সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

রঘুনাথ বড় হয়ে গেছে - নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
২ মার্চ ২০২২ ০৬:০৮

আপডেট:
২ মার্চ ২০২২ ০৬:৩৫

 

আঁকার ক্লাস থেকে জোজো বাড়ি এলো কোলে একটা ছোট্ট বিড়ালছানা নিয়ে| ধবধবে সাদা রং, একজোড়া নীলচে চোখ| সবসময়ের কাজের লোক বীণামাসি দরজা খুলে দিয়ে বলল"একে আবার কোথা থেকে নিয়ে এলে জোজোবাবা? বৌদি দেখলে ভীষন রাগ করবে|" জোজো একগাল হেসে জবাব দিল "রাস্তার ধারে মিউ মিউ করে কাঁদছিল| দেখে এত মায়া লাগলো|" কথা শেষ হতে না হতেই জোজোর মা ঘরে ঢুকেই জোজোর হাতের দিকে তাকিয়ে চীৎকার করে উঠলেন "আবার একটা| কেন ঐ দুটো গুন্ডা রয়েছে তাতেও শখ মিটছে না? " মার কথা শেষ না হতেই বিড়ালছানাটা হঠাৎ লাফ মেরে জোজোর কোল থেকে নেমে মার দিকে এগোতেই  মায়ের তারস্বরে চীৎকার "ধর ওটাকে|" জোজো ওটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল "মা এর নাম আজ থেকে রঘুনাথ|" মার গজগজ "আদিখ্যেতা দেখ, বিড়ালের নাম রঘুনাথ| তা হবে না কেন, ঐ দুটো গুন্ডার নামগুলোও তো এই একইরকম|"
                 মার উল্লিখিত গুন্ডাদের নাম আত্মারাম আর সীতারাম| এই নামকরন ও জোজোর দেওয়া| ছোট থেকেই জোজো মার্জারপ্রিয়| রাস্তায় বিড়াল দেখলেই জোজো দাঁড়িয়ে পড়ে, পারলে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে| জোজোর বাবা এই আধা মফস্বল শহরে বাড়ী কেনার পর থেকেই আত্মারাম এখানে আছে| ঘন পাটকিলে রঙের, ঘাড়ে কালো ছোপ, লেজখানি পুরুষ্টু আর মুখে বেশ আত্মবিশ্বাসের ছাপ নিয়ে আত্মারাম এই বাড়িতে কায়েম হয়ে আছে বছর ছয়েক ধরে| বেশ কিছুদিন পরে একদিন সীতারাম রাস্তা ভুলে জোজোদের বাড়ীতে ঢুকে পড়েছিল| রোববারের দুপুরবেলা, মাংসের ঝোল ও হাড় দিয়ে মাখা ভাত জোজো আত্মারামকে দিচ্ছিল|  সীতারাম এসে দাঁড়াতে সেও খানিকটা ভাগ পেল| সেই খেয়ে সীতারাম এতোই মোহিত হলো যে সে ভুলেও আর কোথায় যায় না| জোজোদের বাড়ীতেই থেকে গেল| তবে শুরুতে  ঠিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হয়নি|  বস্তুত: আত্মারাম মোটেও সবকিছুর ভাগ দিতে রাজী ছিল না| তবে সীতারাম ও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়| বেশ কিছুদিন আঁচড়া আঁচড়ি, কামড়া কামড়ির পর এখন মোটামুটি রফা হয়েছে দুজনের| তবে আত্মারাম তার বেডরুমটা ছাড়েনি বন্ধুকে|  সিঁড়ির তলায় পরিত্যক্ত টিভির বাক্স তার বেডরুম আর সীতারাম ঐ বাক্সটার গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকে|
           অতএব রঘুনাথ রয়ে গেল| সে থাকে দোতলায় জোজোর ঘরে| রোগা, পাতলা ছোট্ট বিড়ালছানা| রোজ সকালে দুধ পাউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট, দুপুরে ও রাতে মাছমাখা ভাত এই জব্বর মেনুতে সে বেশ ভালই আছে| কিন্তু চেহারাটা সেই জিরজিরেই রয়ে গেছে| আত্মারাম সীতারামের মতো পুষ্ট নয়| মাঝে মাঝে হালকা পায়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে যখন সে
নেমে আসে, আত্মারাম সীতারাম রীতিমত অবজ্ঞার চোখে তার দিকে তাকায়| হাতখরচের টাকা দিয়ে জোজো একদিন দোকান থেকে একটা সেরেলাক নিয়ে বাড়িতে ঢুকল| মায়ের জিজ্ঞাসু চোখ দেখে বলল "রঘুনাথের  চেহারাটা কেমন রোগাপাতলাই আছে|  কাল থেকে সকালে দুধ পাউরুটির বদলে ওকে সেরেলাক খাওয়াব|" প্রচন্ড রাগে ক্ষোভে মায়ের মুখ থেকে কোনো কথা বেরোল না|   মা ঘরের বাইরে যেতেই জোজো একলাফে রঘুনাথের খাওয়ার বাটিটা এনে তাতে দুধ সেরেলাক গুলে ফেলেছে| রঘুনাথের মুখের কাছে ধরতেই সে খানিক ক্ষন তাকিয়ে দেখল| এই ধরনের খাদ্যবস্তু সে আগে কখনো পায়নি| তবে গন্ধটা খাসা বেরোচ্ছে দেখে সে দ্বিধা না করে খেয়ে নিল|
