সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী যেন সময়ের দলিল : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৪৬

আপডেট:
৩ নভেম্বর ২০২২ ০১:৫৩


বাসায় রাখা পত্রিকার পাতা থেকে জানলাম বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা ডায়েরির সংকলন বাজারে আসছে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' নামে। সপ্তাহান্তে দৌড়ালাম শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের এই ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকানে। যেয়েই বইটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলাম। বইয়ের মধ্যে ঐতিহাসিক কিছু ছবি ছিলো। এরপর বইয়ের দামটা দেখে চুপসে গেলাম কারণ পকেটে অত টাকা নেই। মনের মধ্যে একটা প্রচন্ড আক্ষেপ তৈরি হলো। বইটা তাকে রেখে দোকানিকে বললাম, এই বই সরকারিভাবে প্রত্যেক পরিবারে এক কপি করে বিনামূল্যে বিতরণ করা উচিৎ। দোকানি আমার কথা শুনে এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি এইমাত্র টুপ করে খসে পড়েছি মঙ্গল গ্রহ থেকে। বইটা কিনতে না পেরে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে আসলাম। এরপর হয়তোবা মনের ভেতরের রাগ থেকেই বইটা আর সংগ্রহ করা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে প্রবাসে আসার পর এক বড় ভাইয়ের আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। তবুও বইটা পড়া হয়নি। অবশেষে এইবার পড়া শুরু করলাম জাতীয় শোক দিবসের পর। যেই শুরু করলাম এরপর একটানা পড়ে শেষ করলাম। প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে বই পড়ার সময় বের করা মোটামুটি অসম্ভব। তবুও আমি ট্রেনে, অফিসের কম্পিউটারে পিডিএফ আর বাসার অবসর সময়টুকু মিলিয়ে বইটা পড়লাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্যান্য লেখকদের লেখা পড়েছি তন্মধ্যে এবিএম মুসার লেখা 'মুজিব ভাই' বইটা মনে দাগ কেটেছিল। আর বঙ্গবন্ধুকে শুনেছি কত না গল্প। এর বাইরেও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় উনাকে নিয়ে পড়েছি ছোটখাটো অনেক লেখাই। কিন্তু উনার নিজের হাতে লেখা একটা বই সেইসব আনন্দ উত্তেজনাকে ছাপিয়ে গেছে।

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

বইয়ের শুরুতে শেখ হাসিনার লেখা একটা ভূমিকা আছে। সেখানে তিনি লিখেছেন - "আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দী হিসেবেই কাটাতে হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বারবার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনও আপোষ করেন নাই। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেন নাই। তাঁর জীবনে জনগণউ ছিল অন্তঃপ্রাণ। মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন - এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।" এরপর আছে এই ডায়েরি হাতে পাওয়ার গল্প। এবং হাতে পাওয়ার পর উনাদের দুবোনের মনের অবস্থার বর্ণনা। আরও আছে পাঠোদ্ধারের গল্প। উনি আরও লিখেছেন - "এই লেখাগুলো বারবার পড়লেও শেষ হয় না। আবার পড়তে ইচ্ছা হয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য, একজন মানুষ কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন, জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে পারেন তা জানা যায়। জীবনের সুখ-স্বস্তি, আরাম, আয়েশ, মোহ, ধনদৌলত, সবকিছু ত্যাগ করার এই মহান ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায়।... তথ্যবহুল লেখায় পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাঙালির স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা চক্রান্ত ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনা ও ইতিহাস জানার সুযোগ হবে।" এই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন। ১৯৬৬-৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে একান্ত নিরিবিলি সময়ে তিনি লিখেছেন। বইয়ের শেষে সংক্ষিপ্ত আকারে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে যেটা লেখকের লেখা না। বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখাটার তীব্র স্রোতে ভেসে এসে পাঠককে তাই ধাক্কা খেতে হয়। এমন পরোপকারী, জনদরদি একজন মানুষের এমন পরিনতির কথা পড়ে।

