সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

বাদশাহ্ বাবর: শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০১৯ ২২:৫৩

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ১০:১৬

শাহান আরা জাকির পারুল

 

২৫ মার্চ। ১৯৭১।

শীত চলে গেলেও আজকের সকালটা কেমন মেঘাচ্ছন্ন। শীত পড়েছে বেশ। বসন্তের ছোঁয়া। চারদিকে কুয়াশায় ঝাপসা।

উঠানের একপাশে একচিলতে রোদ্দুর উুঁকিঝুকি মারছে।

ঘরের এক কোনে পক্ষাঘাতগ্রস্থা বুড়ো মা করিমন বিবি কোঁকাচ্ছে, যেন কত ঠান্ডা পড়েছে। সাবিহা মাটির সানকিতে পান্তা ভাত, পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ দিয়ে মেখে ছেলেকে ডাকে।

ও বাজান ওঠ! তাড়াতাড়ি খায়া ল। বাসাত কামে যাওয়া লাগবি। দেরী হয়া গ্যালো। ও বাবর--।

মা, আইজক্যা তুই কামে যাবি না কলাম।

না সোনা। ও কথা কোস ন্যা। কামে না গেলি কি খায়া থাকপো বাজান। আমার জ্বর আইছে! তুই আইজ কামে যাব্যার পারবিন্যা কলাম। আমার কাছে থাক। মানিক আমার ওঠ। চারডা খায়া আমাক বিদায় কর বাজান। আমার জ্বর। ঠান্ডাবাত খাব নানে। সাবিহা এবার রেগে যায়। মাঝে মাঝেই বাবর এমন জ্বরের ভান করে। মা যাতে অন্য বাসায় কাজে যেতে না পারে। দেখ বাবর, ওঠ তাড়াতাড়ি। উঁ-মনে অয়-য্যান বাদশা বাবর হই’ছিস না? হ,হ, আমি বাদশাহ। তোর বিবিসাব না আমাক বাদশা বাবর কয়! হা.... হা..হা.. আমি বাদশা বাবর। আর তুই বাদশার মা। পাগল ছাওয়াল কুনকার।  সাবিহা মুখ টিপে হাসে।

করিমন বিবি খুক খুক করে কাশতে কাশতে বাবরকে ডাকে। ও বাবর, মা’রে কামে যাব্যার দে। আয়তো বাই আমার খ্যাতার তলে শুয়্যা থাক। গা ওম হবি, আয়।

না নানী। তুমার গায় গন্ধ। গোসল কর না এক মাস। উঁহ্...। নবাবের ব্যাটা বাদশাহ্। করিমন বিবি বিরক্ত হয়ে আবার খুকুর খুকুর কাশতে কাশতে শুয়ে থাকে। সাবিহা কুয়াশা ঠেলে তাড়াতাড়ি একরকম দৌড়ে দৌড়ে যেতে থাকে। ঠিকা কাজ করে। বিবি সাব খুব দয়ালু। তার দয়াতেই সাবিহার খাওয়া চলে।  বাবরকে খুব আদর করে। আদর করে বাদশা বাবর বলে ডাকে।

সাবিহা খুব খুশী হয়। বাবরকে ছয় মাসের রেখে রিকসাওয়ালা কালাম মিয়া নিরুদ্দেশ হয়। অনেক দিন পর সাবিহা জেনেছে তার কপাল পুড়েছে। কালাম মিয়া আর একটা বিয়ে করে সংসার করছে। ঘৃণায় সাবিহা নিজের পথ নিজে দেখে। দূর সম্পর্কের এক খালার সাথে ঢাকায় আসে কাজের খোঁজে। ভাগ্যক্রমে ভাল একটা বাসায় ঠিক কাজ পায়।

জান-প্রাণ দিয়ে সাবিহা বিবি সাবের জন্য খাটে। বিবি সাহেবও তার ভালমন্দ খোঁজ খবর নেয়। খাওয়া পরা দেয় পর্যাপ্ত।

