছেন যে হাঁটা চলা করতে পারছেন না। বৃক্ষতল থেকে উঠে নদীতীরে যেতে গিয়ে পড়ে গেলেন সিদ্ধার্থ। শিষ্যরা ধরাধরি করে তাঁকে এনে আবার বৃক্ষতলে শুইয়ে দিলো। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চেতন অবচেতনের মাঝে... আচ্ছন্নতার মধ্যে সিদ্ধার্থ দেখলেন চারিপাশে সুনীল মেঘরাশি। সেই মেঘের ভিতর থেকে ছুটে আসছে এক আশ্চর্য নরম আলো। সেই মেঘের আসনে বসে এক সুন্দর দেবতা সেতার বাজাচ্ছেন। সেতারের তিনটি তারের প্রথম তারটি খুব শক্ত করে বাঁধা, তৃতীয় তারটি আবার খুবই ঢিলা ভাবে বাঁধা। কিন্তু মাঝের তারটি সুন্দর ভাবে ভারসাম্য রেখে সুরে বাঁধা। না খুব শক্ত, না খুব ঢিলা। দেবপুরুষ সেই মাঝের তারটি দিয়েই সুর খেলাচ্ছেন। সেই সুর ছড়িয়ে যাচ্ছে দিগ দিগন্তে... ।
যেন একটা আলোর ছটা এসে তাঁর সব আচ্ছন্নতা কাটিয়ে দিলো। সিদ্ধার্থ আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। তাঁকে ঘিরে বসেছিল তাঁর পাঁচ শিষ্য। দুর্বল.. মৃতপ্রায়.. সিদ্ধার্থকে উঠে বসতে দেখে তারা অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলো "প্রভু, আপনি কি সত্যের সন্ধান পেলেন?"
সিদ্ধার্থ বললেন "হ্যাঁ, আমি এক সত্যকে উপলব্ধি করেছি। এই সত্য জীবনের অর্থ বোঝার সত্য নয়, এই সত্য আমায় বুঝিয়েছে মধ্য পথ অবলম্বন করো। ভোগ প্রাচুর্যের আবহে নয়, অহেতুক শরীরকে কষ্ট দিয়ে আত্মপীড়ন করে নয়, মধ্যের পথ ই হলো সফলতার পথ। শরীরকে অহেতুক পীড়ন না করে পরিমিত জল-আহার দিয়ে তপস্যা করতে হবে। দুর্বল, কঙ্কালসার শরীরে এই তপস্যা করা যাবে না।" সিদ্ধার্থের এই কথা মন:পুত হলো না শিষ্যদের। তারা জীবন ভোর দেখে এসেছে যোগী, তপস্বীরা আহার, নিদ্রা ত্যাগ করে তপস্যা করে যান। তারা সিদ্ধার্থকে সেখানেই ত্যাগ করে আরো বড় ঋষির সন্ধানে চলে গেলো। সিদ্ধার্থ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন| দুর্বল শরীরে নেমে এলেন নদীতটে। নদীজলে স্নান সেরে বনপ্রান্তে এক বিশাল বটবৃক্ষের তলে পদ্মাসনে বসলেন। সম্ভবত: তিনি যখন স্নান করছিলেন কেউ এসে বৃক্ষতলাটিকে পরিমার্জিত করে গেছে। তিনি চক্ষু নিমীলিত করলেন। নদীজলে স্নান সেরে তাঁর শরীর স্নিগ্ধ হয়েছে কিছুটা। প্রভাতের মনোরম হাওয়ায় তাঁর ক্লান্তি কিছুটা উপশম হয়েছে। কিন্তু এখনো খুব দুর্বল তাঁর অনাহারগ্রস্ত শরীর। