সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

পশুর হাটে প্রেমিকার সাথে দেখা : হাসান আলী


প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০২২ ০১:৫১

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ০৪:১৪


আমার বাড়িওয়ালা গত জুনে এক লাফে দু'হাজার টাকা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করেছেন। অন্য ভাড়াটিয়ারা আমার নেতৃত্বে বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করলো। তাঁর সাফ জবাব, না পোষালে অন্য খানে চলে যান। জমিদার বাড়িওয়ালার সামনে কাকুতি-মিনতিতে কাজ হলো না। ফিরে আসার সময় সবাই কোন না কোন মনত্দব্য করলো। শেষে একজন মনত্দব্য করলো, আপনি বাড়িওয়ালার খাস লোক কিছু সুবিধা আপনি পাবেন। এসব মন্তব্যে গা জ্বলে উঠলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, বাড়িওয়ালার খাস লোক হওয়ার দরকার নেই। প্রতি বছরই তিনি আমাকে সঙ্গে করে পশুর হাটে কোরবানির পশু কেনেন। আমিও সবার সামনে দিয়ে বুকটান করে বাড়িওয়ালার গাড়িতে পশুর হাটে যাই। স্ত্রীর সামনে ভাব নেই। বলি, তুমি আমাকে গুরুত্ব দেওনা। জ্ঞানী লোকেরা ঠিকই আমার গুরুত্ব বোঝে। স্ত্রী টিপ্পনি কেটে বলবে, সবারই চামচা থাকে। তোমারও চামচা হওয়ার সখ। চামচা আর টিস্যু পেপার একই রকমের জিনিস। আমি আর স্ত্রীকে ঘাটতে চাইলাম না। আমি জানি কিছুক্ষণ পরই আরও জঘন্য কুৎসিৎ কোনো কথা মুখ দিয়ে বের হতে পারে। হয়তো বলে বসবে, আকাশে সূর্য যতক্ষণ-বালুর তাপ ততক্ষণ।

শেষ রৰা হলো না। বাড়িওয়ালা দারোয়ান দিয়ে খবর পাঠালো দেখা করতে। আমাকে দেখে একগাল হেসে বললো, চলুন গাবতলী গরুর হাটে যাই। আমি বিভিন্ন অজুহাত তুলে না যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কাজ হলো না। যেতে হলো তার সাথে। স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। এগিয়ে এসে হাতে ছাতাটা গুঁজে দিলেন। আমি ছাতা হাতে বাড়িওয়ালার সাথে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। যানজট অতিক্রম করে হাতিরপুল থেকে গাবতলীতে যেতে ঘন্টাদেড়েক লেগে গেল। গাবতলীতে শত শত ট্রাক গরু নিয়ে নামানোর অপেৰায় রয়েছে। গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে কেন যেন মায়া হয়। কতদিনের পরিচিত স্থান ত্যাগ করে বেপারীর সাথে গাবতলীর হাটে গরুগুলো আসছে। আহা! যেখানে গরু নামানো হয়েছে সেখানে বেপারীরা ক্ষুধার্ত গরুগুলোকে খড়-বিচালী, খৈল-ভূসি খাওয়ানোর জন্য ব্যসত্দ। কেউ কেউ গরুর গা ধুয়ে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ অসুস্থ গরুর সেবা করছেন। দালাল, চাঁদাবাজ, টাউট, পকেটমার থেকে শুরু করে নানা ধরনের লোক গাবতলীর হাটে গিজ গিজ করতে থাকে। বেশ কয়েক বছর ধরে আসা যাওয়া করে আমার কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাড়িওয়ালাকে দালালের দল ঘিরে রেখেছে। বিভিন্ন সাইজের গরু দেখাচ্ছে। বাড়িওয়ালার ছেলে দামী মোবাইলে গরুর ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করছেন। ফেসবুকের দু'একটা মনত্দব্য আমাকে শোনালো। বেপারীরা হাটে ক্রেতা কম দেখে কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করলো। পাশাপাশি আবার কেউ কেউ আশাবাদী মনত্দব্য করলো।

গরু দেখে দেখে আমি কিছুটা ক্লানত্দ হয়ে পড়েছি। গাবতলী হাটের উত্তর-পশ্চিম দিকে ছোট খাট একটা জটলা দেখে কিছুটা উৎসাহী হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কিছুৰণের মধ্যে দেখা গেল কালো বোরকা পরা লম্বা-সুন্দরী মহিলা আমাদের দিকে আসছেন। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। কাছে আসতেই আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম। এতো দেখি আমার হাই স্কুল জীবনের পান্না। আমি নিশ্চিত হবার জন্য তার মুখের তিলটা খুঁজছি। হঠাৎ দমকা হাওয়া মধ্যবয়সী সুন্দরীর মুখের চুল সরিয়ে দিল। আমি নিশ্চিত হলাম ইনি পান্না। নবম শ্রেণিতে পড়তাম আমি আর পান্না পড়তো ষষ্ঠ শ্রেণিতে। পান্নার জন্য স্কুলের ছাত্র শিৰকের মধ্যে এক ধরনের চঞ্চলতা শুরু হলো। কে এই কিশোরী মেয়েটিকে জয় করবে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। যারা স্কুলে আগে আসতো, তারা এসেই খোঁজ নিত পান্না এসেছিল কিনা। আসলে কমন রুমের সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি বেড়ে যেত আমাদের। কখনও কেউ একজন চিৎকার করে উঠতো ঐ আসছে। সঙ্গে সঙ্গে শত শত উৎসুক চোখ রাসত্দার দিকে তাকিয়ে থাকতো। স্কুলে এক ধরনের প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতো।