ইসরে, অনেক দেরী হয়া গ্যাল আইজ। আম্মা যে কি কবিনে! বাবরডা মাঝে মধ্যে আমাক বড়ই জালাতন করে। কামে যাওয়ার সুমায় কেমুন দেরী করায়া দ্যায়! আইজ বাড়িত যায়া আচ্ছা করে শাসন করা লাগবি।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সাবিহা ছুটে চলে কাজের বাড়ির দিকে। হঠাৎ রাস্তার পাশে দোকানে অনেক লোকের ভীড় দেখে থমকে দাঁড়ায় সাবিহা। রেডিওতে কেডা য্যান বাষণ দিচ্ছে। দেশবাসীর কাছে কি য্যান আর্জি জানাচ্ছে। থাউকগা, ও সব শুন্যা আমার কাম কি?

সাবিহা আপন মনে বির বির করতে করতে আবার জোড়ে জোড়ে হাঁটতে থাকে। এই তো এসে গেছি। বিবি সাব বারান্দায় দাঁড়ায়া আছে। সাবিহা কাঁচুমাচু হয়ে নাজমা চৌধুরীর সামনে দাঁড়ায়।

আম্মা, আমারে মাফ করবেন। ছাওয়ালডা বড় দুষ্টু, কামে আসার সুমায় জ্বরের ভান করে মাঝে মধ্যে বাঁধা দেয়।

না না, ঠিক আছে। যাও কাজ করো। সাবিহা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢোকে। থালা বাসন ধুয়ে, চুলা মুছে, রুটির পানি চুলায় দেয়। নাজমা এসে সাবিহাকে সাহায্য করে।

সাবিহা টি বানায়। নাজমা সেঁকে দেয়। নাজমা মাঝে-মাঝেই সাবিহার এটা ওটা কাজে নিজেও সহায়তা করেন। এই ফাঁকে সাবিহার খবরাখবর নেন। সাবিহা খুব খুশী হয়। কিন্তু আজ নাজমার মনটা বিষন্ন। সাবিহার সাথে তেমন কথাবার্তাও বলছেন না। সাহিবা এসব লক্ষ্য করে। আম্মা, আপনার শরীরডা বুঝি আইজ খারাপ? না বুয়া, মনটা খারাপ। দেশের অবস্থা ভাল না। কখন কি যে হয়!

হ’ আম্মা। আসার সুময় দ্যাখলাম, দুকানে ম্যালা মানুষ চাক্ হয়া রেডিওতে কার য্যান বাষন শুনতিছে। আর কি সব বলাবলি করতিছিল। দ্যাশে নাহি যুদ্ধ লাগবি। কিসের যুদ্ধ আম্মা? আমরা ব্যাবাক মানুষ কি মরা যাব? হায়াত মউত সব তো আল্লাহর হাতে বুয়া। দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ হবে।

কিয়ের স্বাধীনতা আম্মা?

আমাদের মায়ের ভাষার স্বাধীনতা। ক্যা, আমাগো বাষার কি অইছে? তুমি কি তোমার নিজের ভাষা বাদ দিয়ে অন্য কোনো ভাষার কথা বলেতে পারবে? না, না আম্মা কুনোদিনও না।

আমরা অন্যদেশের কাছে বন্দী। পাকিস্তানীরা আমাদের সবকিছু কেড়ে নিতে চায়। এই আমাদের সোনার দেশ, মাটি, ভাষা, সবকিছু। এইডা তো খুব খারাপ কতা আম্মা! সেই জন্যেই এখন আমাদের দেশের সমস্ত মানুষ বাধা দিতে প্রস্তুত। তুমি আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাড়ী চলে যাও। আচ্ছা আম্মা। সাবিহা ঝটপট কাজ করতে থাকে। কাপড়-চোপড় ধোয়ার জন্য বাথরুমে যায়। নাজমা বাধা দেয়।

আজ আর কাপড় ধুতে হবে না। তুমি চলে যাও। বিকেলে আজ আসতে হবে না। চুপচাপ ঘরে থাকবে। সন্ধ্যায় ঘরের বের হবে না। তোমার অসুস্থা মা ও ছেলের দিকে খেয়াল রাখবে।

