সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধ সন্তান: শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০১৯ ০৬:০৪

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ১০:১৬

শাহান আরা জাকির পারুল

 

জোড়া খুন! জোড়া খুন! পালাও পালাও। কাপাসিয়া গ্রামের লোকজন ছুটোছুটি করছে। গ্রামের চেয়ারম্যান কছিমুদ্দিন ও তার ছেলে মাইনুদ্দিন খুন হয়েছে আজ রাতে। বিচার আচার শেষে ভুরি ভোজ করে বাপ-বেটা তাস খেলে কাছারী ঘরেই ঘুমাচ্ছিল। দুইজন দুই খাটে। ঐখানেই খুন। লোকজনের কানাঘুষা চলতে থাকে।

এই তরা সগলে তাড়াতাড়ি পলা। থানা থেক্যা গাড়ী ভরা দারোগা পুলিশ আসতিছে।

আসুক। আসব্যার দ্যাও। আমরা তো আর খুন করি নাই।

না করলি কি হবি। সাক্ষী দেওয়া লাগবি।

সাক্ষী আবার কিসের? শালা, হারামজাদা দুইডা খুন অইছে। বালো অইছে। গেরামডায় এইবার শান্তি ফির‌্যা আসবি।

হ, হ, ঠিক কইছস দোস্ত। শালা, রাজাকারের বাচ্চা। বুকের রক্ত দিয়া, দ্যাশ স্বাধীন করলাম আমরা। আর হারামজাদারা মজা লুটতাছিল ঐ সুময়। আমরা না খায়া মরি। আর হারামজাদারা সারা রাত গাঁজা ভান টান্যা তাস জুয়া খেলে। পিকনিক করে। কিন্তু এমুন কামডা ক্যাডা করলো?

সে চিন্তা দারোগা পুলিশের করব্যার দে। এখন চল্ আমরা পলাই। হ,হ, চল। বউ বাচ্চা নিয়ে অনেকেই ভয়ে অন্য গ্রামে চলে গেল। এই গ্রামেই একটা ছোট্ট ছোনের ছাউনী দেয়া কুড়ে ঘরে বাস করে জয়তুন, তার একমাত্র সন্তান বিজয়কে নিয়ে।

জয়তুন পাগলী। সবাই ওকে পাগলী বলেই ডাকে।  কখনো সে ভাল। কখনো একেবারেই বেসামাল। বয়সের তুলনায় অভাবের জীবনে বার্ধক্য খুব বেশি ভর করেছে শরীরে। চোখ দুটি কোটরে ঢুকে গ্যাছে। এরপরও সে যে একসময় অপরূপ সুন্দরী ছিল, তার ছাপ সারা দেহে স্পষ্ট।

অনেক ঝড় ঝঞ্জার মাঝে জয়তুন এক নিরব ইতিহাস।

১৬ ডিসেম্বর,১৯৭১। বিজয় দিবস। এই বিজয়ের মাসেই জয়তুন এর ছেলের জন্ম। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা তাই ওর নাম রেখেছে বিজয়।

বিজয় আজ টগবগে তরুণ। উচুঁ লম্বা ফর্সা, সুঠাম দেহ। বিজয়, চেয়ারম্যান বাড়ীর পাহারাদার। ঘরের আঙিনায় বড়–ই গাছের নীচে জয়তুন আর বিজয় চুপচাপ বসে ছিল। বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে পালানোর সময় একজন গ্রাম-বাসী বললো কিরে বিজয়, অহনো মায় ব্যাটা বস্যা রইছিস্? পলাস নাই? না, পলাব ক্যা? পলা, পলা তাড়াতাড়ি। তুই না চেয়ারম্যানের বাড়ীর পাহাড়াদার? তাই কি? আমি তো রাইত দশটায় বাড়িত চল্যা আসি। চেয়ারম্যান ছুটি দিয়া দ্যায়। খুনতো অইছে ম্যালা রাইতে।  হ, বুঝছি। ব্যাডা অকাম কুকামের সময় পাহাড়াদার রাখে না। আইচ্ছা বাজান, মায়েরে লয়া বালমতন থাকিস। দারোগা কিছু জিগাইলে সত্য কথা কস। ডরাস ন্যা।

