সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

সেই মোহানার ধারে : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৩৩

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৮:৫০

 

খোলা জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসছে মৃদুমন্দ আরামদায়ক সুশীতল বাতাস| এই প্রাসাদ সংলগ্ন দিগন্ত বিস্তৃত মনোহর উদ্যান| শাক্যরাজ শুদ্ধোদনের রাজধানী কপিলাবস্তু বিখ্যাত উদ্যান নগরী| সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা বাহারী উদ্যান| রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যান তো আরো সুসজ্জিত, পুস্পশোভিত হবে বলাই বাহুল্য| প্রাসাদের এই কক্ষটির জানালা বেয়ে একটি সুগন্ধি লতানে গোলাপ নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে রঙীন পুস্পদলে| অপরাহ্ন শেষের মুখে, দূরে ঢেউখেলানো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গৃহপালিত পশুদের নিয়ে তৃনভূমি থেকে নেমে আসছে রাখালিয়ার দল| নীড়ে ফিরে আসা পাখির দল কলকাকলিতে মুখর| দূরে কোথাও বেজে উঠছে মন্দিরের পবিত্র ঘন্টাধ্বনি| বড় সুন্দর মায়াময় এই পৃথিবী| গবাক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাক্য রাজকুমার| পরনে তাঁর মহার্ঘ পট্টবস্ত্র, গলায়, কানে, বাহুতে পরিধেয় রত্নমালা| তিন তিনটি প্রাসাদ তাঁর জন্য নির্মান করে দিয়েছেন পিতা শুদ্ধোদন| সুরম্য, রম্য ও শুভ নামক এই প্রাসাদগুলি নবতল, পঞ্চমতল, ও সপ্ততল বিশিষ্ট| রাজার নির্দেশে সুসজ্জিতা, রূপবতী নর্তকী, গায়িকা রমণীর দল সর্বদা প্রস্তুত রাজপুত্রের চিত্তরঞ্জনের জন্য| কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না শাক্য রাজপুত্র সিদ্ধার্থের| যেন কোনো কিছুই সঠিক সত্য নয়| মায়াজাল মাত্র| কিন্তু কি সেই সত্য যা প্রহেলিকাজাল ছিন্ন করে ধরা দেবে রাজপুত্রের সামনে| নির্জন প্রাসাদের উদ্যানে ভ্রমণকালে কতসময় তাঁর মনে হয় সেই সত্যকে স্পর্শ করে নিজেকে শান্ত করবেন| তাঁর আশেপাশে সবাই বহমান জীবনে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে| ঠিক যেন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা একরাশ গাভী মহিষের দল| শুধু তাঁর কেন এই অস্থিরতা, বিষণ্ণতা?
দরজায় মৃদু ধ্বনি শোনা গেলো| সিদ্ধার্থ দেখলেন তাঁর সর্বক্ষণের অনুচর ছন্দক দাঁড়িয়ে| কখন সন্ধ্যা নেমে গেছে অগোচরে| বহুমুখী দীপাধার ঘৃত পূর্ণ করে কক্ষে কক্ষে নরম সুগন্ধি আলো জ্বালিয়ে গেছে রাজভৃত্যেরা| দেবদেউলগুলি থেকে ভেসে আসছে মৃদু আরতির ধ্বনি| সিদ্ধার্থ ছন্দককে প্রশ্ন করলেন, " বলো ছন্দক, তুমি কি বলতে চাও|"
"রাজকুমার, রথ প্রস্তুত| আপনার প্রিয় অশ্ব কন্থক ও তৈরী| মহারাজ নির্দেশ দিয়েছেন আপনাকে সান্ধ্যভ্রমণে নিয়ে যেতে|"
এইজন্যই কি সিদ্ধার্থের এতো অবসন্ন লাগে? পিতা তাঁকে অপরিসীম স্নেহ করেন| কিন্তু তাঁর নির্দেশে সিদ্ধার্থকে বেশিরভাগ সময় প্রাসাদে বা প্রাসাদসংলগ্ন উদ্যানে কাটাতে হয়| এও একরকম বন্দী জীবন| মাঝে মাঝে মহারাজার নির্দেশে ছন্দক তাঁকে সান্ধ্যভ্রমনে ঘুরিয়ে আনে রোহিণী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, নগরীর পথঘাট| যদিও দক্ষ গুরুর কাছে সিদ্ধার্থের ধনুর্বিদ্যা, অশ্বচালনা ভালই শেখা হয়ে গেছে বহুদিন| অনান্য রাজকুমারদের থেকে তিনি অনেক দক্ষ এইসব বিদ্যায়| কন্থক তাঁর প্রিয়তম