               তার প্রিয় মার্জারবাহিনী নিয়ে জোজো বেশ ভালোই আছে| কিন্তু মায়ের মনে অশান্তির শেষ নেই| ইদানীং আত্মারাম আর সীতারামের দৌরাত্মি খুব বেড়েছে| গত সপ্তাহে ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুশাক রান্না হয়েছিল| তরকারির বাটিটা খাবার টেবিলে রাখতে না রাখতেই আত্মারাম কোথা থেকে এসে লাফ দিয়ে মাছের মাথাটা নিয়ে পালালো| ওদিকে সীতারাম সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরের জন্য এনে রাখা সন্দেশের বাক্স মুখে করে নিয়ে পগার পার| প্রায়ই রান্নাঘরে দুধের সসপ্যান উল্টানো, কাঁচা মাছ চুরি করে পাঁচিলে বসে খাওয়া এসব তো লেগেই আছে|  এতটুকু অন্যমনস্ক হবার জো নেই ওদের জন্য| তবে সবচেয়ে  চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল বিজয়া দশমীর পরের দিন সকালে| বাজার থেকে বড় বড় নীলচে রঙের জাম্বো সাইজের গলদা চিংড়ি নিয়ে এসে জোজোর বাবা মাকে বললেন "বেশ মিস্টি মিস্টি করে নারকেল দিয়ে মালাইকারিটা রান্না করো তো| দুপুরে জমিয়ে খাওয়া যাবে|"  মা ধীরে সুস্থে অনেক সময় নিয়ে মালাইকারিটা রান্না করলেন| সারা বাড়ি তখন ম -ম করছে মালাইকারীর গন্ধে| আত্মারাম সীতারাম চঞ্চলভাবে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে সমানে| রান্না শেষ করে মা মালাইকারীর বাটিটা  নিয়ে উঠে গেলেন দোতলায়| দোতলার দরজা বন্ধ করে শোবার ঘরের টেবিলে মাছ ঢাকা দিয়ে রেখে ধীরে সুস্থে নিশ্চিন্ত হয়ে মা স্নানে ঢুকলেন| আধঘন্টা পরে এক তীব্র গগনভেদী আর্ত চীৎকার| স্কুল এখন বন্ধ| জোজো তাই সামনের বারান্দায় ব্যাট হাতে একবার শচীন একবার সৌরভ হচ্ছিল| নিচে খাবার  টেবিলে জোজোর বাবা কাগজ পড়ছিলেন| মালাইকারীর বাটি দোতলায় চলে যাবার পর আত্মারাম সীতারাম উদাসভাবে পাঁচিলের উপর বসেছিল| মা কি তবে বাথরুমে পড়ে গেছে?  এই ভেবে জোজো দৌড়ে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখতেই উপর থেকে একটা চটি উড়ে এল| চটির গতিটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল| কেননা রঘুনাথ ঠিক চটির পিছন পিছন বিদ্যুৎবেগে নেমে এলো| মুখে ইয়া বড় লালচে রঙের গলদা চিংড়ি|  মা সিঁড়ির উপর থেকে চীৎকার করে উঠলেন "জোজো ধর ওটাকে| আজকে ওর একদিন কি আমার একদিন|" জোজো পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল রঘুনাথ উধাও| সেইসঙ্গে উধাও পাঁচিলের উপর বসে থাকা আত্মারাম সীতারাম|
                সমস্ত বাড়িতে একটা শোকের আবহাওয়া| বিড়ালে মুখ দেওয়া মাছ মা কাউকে খেতে দেবেন না| ফেলেই দেবেন সমস্তটা| আহা! জোজো দেখল সোনালী তেল, নারকেলের দুধ মেশানো ঝোলের উপর কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে আছে লালচে রঙের জাম্বো প্রণেরা| বাবার ও মনটা খারাপ| তবে মুখে কিছু বলছেন না| ভুতোর মা ঘর মুছছিলো| সে বলল " বৌদি ফেলো না| আমাকে দিয়ে দাও, বাড়ী নিয়ে যাবো| আমাদের ওসবে কিছু হয় না|" অতএব টিফিনবাক্সে করে গলদা চিংড়ির মালাইকারী চলে গেল ভুতোর মায়ের সাথে| দুপুরের মেনু এখন শুকতো, ডাল আর আলুভাজা| নীরস মুখে তাই দিয়ে খেয়ে জোজো  আত্মারাম সীতারামের বরাদ্দ ডালমাখা ভাত প্লেটে করে নিয়ে নিচে নেমে এলো | রঘুনাথের ব্যাপারটা যে কি করে ম্যানেজ হবে শেষ পর্যন্ত? মা কি আর রঘুনাথকে ঘরে ঢুকতে দেবেন? জোজো জানে না| নিচে নেমে ভাতের প্লেট রেখে আত্মারাম সীতারামকে ডাকতে গিয়ে জোজোর চক্ষু চড়কগাছ| উঠানে সারি দিয়ে বসে আছে আত্মারাম, সীতারাম আর রঘুনাথ| রঘুনাথ বসেছে দুজনের ঠিক মাঝখানে| সীতারাম একবার উপেক্ষার দৃষ্টি মেলে জোজোর আনা ভাতগুলোর দিকে তাকাল| আত্মারাম  জোজোর সামনেই আদর করে চেটে নিল রঘুনাথের গা| তিনজনের চোখে মুখে এক পরিপূর্ণ তৃপ্তির ছাপ| আত্মারাম যেন রঘুনাথের গা চেটে বলতে চাইল "বাহ! ছোটে ওস্তাদ|"
                জোজো ধীরপায়ে সিঁড়িতে উঠছিল| সেরেলাকের টিনটা আর লাগবে না| রঘুনাথ বড় হয়ে গেছে|

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top