সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

ময়ূরাক্ষী - অভিনব জীবনবোধের সন্ধান (বুক রিভিও) : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৬ নভেম্বর ২০২২ ০২:৫৫

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ১৯:৩৬

 

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক ব্যক্রমধর্মী চরিত্র হিমু। যার পুরো নাম হিমালয়। যাকে তার বাবা হিমালয় পর্বতের মতো করে বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। এভাবে বড় করতে যেয়ে হিমুর বাবা হিমুকে দিয়ে অনেক ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। এরপর একসময় তিনি মারা যান। হিমু থাকতে শুরু করে তার মামাদের সাথে। মামারা তিনজনই ভয়ংকর ধরণের খারাপ মানুষ। এরপর একসময় হিমু শহরে চলে আসে। পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবী পরে সারারাত জেগে শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাটতে থাকে। এভাবেই সে বিভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়। হিমু নিজেও তার বাবার মতো নিজেকে নিয়ে অনেক ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। ব্যক্তিগতভাবে তার ইনট্যুইশন ক্ষমতা খুবই প্রখর। এভাবেই হিমুর গল্প এগোতে থাকে। তখনকার সময়ে হিমু বাংলাদেশের কিশোর এবং তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন চরিত্র ছিলো। একটা প্রজন্ম হিমুর অনুকরণে পড়াশোনা মাথায় তুলে হলুদ পাঞ্জাবী পরে সত্যি সত্যিই রাস্তায় ঘোরাও শুরু করে।
হিমুকে মহামানব বানানোর স্বপ্ন নিয়ে হিমুর বাবা তার নিজের কিছু বাণী চামড়ায় বাঁধানো তিনশ একুশ পৃষ্ঠার একটা খাতায় তিনি মুক্তোর মতো গোটা গোটা হরফে লিখে গিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি মাত্র আঠারো পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখতে পেরেছিলেন। এরপরই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যেমনঃ উপদেশ নম্বর এগারো - সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান। এই অনুচ্ছেদে লেখা ছিলো - 'সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান করিবে। ইহাতে আত্মার উন্নতি হইবে। সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং আত্মাকে জানা একই ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিও -
বহুরূপে সম্মুখে তোমার,
ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?'
হিমুর বাবার একটা উপদেশের শিরোনাম হচ্ছে - নির্লিপ্ততা। তিনি লিখেছেনঃ 'পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ এবং মহাজ্ঞানীরা এই জগৎকে মায়া বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র চিন্তা ও ক্ষুদ্র বিবেচনায় দেখিয়াছি আসলেই মায়া। স্বামী ও স্ত্রীর প্রেম যেমন মায়া বই কিছুই নয়, ভ্রাতা ও ভগ্নির স্নেহ-সম্পর্কও তাই। যে-কারণে স্বার্থে আঘাত লাগিবা মাত্র স্বামী-স্ত্রীর প্রেম বা ভ্রাতা-ভগ্নির ভালোবাসা কর্পূরের মতো উড়িয়া যায়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে নির্লিপ্ত হইতে হইবে। কোনকিছুর প্রতিই তুমি যেমন আগ্রহ বোধ করিবে না আবার অনাগ্রহও বোধ করিবে না। মানুষ মায়ার দাস।' এই মায়া কাটানোর জন্য যখনই হিমুর কোন কিছুর প্রতি মায়া তৈরি হয়েছে তার বাবা সেটাই ধ্বংস করে ফেলেছেন। শৈশবে একবার একটা খেলনা হিমুর খুব পছন্দ হলে সেটা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলেন। একটা লাল ঠোঁটের সবুজ টিয়াপাখির গলা টিপে হত্যা করেন। এরপর হিমুকে বলেন - 'মন খারাপ করবি না। মৃত্যু হচ্ছে এ জগতের আদি সত্য। তিনি তাঁর পুত্রের মন থেকে মায়া কাটাতে চেষ্টা করছেন।'