অশ্ব| তাঁকে সওয়ার করে সান্ধ্যভ্রমণগুলি তাঁর প্রিয়| কিন্তু অনান্য রাজপুত্রদের মতো ধনুকে শরযোজনা করে পশুশিকারে তাঁর অত্যন্ত অনীহা| কেমন যেন অন্তর থেকে সায় দেয় না এই নিরীহ পশুপাখি হত্যা| বেদনায় উদ্বেলিত হয়ে যায় হৃদয়| অন্য রাজপুত্রের দল সিদ্ধার্থের এই বিষণ্ণতা দেখে পরিহাস করে| বিশেষ করে দেবদত্ত, সম্পর্কে যে তাঁর জ্ঞাতিভ্রাতা| আর সিদ্ধার্থের দেবদত্তকে দেখলে মনে হয় পূর্বজন্মের ঝাপসা হয়ে যাওয়া এক বিস্মৃত শত্রুর মুখ| কিন্তু না, এই একাকীত্ব, বিষাদচ্ছন্নতা কাটাতে তাঁকে ছন্দকের সাথে সান্ধ্যভ্রমনে বেরোতে হবে| সান্ধ্যভ্রমণ কিছু সময়ের জন্য হলেও মনের ভার লাঘব করে দেবে| সম্মতি জানিয়ে সিদ্ধার্থ কক্ষ থেকে নিস্ক্রান্ত হতে গেলে এক রাজভৃত্য এসে তাঁর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো|
"প্রণাম রাজকুমার, মহারাজ স্বয়ং আসছেন আপনার কক্ষে| একটু অপেক্ষা করতে বললেন|"
সিদ্ধার্থ কক্ষে অপেক্ষায় রইলেন| অনতিবিলম্বে মহারাজ শুদ্ধোধন প্রধান অমাত্যকে নিয়ে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলেন| ষোলো বছরের নবীন যুবক পুত্রের পিঠে স্নেহের হাত রেখে পিতা খুব নরম গলায় বললেন" কুমার, আমি ঠিক করেছি এইবার তোমার বিবাহের ব্যবস্থা করবো| কিন্তু তার আগে আমি জানতে চাই তোমার বিবাহে সম্মতি আছে কি? "
শুদ্ধোধনকে অবাক করে সিদ্ধার্থ নম্রভাবে জানালেন "আমার বিবাহে কোনরূপ আপত্তি নেই|'
অত্যন্ত খুশি পিতা আবার প্রশ্ন করলেন " কি ধরনের পাত্রীকে তুমি জীবনসঙ্গিনী করতে চাও? "
একমূহুর্ত ভেবে নিয়ে রাজকুমার উত্তর দিলেন "যে কন্যা অতীব ধৈর্য্যশীল, নম্র ভদ্র, ত্যাগপরায়ণা সেই আমার যোগ্য জীবনসঙ্গিনী হবে বলে আমার বিশ্বাস|"
"তাই হবে| আমার অমাত্যেরা সারা রাজ্যপাট ঘুরে খুঁজে নিয়ে আসবে তোমার মনোমত পাত্রীকে||"
সিদ্ধার্থ ছন্দকের সাথে বেরিয়ে গেলেন সান্ধ্যভ্রমণে| তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন মহারাজ| পুত্রকে নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই| অনান্য রাজপুত্রদের মতো নয় সে| সর্বপ্রকার
রাজকীয় স্বাচ্ছন্দ্যে বিমুখ, আত্মমগ্ন, অত্যধিক দয়াবান নরম হৃদয়ের এই রাজপুত্র কিভাবে নেবেন শাক্য রাজবংশের ভার? কি আশ্চর্য তাঁর জন্মবৃত্তান্ত| রাজার প্রাসাদের সুললিত শয্যায় নয়, প্রকৃতির মাঝে ভরা পূর্ণিমায় শালবনের জঙ্গলে ঝরে পরা শালপাতার শয্যায়| মহারাজের দুশ্চিন্তার আরো অন্যতম কারন জন্মলগ্ন দেখে বিচার করে রাজজ্যোতিষী ভবিষৎবাণী করেছেন এই জাতক প্রবজ্যা নেবেন, রাজশক্তি নয়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা শাসন করবেন সমগ্র ভুবন| সেই থেকে মহারাজের উদ্বেগের শেষ নেই| বংশের একমাত্র প্রদীপ সন্ন্যাস নিলে বংশরক্ষা, রাজ্যশাসন কে করবে? অতীব সৌভাগ্যের ব্যাপার যে কুমার বিবাহে সম্মতি দিয়েছেন| | একবার সংসারে মন বসে গেলে হয়তো সন্ন্যাস নেওয়ার সম্ভাবনা দূরীকৃত হতে পারে| প্রধান অমাত্যের দিকে স্মিতহাস্যে তাকালেন শুদ্ধোধন| তাঁর দেওয়া পরামর্শ কার্যকর হয়েছে|
সান্ধ্যভ্রমণে যেতে যেতে আবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিলেন সিদ্ধার্থ| তিনি সহসা বিবাহে সম্মতি দিলেন কেন? আসলে মনের এই একাকিত্বের ভার তিনি আর বহন করতে চাইছিলেন না| একজন যথার্থ বন্ধু এলে হয়তো উপশম হবে ভার| বন্ধু, হ্যাঁ তাঁর ভাবী জীবনসঙ্গিনী হবেন তাঁর বন্ধু| যে বন্ধুত্বে মিলে যায় মনের যাবতীয় সুরমূর্ছনা|

