সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

দিনান্ত : জনা বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১ ডিসেম্বর ২০২২ ০২:২৯

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ১৩:৫৪

 

পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার পর থেকে হেনা ফয়জুন্নেসার গৃহে আশ্রিতা। সময়টা ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ। বাংলাদেশে কুমিল্লা জেলায় উচ্চ শিক্ষিতা, বিদুষী, সমাজ সংস্কারক পশ্চিমগাঁয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেসাকে এক ডাকে দুই বাংলার অনেকেই চেনেন। তিনি জমিদার বংশের কন্যা সন্তান, আবার মোগল রাজত্বের উত্তরসূরীও বটে। বাবার মৃত্যুর পর তিন ভাই বোনের মধ্যে প্রথম সন্তান হিসাবে ফয়জুন্নেসা জমিদারী লাভ করেন এবং মায়ের মৃত্যুর পর মাতুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণীও হন। প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম, রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি কৃতিত্বের জন্য ফয়জুন্নেসার নাম চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে। তবে কিছু নিন্দুক সব স্থানেই থাকে। তারা অসূয়াবশত: ভালো কাজেরও নিন্দা করে থাকে।
ফয়জুন্নেসার ছোটবেলার বান্ধবী ফতেমার কন্যা হেনা ফয়জুন্নেসার সন্তানসমা। হেনাকে জন্ম দিতে গিয়ে ফতেমার মৃত্যু হয়। তখন থেকেই হেনার প্রতি ফয়জুন্নেসা স্নেহের আঁচল বিছিয়ে দেন। হেনার পড়াশোনার জন্য গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করেন।হেনার উনিশ বছর বয়সে ফয়জুন্নেসা নিজের খালাতুতো ভাই সেলিমের সঙ্গে হেনার বিবাহ দেন। কুমিল্লায় ফয়জুন্নেসা প্রতিষ্ঠিত জানানা হাসপাতালে জন্ম নেয় হেনার পুত্র সন্তান। তবে বিয়ের পর থেকে সেলিমের পরিবর্তন শুরু হয়। রোজগারে মন ছিলনা। নববিবাহিতা বধূকেও অবহেলা করতে শুরু করে। সেলিমের অতিরিক্ত পানাসক্তি দেখে হেনা বিয়ের পর প্রায়ই ফয়জুন্নেসার কাছে এসে কান্নাকাটি করত।
বর্তমানে পশ্চিমগাঁও-এর সাড়ে তিন একর জমিতে ফয়জুন্নেসা নিজের একটি গৃহ নির্মাণ করে স্বতন্ত্রভাবে আছেন। গৃহের একটু দূরে খোলা ধানক্ষেত, সামনে ও পাশে পুকুর। জমিদারী কাজের সূত্রে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেই হয় ফয়জুন্নেসাকে। গ্রামের চাষী বউরা নানান সমস্যা নিয়ে তাদের নওয়াবের কাছে আসে। এছাড়া গ্রামের বিভিন্ন বর্ণের মানুষ তাদের নওয়াবকে তাদের আপনজন বলে মনে করে, ভরসা করে। ফয়জুন্নেসাও প্রজাসাধারণের সব রকম সমস্যার পাশে দাঁড়ান। হেনার সমস্যা নিয়ে তিনি বিশেষ ভাবিত। সে সময় মুসলিম সমাজের নানান সংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এক মুক্তমনা নারী হিসাবে ফয়জুন্নেসা নিজের অবস্থান নির্ধারণ করেন। অবসর সময় সাহিত্য চর্চায় ডুবে যান তিনি। লেখার মধ্যে এক অসীম পরিতৃপ্তি লাভ করেন। মনের বারান্দায় নিজের মতো করে বিচরণ করেন। তাঁর স্বতন্ত্র নারীসত্তার প্রকাশ ঘটে তাঁর গদ্যের ছত্রে ছত্রে।
গ্রামের খোলা আকাশের নীচে এত বড় বাড়িতে দুতিন জন পরিচারক,পরিচারিকা এবং হেনার শিশু পুত্র সহ হেনাকে নিয়ে ফয়জুন্নেসা থাকেন। হেনার অন্ত:সত্তা অবস্থায় সেলিম নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তাই হেনার সব দায়িত্ব ফয়জুন্নেসা নেন। লোকজন কানাঘুসো করে সেলিমের অনেক ধার হয়ে গেছিল। ফেরত না দিতে পারায় রাতের অন্ধকারে সেলিমকে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে।