আমি বই পড়তে বসলে হাতের কাছে কয়েক রঙের হাইলাইটার রাখি চুম্বক অংশগুলো মার্ক করার জন্য। এই বইটা পড়ার সময় এমন হয়েছে যে প্রায় প্রতিটা পাতাতেই আমি কিছু না কিছু লাইন মার্ক করেছি। কারণ এই বইটা শুধুই বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী না বরং সময়ের দলিল। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালে যখন এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন চলছে। ব্রিটিশদের তাড়িয়ে এরপর ক্ষমতায় আসে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু শুরু থেকেই তারা আমলা নির্ভর একটা জনবিচ্ছিন্ন সরকার গঠন করে। এরপর তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে যায় যে তারা একসময় জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সেটা আর খেয়াল করেনি। যখন আওয়ামীলীগ যখন একমাত্র বিরোধীদল হিসেবে আবির্ভুত হলো তখন আবার জোরপূর্বক তাদেরকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র একই সময়ে জন্ম নিলেও পাকিস্তান তার লক্ষ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছিলো। দীর্ঘ সময় পার করেও তারা একটা শাসনতন্ত্র দেশের জনগণকে দিতে পারেনি যার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা হবে।

বইয়ের শুরুটা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় - "বন্ধুবান্ধবরা বলে, তোমার জীবনী লেখ। সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।...হঠাৎ মনে হল লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কি? সময় তো কিছু কাটবে। বই ও কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ দুইটাও ব্যাথা হয়ে যায়। তাই খাতাটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম।... আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু-আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।"

পুরো বইটার সবচেয়ে উপভোগ্য দিক হলো বইটা প্রথম পুরুষে লেখা। প্রথম পুরুষে লেখা যেকোন বই দ্রুতই পাঠককে তার বইয়ের পাতায় একতাবদ্ধ করে ফেলে। পাঠক দিব্যদৃষ্টিতে সকল ঘটনা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেন। আমিও এই বই পড়তে যেয়ে বঙ্গবন্ধুর একেবারে শৈশব থেকে শুরু করে সমস্ত ঘটনাবলীই যেন দেখতে পেলাম। এছাড়াও বইতে লেখক অনেক ঘটনা নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন যেটা ভবিষ্যতে এসে ফলে গিয়েছে। এতেকরে লেখকের দূরদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায়। এছাড়াও আমাদের মানসিকতা গঠনের বিষয়টাকেও দেখেছেন খুবই গভীর দৃষ্টিতে। বাংলাদেশিদের চরিত্রের এমন অনেক বিষয়ে লেখক আলোকপাত করেছেন যাতেকরে সহজেই আমাদের ব্যক্তিগত এবং জাতিগত চরিত্রের মনস্ত্বাত্বিক বিশ্লেষণ সহজ হয়ে যায়। পাশাপাশি রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব কর্তব্য কেমন হতে হবে সেই বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়াও সরকারি আমলা এবং মিলিটারির কর্মপরিধি কেমন হবে সেটাও বুঝতে পারা যায়। আর এর অন্যথা হলে দেশ ও জাতির কপালে কি ঘটতে পারে সেই বিষয়েও লেখক আলোকপাত করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে। তাঁর আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। এরপর লেখাপড়ার পাঠ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন - "আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আব্দুর রশিদ একটা এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়ালেখা করে আমার আব্বার কাছে চলে যাই এবং চতুর্থ শ্রেণীতে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হই।... ১৯৩৪ সালে আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতাম। হঠাৎ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে।... ১৯৩৬ সালে আমার চক্ষু খারাপ হয়ে পড়ে। গ্লুকোমা নাম একটা রোগ হয়। ডাক্তারদের পরামর্শে আব্বা আমাকে নিয়ে আবার কলকাতায় রওয়ানা হলেন চিকিৎসার জন্য।...দশ দিনের মধ্যে দুইটা চক্ষুই অপারেশন করা হল। আমি ভাল হলাম। তবে কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে, চশমা পরতে হবে। তাই ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা পরছি।... ১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম।"