পান্নার প্রতি স্কুলের কিশোরদের অতিরিক্ত মনযোগে হেড মাস্টারের মেজাজ চড়া হয়ে উঠলো। একেক দিন একেক ক্লাসে জোড়বেত দিয়ে ছাত্র পেটাতেন। সারা স্কুলের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছিল। 'পান্না' জ্বরে আক্রান্ত কিশোররা দ্রুত আরোগ্য লাভ করলো। তারপর আমি দশম শ্রেণিতে পান্না সপ্তম শ্রেণিতে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পান্নার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পেলাম। সাহস করে পান্নাকে চিঠি লিখলাম। প্রিয় 'পা', আমার জন্ম হয়েছিল তোমার জন্য। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। তোমাকে পেতে চাই সব কিছুর বিনিময়ে। আই লাভ ইউ। ইতি তোমার 'হা'। জোড় বেতের পিটুনি খাবার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পান্নার হাতে গুঁজে দিলাম চিরকুটখানি। তার হাত যেন প্রস্তুত ছিল এই চিরকুটটির জন্য। পরদিন পান্নার কাছ থেকে চিরকুট পেলাম। প্রিয়-'হা', অমন হা করে তাকিয়ে থেকো না। মাছি ঢুকবে। ডায়রিয়া হলে মতলব যেতে হবে। এই নিয়ে ছত্রিশ খানা চিঠি পেলাম। উত্তর দিতে ছত্রিশ বছর লাগবে। ততদিনে তুমি বুড়ো আর আমি বুড়ি হব। তোমার নাকের সর্দি দেখলে আমার বমি আসে! ইতি-'পা'।

পান্নার ভালবাসার তীর আমাকে বিদ্ধ করলো। আমি মনোযোগী হলাম পড়াশুনায়। প্রি-টেস্ট পরীৰার পর একদিন সকালে স্কুলে শুনলাম গত রাতে পান্নার বিয়ে হয়েছে। বর অনেক টাকার মালিক। সপ্তাহ খানেক পর শুনলাম পান্না স্বামীর সাথে ঢাকা চলে গেছে। ছত্রিশ বৎসর পর গাবতলীর গরুর হাটে পান্নার সাথে এভাবে দেখা হবে কল্পনা করিনি কোনদিন। পান্নার কণ্ঠস্বর আমাকে বাসত্দবে ফিরিয়ে আনলো। কী ভাই গরু কিনেছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি পান্না। মাথা নেড়ে জানালাম আমি চিনতে পেরেছি। পান্না আমাকে সঙ্গীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্কুল জীবনের সহপাঠী হিসেবে। আমার বাড়িওয়ালা যে গরুটা পছন্দ করেছিল পান্না সে গরুটি দরদাম করে এক লৰ নব্বই হাজার টাকায় কিনে নিল। বাড়িওয়ালা চরম বিরক্ত হয়ে আমাকে নিয়ে অন্যত্র যেতে চাইলেন। পান্না আমাকে ডেকে নিলো তার সঙ্গে। পান্নার আহ্বানে আমি সাড়া দিলাম। দু'জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে শুনলাম পান্নার অর্থ-বিত্তের সংবাদ। স্বামীর গার্মেন্টস্, স্পীনিং মিল, রিয়েল এস্টেট এবং ব্যবসায় দশ হাজার লোক খাটে। বছরে নয় মাস বিদেশেই কাটাতে হয়। আমি অবাক হয়ে পান্নার কথা শুনি। পান্না ব্যাগ থেকে আমাকে একটা কাল চকলেট দিলেন। আমি মুখে পুরে চুষতে লাগলাম। এক সময় কাল প্রাডো গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়াল। পান্না গাড়িতে গিয়ে বসলো। টিস্যু পেপারে ঘাম মুছলো। আমাকে বাসায় যাবার নিমন্ত্রণ করলো। আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো পান্না। প্রাডো বিদায় জানালো ধূলা উড়িয়ে। গাবতলী থেকে পাবলিক বাসে গাদাগাদি করে ঘামে ভিজে বাংলা মোটর এসে নামলাম। হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। পথেই দেখা হলো বাড়িওয়ালার সাথে। বাড়িওয়ালা রেগে আগুন। বললেন, মিয়া দু'দিন পর জামাইর শ্বশুর হবেন। এখনও মেয়ে লোক দেখলে পাগল হয়ে যান। ঐ মহিলাতো আপনাকে পাত্তাই দিল না এবং গাড়িতেও নিলনা। আমি মাথা নিচু করে বাসায় ঢুকলাম। ছাতা হারিয়ে এসেছি বলে বউ ক্ষেপেছে সাংঘাতিক। বিদু্ৎ নেই সন্ধ্যা থেকে। হাতে হারিকেন নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।

 

হাসান আলী
উন্নয়ন কর্মী ও কলাম লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top