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর সমগ্র শরীর বিদ্রোহ করছে। প্রয়োজনীয় অন্নজল না দিলে সে মনের সাথে সহযোগীতা করবে না। অথচ এই দুর্বল শরীরে নিকটবর্তী গ্রাম থেকে তিনি যে মাধুকরী করে কিছু সংগ্রহ করে আনবেন তাও সম্ভব নয়। তিনি মনকে স্থির করে শান্ত ভাবে বসে রইলেন| সহসা চারপাশে সুগন্ধি ধুপ ধুনোর গন্ধে ভরে উঠলো। কে যেন একরাশ পুষ্প তাঁর চরণে নিবেদন করলো| সিদ্ধার্থ চক্ষু মেলে দেখলেন তাঁর সম্মুখে দুই নারী। একজন কিশোরী, অন্যজন তরুণী। তরুণীটি তাঁর সামনে নত হয়ে তাঁকে প্রণাম করছে| সিদ্ধার্থ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তরুণীকে উদ্দেশ্য করে বললেন "কে তুমি ভদ্রে? তুমি কি জানো তুমি ভ্রমবশত: আমাকে পূজা নিবেদন করছো? আমি তোমারি মতো একজন সাধারণ মানুষ, কোনো দেবতা নই। আমি একজন তপস্বী।"
সুজাতা বিনীতভাবে বললেন " প্রভু, আমি সুজাতা| নিকটবর্তী সেনানী গ্রামে বাস করি। বনদেবতার কৃপায় আমি বহুদিন পর পুত্রসন্তান লাভ করেছি। আজ এখানে বনদেবতার কাছে আমার মানত পূরণের পুজা নিবেদন করতে এসেছি। আমি তো বনদেবতাকে দেখিনি কখনো। আমার কাছে আপনিই বনদেবতা। দয়া করে প্রভু এই পরমান্ন গ্রহণ করুন। আমি স্বহস্তে শুচিসম্মত ভাবে প্রস্তুত করে এনেছি দেবতাকে অর্ঘ দেব বলে।"
একটি বৃহৎ সোনার বাটিতে অমৃত-সম পরমান্ন। পাত্রটি গ্রহন করে সিদ্ধার্থ স্মিতভাবে বললেন "ভদ্রে আমার বিশ্বাস তোমার নিবেদিত অন্ন সেবনে আমি তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করবো| তোমার কল্যাণ হউক।"
সিদ্ধার্থকে পুনর্বার প্রনাম জানিয়ে সুজাতা পূর্ণার হাত ধরে ফিরে গেলো। আজ সে এক অনির্বান শান্তি লাভ করেছে। সে জানে না কে এই দেবোপম পুরুষ। সত্যই কি তিনি তপস্বী না ছদ্মবেশী বনদেবতা? তিনি যেই হোন যেন তাঁর তপস্যায় সিদ্ধি লাভ হয়।

তিনঃ

আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। সুজাতার আনা পরমান্ন অল্প আহার করে সিদ্ধার্থ একটি অশ্বথ বৃক্ষের তলায় পদ্মাসনে ধ্যানে বসেছেন। এখন তাঁর শরীরে অনেক বল এসেছে। তাঁর অন্তরে এক নির্মল প্রশান্তি খেলা করছে। আজ তিনি সিদ্ধি লাভ না করে আসন ত্যাগ করবেন না।
"ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুলর্ভাং
নৈবাসনাং কায়মতশ্চলিষ্যতে"
এই আসনে তাঁর শরীর শুকিয়ে যায় যাক, ত্বক খসে পড়ুক, মাংস গলে যাক, তবু বোধিলাভ না হলে তিনি আসন ত্যাগ করবেন না। আজ তাঁর কোনো যন্ত্রনা নেই, নেই কোনো অস্থিরতা। আছে শুধু বৃক্ষতলে ধ্যানে বসার এক অপার শান্তি। রাত্রির প্রথম প্রহরে অরণ্যে পশুদের চলাফেরার শব্দ, ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় সিদ্ধার্থের খুব মনে হলো এই ধ্যান করার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি উঠে অন্য কোথাও চলে যাবেন। পরক্ষণেই বুঝলেন এইসব মারের প্রলোভন, তিনি অনড় রইলেন। তাঁর দুই চোখ বন্ধ ছিল। আরো একবার তাঁর মনে দারুণ ভীতির সঞ্চার হল, মনে নানারকম চিন্তাভাবনার উদয় হলো। মনসমুদ্রতলে