এই সময় পুলিশের বাঁশীর শব্দ শোনা গেল। গ্রামে যারা ছিল, সবাই ভীত সন্ত্রস্ত।  চেয়ারম্যানের বাড়ীতে দোয়া দরুদ পড়া চলছে। লাশ দুইটা পাশাপাশি সাদা কাপড়ে ঢাকা। সারা ঘর রক্তে ভাসা। চেয়ারম্যানের কাছারী ঘরের সামনে পুলিশের গাড়ী এসে দাঁড়ালো। দু’তিন গাড়ী ভর্তি পুলিশ। দারোগা নামলেন। একসাথে পুলিশের হুইসেল তিন চারবার বেজে উঠলো। পুরোগ্রাম ঘিরে ফেলা হোল। আর পালানোর কোন সুযোগ নেই কারো।

জয়তুন ভয়ে বিজয়কে জড়িয়ে ধরলো।

মা, ডর কিসের? আমি তর পাশে রইছি ন্যা?

হ, বাজান। তুই-ই তো আমার সব। গ্রামের লোকজনকে দারোগা সাহেব নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগলেন। দু’চারজনকে থানায় যেতে হবে জানিয়ে দিলেন।

এমন সময় অদুরে দাঁড়িয়ে থাকা উচাঁ, লম্বা, বলিষ্ঠ দেহী বিজয়কে দেখে ইশারায়‘ ডাকলেন। জিজ্ঞাসাবাদে চেয়ারম্যানের পাহাড়াদার জানার পর থানায় যেতে বললেন। বিজয় শক্ত সবলভাবেই যেতে রাজী হলো। পুলিশের ভ্যানে উঠলো বিজয় নির্ভয়ে। কিন্তু বিপর্যয় ঘটালো জয়তুন। লোকজনের মুখে, বিজয়কে থানায় নিয়ে যাচ্ছে শুনে, চিৎকার করতে করতে দারোগা সাহেবের পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়লো।

হুজুর আমার বিজয়কে ছাড়্যা দ্যান হুজুর। আমি খুন করছি। বিজয় খুনী না হুজুর। আমার বিজয় নির্দোষ। অরে ছাড়্যা দ্যান হুজুর। আমার লয়া যান। জয়তুন এর কথা শুনে, দারোগা-পুলিশের চক্ষু উৎপাটন এর অবস্থাা। গ্রামবাসী বাকরুদ্ধ।

পাগলীটা বলে কি। এই.....হাতকড়া পরাও পাগলীটাকে। সংগে সংগে বিজয় চিৎকার করে ওঠে--স্যার আমি খুন করছি স্যার। মায় খুন করে নাই। সবাই আরও অবাক! গ্রামবাসী হতভম্ব। মা ব্যাটা বলে কি! কেউতো কল্পনাও করতে পারে নাই। হুজুর, আমার বিজয়রে ছাড়্যা দ্যান।

স্যার আমার মা’রে ছাড়্যা দ্যান। জয়তুন ও বিজয় দুজনেই দাড়োগা সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে। ঠিক আছে, ঠিক আছে। দুজনেই থানায় চল। সব কথা শুনে ছেড়ে দেব। জয়তুন ও বিজয়কে হাতকড়া পড়িয়ে পুলিশভ্যানে তোলা হোল। গ্রামবাসী তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। কড়া পাহাড়ায় গাড়ী এগিয়ে চলালো। পেছনে ফেলে যাওয়া গাঁয়ের দিকে তাকিয়ে জয়তুন হারিয়ে যায়, পুরনো দিনগুলোতে।

এই তো সেদিন এর কথা। ছোট্ট বেলা বিকেল হলেই, উঠানে সাথীদের সাথে চিবুড়ি খেলা। গোল্লাছুট। চোখ বেঁধে কানা মাছি ভোঁ ভোঁ, ওপান্টি বায়োস্কোপ, আরও কত খেলা। কি মধুর জীবনই না ছিল। বর্ষার ভরা গাঙ্গে ডুব সাঁতার খেলা। সখীদের সাথে শাপলা তুলে, মালা গেঁথে গলায় পরা।