এছাড়া হিমুকে তার বাবা পড়াশোনাও করিয়েছিলেন অবশ্য সেটা কোন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিলো না। তার বাবার কাছেই হিমু পড়েছিল ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক ভূগোল আর নীতিশাস্ত্র। নীতিশাস্ত্র বলতে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এইসব। মিথ্যা বলা খারাপ কিন্তু আনন্দের জন্য মিথ্যা বলায় অন্যায় নেই। মিথ্যা দিয়েই সত্যকে চিনতে পারা যায়। যেমন গল্প, উপন্যাস এসব মিথ্যা কিন্তু এসব মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে চিনতে পারি। ইংরেজি এবং বাংলার জ্ঞানও এতো গভীর ছিলো যে ছোট বয়সেই হিমু জানতো অমাবস্যার ইংরেজি নিউমুন, মৃন্ময় শব্দের অর্থ মাটির তৈরি।
হিমুর নামকরণ বিষয়েও তার বাবার ছিলো নিজস্ব মতামত। নদীর নামে, ফুলের নামে, গাছের নামে মানুষের নাম হতে পারলে হিমালয় কেন নাম হতে পারবে না। আর হিমালয় নামকরণের কারণ যাতে ছেলের হৃদয় হিমালয়ের মতো বড় হয়। কিন্তু আকাশ রাখেন নাই কারণ আকাশ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কিন্তু হিমালয়কে স্পর্শ করা যায়। ষোল বছর পর যদি হিমু মনেকরে তার বাবার সিদ্ধান্ত ভুল, তখন সে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এরপর মানুষের শতগুণ সম্পর্কে হিমুকে ধারণা দেবার জন্য তার মৃত্যুর পর মামাদের সাথে থাকার ব্যবস্থা করে যান কারণ মামারা ছিল পিশাচ শ্রেণীর। এরপর মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে তিনি বলেন - 'শোন হিমু, কোনরকম উচ্চাশা রাখবি না। টাকাপয়সা করতে হবে, বড় হতে হবে, এইসব নিয়ে মোটেও ভাববি না। সমস্ত কষ্টের মূলে আছে উচ্চাশা।'
এভাবে বড় হতে হতে হিমুর মধ্যে একটা স্বকীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। তার ভাষায় - 'আমি মহাপুরুষ নই। কিন্তু এই ভূমিকায় অভিনয় করতে আমার বড় ভালো লাগে।...আমার মতে মহাপুরুষ হচ্ছে এমন একজন যাকে পৃথিবীর কোন মালিন্য স্পর্শ করেনি। এমন কেউ কি সত্যি সত্যি জন্মেছে এই পৃথিবীতে?...আমি ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলি। অসহায় মানুষদের দুঃখকষ্ট আমাকে মোটেই অভিভূত করে না।...কঠিন মানসিক যন্ত্রনায় কাউকে দগ্ধ করার আনন্দের কাছে সব আনন্দই ফিকে।...মহাপুরুষরা আজীবন চিরকুমার থাকেন। বিয়ে করার পর যারা মহাপুরুষ হন তাঁরা স্ত্রী-সংসার ছেড়ে চলে যান। যেমন বুদ্ধ দেব।'
হিমুর বাবা হাতেকলমে হিমুকে মহাপুরুষের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। যেমন তার একটা উপদেশ এমন - 'যখনই সময় পাবি ছাদে এসে আকাশের তারার দিকে তাকাবি, এতে মন বড় হবে। মনটাকে বড় করতে হবে। ক্ষুদ্র শরীরে আকাশের মতো বিশাল মন ধারণ করতে হবে।...শুধু হৃদয় বড় হলেই চলবে না, তোকে বুদ্ধিমানও হতে হবে। তোর জ্ঞান এবং বুদ্ধি হবে প্রেরিত পুরুষদের মতো।' হিমুকে নিয়ে তার বাবার মনে অনেক স্বপ্ন অনেক আশা ছিলো। সেটা বোঝা যায় তার এই কথায় - 'তোর ওপর আমার অনেক আশা। অনেক আশা নিয়ে তোকে বড় করছি। তোর মা বেঁচে না থাকায় সুবিধা হয়েছে। ও বেঁচে থাকলে আদর দিয়ে তোকে নষ্ট করতো।'
