সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

সাত রঙা এক পাখি : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১ মে ২০১৯ ১৫:৩৮

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২০:২৯



সাত রঙা এক পাখি 
করছে ডাকাডাকি
খুকুর চোখে ঘুম নেই
চোখ মেলে সে চাইলো যেই 
জানালা খুলে দেখলো একি 
রঙে ভরা পাখি সেকি 
গান শুনিয়ে ঘুম ভাঙালো
খুকুমনির মন রাঙালো
মিষ্টি  হেসে খুললো আঁখি॥

 যে খুকুমনির কথা সবাই শুনছো, ওর প্রকৃত নাম পৌলমী। পৌষ মাসে জন্ম। বাবা মা খালা ফুপু সবার প্রিয়। প্রানের চেয়েও যেন প্রিয় সে। আদর সোহাগের অন্ত নেই। কিন্তু তাহলে কি হবে? পৌলমার মনে যে অনেক কষ্ট! সে জন্ম থেকেই বাকহীন। কথা বলতে পাওে না। সব কথা শুনতে পারে বুঝতে পারে। কিন্তু বলতে পারে না। 

মৌসুমী ফুল, গাঁদা, চাঁপা, গোলাপ, জবা ও আরও কত কী! জনালার পাশেই বড় একটা কাঁঠালি চাঁপার গাছ। পাশে কামিনী। ফুলের সুভাস নিয়েই পৌলমী ঘুমোতে যায়। আবার ঘুম ভেঙ্গেও নতুন ফুলের সুবাসে। কত রকম পাখিরা আনাগোনা করে। হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত পাখি বসেছে কাঁঠালি চাঁপার গাছের ডালে। 

আজ পৌলমীল জন্মদিন। সাত বছর পূর্ণ হয়ে আট বছরে পা দেবে। তার বয়সী শিশুরা স্কুলে যায়। ব্যাগ কাঁধে ঝুপঝাপ দৌঁড়ায়। পৌলমী চেয়ে চেয়ে দেখে। তার বুকের মধ্যে স্বপ্নের খেলা করে। কাউকে বুঝাতে পারে না। চোখ গড়িয়ে টপটপ কওে পানি পড়ে। লোনা চোখের পানিতে দু’গাল ভেসে যায়। পৌলমীর আর কোন ভাই বোন নেই। মা বাবার মাঝখানে এখনো ঘুমোয়। তার ঘুমানোর খাটটি দেয়ালে লাগা জানালার ধার ঘেঁষে। জানালা খুললেই বিশাল ফুলের বাগান। কত ফুলের সমাহার। 

কিন্তু আশ্চর্য! আজ বাগানো কোনো ফুল ফোটে নাইতো? 
কলিগুলো কেমন আধো ফোটা। আর ফুলগুলোর রঙ গেল কোথায়? গব যে একেবারেই ঝাপসা। পৌলমী মাকে ডেকে বলতে চায়। বলতে পাওে না। পাখিটি সুওে সুওে গান করে।

পৌলমী কান পেতে শোনে। মনে মনে বলে, 
এই পাখি তুই আমার বন্ধু হবি?
আমিতো তোমার বন্ধু। তুমি আমাকে চিনতে পার নাই। আমি তোমার মধ্যে মধ্যে বাসা বেঁধেছি। 
পাখিটি যেন পৌলমীর কানের কাছে এসে কথা বলে বললো।  
পৌলমী অবাক হয়। 
পাখিটি তো আসলেই উড়ে এসে একেবাওে তার জানালার পাশের ডালে বসে আছে।
এই পৌলমী! কেমন আছ? তুমি ভাল আছ তো? 
কী অদ্ভুদ! 
পাখিটা কথা বলছে। 

কিন্তু ওকি জানে না যে আমি কথা বলতে পারি না? 
কে বলেছে, তুমি কথা বলতে পার না? 
এইতো আমি তোমার মনের কথা শুনতে পাচ্ছি। 
ঠিক বলছো। 
হ্যাঁ, আমরা পাখিরা মানুষের মত মিথ্যে কথা বলি না। তুমি ভাল হয়ে যাবে। 
কেমন করে?
এই যে আমার মিষ্টি গান শুনে শুনে। 
কিন্তু, তুমিতো হঠাৎ আজ এলে। 
না, না আমি সব সময়ই তোমার মনের মধ্যে আছি। তুমি চিনতে পারনি। এতোদিন। 
কেন বলতো?
তুমি তখন অনেক ছোট ছিলে যে। 
জান, আমার জন্মদিন। আমাদেও বাসায় আজ অনেক অতিথি আসবে। 
আমাকে নেমন্তন্ন করবে না? 
বারে, তুমি তো এসেই গেছ!
তুমি খুশি হয়েছ? 
হ্যাঁ, খুব খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু আজ আমার জন্মদিনে বাগানের ফুলগুলো সব গোমরা হয়ে আছে। ওরা কেউ ফোটেনি, কেন বলতে পার? 
ওদেও রঙগুলোও কেমন ঝপাসা হয়ে গেছে। 
গব ঠিক হয়ে যাবে। 