আইচ্ছা আম্মা। দোয়া করিয়েন। আমাদের জন্যেও দোয়া কোর বুয়া।

আদাবরের ছোট্ট একটি খুপরি ঘরে ভাড়া থাকে সাবিহা। বেলা পড়ে আসছে। সাবিহার বুকটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। বাবরডা বড চটপটা। যহন তহন ঘরের বাইরে যায়। আসে অনেক বেলায়। সাবিহা সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাসায় ফেরে। ফিরে এসে দেখে চারপাশের লোকজন সবাই আতঙ্কে এটাসেটা বলাবলি করছে। বাবর ও করিমন বিবি উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে। মা, দ্যাশে বলে যুদ্ধ লাগপি! সারা রাস্তায় পুলিশ ঘুরত্যাছে। কেউ ঘরের বাইরে যাব্যার পারবি ন্যা। হ, বাজান। বাইরে যাস ন্যা। গন্ডগোল হবি, গরের মধ্যে চুপচাপ বস্যা থাক।

সন্ধ্যে হয়ে এল। সমস্ত লোকজন যে যার ঘরে চুপচাপ। অন্ধকার হতেই সকাল সকাল সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে কুপির আলো নিভিয়ে দিল। শুয়ে পড়লো সবাই। রাত গভীর। চারদিক শুনশান। হঠাৎ প্রচন্ড গুলির আওয়াজ।

দুম দুম্!! দাড়–ম দুড়–...ম্, ঠ্যা, ঠ্যা, ঠ্যা।

বাবর মাকে জড়িয়ে ধরলো ভয়ে। আচমকা গুলির শব্দে লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়লো। যে যেমন পারছে পালাতে লাগলো। যার যার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

করিমন বিবির কাশি আরো বেড়ে গ্যাল। নিশ্বাসের শাঁ শাঁ শব্দ। মা, ওমা আমরা কই যাব? নানীরে ক্যামনে নিব্যা? বাবর সাবিহাকে অস্থির করে তুললো। গুলির আওয়াজ বেড়েই চললো। মনে হয় তাদের ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে শব্দ। বুটের খুট খাট আওয়াজ। সাবিহা অসুস্থা পক্ষাঘাত গ্রস্থা মাকে, কিভাবে নেবে বুঝে উঠতে পারে না।

ওমা। তাড়াতাড়ি কর। বাবরকে নিয়া তাড়াতাড়ি যা মা। ও নানী, তুমি কেমনে যাব্যা? ও সুনা, আমার জন্য তুরা ভাবিস না। আমি তো মরা মানুষ। আমারে গুলি কইরা মাইরা ফেললি কিচ্ছু হবি ন্যা। তুরা দুইজন তাড়াতাড়ি এইখান থেক্যা চল্যা যা মা। না, মা। তুমারে রাখা যাব্যার পারব না নে। সাবিহা কেঁদে ফেলে। আরো জোড়ে গুলির আওয়াজ হয়। মাগো, তাড়াতাড়ি’ল। আশপাশের ব্যাবাক মানুষ চলা গ্যাছে কেউ নাই। বাবর সাবিহার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। অসহায় রোগক্লিষ্ট করিমন বিবি কুঁকাতে থাকে। বাবর ও সাবিহা একটা কাপড়ের পুটলী হাতে করিমন বিবিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মারে, কাঁদিস ন্যা। তাড়াতাড়ি যা। মরা মানুষের জন্য কাঁদা লাগবে না। তাড়াতাড়ি যা। চোখ মুছতে মুছতে সাবিহা ও বাবর গ্রামের উদ্দেশ্যে ত্রস্ত পায়ে রওয়ানা হয়।

হাজার হাজার মানুষের মিছিল যেন রাতের অন্ধকারে মাটির রাস্তা ধরে অনিশ্চিত পথে এগিয়ে চলছে। সাবিহা ও বাবর মিশে যায় সে মিছিলে।