হিমু তার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্যে সারাদিন পথে পথে ঘুরে। মহাপুরুষ হবার সাধনা করে। যখন খুব ক্লান্ত অনুভব করে তখন একটা নদীর স্বপ্ন দেখে। অনেকটা অবাস্তব মনে হলেও হিমুর জীবনে কাকতালীয় ঘটনার সমাবেশ অনেক বেশি। এই নদী আবিষ্কারের ঘটনাটাও কাকতালীয়। ক্লাস সিক্সে মফিজ স্যার তাদের জিয়োগ্রাফি পড়াতেন। একদিন ক্লাসে এসেই হিমুকে জিজ্ঞেস করলেন - 'এই একটা নদীর নাম বল তো। চট করে বল।' তার উত্তরে হিমু বলেছিল - আড়িয়াল খাঁ। স্যার এগিয়ে এসে প্রচন্ড চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর পোড়ানো শেষ করে স্যারের মন খারাপ হয় এবং তখন বলেন - 'আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম।' এরপর হিমু হঠাতই বলে বসে সেই নদীর নাম - ময়ূরাক্ষী।
এরপর মফিজ স্যার যেদিন মারা যান সেদিন রাত্রেই প্রথম ময়ূরাক্ষী স্বপ্নে দেখে। হিমুর ভাষায় - 'ছোট একটা নদী। তার পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। নিচের বালিগুলি পর্যন্ত দেখা যায়। নদীর দুধারে দুর্বাঘাসগুলি কী সবুজ! কী কোমল! নদীর ঐ পাড়ে বিশাল ছায়াময় একটা পাকুড় গাছ। সেই গাছে বিষণ্ণ গলায় একটা ঘুঘু ডাকছে। সেই ডাকে এক ধরণের কান্না মিশে আছে। এরপর হিমু আরো বলেছে - 'নদীর ধার ঘেঁষে পানি ছিটাতে ছিটাতে ডোরাকাটা সবুজ শাড়ি পড়া একটা মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমি শুধু তার মুখটা দেখতে পেলাম। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে খুব চেনা, খুব আপন মনে হলো। যেন কত দীর্ঘ শতাব্দী এই মেয়েটার সঙ্গে কাটিয়েছি।'
এই নদীর প্রসঙ্গেই হিমুর মনেপড়ে তার মায়ের কথা। এই নদীর কোমল স্পর্শ যেন তাদের মায়ের আঁচলের শীতল পরশ। হিমুর ভাষায় - 'আমার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্যে সারাদিন আমি পথে পথে ঘুরি। মহাপুরুষ হবার সাধনা করি। যখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একজন তরুণী ছুটে চলে যায়। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। এই তরুণীটি আমার মা। আমার বাবা যাকে হত্যা করেছিলেন।' এমনসব পরিবেশে বেড়ে উঠতে উঠতে হিমু হয়ে যায় অন্য মানুষ। সেই মানুষকে আসলে কোনভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। হিমুর ভাষায় - 'আমাকে তো আর-দশটা সাধারণ ছেলের মতো হলে চলবে না। আমাকে হতে হবে অসাধারণ। আমি সারাদিন হাটি। আমার পথ শেষ হয় না।'
এই উপন্যাসের শেষ লাইনটা এক কথায় আমাদের জীবনবোধের জায়গাটাতে নাড়া দেয়। মানুষের জীবন তো আসলে একটা অনির্দিষ্ট যাত্রা। কোথা থেকে শুরু আর কোথায়ই বা শেষ হবে তার উত্তর খুঁজে বেড়ানোর মধ্যেই জীবনের গূঢ় অর্থ বিদ্যমান। কিন্তু সবাই কি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়? হয়তোবা দুয়েকজন পায় কিন্তু তারা তখন আর সাধারণ মানুষ থাকেন না। হয়ে উঠেন অসাধারণ। হিমুর ভাষায় -
'গন্তব্যহীন গন্তব্যে যে যাত্রা তার কোন শেষ থাকার তো কথাও নয়।'

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top