মা আজ ফুলদানিতে ফুল রাখতে পারবে না। 
ঘর সাজাতে পারবে না। ওসব না হলে তো আমি মরেই যাবো। 
ছি পৌলমী, এমন কথা বলতে নেই। 
তাহলে ওরা ফুটছে না কেন? 
ওদেও রঙগুলা সব কোথায় গেল? 
সময় মত ওরা ওদেও রঙ ফিরে পারে।
তুমি কোনো চিন্তা করো না। 
আচ্ছা বন্ধু, তোমার ঐ মিষ্টি কণ্ঠটা আমায় দিতে পারবে?  
নিশ্চয় পারবো। তুমি যে আমার মনে বন্ধু। 
কি মিষ্টি তোমার গলার স্বর। আর মিষ্টি গায়ের রঙ। 
তোমার পছন্দ হয়েছে পৌলমী? 
খু-উ-ব। এমন পাখি আমি কখনো দেখি নাই। 
সবাই তো সবকিছু দেখতে পারে না।  
দেখার মত চোখ থাকা চাই। বোঝার মত মন থাকা চাই। 
কিন্তুু ৃৃ... আমিতো কোনো কথা বলতে পারি না। 
তাই তো তুমি ্এত সুন্দর। 
জান বন্ধু, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি ভাল হয়ে যাব। 
হবেই তো বন্ধু। 
সত্যি বলছো? 
একদম সত্যি। 
জান মা বলেন, যারা ফুল পাখি পছন্দ করেন তারা স্বর্গেও সুখ বুঝতে পারেন। এই দেখ না তোমাকে কেমন ভালবেসে ফেললাম। পাখি বন্ধু তুমিও কি আমায় এমন ভালবাসো?
না হলে তোমার কাছে এলাম কি করে? 
দুষ্টু মেয়ে কোথাকার। 
আচ্ছা, তোমার আর কোনো পাখি বন্ধু নেই? 
 হ্যাঁ অনেক আছে এই তো দেখ, তোমার বাগানে কত পাখি বসে আছে। 
কিন্তু ওরা তোমার মত এত সুন্দও নয় কেন? 
ছি পৌলমী, এমন কথা বলতে নেই। 
ওরাও তোমার বন্ধু যে। 
শুনলে কষ্ঠ পাবে। 
কাউকে কষ্ঠ দিতে নেই। 
দুষ্টুকেও মিষ্টি কথা বলে আপন করে নিতে হয়। 
তুমি এত সুন্দর হলে কি করে? 
আমি পাখি রাজ্যের রাজকুমার। 
তাই বুঝি,কি মজা।
তাইতো তুমি এতো সুন্দর।
কেন পৌলমী তুমিও তো রাজকন্যা। কত সুন্দর। 
কে বলেছে সুন্দরও, যে কোনো কথাই বলতে পারে না...
পৌলমী কেঁদে ফেলে। 
কেন বলতে নেই? তুমি কি জান, আমার মনে কত কষ্ট? 
জানি বলেই তো তোমাকে এত ভালবাসি। 

তুমি আমার কথা বুঝতে পার? 
আমরা পাখিরা তো মানুষের মত কথা বলতে পারি না। কিন্তু মিষ্টি সুরে গান করি। সে সুরও সবাই বুঝতে পাওে না। তুমি ঠিকই বুঝেছ। 
এখন থেকে প্রতিদিনই তুমি আসবে তো পাখি বন্ধু? 
প্রতিদিন কেন, প্রতিক্ষণই আমি তোমার পাশে থাকবো। 
তোমার মা বাবা বকা দেবে না? 
কে দেবে? আমি তো খারাপ কিছু করছি না। আমার মা বাবা তো আমাকে ভাল কাজ করারই উপদেশ দিয়েছেন। ঐ দেখছ না, ডালে ডালে আমার চেলা সামন্ত বসে আছে। 
খারাপ কিছু করলে কি ওরা আমায় রেহাই দেবে ভেবেছ? 
ওরে বাবা তাই নাকি! 
হুঁ। তাইতো দেখছি। 
আমার যে এখন যাবার সময় হয়ে এল বন্ধু। 
বল কি, কোথায় যাবে? 
বারে, আমার মা বাবা আমার জন্যে চিন্তা করবে না বুঝি? 