খুপরি ঘরে একা পড়ে থাকে করিমন বিবি। গগণ বিদারী গুলির আওয়াজের সাথে মিশে যায় তার কুঁকানীর শব্দ।

পরদিন সন্ধ্যায়, বাস, নৌকায়, পায়ে হেঁটে বিভিন্ন ভাবে অতি কষ্টে নিজ গ্রামে এসে পৌছে সাবিহা ও বাবর। কিন্তু, কোথায় থাকবে তারা? হঠাৎ কে যেন জিজ্ঞেস করে- কিডারে, সাবিহা না? হ’ চাচা। বাবর তো দেহি ম্যালা বড় হয়া গ্যাছে! ও বাবর, নানারে সালাম কর। না, না, সালাম লাগবি ন্যা। তা-তুরা ডাহা থেক্যা আসলি বুঝি? কি অবস্থা ঐ খানকার? তোর মা কই সাবিহা? সাবিহা ডুকরে কেঁদে ওঠে। সব কথা শুনে জমির আলীর মায়া হয় খুব। দুর সম্পর্কের চাচা। সাবিহার বাবার সাথে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল জমির আলীর।

ল, ল,.. (চল্ চল্) আমার বাড়ীতে থাকবি তরা। কুনো চিন্তা করিস ন্যা। সাবিহা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়। সাবিহাকে দেখে জমির আলীর স্ত্রী খুশীই হয়। ছেলে-মেয়ে নিয়ে একা একা সংসার সামলানো কঠিন। কাজে কামে সাবিহা ও বাবর সাহায্য করতে পারবে।

দিনে দিনে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। গ্রামে গঞ্জে মিলিটারীর অত্যাচার। এক রাতে জমির আলী সাবিহাকে কিছু কাজ বুঝিয়ে দেয়। শোন মা সাবিহা, খুব সাবধানে থাকবি, মাঝরাতে দরজায় টোকা শুনলে সজাগ হবি।

ভয় পাবি না। ঐ সুমায় মুক্তিবাহিনীর মানুষ আসে আমাগর বাড়ীত। মুড়ি, চিড়া, ডালভাত নিয়া যায়। কাউরে এ খবর দিবি না।

সন্ধ্যা রাতে কিছু বাড়তি ভাত তরকারী রান্ধ্যা রাখবি। তর চাচী ছাওয়াল পাল লয়া রাঁধব্যার পারে না। ঠিক আছে, চাচা। আমি রাধঁবনে। আর শোন্ মা। গেরামে রাজাকার, আলবদরে ভরে গ্যাছে। হারামজাদারা কেউ য্যান কিচ্ছু ট্যার না পায়। আইচ্ছা চাচা।

সাবিহা প্রতিরাতে খুব যত্নসহকারে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার তৈরী করে তাদের হাতে তুলে দিতে থাকে।  বাবর- এর বয়স তখন বার কি তের হবে। ঠোঁটের উপর হালকা গোঁপের রেখা দেখা যায়।  কন্ঠ ভারী।  স্বর বদলাচ্ছে।  ভারী চঞ্চল স্বভাবের।

একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বায়না ধরে, সে মুক্তিবাহিনীতে যাবে। কমান্ডার কিছুতেই রাজী হয় না। এই বা”চা ছেলে যুদ্ধ করবে কিভাবে?

সাবিহা কিছুতেই চোখের আড়ালে যেতে দেবে না প্রানের ধন বাবরকে। বাবর যাবেই।

এদিকে গ্রামে টাকার লোভে ছোট বড় সব ছেলেরা রাজাকার, আল বদরে নাম লেখাচ্ছে। জমির আলী সাবিহাকে বললো, মারে বাবররে যাব্যার দে মুক্তিবাহিনীতে। রাজাকার হবার চাইতে যুদ্ধে মরা বাল মা। বাবর চলে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। সাবিহা চোখের জলে ভাসে আর কাজ করে। ফেলে আসা অসুস্থা মা আর বাবরের কথা ভেবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ডুকরে ডুকরে আপন মনে কাঁদে। কিশোর বাবর দুষ্টু হলেও বুদ্ধিমান। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভেবে পাচ্ছিলেন না, বাবরকে কি কাজ দেয়া যায়!বাবর গদ্ গদ্ হয়ে বললো-স্যার, আমি পাক সেনাগো ক্যাম্পে কলা সাপ্লাই করবো। কলার মধ্যি কিছু ভরি দিলি অয় না স্যার?