(২)
কপিলাবস্তু আজ জনসমাগমে পরিপূর্ণ| যেন কোনো উৎসব লেগেছে| রাজপ্রাসাদের সম্মুখে রং বেরঙ্গের শিবিকা| পুস্প মাধুরীতে, অগুরু চন্দন সুবাসে, সুন্দরী রমণীর সমাগমে ভরে উঠেছে প্রাঙ্গন রাজা শুদ্ধোধনের আদেশে অমাত্যরা রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্য যেসব সুন্দরী সুলক্ষণা নবযুবতীদের মনোনীত করেছিলেন, তাদের সবাইকে আজ ডাকা হয়েছে এই অভ্যর্থনা সভায়| রাজকুমার এক এক করে সবার হাতে তুলে দেবেন উপহার| আর যাকে তিনি মনোনীত করবেন তিনিই হবেন রাজবধূ| সভামন্ডপের মধ্যস্থলে সিংহাসনে বসে আছেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ| মনোনীতা কন্যাদের মধ্যে উপস্থিত যশোধারা, দেবদহের রাজা সুপ্রবুদ্ধের ভ্রাতা দন্ডপাণি শাক্যের একমাত্র রূপবতী কন্যা| ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে যশোধারা একমনে রাজপুত্রকে লক্ষ করছিলেন| রাজপুত্রের দীঘল অনিন্দ্যকান্তি চেহারা সবার কাছেই মনোমুগ্ধকর কিন্তু যশোধারাকে চুম্বকের মত টানছিল তাঁর মায়াময় মুখমন্ডল| নতমস্তকে রাজপুত্র এক এক করে সব কন্যাদের হাতে তুলে দিচ্ছেলেন উপহারসামগ্রী| একটি বারের তরেও মুখ তুলে দেখেননি কন্যাদের| যশোধারা অবাক হয়ে ভাবছিলেন একবার ও না দেখে রাজপুত্র নিজের জন্য পাত্রী কিভাবে নির্বাচন করবেন? সবার পালা শেষ হয়ে গেলো| ধীর পায়ে যশোধারা এবার রাজপুত্রের কাছে এলেন| সিদ্ধার্থ ও উপহারের থালা থেকে উপহার তুলতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন সব উপহার শেষ হয়ে গেছে| এইপ্রথম সিদ্ধার্থ মুখ তুলে দেখলেন তাঁর সম্মুখে দাঁড়ানো নারীকে| অপ্রস্তুত রাজকুমার লজ্জিত ভাবে বললেন, "ভদ্রে, এখন ই উপহারসামগ্রী অন্তপুর থেকে আসবে| একটু অপেক্ষা করো|"
"আমার কোনো উপহার লাগবে না রাজপুত্র| আপনি
ব্যস্ত হবেন না|" যশোধারা বিনীত ভাবে উত্তর দিলেন|সিদ্ধার্থ দেখলেন তাঁর সামনে এক অতি লাবণ্যময়ী তরুণী| তাঁর খুব চেনা লাগলো| যেন বহু যুগ ধরে একসাথে, এক বন্ধনে অতিবাহিত করেছেন দিবস রজনী| যেন নরম স্নিগ্ধ আলোয় মাখা আকাশের চন্দ্রিমা| আর যশোধারার মনে হলো রাজপুত্রের চোখদুটি যেন সবুজ বনানীর মাঝে গভীর এক স্বচ্ছ জলাশয়, যে জলাশয়ে আকাশের চাঁদ ধরা দেয় নিজেকে| সিদ্ধার্থ নিজের গলার বহুমূল্য মুক্তামালা পরিয়ে দিলেন যশোধারাকে| চারপাশের সবাই পুস্পবর্ষন করতে লাগলো| শঙ্খ বেজে উঠলো| কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে সিদ্ধার্থের সাথে যশোধারার বিবাহ একপ্রকার স্থির হয়ে গেলো|
বিবাহ হয়ে গেলো| তবে এই বিবাহে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছিলো| সিদ্ধার্থ ও যশোধারা পরস্পর পরস্পরকে পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু রাজা শুদ্ধোধনের কাছ থেকে বিবাহ প্রস্তাব এলে, খুব একটা খুশি মনে গ্রহণ করেননি যশোধারার পিতা দন্ডপাণি শাক্য| অতি কোমল স্বভাবের শান্ত রাজপুত্র সিদ্ধার্থকে তাঁর মনে হয়েছিলো এই যুবক রাজ্যশাসন করতে অক্ষম হবেন, তাঁর সুন্দরী কন্যাকেও সুরক্ষা দিতে পারবেন না| যশোধারার জন্য দন্ডপাণি এক স্বয়ংবর সভার আয়োজন করলেন| শর্ত ছিল এই সভায় উপস্থিত সব রাজপুত্রকে অসিবিদ্যা, মল্লযুদ্ধ, ধনুর্বিদ্যা, শাস্ত্রজ্ঞানে যিনি পরাজিত করবেন, যশোধারা তাকেই বরমাল্য দিয়ে