লুক্কায়িত কামনা, বাসনা, লোভ, মোহ এসে তাঁকে বাধা দিতে লাগলো। কিন্তু সিদ্ধার্থ অবিচল শান্ত, স্থির রইলেন। অবশেষে শূন্যতায় হারিয়ে গেল তারা। তিনি ধ্যানের গভীর পর্যায়ে প্রবেশ করলেন। রাত্রির প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হলে সিদ্ধার্থ সম্যক দৃষ্টি লাভ করলেন। তাঁর পূর্বজন্মের স্মৃতি উন্মোচন হলো। নদীর বয়ে যাওয়ার মৃদু কলতান, অরণ্যে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ও অনান্য কীটপতঙ্গের শব্দ, ঘুমন্ত পাখিদের নড়াচড়ার শব্দ, গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি নিশীথ রাত্রির যাবতীয় শব্দ তাঁর শ্রবণে ধরা পড়ছিল অথচ তিনি কিছুই শুনতে পারছিলেন না।
ধীরে ধীরে তিনি ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করলেন। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে তাঁর আয়ত্ত হলো চুত্যোৎপতি জ্ঞান অর্থাৎ জীবের জন্ম মৃত্যু রহস্য। রাত্রির শেষ যামে তিনি উপলব্ধি করলেন দু:খ মুক্তির পরিপূর্ণ জ্ঞান বা সম্বোধি। তিনি উপলব্ধি করলেন জগতে যত কিছু দু:খ, কষ্টের মূলে রয়েছে অবিদ্যা, অজ্ঞানতা আর মানুষের কামনা, বাসনা, আকাঙ্খা। জন্মগ্রহণ থেকেই মানুষ অবিরাম নিজের আকাঙ্খার পিছনে ছুটে চলেছে। এই কামনা বাসনা থেকে নিজেকে মুক্তি করতে না পারলে দু:খ, কষ্ট থেকে মানুষের মুক্তি নেই। তাই বাসনার নিবৃত্তি ঘটাতে হবে, তবেই নির্বান আসবে। নির্বাণ লাভের জন্য মানুষের জীবন ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ সংকল্প, সৎ জীবন, সৎ চেষ্টা, সৎ স্মৃতি, সম্যক দৃষ্টি. সম্যক সমাধি, এই অষ্টাঙ্গিক মার্গের দ্বারা জীবন শুদ্ধ করতে হবে।
রাত্রির ঘোর তামস জাল ছিন্ন করে খুব নরম ভাবে নেমে এলো প্রভাত। সিদ্ধার্থ তাঁর আসন ছেড়ে নদীতটে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর অন্তরে আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই। প্রজ্ঞা নেত্রে তিনি উপলব্ধি করেছেন শ্বাশত সত্য। লব্ধ করেছেন বোধি জ্ঞান। আজ থেকে তিনি বুদ্ধ। তিনি জাগ্রত এক সত্তা। এক অনির্বচনীয় কান্তি তাঁর শরীরে ফুটে উঠেছে। তিনি আপন মনে শুধু সেই সত্যের কথা বিশ্লেষন করে যাচ্ছেন। এই প্রায়ান্ধকার ভোরে একদল হরিণ অরণ্য থেকে বেরিয়ে নদীতে এসেছে তৃষ্ণা মেটাতে। তারা অবাক হয়ে দেখছে এই দেবপুরুষকে। পাখিরা জেগে উঠে কলতান শুরু করেছ। যেন কলতান নয় বুদ্ধের বন্দনা। বুদ্ধ এসব কিছুই নজর করছেন না। যেন এক অসীম ঘোরের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে অনন্ত সময়। তিনি নদীতীর থেকে আবার ফিরে এলেন অরণ্যে। অন্য এক বৃক্ষতলে আসীন হলেন আবার। পুনরায় ধ্যান, পুনরায় সমাধিস্থ। চারিপাশে বয়ে যাওয়া জীবন, সময় চক্র, কোনো কিছুই তাঁকে নাগালের মধ্যে আনতে পারছে না।