মানে, কি ভরি দিবি? এই মানে, বিষ-টিষ ঢুকায়া দিলিই স্যার, কাম হয়া যায়। সব মইরা ছাপ হবিনি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভাল কথা তো বলছিস বাবর। এক্কেবারে শাহান শাহ্ বাদশা বাবর এর মতই বুদ্ধি। কমান্ডার খুশী হয়ে বাবরকে কলা সাপ্লাই এর দায়িত্ব দিলেন পাক সেনাদের ক্যাম্পে। বাদশা নামে বাবর কাজ শুরু করে দিল মহানন্দে।

কিছুদিনের মধ্যেই সে পাকসেনাদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে গেল। কলা খেতে খেতে মাঝে মাঝে পাক আর্মীর ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করে-এই শালে, তু মক্তিবাইনীর চেলা নেহি তো?

নেহি, নেহি, হাম মুক্তিবাইনী নেহী জান্তা, নেহী চিনতা স্যার!

দিন শেষে কাম্পে ফিরে এসে রসিয়ে রসিয়ে বাবর এ সব কথা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মজা করে গল্প করে।

যখন পাক সেনাদের সাথে বাবরের খুব রম রমা সম্পর্ক গড়ে উঠলো। সে সময়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হোল, কলার মধ্যে পয়জন ঢুকিয়ে দেয়া হবে।

যা ভাবা, তাই করা হোল। সিরিঞ্জ নিয়ে কলার মধ্যে পয়জন ঢুকিয়ে দেয়া হোল। একদিন বিষাক্ত কলা খেয়ে অনেক পাকসেনা মারা গেল। তাদের অস্ত্রসস্ত্র মুক্তিবাহিনী লোপাট করে নিয়ে গেল।

মুহুর্তে খবর ছড়িয়ে পড়লো পাকসেনাদের মধ্যে। গরম হয়ে উঠলো তারা বাবরের উপর। পরদিন বাবর আর ক্যাম্পে গেল না।

তাকে ধরে আনার জন্য পাকসেনারা রাজাকার, আলবদরদের লাগিয়ে রাখলো।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিরাপত্তার জন্য বাবরকে পাঠিয়ে দিলেন অন্য এলাকায়! বাবর এখন দায়িত্ব পরিবর্তন করে একটি রেল স্টেশনে চা, পান, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি করতে লাগলো। ওর মিষ্টি ডাকে যাত্রীরা এক কাপ চা পান না করে থাকতে পারে না। কেউ পান, কেউ সিগারেট নেয়। বাবর উৎসাহে হাঁকডাক করে। এই চা... পান...বিড়ি..সিগারেট। এই...এদিকে আয়।

ট্রেনের জানালা দিয়ে একজন যাত্রীর ডাক শুনে বাবর দৌড়ে যায়। এই....তোর নাম কিরে? চা খেতে খেতে যাত্রীটি জিজ্ঞেস করে। আমার নাম বাদশাহ্ স্যার। উহ্! তুই আবার বাদশা হলি কবেরে? তুই না বাবর? বাবর চমকে ওঠে। পরক্ষনেই আশ্বস্ত হয়। ও...কেডা আপনে? ফজলু বাই? হ, হ,। চিনছিস আমারে?