বরণ করে নেবেন| রাজপুত্র সিদ্ধার্থ এই সভায় যোগদান করে সবাইকে অনায়াসে পরাজিত করে যশোধারার বরমাল্য গ্রহন করেছিলেন| রাজা শুদ্ধোধন ও কপিলাবস্তুর সব অধিবাসীদের স্বস্তির মধ্যে বিবাহ সুসম্পন্ন হলো| এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো সিদ্ধার্থের জীবনে| তাঁর মনের বিষন্ন ভাব অনেকটা দূরীভূত হয়েছে| যশোধারার মধুর কোমল সাহচর্যে কেটেছে একাকীত্ব| যশোধারা বাস্তবিক অর্থেই সুশীলা, গুণবতী নারী| দেবদ্বিজে ভক্তি, গুরুজনদের শ্রদ্ধা, অতিথিপরায়নতা, পশুপাখিদের প্রতি দয়ামায়া, দাসদাসীদের প্রতি সস্নেহ আচরন, শাস্ত্র ও সংগীত বিশারদ সর্বগুণে গুণান্বিতা| স্ত্রীকে সাথে নিয়ে সিদ্ধার্থ একদিন নিকটস্থ অরণ্যের ভিতরে এক আশ্রমে এলেন| ভারী সুন্দর এই আশ্রম| সবুজ বনানী, দর্পণের মত স্বচ্ছ জলের হ্রদ, দূরে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি, পাখিদের কলকাকলি সব মিলিয়ে এক অসাধারণ নৈসর্গিক পরিবেশ| রাজকুমারকে দেখে আশ্রম থেকে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ মুনি| সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করলেন"প্রভু আপনি কে? "
"আমি মুনি কৌগুণ্য| রাজকুমার সিদ্ধার্থ আপনার জন্মলগ্ন বিচার করে যে সাতজন রাজজ্যোতিষী ভবিষৎবাণী করেছিলেন, আমি তাঁদের একজন| সাতজনের মধ্যে আমিই একা জীবিত আছি| এখন আমি আশ্রমবাসী|"
আপনি কি প্রভু জ্যোতিষচর্চা ত্যাগ করেছেন? "
"হ্যাঁ, আমার এখন বয়স হয়েছে| আর দীর্ঘদিনের সাধনায় উপলব্ধি করেছি ভবিষৎবাণী করে কোনো কিছু প্রতিরোধ করা যায় না| যা ঘটবার তা ঘটবে| একমাত্র ঈশ্বর আর মহান সাধকেরাই পারেন সঠিক সত্য জানতে|"
"কিভাবে আয়ত্ত করা যাবে এই মহান সাধনা? "
কৌগুণ্য স্মিত হেসে বললেন, "রাজকুমার আপনি বিবাহ করে সংসার জীবনে প্রবেশ করেছেন| এখন আপনার এইসব না ভাবাই মঙ্গল|"
সিদ্ধার্থ আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন| কিন্তু কৌগুণ্যের সাথে কথা বলে তাঁর ভাল লাগলো| তিনি প্রায়ই যশোধারাকে নিয়ে আসতে লাগলেন কৌগুণ্যের আশ্রমে| কৌগুণ্যের কাছ থেকে নানা শাস্ত্রজ্ঞান আহরন করে আশ্রমে সময় নির্বাহ করতে লাগলেন| মহারাজা শুদ্ধোধনের কাছে সিদ্ধার্থের ঘনঘন কৌগুণ্যের আশ্রমে যাওয়ার সংবাদ পৌছলে মহারাজ ব্যাপারটা ভালোভাবে নিলেন না| ফলস্বরূপ কোনো এক প্রভাতে সিদ্ধার্থ ছন্দককে আশ্রমে যাওয়ার জন্য রথ প্রস্তুত করতে বললে ছন্দক জানালো কৌগুণ্য মুনি চিরকালের মতো আশ্রম পরিত্যাগ করে কোথায় চলে গিয়েছেন|
আশ্রমে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু সিদ্ধার্থ এখন প্রায়ই ছন্দককে সাথে নিয়ে নগরীর পথে সান্ধ্যভ্রমণে বেরোন একাই| যশোধারা বহুসময় রাজ -অন্তপুরে গৌতমীর সাথে সংসারে ব্যস্ত থাকেন| এইসময় পরপর চারদিন তিনি নগরীর পথে এক অসুস্থ ব্যক্তি, এক বৃদ্ধ ব্যক্তি, এক সন্ন্যাসী ও একজন মৃত ব্যক্তির শবযাত্রা দেখে উদ্বেল হয়ে গেলেন| ছন্দককে প্রশ্ন করে জানলেন এই জরা, এই ব্যাধি, মৃত্যু সবই মানবজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ| এর থেকে কারো মুক্তি নেই| মানুষের এইসব দু:খের কারণ কি? সত্যই কি সন্ন্যাস নিয়ে সাধনায় ব্রতী হলে এর উত্তর পাওয়া যাবে? এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন সিদ্ধার্থ প্রাসাদে ফিরে এলেন| স্বামীকে অন্যমনস্ক দেখে যশোধারা তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, "প্রভু আজ আপনাকে এতো চিন্তামগ্ন বিষণ্ণ লাগছে কেন? "