ঠিক উনপঞ্চাশ দিন পরে ঘোর কাটলো বুদ্ধের।এই উনপঞ্চাশ দিন তাঁর কেটেছে এই সার সত্যকে অন্তরস্থ করতে। তিনি চোখ মেলে তাকালেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন সাধারণ মানুষ লোভ, বাসনা, অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই সার সত্য তারা বুঝতে সমর্থ হবে না। মোহান্ধ তাদের নিদ্রিত সত্তাকে প্রথমে জাগ্রত করতে হবে। তার জন্য দরকার পরিক্রমা ও অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রচার। তাঁকে শিষ্যদের নিয়ে সংঘ গঠন করতে হবে। সহসা অরণ্যের শুকনো পাতার উপর দিয়ে মানুষের চলার আওয়াজ শোনা গেলো। দুইজন বণিক চালের পিঠে ও মধু নিয়ে বুদ্ধের চরন তলে নিবেদন করে প্রণাম জানালো।
"তোমাদের পরিচয়? " বুদ্ধ প্রশ্ন করলেন।
"প্রভু, আমরা তপসসু আর ভল্লিক। আমরা বণিক। আমরা ধর্মের উপর কিছু শুনতে চাই আপনার কাছ থেকে।"
বুদ্ধ তাদের তাঁর নবোপলব্ধ সত্যের কথা শোনালেন। তারা অভিভূত হয়ে গেলো। এই নতুন ধরনের উপদেশের কথা তারা আগে কখনো শোনে নি।
"প্রভু আপনি আমাদের আপনার শিষ্য করে নিন। আমরাও আপনার সাথে পরিক্রমায় যেতে চাই।"
বুদ্ধ সম্মত হলেন। এইবার ছেড়ে যেতে হবে এই বোধিস্থান। কিন্তু না, তার আগে আরো একটি কাজ আছে তাঁর। বৃক্ষতল থেকে সযত্নে তিনি তুলে নিলেন সুজাতার ভক্তিভরে নিবেদিত সেই স্বর্নময় পরমান্নের বাটি। এই উনপঞ্চাশ দিন অল্প অল্প করে এই পরমান্ন গ্রহন করে তিনি সত্যলাভের তপস্যা করতে পেরেছেন।
"হে ভদ্রে, তোমার কল্যাণ হউক। তোমার নিবেদিত এই পরমান্ন আমাকে জীবনী শক্তি দিয়েছে তপস্যার জন্য। মঙ্গল হউক তোমার, মঙ্গল হউক সবাকার।"
সেই স্বর্ণের বাটি নিয়ে নদীতীরে নেমে এলেন বুদ্ধ। এই বাটির তাঁর আর কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি মাধুকরী করে অনন্ত পথ পরিক্রমায় যাবেন সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁর মাধুকরীর জন্য সাধারণ একটি বাটিই যথাযথ। স্বর্ণনির্মিত বাটি নিস্প্রয়োজন। আস্তে করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন সেই বাটি। নৈরঞ্জনা নদীর স্রোতের তালে তালে খড়কুটোর সাথে কোথায় চলে গেল সেই স্বর্ণবাটি।
অনন্ত পথ পরিক্রমায় হেঁটে চলেছেন এক পরম পুরুষ। চারিপাশের লোকজন সেই অনিন্দ্যকান্তি দেবোপম পুরুষকে দেখে শ্রদ্ধায় নত হয়ে প্রশ্ন করছে" কে আপনি প্রভু? আপনি কি দেবতা?"
"না"
"আপনি কি মহাপুরুষ?"
"না"
"তবে আপনি কে?"
"আমি জাগ্রত"

সমাপ্ত

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top