হঠাৎ ভস করে হুইসেল দিয়ে ট্রেন চলা শুরু করে। বাবর নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আরে চল। সামনের স্টেশন থেক্যা ঘুইরা আসি। তোর সব পান, বিড়ি, চা বিক্রি হয়া যাবি। না, না, ফজলু বাই। আমি এই খানেই চা বেচি। চল্ চল্ ঘুইরা আসবি আমার সাথে। ট্রেন চলতে থাকে ঝক ঝক করে।

পরের ষ্টেশন ট্রেন থামতেই ফজলু পটিয়ে বাবরকে নিয়ে যায় পাকসেনাদের ক্যাম্পে। বাবর-এর বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে আতঙ্কে। আসলে, ফজলু ছিল রাজাকারের কমান্ডার। টেনে হেঁচড়ে বাবরকে নিয়ে যায় পাকি ক্যাপ্টেন-এর সামনে।

তো, ইয়ে হ্যায় বাদশাহ্ বাবর? পাকড়াও। মুহুর্তে কয়েকজন পাকসেনা বাবরকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে। চোখ বাঁধে কালো কাপড়ে। ফুটবলের মত ক্যাপ্টেন লাথি মেরে ফেলে দিল বাবরকে। ক্যাম্পের দেয়ালে চোট খেয়ে কপাল ফেটে রক্ত পড়লো দরদরিয়ে। বাবর আবার উঠে দাঁড়াল। ফায়ার.....।

সহজ সরল বাবর ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতেই গুলি করলো পাঁজর বরাবর।

মা.... বলে ছটফট করে দুর্বাঘাসের উপর গড়াগড়ি খেল কয়েকবার।

ক্রুদ্ধ পাকসেনাদের অর্ডারে ফজলু রাজাকার বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল বাবর-এর নিস্পাপ কচি দেহটিকে। মৃত্যুর আগে বাবর ফজলুকে অনেক কাকুতি মিনতি করলেও, বেঈমান বিশ্বাসঘাতক ফজলুর অন্তর কাঁপেনি একবারও।

বাবর গোঙ্গাঁতে গোঁঙ্গাতে দেখতে পায়-তার মা মাটির শানকিতে পেয়াঁজ মরিচ দিয়ে ভাত মাখিয়ে ডাকছে। “আয় বাজান, খাতি আয়”।

নানী করিমন বিবি কাঁথার নীচে গা ওম করার জন্য আকুলি বিকুলি করছে। “আয় বাই, আমার খ্যাতার নীচে আয়। গাও ওম হবী।”

বাবর-এর নিস্পাপ কচিদেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। শয়তান ফজলু টেনে হেঁচড়ে গুম করে দেয় লাশ। রাতে বাবর ক্যাম্পে ফিরে না আসায় মুক্তিযোদ্ধারা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। ছদ্মবেশে খোঁজ নিতে থাকে।

পরদিন বাবরের খোঁজ জানতে পেরে মর্মাহত মুক্তিযোদ্ধারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কিশোর এই ছেলেটি সবাইকে মায়ার জালে বেঁধে ফেলেছিল যেন। অনেক চেষ্টা করেও বাবর-এর লাশটি উদ্ধার করতে পারে নাই তারা। স্থান পরিবর্তন করে মুক্তিযোদ্ধারা আবার যে যার দায়িত্বে চলে যায়। যুদ্ধ শেষ হয় একদিন।

দেশ স্বাধীন হয়।একে একে ঘরে ফেরে মুক্তিযোদ্ধারা। কেউ পা হারিয়ে, হাত হারিয়ে। কেউ হুইল চেয়ারে বসে, একবারেই পঙ্গুঁ। সাবিহা পথ চেয়ে বসে থাকে। দিন গোনে।কবে আসবে তার বুকের ধন বাবর। বাবর আর ফেরে না। দিন যায়। মাস যায়। একদিন গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে বাবরের সব ঘটনা জানতে পারে সাবিহা। মা ছেলে দুজনকে হারিয়ে উন্মাদ সাবিহা। তার যেন বিশ্বাসই হয় না কিছুই। মনে হয়, মা বুঝি বেঁচে আছে এখনো আদাবরের ঐ খুপরি ঘরটাতে। এখনো খুক খুক করে কাশছে।  বাবর এসে ডাক দিচ্ছে-