য়জুন্নেসা হেনার পুত্র সন্তানের নাম রেখেছেন আব্দুল। দু বছরের ছোট শিশুর প্রতি বড় মায়া পড়ে গেছে তাঁর।
আব্দুল কখনো টালমাটাল পায়ে একটু একটু হাঁটে, আধো আধো কথা বলে।
বীরেন্দ্র ঘোষ কুমিল্লায় বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ান। তিনি কলকাতার কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে ঢাকায় নিজের গৃহে ফিরে আসেন। অবস্থা সচ্ছল, একমাত্র ছেলে, বনেদী পরিবার। ফয়জুন্নেসা তাঁর নায়েবের থেকে বীরেন্দ্র সম্পর্কে জানতে পেরে ডেকে পাঠান বীরেন্দ্রকে।কুমিল্লায় ফয়জুন্নেসা তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরির কথা বললে বীরেন্দ্র এক কথায় রাজী হয়ে যান। তবে তাঁর বাবার আপত্তি ছিল। পারিবারিক ব্যবসার কাজে ছেলেকে যোগ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু বীরেন্দ্র রাজী হননি। বীরেন্দ্রর বাবা দু:খ পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু শিক্ষকতার আদর্শ বীরেন্দ্রর কাছে অনেক বড়।
ফয়জুন্নেসার বাড়িতে বীরেন্দ্রর ঘন ঘন যাতায়াত। অনেক বই পত্রের লেনদেন হয় দুজনের। বীরেন্দ্রকে ফয়জুন্নেসা পুত্রসম দেখেন। বাহান্ন বছর বয়সে জীবন অভিজ্ঞা ফয়জুন্নেসা মানুষ চিনেছেন। কম বয়সে জমিদার সৈয়দ মহম্মদ গাজীর সঙ্গে বিয়ের পর কিছুদিন সব ঠিকই চলছিল,তবে দুজনের মানসিক মিল না হওয়ায় দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। সে সময় নানান সামাজিক কুসংস্কার ও মহিলাদের ওপর নির্যাতনের বাস্তব সমস্যাগুলো ফয়জুন্নেসাকে ভাবায়। তাই তিনি হোমনাবাদ পরগণায় বাবার জমিদারীর উত্তরাধিকারিণী হয়ে নানান উন্নয়নমূলক কাজে ও জনগণের সেবাব্রতে যোগ দেন।
বাইরের কাজের সঙ্গে সঙ্গে ফয়জুন্নেসার সাংসারিক কাজে নৈপুণ্যের অভাব ছিলনা। তিনি স্বামী ও শাশুড়ির যত্নের কোন ত্রুটি রাখেননি। সাংসারিক খুঁটিনাটি বিষয়েও খেয়াল ছিল তাঁর।
কিন্তু একদিন ফয়জুন্নেসা তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাই-এর থেকে জানতে পারেন সৈয়দ মহম্মদ গাজীর পূর্বে একজন স্ত্রী ছিলেন। ফয়জুন্নেসা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের প্রায় সতেরো বছর পর এ কথা জেনে ফয়জুন্নেসা স্বামীকে সরাসরি প্রশ্ন করেন কথাটি সত্যি কিনা! গাজী সাহেব কথাটি সত্যি বলে স্বীকার করেন। অপ্রত্যাশিত ভাবে ফয়জুন্নেসার মন ভেঙে যায়। কিন্তু এজন্য জমিদারীর কাজে তাঁর কোন অবহেলা লক্ষ্য করা যায়না। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন, বলেন, "হে আল্লাহ! আমার কি দোষ ছিল!" কদিন যেতেই ধীরে ধীরে তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। নিজেকে দুর্দশাগ্রস্ত, পিছিয়ে পড়া নারীদের সেবাব্রতে উৎসর্গ করেন।
এর কিছুদিন পর ফয়জুন্নেসা স্বামীর থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে কুমিল্লায় তিন একর জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ করেন। শুরু হয় তাঁর স্বতন্ত্র জীবনযাত্রা।