সিদ্ধার্থ যশোধারাকে তিনি নগরীর পথে যা
প্রত্যক্ষ করেছেন সব জানালেন| পরিশেষে বললেন, "হে প্রিয়া, মানবজীবনের দু:খকষ্টের কারন কি আর কি করেই বা এর থেকে মোক্ষলাভ হবে তা আমায় জানতেই হবে| এর জন্য কঠোর সাধনা ব্রতী হতে হবে|"
যশোধারা আশংকায় কেঁপে উঠলেন| তবে কি সত্যি হতে চলেছে জ্যোতিষীর ভবিষ্যবাণী? না.. না.. এ কি করে সম্ভব? আর কিছুদিন পরেই জন্ম নেবে তাঁদের সন্তান| অত্যন্ত আকুলভাবে তিনি সিদ্ধার্থকে বললেন, " আর কিছুদিন পরেই জন্ম নেবে আমাদের সন্তান| স্বামী, আপনি কথা দিন আমাকে না জানিয়ে অনুগ্রহ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না|"
সিদ্ধার্থ পরম স্নেহভরে যশোধারার স্কন্ধে হাত রাখলেন| যশোধারা আশ্বস্ত হলেন| কিন্তু সিদ্ধার্থ আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন| তিনি উপলব্ধি করছিলেন এক মায়ার নাগপাশ তাঁর দুইপায়ে বেড়ী রচনা করছে|
(৩)

তিনি ফিরে আসছিলেন| সাতটি অশ্বে টানা স্বর্ণরথ দ্রুতগতিতে ধূলা উড়িয়ে ছুটছিলো কপিলাবস্তুর নগরীর পথ দিয়ে| সসাগরা পৃথিবী জয় করে ফিরে এসেছেন রাজকুমার| কপিলাবস্তুর সব পুরবাসী তাঁর ফিরে আসার পথের দুইধারে জমায়েত হয়ে পুস্পবর্ষন করছে, জয়ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে| সেই ভিড়ের ভিতর যশোধারাও রয়েছেন মলিন বসনে, আলুলায়িত কেশদামে| প্রখর সূর্যকিরণে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে যশোধারার দৃস্টি| বারংবার চেষ্টা করে ও রাজকুমারের মুখটি তিনি দেখতে পারছেন না| সহসা রথ থেমে গেল যশোধারার সম্মুখে| রথ থেকে নেমে এলেন সেই অনিন্দ্যকান্তি রাজপুত্র| যশোধারার সামনে এসে তাঁর শীর্ণ, কম্পিত হাত স্পর্শ করে নরম স্বরে বললেন"আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে প্রিয়ে|"
যেন একরাশ আলোর ফুল ঝরে পড়লো মাটিতে| রংবেরঙ্গের প্রজাপতিরা খুশীতে মেলে ধরলো পাখা| কলতানে মুখর হয়ে উঠলো ঝর্ণা, পাখিরা| যশোধারা দেখলেন তাঁর সামনে আবার সবুজ বনানীর মাঝে স্বচ্ছ জলাশয়সম দীঘল সেই আঁখি| যশোধারা বিহ্বল হয়ে পড়ছিলেন| সেইসময় ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন ডাক দিল " বধূমাতা, উঠে পড়ুন, প্রভাত হয়ে গিয়েছে| রাজমাতা গৌতমী আপনাকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিয়েছেন|"
এক মূহুর্তে ছিন্ন হয়ে গেলো স্বপ্নজড়িমা| যশোধারা ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন ভূমিশয্যায়| বহুদিনের বয়স্কা রাজপরিবারের দাসী তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে|
"কিসের প্রস্তুতি? " যশোধারা প্রশ্ন করলেন|
"আজ রাজকুমার ফিরে আসছেন বুদ্ধ হয়ে| সারা কপিলাবস্তুর পুরবাসীরা তাঁকে স্বাগত জানাতে নগরীর পথের দুইপ্রান্তে জমায়েত হয়েছে| রাজমাতা আপনাকে এই গৈরিক বসন পরিত্যাগ করে সুসজ্জিতা হতে নির্দেশ দিয়েছেন|"