“মা, মারে..... ভাত দিবিনে?” “আইজক্যা বাসাত কামে যাব্যার পারবিন্যা। আমার জ্বর আইছে। কাছে থাক।”

কত কথা মনে পড়ে সাবিহার। অস্থিার মনটাকে শক্ত করে, গভীর বিশ্বাস নিয়ে সাবিহা আবার রওয়ানা হয় ঢাকার সেই আদাবরে। এছাড়া কোন উপায় নাই যে। গ্রামের আশ্রয়দাতা জমির চাচা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায়, তাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে রাজাকার এর দল। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলেছে. তাকে। 

অসহায় সাবিহা, আরও কয়েকজনের সাথে চলে আসে আদাবরে। এসে কিছুই পায় না। বিরান ভিটা। তার খূপরি ঘরের সন্ধান কেউ দিতে পারে না। ক্লান্ত সাবিহা পা টেনে টেনে বিবি সাবের বাসায় যেতে থাকে। শ্যামালী দুই নাম্বার রোডের বিশাল বাড়ীটি থমথমে। কলিংবেল টিপতেই বেরিয়ে আসেন নাজমা চৌধুরী।

কে তুমি? আম্মা, আমি সাবিহা। সাবিহা? তোমার একি অবস্থা? এসো, এসো ভেতরে এসো। তোমার মা, বাদশা বাবর...

সাবিহা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। সব ঘটনা শুনে নাজমা অস্থিার হয়ে যায়। তার একমাত্র সন্তান শুভ শহীদ হয়েছে। স্বামী আহত। এক পা মাইনে উড়ে গ্যাছে। কৃত্রিম পা। নাজমা আঁচলে চোখ চেপে কাঁদতে থাকে। কামরুল চৌধুরী ক্রাচে ভর করে এসে নাজমার কাঁধে হাত রাখে। তুমি এমন অস্থিার হলে, সাবিহা বেচারী আরও ভেঙ্গে পড়বে নাজমা। শান্ত হও সবাই।

আব্বা! ক্রাচে ভর করা কামরুল চৌধুরীকে দেখে চমকে ওঠে সাবিহা। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

এই দেখ, দেশের জন্য একটা পা হারিয়েছি। আমার বুকের ধন নীল মনি শুভ সোনাকে হারিয়েছি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া টগবগে তরুণ ছেলে আমার। তুমি তো একা নও সাবিহা! দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য আমরা সবাই কাউকে না কাউকে হারিয়েছি। নইলে, এ দেশ স্বাধীন হতো না।

আব্বা...আমার যে কেউ...। তোমার সবাই আছে। দেশের সবাই তোমার সন্তান। তুমি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মা। তোমার বাবর তো শাহানশাহ্। আজ থেকে তুমি আমাদের কাছেই থাকবে সাবিহা। সাবিহা অবাক হয়ে কামরুল চৌধুরীর কথা শোনে। দেয়ালে টাঙানো শুভর ছবিটার দিকে অপলক চেয়ে থাকে নাজমা ও কামরুল চৌধুরী। কেমন হাসি হাসি মুখখানা। সাবিহাও চেয়ে থাকে ছবিটার দিকে। ধীরে ধীরে শুভর ছবির মধ্যে বাবর-এর প্রতিচ্ছবি যেন ফুটে ওঠে।

সাবিহা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ছবিটার দিকে। শুভ হাসছে মিষ্টি মিষ্টি। হাত বাড়িয়ে ছবিটাকে চুমোয় চুমোয় ভরে দেয় সাবিহা।

সোনার মুকুট পড়ে শুভ ও বাবর যেন হাসতে হাসতে মিলিয়ে যায় কোথায়। সাবিহা ছবিটাকে বুকে চেপে ধরে। সাবিহার এ মমতার শীতল ছোঁয়া, হয়তো শুভ ও বাবর এর বিদেহী আত্মাকে স্পর্শ করে নিরবে।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
লেখক ও গবেষক

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top