একদিন সাঁতার কাটার সময়, পানির নীচে কে যেন পা চেপে ধরে। কেউ আশ পাশে নেই। সবাই অনেক দূরে, ভয়ে সেদিন জয়তুন কি চিৎকারই না করেছিল! ডুবে গিয়ে অনেক পানি ও খেয়েছিল। অনেক কষ্টে চিৎসাঁতার দিয়ে গাঙ্গেঁর কিনারায় আসতেই দেখে, তাদের ই গাঁয়ের ছেলে নাসির তার পাশেই সাঁতরে আসছে আর মুখ টিপে টিপে হাসছে। কি মিষ্টি মুখখানা।

ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে জয়তুনের দিকে। জয়তুনের বুক কেঁপে ওঠে। কোথায় চলে যায় ভয়ডর। নাসিরকে তার খুব ভাল লাগে। কি দ্যাখতাছ? তোরে দেখি জয়তুন। তুই ম্যালা বড় হয়া গেছিস। আগে দেহ নাই? দেখছি। তয় আইজ ব্যেশী ভাল কর‌্যা দেখতিছি। অনেক সুন্দর হইছিস। যাও... কী যে কও...। সত্যি কচ্ছি, তুই পরীর লাহান সোন্দর হইছিস। মিছা কতা কব্যা নাতো। পরী তুমি চক্ষে দ্যাখছ?

নাসির জয়তুনের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে পরী দেহি নাই। অহন দ্যাখলাম। জয়তুন লজ্জায় লাল হয়ে যায়। এভাবে বেশ কিছুদিন যাবার পর নাসির তার বাবা মাকে তার পছন্দের কথা খুলে বলে। সাথে সাথে নাসিরের বাবা মা জয়তুনের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।

ধুমধাম করে দুজনের বিয়ে হয়ে যায়।  সুখের সংসার। বিয়ের তিন মাস পর দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। পাকসেনাদের তান্ডব বেড়ে চলে। গ্রামের অনেক লোকজন মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে ভারত চলে যায়। নাসিরের চেনা জানা কেউ নাই গ্রামে। মিলিটারীর ভয়।

যুবক ছেলে বাড়ীতে আছে জানলেই গ্রাম ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধা ভেবে মেরে ফেলে। আর মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়।  পাকহানাদারদের সহযোগীতার জন্য গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠে রাজাকার আলবদর বাহিনী। শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয় প্রতিটি গ্রামের মাতব্বর শ্রেণীর লোককে। কছিমুদ্দিন এই গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল। মাঝে মাঝেই পাকসেনাদের সাথে গরু ছাগল জবাই করে মহোৎসব করতো। আর অল্পবয়সী মেয়েদের তুলে দিত তাদের হাতে।

দেশ স্বাধীনের আগে পরে গ্রামে বহাল তবিয়তে চেয়ারম্যানের পদটি তিনিই দখল করে বসেছিলেন এতদিন। জয়তুনের চোখ দুটি অগ্নিশিখার মত ঝলকানি দিতে থাকে। এসব স্মৃতি প্রতিটি মুহুর্তে তাকে খাবলে খাবলে খায়। যা দেখানো যায় না বা কাউকে বোঝানোও যায় না, সে এক কঠিন নারকীয় যন্ত্রণা। একদিন রাতে কছিমুদ্দিন নাসিরকে ডেকে বলে- ওই নাসির, ঘরে বস্যা বস্যা কি করিসরে? খালি দিনরাইত বউর সাথে ঘুসুর ঘুসুর।

আয়, আয়, রাজাকারের খাতায় নাম লেখ্যা দেই। দেখছসনা আমার ছাওয়াল মাইনুদ্দিন নাম লেখাইছে, আরও কতজন নাম দিতিছে। দ্যাশের যা অবস্থাা চলবি ক্যামনে? বাল টাহা পয়সা পাবি। তুইও নাম লেখা। না, না, চাচা। রাজাকারের খাতায় নাম দিমু না। তয় কিসে দিবি নাম অ্যা? কথা কোস ন্যা ক্যা? বুঝছি, মুক্তিবাহিনীত নাম দিবি না? হ, নাম লেখাইলে মুক্তিবাহিনীতেই লেহাব। দ্যাশের সাথে বেঈমানী করব্যার পারব না নে।