বঙ্গবন্ধুর জীবন বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদীর মতো। সেই নদী যেয়ে মিশেছে অন্য অনেক নদীর সাথে। কখনও তারা বয়ে চলেছে একসাথে আবার কখনও বা আলাদা পথে। সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের এবং মাওলানা ভাসানীর মতো ব্যক্তিত্বের। উনারা সবাই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর মাথার উপর ছায়া হয়েছিল তাঁর বাবা। হয়তোবা পরিবারের বড় সন্তান হওয়াতেই বঙ্গবন্ধু তাঁর বাবার আদর কিছুটা বেশি পেয়েছিলেন। দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর বাবা অনেকবার সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর মুখ দর্শনের পরপরই। বঙ্গবন্ধুও তাঁর বাবাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসতেন। সকল প্রকার আবদারের কেন্দ্র ছিলেন অন্তঃস্থলবাবা। বঙ্গবন্ধুর বাবা বলেছিলেন - 'sincerity of purpose and honesty of purpose' থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না। আরেকদিন কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাবা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলেছিলেন - "দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাবো না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।" বঙ্গবন্ধুর বাবা অনেক সময় তাঁর সাথে রাজনৈতিক আলাপ করে প্রশ্ন করতেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে খুবই ভালোবাসতেন। আর বঙ্গবন্ধুও তাঁকে ত্যাগী নেতা হিসাবে অন্তরের অন্তঃস্থতল থেকে শ্রদ্ধা করতেন। এমন না যা শহীদ সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর কখনও মনোমালিন্য হয়নি কিন্তু সেটা সাময়িক। আসলে দুজনের মনের এবং নীতির মিল থাকলে ভুল বুঝাবুঝিগুলো হয় নিতান্তই সাময়িক। শহীদ সাহেবকে নিয়ে এই বইয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয়েছে। তাঁর পাকিস্তান আন্দোলন, পাকিস্তানের ঐক্যে নিজেকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া আবার পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মন্ত্রিত্ব গ্রহণসহ অনেক বিষয় এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। বঙ্গবন্ধু বারবারই শহীদ সাহেবের ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় - "তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন।… অনেক শুনে আশ্চর্য হবেন, শহীদ সাহেবের কলকাতায় নিজের বাড়ি ছিল না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি, ভাড়া করা বাড়ি। তিনি করাচিতে তাঁর ভাইয়ের কাছে উঠলেন, কারণ তাঁর খাবার পয়সাও ছিল না।... বাংলাকে তিনি যে কতটা ভালবাসতেন তাঁর সাথে না মিশলে কেউ বুঝতে পারত না।... শহীদ সাহেব ছিলেন সাগরের মত উদার। যে কোন লোক একবার তাঁর কাছে যেয়ে হাজির হয়েছে, সে যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।" এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে নানা বলে সম্বোধন করেছেন আর মাওলানা ভাসানীকে বলেছেন মাওলানা।

এই বইটা পড়লে বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক চরিত্রের মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু একাধারে ছিলেন দুরন্ত আবার অন্যায় দেখলে প্রতিবাদী। একদিকে প্রকৃতিপ্রেমী আবার অন্যদিকে তাঁর হাস্যরসও ছিলো ঈর্ষণীয়। একবার দিল্লিতে একটা কনভেনশনে যোগ দিতে যেয়ে সেখানে ভ্রমণের সুযোগ পান। সেই সুযোগে দিল্লির সব দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শণ করেন। সেইসব জায়গার চমৎকার বর্ণনা আছে এই বইতে। তাজমহলের সৌন্দর্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন - "কি দেখলাম ভাষায় প্রকাশ আমি করতে পারবো না। ভাষার উপর আমার সে দখলও নাই। শুধু মনে হল, এও কি সত্য! কল্পনা যা করেছিলাম, তার চেয়ে যে এ অনেক সুন্দর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাজকে ভালোভাবে দেখতে হলে আসতে হবে সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যাবার সময়, চাঁদ যখন হেসে উঠবে তখন।... সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না। দারোয়ান দরজা বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাজমহলেই ছিলাম।"