দাসীকে চলে যেতে বলে যশোধারা স্থিত হয়ে ভূমিশয্যায় বসে রইলেন| তিনি তো জানেন আজ রাজপুত্র ফিরে আসছেন মহারাজার অনুরোধে| আজ থেকে সাত বৎসর আগে এক পূর্ণিমার রাতে সদ্যপ্রসূতি স্ত্রী আর সদ্যোজাত পুত্রকে পরিত্যাগ করে সকলের অজান্তে গভীর নিশীথে তিনি সংসার ত্যাগ করেছিলেন| অনুচর ছন্দক ফিরে এসে জানিয়েছিলো তিনি বোধিজ্ঞানের সাধনায় নিজেকে মুক্ত করেছেন সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে| পরিধান করেছেন ছিন্ন কাষায় বস্ত্র, মাধুকরী করে দিনান্তে তাঁর একবার স্বল্প আহার| তীব্র অভিমানকে ছাপিয়ে এক তীক্ষ্ণ কষ্টবোধ বিদীর্ণ করে দিয়েছিলো যশোধারাকে| তিনি স্থির করেছিলেন তিনিও স্বামীর পথের অনুগামিনী হবেন| রাজপ্রাসাদের যাবতীয় বিলাসব্যসন ত্যাগ করে তিনি তুলে নিয়েছিলেন গৈরিক বসন, ভূমিশয্যা, দিনান্তে একবার মাত্র স্বল্পাহার| কিন্তু তাতেও শান্তি আসেনি| বিবাহের পর দীর্ঘ ষোলোটি বৎসর দাম্পত্যের পর রাজকুমার তাঁকে একবার ও না জানিয়ে কেন সংসার ত্যাগ করলেন?| বিশেষত: সেইসময়ে যখন তাঁদের নবজাত পুত্রের লালনে পিতার প্রয়োজন| তবে কি স্ত্রীর সঙ্গমাধুর্য, প্রণয় সব তাঁর কাছে তৃণসম নগণ্য ছিল? যশোধারা তাঁকে কোনো বন্ধনেই আবদ্ধ করতে পারেননি| কিসের অভাব ছিল যশোধারার মধ্যে| যশোধারা মনস্থির করলেন তিনি নিজেকে সুবিন্যস্ত, সুসজ্জিত করবেন না| রাজকুমার ফিরে এসে দেখুন তাঁর বিহনে তাঁর প্রিয়তমা পত্নীর কি করুণ দশা| সকলের কাছে তিনি আজ ভগবান বুদ্ধ, কিন্তু যশোধার কাছে তিনি তাঁর প্রিয়তম স্বামী রাজপুত্র সিদ্ধার্থ|
বাইরে তীব্র কলরব শোনা গেলো| বুদ্ধ তাঁর অনুচরদের নিয়ে প্রাসাদের নিকটেই এসে পড়েছেন| পুরবাসী উন্মত্তের মতো পুস্পবর্ষন করছে, জয়ধ্বনি করছে তাঁর বোধিজ্ঞানলাভের| যশোধারা ধীরে ধীরে বাতায়নের কাছে এলেন| এই দীর্ঘ সাত বৎসরে শোকে, অভিমানে, যন্ত্রনায় তিনি মানসিকভাবে অবসন্ন হয়ে গিয়েছিলেন| শিশুপুত্র রাহুলের যত্নাদি ও ঠিকমতো হয়নি| রাজপুত্র সিদ্ধার্থ আজ ফিরে এসেছেন কপিলাবস্তুতে বুদ্ধ হয়ে| এইবার কি সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে? তিনি দেখলেন আনন্দ, সারিপুত্র প্রভৃতি অনুচরদের সাথে বুদ্ধ আসছেন| তাঁদের সবার হাতে ভিক্ষাপাত্র| সবার কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে নিতে আসছেন এক অনিন্দ্যকান্তি দেবোপম মহাপুরুষ| যশোধারা আর সহ্য করতে পারলেন না স্বামীর হাতের ভিক্ষাপাত্র| ছুটে গেলেন মহারাজ শুদ্ধোধনের কাছে|
"পিতা, আপনার পুত্র ভিক্ষা যাচনা করছেন পুরবাসীর কাছে| আপনি দয়া করে কিছু ব্যবস্থা করুন|" যশোধারার আকুল আর্তি শুনে মহারাজ প্রাসাদের বাইরে এসে বুদ্ধ ও তাঁর অনুচরদের জোড়হস্তে অনুরোধ করলেন প্রাসাদে আসতে| বুদ্ধ প্রথমে সবিনয়ে প্রত্যাখান করলেন| কিন্তু মহারাজ বললেন" পুত্র হিসাবে তোমার কি একবার পিতার কাছে, পরিবারের কাছে আসা উচিত নয়? " বুদ্ধ সম্মত হলেন| মহারাজা নিজে দাঁড়িয়ে বুদ্ধ ও তাঁর অনুচর শ্রমণদের আহারের ব্যবস্থা করলেন| সবার সাথে বুদ্ধের সাক্ষাৎ হলো| সবাই এসে বুদ্ধকে প্রণাম করে তাঁর কাছ থেকে বোধিজ্ঞানতত্ব শুনলো| কিন্তু যশোধারা এলেন না বুদ্ধের সামনে| রাজমাতা গৌতমীর নির্দেশে সেই বয়স্কা দাসী এলো যশোধারার কক্ষে|
" বধূমাতা, রানি গৌতমী আপনাকে ভগবান বুদ্ধের কাছে আসতে বলেছেন| "