ফয়জুন্নেসার পড়ার ঘরের টেবিলটা পশ্চিমের জানলার সামনে। সেদিকে তাকিয়ে আকাশের রঙের খেলা দেখতে দেখতে তিনি ভাবেন জীবনও আকাশের চিত্রপটের মতোই বিচিত্র! এক অমোঘ শক্তির অঙ্গুলি হেলনে শুরু হয় জীবনের নানান অঙ্ক । বিশ্বাস, ভালোবাসা প্রভৃতি অনুভূতিগুলো মূল্য না পেলে মানুষ কঠিন হয় ঠিকই, তবে ভেতরে ভেতরে ক্ষমা, মমতা,সহানুভূতির ফল্গুধারা অব্যাহত থাকে।
বীরেন্দ্র ফয়জুন্নেসার বাড়িতে এলে হেনার পুত্র আব্দুল ছুটে আসে। ছোট শিশু বীরেন্দ্রর স্নেহ বোঝে। হেনা বীরেন্দ্রকে শ্রদ্ধা করে। বীরেন্দ্রর সৌম্য সুন্দর চেহারা, উদাত্ত কণ্ঠ ও সংস্কারমুক্ত মনের প্রতি হেনা আকৃষ্ট হয়। অন্যদিকে বীরেন্দ্রও হেনার প্রতি মুগ্ধতা অনুভব করেন। খুবই স্বাবলম্বী মানসিকতা হেনার। হেনা একদিন বীরেন্দ্রকে ভরসা করে বলে, "আপনি তো অনেক জায়গায় যান। সভাসমিতি করেন। আমার জন্য একটা কাজ খুঁজে দিলে ভালো হয়।"
"কি কাজ করতে চাও?"
"সেলাই এর কাজ হলেই হবে। প্রাথমিক ইস্কুলের শিক্ষকতার কাজ তো আমি পাবনা।"
বীরেন্দ্র খানিকক্ষণ হেনার দিকে তাকিয়ে থাকেন। হেনা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। বীরেন্দ্র বলেন, "আমার দিকে তাকাও হেনা। আমায় দূরের কেউ ভেবনা।"
হেনা স্নিগ্ধ দুটি চোখ তুলে বীরেন্দ্রর দিকে তাকায়। বীরেন্দ্র বলতে শুরু করেন, "তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি। তুমি যতই নিজেকে এই গৃহের আশ্রিতা ভাবো, নওয়াব ফয়জুন্নেসা কিন্তু তা মনে করেননা।"
"আমি জানি। উনি না থাকলে আমার যে কি হত!"
হেনার কথায় কৃতজ্ঞতা ফুটে ওঠে।
"আমায় আর কদিন সময় দাও হেনা। তোমার মনে আর কোন কষ্ট থাকবেনা।"
বীরেন্দ্র হেনার দুটো হাত ধরে তাকে আশ্বস্ত করেন। এরপর বীরেন্দ্র তাঁর বাড়িতে হেনাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানান। তখনকার দিনে স্বাভাবিক ভাবেই এই সিদ্ধান্ত বীরেন্দ্রর বাড়ি থেকে মেনে নেননা। তবে বীরেন্দ্রর সিদ্ধান্ত শুনে ভীষণই খুশি হন ফয়জুন্নেসা।
বীরেন্দ্র হেনার ছেলেকে নিজের ছেলে বলে স্বীকার করতে চান। ফয়জুন্নেসা বীরেন্দ্রর উদারতা দেখে অভিভূত হন। বীরেন্দ্রকে বলেন, "তোমরা ছেলে নিয়ে কলকাতা চলে যাও। কালীঘাটে বিবাহ করে নতুন জীবন শুরু করো। ওখানে হেনার পূর্ব জীবন নিয়ে কেউ কোন কথা বলবেনা। আব্দুল তোমার ছেলের পরিচয়ে বড় হবে। অর্থের জন্য চিন্তা করতে হবেনা। সব দায়িত্ব আমার। কলকাতায় আমার একজন পরিচিত আছেন,তাঁর ব্যবসার কাজ তুমি দেখাশোনা করবে আমি তাঁকে বলে দেব।"
বীরেন্দ্র ও হেনা ফয়জুন্নেসার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কলকাতায় গিয়ে সংসার পাতেন। ফয়জুন্নেসা হেনার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হন।
বই লেখা ও জমিদারীর কাজের ব্যস্ততায় ফয়জুন্নেসার বয়স বাড়ে। কলকাতা থেকে একদিন খবর আসে হেনার ছেলে আব্দুল জলপানি পেয়ে প্রথম ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। দিনান্তের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় ফয়জুন্নেসার চোখ। সারা জীবন ভালো মন্দ স্মৃতিগুলো বড় বেশী অন্যমনস্ক করে আজকাল। কাজের ক্লান্তিও গ্রাস করে। তবে মানুষের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরেছেন এই সান্ত্বনাটুকুই তাঁর কাছে যথেষ্ট!

 

জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top