এছাড়াও এই বইয়ে বাঙালিদের চরিত্র নিয়ে আছে গূঢ় বিশ্লেষণ। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় - "আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল 'আমরা মুসলমান' আর একটা হল আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাস ঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, 'পরশ্রীকাতরতা'। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে 'পরশ্রীকাতর' বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে 'পরশ্রীকাতরতা'। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।... অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।" এছাড়াও বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিষয়ে লিখেছেন - "সাধারণত দোষী ব্যক্তিরা গ্রেফতার বেশি হয় না। রাস্তার নিরীহ লোকই বেশি গ্রেফতার হয়। তাদের কাছে বসে বলি, দাঙ্গা করা উচিত না; যে কোন দোষ করে না তাকে হত্যা করা পাপ। মুসলমানরা কোন নিরপরাধীকে অত্যাচার করতে পারে না, আল্লাহ ও রসুল নিষেধ করে দিয়েছেন। হিন্দুদেরও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তারাও মানুষ। হিন্দুস্তানের হিন্দুরা অন্যায় করবে বলে আমরাও অন্যায় করব-ইটা হতে পারে না।"

বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সেই বিষয়ে 'কারাগারের রোজনামচা' বইটা পড়ার পর লেখার ইচ্ছা আছে। কারাগারে বন্দি থাকা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন - "কারাগারের অন্ধকার কামরায় একাকী থাকা যে কি কষ্টের, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না।" এভাবে কারাগারে বন্দি থাকতে থাকতে তিনি পরিবার পরিজন থেকে বেশিরভাগ সময়ই বিচ্ছিন্ন থাকতেন। আবার কারাগারের বাইরে থাকলেও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে পরিবারকে ঠিকমতো সময় দিতে পারতেন না। পরিবারের মানুষদের সাথে বন্ধনটা কেমন হয়ে গিয়েছিলো তার একটা মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে এই বইতে। একটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় - "একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, হাচু আপা, হাচু আপা, আমি তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলি। আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, আমি তো তোমারও আব্বা। কামাল আমার কাছে আসতে চাইতো না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়।"

বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম ধাপ ছিলো ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং কারাবরণ করেছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি ছিলো বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম টান। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধু একদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে - "নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তারই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেডারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।" আব্বাসউদ্দিন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন - "মুজিব বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।" বঙ্গবন্ধু আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে কথা দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তো আসলে ছিলেন বাংলার জনসাধারণের বন্ধু। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ তাকে ভালোবাসতেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময়ের একটা ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। এই বই থেকে বঙ্গবন্ধুর জবানিতে লেখাটা হুবহু তুলে দিচ্ছি - "আমার মনে আছে খুবই গরিব বৃদ্ধ এক মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমাকে একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই। আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না। টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা। নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারবো না।"

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের বিষয়টা সর্বজন বিদিত তাই আমি ইচ্ছে করেই সেদিকটা এড়িয়ে গেছি। এই বইটা পড়ে আমি যেন বঙ্গবন্ধুর সাথে সেই সময়ে পরিভ্রমণ করে আসলাম। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর বেশকিছু দুর্লভ স্থিরচিত্র স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি আছে উনার হাতে লেখা ডায়েরির প্রতিলিপি। এটা আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে। কেমন ছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির হাতের লেখা। বারবার ছুঁয়ে দেখেছি। পরিশেষে একটা কথায় বলতে চাই বাংলাদেশি হিসেবে জন্ম নেয়া প্রত্যেকের অবশ্য পাঠ্য এই বইটি। এই বই নিয়ে হোক অনেক পাঠ সমাবেশ। হোক আলোচনা। শুরুতে যে কথাটা বলেছিলাম সেখানে ফিরে আসি। সরকার অন্ততঃপক্ষে এই বইয়ের একটা করে কপি প্রতি পরিবারকে বিনামূল্যে দিয়ে পাঠে উৎসাহিত করতে পারে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top