" যাও দাসী, তুমি গিয়ে তাঁকে বল যশোধারা ভগবান বুদ্ধের কাছে যাবেন না| বুদ্ধ যদি মনে করেন যশোধারার মধ্যে এমন কিছু গুণাবলী আছে যার জন্য তাঁর কাছে যাওয়া যায়, তবে তিনি নিজেই আসবেন যশোধারার কাছে | এটা আমার দৃঢ বিশ্বাস|" কোথা থেকে এলো এই তেজদৃপ্ত কন্ঠস্বর? শোকে, অভিমানে শীর্ণা দীর্ণা এই নারীর জমাট অভিমানের ভিতরে কি লুক্কায়িত ছিল এই তেজ? দাসী ফিরে গিয়ে এই বার্তা শোনালে উপস্থিত সবাই ভ্রুকুটি করলো| স্বামী যাকে পরিত্যাগ করে গেছেন সেই নারীর তো ছুটে এসে ব্যাকুলভাবে স্বামীর পদস্পর্শ করা উচিত| যেখানে উপস্থিত সবাই এমন কি মহারাজা শুদ্ধোধন ও পুত্রের পদস্পর্শ করে প্রনাম জানিয়েছেন এবং ভগবান বুদ্ধ তাঁকে আশীর্বাদ ও করেছেন| আসলে এই প্রনাম সেই আত্মাকে যিনি বোধিজ্ঞান লাভের পর নিজেকে নিয়ে গেছেন পরমার্থের দিকে| উপস্থিত সবাই গুঞ্জন শুরু করলো| কিন্তু বুদ্ধ স্মিতহাস্যে জানালেন তিনি নিজে গিয়ে যশোধারার সাথে সাক্ষাৎ করে আসবেন| আনন্দ বুদ্ধের সাথে আসছিলেন, বুদ্ধ তাকে নিরস্ত করে একাকী যশোধারার কক্ষে প্রবেশ করলেন| এই সেই মহালগ্ন, যশোধারার বহু আকাঙ্খিত মূহুর্ত| অথচ তিনি কথা বলতে পারছেন না| তীব্র আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠছে তাঁর শরীর| বুদ্ধের সামনে এক মলিনবসনা শীর্ণা ক্লেশক্লিষ্টা যশোধারা| যশোধারা ভেবেছিলেন বুদ্ধ হয়তো তাঁর শারিরীক অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হবেন| কিন্তু বুদ্ধ এইসব যেন কিছুই লক্ষ্য করলেন না| খুব সংযত মৃদুকন্ঠে তাঁর কুশল জানতে চাইলেন| যশোধারা আর নীরব থাকতে পারলেন না| মূহুর্তে সব পুঞ্জীভূত আবেগ অভিমানের দল বিস্ফোরনের রূপ নিলো|
"প্রভু, যে নারী অকারণে স্বামীপরিত্যক্তা সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে তার ভালো থাকার কি ব্যবস্থা রয়েছে? আপনি সমগ্র মানবসমাজের দু:খের কারন ও দু:খ থেকে মুক্তিলাভের সত্যজ্ঞান লাভ করেছেন, কিন্তু নিজের প্রিয়জনকে নিষ্ঠুরভাবে পরিত্যাগ করে তাদের যে দু:খ দিয়েছেন তার কী বিচার আছে আপনার কাছে? এই সুদীর্ঘ সাত বৎসরে আপনি কি একবারের তরেও আমার কথা, আমাদের পুত্রের কথা ভেবে উদ্বেলিত হয়েছিলেন? আপনার যাবতীয় প্রেম প্রণয়ভাষন সকল কি অনৃত ছিল? আমার কি কোনো মূল্যই নেই আপনার কাছে? আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাকে না জানিয়ে আপনি কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না| কোথায় গেল আপনার সেই প্রতিশ্রুতি? " আরো অনেককিছু বলে যাচ্ছিলেন যশোধারা, সহসা তাঁর খেয়াল হলো বুদ্ধ সেই একই রকম স্মিতভাবে বসে আছেন| যেন এই ক্রোধ, অভিমানের মেঘরাশি তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে না| যশোধারা শান্ত হয়ে গেলেন| তারপর বিনীতভাবে ক্ষমা চাইলেন বুদ্ধের কাছে |
" আমায় মার্জনা করুন প্রভু| আমি নিজে কে সংবরন করতে পারিনি|"
বুদ্ধ পরম মমতাভরে বললেন "তোমার কোনো দোষ নেই ভদ্রে| তুমি যা করেছো এটাই স্বাভাবিক| শুধু মনে রেখো এই ক্রোধ, অভিমান, হাসি, কান্না, সুখ, দু:খ কোনোটাই স্থায়ী নয় পৃথিবীতে| সবই সাময়িক| যা সাময়িক, যার কোনো শ্বাশত মূল্য নেই তার জন্য উদ্বেল হয়ো না|"
বুদ্ধ চলে গেছেন প্রাসাদ ছেড়ে অথচ কপিলাবস্তুতেই অবস্থান করছেন| নগরের বিভিন্ন স্থানে অস্টাঙ্গিক মার্গ নিয়ে আলোচনা করছেন| পুরবাসীরা মোহিত হয়ে শুনছে| রাজমাতা গৌতমীর সাথে যশোধারাও মাঝে মাঝে যান সেইসব সভায়| সেইরকম এক সভায় নাবালক পুত্র রাহুলকে বললেন "পুত্র, এই সভায় যিনি সবাইকে বোধিজ্ঞান তত্ত্ব অভিহিত করাচ্ছেন, তাঁকে কি তুমি চেনো? "
" হ্যাঁ মাতা, উনি তো ভগবান বুদ্ধ"
"উনিই তোমার পিতা| তুমি বহুবার পিতাকে দর্শন করতে চেয়েছিলে| যাও বৎস পিতার কাছে গিয়ে তাঁকে বলো জগতের সব পিতা তার সন্তানকে যে ধন দান করেন, আমি আপনার কাছ থেকে সেই ধন চাই|"