বাগানের চাঁপা আর রজনীগন্ধা এসে পাখির কাছ থেকে সাদা রংটি নিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে গাছের ফুল ফুটে গেল। সেই গাছের পাশে চাঁপা আর রজনীগন্ধার সাজে কী সুন্দরও ফুটফুটে ফুলপরী দু’জন পাখা মেলে মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলো। 
এরপর এল গাঁদা। সে নিল হলুদ রঙ। আর সাথে সাথে হলুদ গাঁদার সাজে আর একটা ফুলপরী পাখা মেলে হাসতে লাগলো। 
তারপর এল জবা। সে নিল লাল রঙটি। 
একইভাবে জবার সাজে আর একটা ফুলপরী পাখা মেলে হাসতে লাগলো। 
পৌলমী তো অবাক। আনন্দ যেন শেষ হয় না। 
পাখি রাজকুমার বললো, বন্ধু এখনো আরও বাকী আছে যে। দেখ তারপর..
ওমা একি কা-! 
এরপর এর গোলাপ।  
গোলাপ নিল মিষ্টি গোলাপি রঙটি। তার সাথে নিল সাদা, লাল, হলুদ রঙেরও কিছু কিছু। এরপর কি অদ্ভুদ সাজেই না ফুটে উঠলো বাগানে। লাল সাদা, হলুদ, গোলাপি গোলাপগুলো কী অপরূপভাবে ফটে উঠলো। আর কী মোহনীয় রূপে নানা রঙের গোলাপের সাজে সেজে মুকুট পওে একটি  পরী পাখা মেলে পৌলমীর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলো। 
পাখি বন্ধুটি বললো, গোলাম হলো ফুলের রানী বুঝেছ বন্ধু ?
তাই বুঝি ওর মাথায় মুকুট ? 
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। 
এখন তোমার বাকি রঙগুলো কী করবে বন্ধু ? 
বাকী রঙগুলো? এই যে দেখ, 
দিগন্তে ছড়িয়ে দিলাম। 
সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি রঙে আভা দিগন্তে ফুটে উঠলো। 
আর সেই সাথে কোথা থেকে এক বাঁশিওয়ালা বন্ধু বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাগানের পাশে রাধাচূড়া গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাতে লাগলো। 
বাঁশির সেই মিষ্টি সুরে বাগনের ফুলের চারপাশে পরীরা নাচতে লাগলো। প্রজাপতি, ভ্রমরগুলো পাখা মেলে উড়ে উড়ে ঘুর ঘুওে এ ফুল থেকে ও ফুলে বসলো। পৌলমীর চোখ যেন ভরে না। হাততালি দিয়ে সে ও গাইতে থাকলো, নাচতে লাগলো। ভোরের আলোয় ঘুম ভেঙ্গে জানালার পাশে খাটের উপর পৌলমী আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। 
কেউ আর তাকে ডাকেনি। তার সারা ঘর বাগানের ফুল দিয়ে সাজানো। 
পৌলমী ঘুম ভেঙ্গে অবাক হয়ে মাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে কাঁঠালি চাঁপা গাছটি দেখায়। 
সবাই দেখে সত্যি সত্যি কী সুন্দও চোখ জুড়ানো, নারারঙের অপূর্ব একটি পাখি বসে আছে ডালে। চারদিকে আরও কত পাখি। 
পৌলমী স্পষ্ট বলে ওঠে- মা, ওই সাতরঙা পাখিটিই তো আমাকে কথা বলা শিখিয়েছে। ঐ দেখ কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। 
এই বন্ধু, আমার কাছে আয়। 
হাত বাড়িয়ে পাখিটিকে ধরতে যেতেই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। 

আসলে পৌলমীর যখন ন’মাস বয়স তখন সে খাট থেকে নিচে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ায় তার কন্ঠনালী দূর্বল হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, ধীরে ধীওে আপন গতিতেই একদিন সে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। আজ সে ঘটনাই ঘটলো। বাবা- মা, খালামনি, চাচু সবাই আজ পৌলমীর জন্মদিনের শুরুতে চুমোয় চুমোয় ভওে দিল তার কপাল, চোখ মুখ। 

পৌলমী আপন মনেই বলতে থাকলো- 

সাত রঙা পাখি 
করছে ডাকাডাকি
খুকুর চোখে ঘুম নেই
চোখ মেলে সে চাইলো যেই 
জানালা খুলে দেখলো একি 
রঙে ভরা পাখি সেকি 
গান শুনিয়ে ঘুম ভাঙালো
খুকুমনির মন রাঙালো
মিষ্টি  হেসে খুললো আঁখি॥

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top