ছোট্ট রাহুল মায়ের কথায় সভার ভিড় ঠেলে উপস্থিত হলো বুদ্ধের কাছে| পিতার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে মায়ের শেখানো কথা ব্যক্ত করলো| বুদ্ধ হেসে বললেন " আমি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী পুত্র| আমার কাছে কোনো জাগতিক ধনসম্পদ নেই| আমার যা আছে বোধিজ্ঞানলাভ, সেই সম্পদ পিতা হিসাবে আমি তোমায় দেবো|" রাহুল সানন্দে সম্মত হয়ে গেলো| কি বা সে বোঝে, হয়তো পিতৃসঙ্গলাভের আনন্দ তার কাছে সেরা ধন বলে বিবেচিত হয়েছিলো| বুদ্ধ আনন্দকে নির্দেশ দিলেন রাহুলকে প্রবজ্যা দিতে| রাহুল ও আর ফিরলোনা প্রাসাদে| এইবার যশোধারা সম্পূর্ণ নি:স্ব হয়ে গেলেন| মহারাজা শুদ্ধোধন মানসিকভাবে একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন| রাজপ্রাসাদে শোকের ছায়া নেমে এলো| যশোধারার কিছু বলার নেই| তিনি নিজেই পুত্রকে বুদ্ধের কাছে নিয়ে গেছিলেন| তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা পিতা পুত্রকে নিয়ে গেছেন উত্তরনের পথে|
এরপর কেটে গেছে সুদীর্ঘ সময়| কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে সময়ের নিরন্তর ঢেউ| মহারাজা শুদ্ধোধন দেহ রেখেছেন| রাজমাতা গৌতমীর অনুরোধে ভগবান বুদ্ধ তাঁর সংঘে নারীদের ও অনুমতি দিয়েছেন শ্রমণা হিসেবে| রাজমাতা গৌতমী যোগ দিয়েছেন সংঘে| প্রবজ্যা নেওয়ার আগে রাজমাতা যশোধারাকে যাবতীয় ধনসম্পত্তির উত্তরাধিকারিনী করলে যশোধারা তা প্রত্যাখান করেছেন| যাঁর স্বামী ও পুত্র সন্ন্যাসী, তিনি ধন নিয়ে কি করবেন? তাই গৌতমীর সাথে রাজগৃহে বুদ্ধের কাছে গিয়ে প্রবজ্যা নিয়ে ভিক্ষুণী হয়েছেন| সংঘে তাঁর নাম হয়েছে ভদ্দকচানা থেরী| কঠোর ধ্যান, অনুশীলনের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে| এর মধ্যে মাত্র একুশ বৎসর বয়সে মৃত্যু হয়েছে রাহুলের| যশোধারার হৃদয়ে নির্মম ভাবে বিদ্ধ হয়েছে ভাগ্যের এই শেল| আরো কঠোর তপস্যার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন তিনি| কিন্তু শান্তি কি ছুঁয়ে গেছে তাঁকে?
তীব্র এক শীতে কাঁপছে পাহাড়ী অঞ্চল| তবু পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত বৌদ্ধ মঠে উৎসাহের অন্ত নেই মঠবাসিনী শ্রমণাদের মধ্যে| কেননা আজ ভগবান তথাগত এসেছেন এই মঠে| সভায় বুদ্ধ লক্ষ্য করলেন সব শ্রমণাদের পিছনে উপস্থিত এক বৃদ্ধা শ্রমণাকে| জরায়, রোগে ক্লিষ্টা তিনি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন| বুদ্ধ তাঁর কাছে গিয়ে পরম মমতায় বললেন "হে ভদ্রে, ভদ্রকচ্চানা থেরী, তুমি অহর্ত্ব প্রাপ্তা, মহাভিজ্ঞান প্রাপ্তা সেরা ভিক্ষুণী| তোমার সেবায়, জ্ঞানে আলোকিত সঙঘ| কল্যান হউক তোমার, মঙ্গল হউক তোমার|" বুদ্ধের স্পর্শে ঝাপসা ছানিপড়া দৃষ্টির সামনে ফুটে উঠলো সবুজ বনানীর মাঝে এক গভীর জলাশয়| নুয়ে পরে প্রনাম জানিয়ে তিনি বললেন, " প্রভু আপনি আমায় আলোকিত করেছেন, আমাকে নির্মোহ করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন|" আর কিছু বলা হলো না| অনেকদিনের জমানো শুকনো অশ্রু সহসা ভেসে এলো বলিরেখাময় মুখে| আলো আঁধারের মোহানায় ছুটে গেল জীবনের ঢেউ |
অপরাহ্নের আলোয় তখন আনন্দ, সারিপুত্তদের নিয়ে এক পরমপুরুষ নিজেই আলো হয়ে অনন্ত পথযাত্রায়...... |

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top