উঁ। খুব ঈমানদার হইছস বুঝি? তোর মা-বউ, বাপাচাচার কি পরিণতি হবি ভাব্যা দেখছিস? কল্যাম তো, নাম দিলি মুক্তিবাহিনীত দেব। আমি তুমার সাথে নাই। অ্যা, কি কলিরে? আইচ্ছা, আমিও দ্যাখবনে তোর কত্ত সাহস।   নাসির বাড়ীর পাশেই ডোবায় খরা পেতে জাল দিয়ে মাছ ধরতো। মুক্তিযোদ্ধারা মাছ কেনার ছলে নাসির এর কাছ থেকে খবরা খবর নিয়ে যেত। গ্রামের ব্রীজের উপর পাকসেনাদের অবস্থাান নাসিরের কাছ থেকে জানার পর মুক্তিযোদ্ধারা ঐ ব্রীজ রাতে উড়িয়ে দেয় এক্সপ্লোসিভ বাষ্ট করে। অনেক পাকসেনা নিহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের এই সহযোগিতার খরব বুঝে ফেলে ধূর্ত কছিমুদ্দিন ও তার ছেলে মাঈনুদ্দিন।

সেদিন ছিল জ্যোৎস্নারাত। নাসির খরায় জাল পেতে নৌকার মধ্যে শুয়েছিল। হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে। এ সময়তো মুক্তিবাহিনীর কারও আসার কথা না! কিডারে? তুমরা কিডা? আমরা। ডরাইস ক্যা? আমি আইজক্যা মাছ মারব।

নাসির ধচমচ করে নৌকার গুদামের বাইরে আসে। তাকিয়ে দেখে, বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঈনুদ্দিন ও চার পাঁচজন রাজাকার। দূরে বুনো শুকরের মত চোঁয়াল বের করে কছিমুদ্দিন হাসছে। ইশারায় গুলি করতে বলে। দারুম্ দুরুম তিন চার রাউন্ড গুলি। নাসির লুটিয়ে পরে নৌকায়। রক্তে ভেসে যায় নৌকার চাটাই। জালের মাছগুলি লাফাতে থাকে। মাঝরাতে গুলির আওয়াজে গ্রামবাসী চমকে ওঠে। মিলিটারীর ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। জয়তুন ছুটে যায় নাসিরের খোঁজে।

নাসির তখন মৃত্যুর সাথে লড়ছে। নাসিরের মাথাটা কোলের উপর তুলে নিয়ে জয়তুন চিৎকার করতে থাকে। এসময় একজন মুক্তিযোদ্ধা আসে, তাদের নির্ধারিত সময়ের খবরাখবর নিতে। নাসির গোঙ্গাঁতে থাকে। আমার এ সর্বনাশ কিডা করলো। আল্লারে আমার এহন কি হবি। জয়তুন এর গগণবিদারী চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। নাসির অস্পষ্ট স্বরে শুধু বলে ক...ছি..মুদ্দি-ন। তারপর ঘুমিয়ে পরে অনন্তলোকে। এরপরও শেষ নেই।

একদিন গভীর রাতে কছিমুদ্দিনের সহযোগিতায় পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় জয়তুনকে। বাবা মা ছোট ভাই বাধা দেয়ায় পাখীর মত গুলি করে মেরে ফেলে সবাইকে। ছোট ভাইটি প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাড়ীর পেছনের দেবদারু গাছে উঠে লুকিয়েছিল। রাজাকার মাঈনুদ্দিন তা দেখে ফেলে। ওখানেই গুলি করেছিল। গুলিবিদ্ধ পাখীর মত ছটফট করে ভাইটি মারা গিয়েছিল। জয়তুনের আর কিছু মনে পড়ে না। অনেক রক্তের বিনিময়ে অবশেষে দেশ স্বাধীন হোল।

মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে মা বোনদের খোঁজ করতে লাগলো। অনেকের সাথে জয়তুনকে উদ্ধার করে গ্রামে পৌঁছে দিল। জয়তুন ফিরে এল নিজ গ্রামে। চোখে মুখে একরাশ ক্লান্তি, বিস্ময় আর বেদনা। ভিটে মাটি ছাড়া আজ আর কিছুই যে নেই তার। বাড়ীঘরও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল দুশমনরা। পোড়া ভিটেয় দুর সম্পর্কের এক চাচা একটা ছোনের ঘর তুলে আছে।

জয়তুনকে দেখে সাবাই ছুটে আসে। উস্কোখুস্কো বিভ্রান্ত জয়তুন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। সব চেনা মানুষগুলিই যেন আজ অচেনা লাগছে। সবাই কেমন উৎসুকভাবে তাকিয়ে দেখছে জয়তুনকে। হঠাৎ ভীড় ঠেলে এক মহিলা বলে ওঠে-ওমা, দেখ সগলে, জয়তুনতো পোয়াতী।

প্যাডে বাচ্চা। আর একজন বলে, কস্ বি এইডা তো দুশমনের জন্ম হবি। ছি ছি, জয়তুন ক্যামনে এইডারে পালবি? নানাজনের নানা কথার গুঞ্জন চলতে থাকে। জয়তুন অবুঝ কিশোরীর মত অসহায়ভাবে সবাইকে দেখতে থাকে। ভাবলেশহীন। নির্বাক। নিস্পাপ সে চাহনী।

ও জয়তুন, কই আছিলি এ্যাদ্দিন? তোর এই দশা লয়া ক্যামনে চলবি? আহ্ হারে, তোরে বাচাতি যায়াইতো তোর বাপ মা ভাই সবাই মরলো।

জয়তুনের দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কথা বলার ভাষা নেই। তোরে এহন ক্যাডা খাওয়াবি, পরাবি? জয়তুনের এহন ক্যাডা খাওয়াবি, পরাবি? নানাজনের নানারকম প্রশ্ন। জয়তুনের খাওন পিন্দনের চিন্তা তোগারে করব্যার লাগবি নানে। আমি আছি না?

ক্যা, আমি কি মরে গেছি? কছিমুদ্দিনের কথা শুনে সবাই চমকে ওঠে। কেউ খুশী হয়। কেউ চোখ উল্টিয়ে চলে যায়। শালা, রাজাকার আইছে আইজ দরদ দেখাব্যার। তুই কুনো চিন্তা করিস না জয়তুন। আইজ থেক্যা তোর ভরণ পোষণের সব দায়িত্ব আমার। তোর প্যাডের ডারও।

জয়তুন কছিমুদ্দিনের দিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গেঁর মত চেয়ে থাকে। রক্ত জবার মত লাল টকটকে বিস্ফারিত চোখ দেখে কছিমুদ্দিনের হৃদপিন্ড কেঁপে ওঠে। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে জয়তুন। কাউকে কিছু বুঝতে দেয়ার আগেই তাড়াতাড়ি লুঙ্গির কোঁচা উঁচু করে খট্খট করে কেটে পড়ে কছিমুদ্দিন। কছিমুদ্দিন খুব তোরজোড় করে ভালমানুষের মত জয়তুনের পোড়াভিটের এককোনে টিনের একটা ছাপড়া ঘর তুলে দেয়। খাবার দাবার সব কিছুই সরবরাহ করে।

বদমাইশ কছিমুদ্দিন রাতের গভীরে যখন তখন বিরক্ত করতে থাকে। ঘরের দরজায় টোকা মারে। ফিসফিস্ করে জয়তুনকে দরজা খুলে দিতে বলে। ঘুমের ঘোরে বুঝতে না পেরে একদিন জয়তুন দরজা খুলে দেয়। কছিমুদ্দিনকে এতরাতে দেখে চমকে ওঠে। জয়তুন মাথার পাশে বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখা চাপাতি উঁচিয়ে ধরে-হারামজাদা, লুচ্ছা, বদ-মাইশ!

কছিমুদ্দিন মুখ ঢেকে ছুটে পালায়। এরকম নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনার মধ্যে একদিন জয়তুনের কোল জুড়ে একটি ফুটফুটে ছেলের জন্ম হয়। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা আদর করে নাম রাখে বিজয়। হোক না সে শক্রপক্ষের ঔরষজাত। জয়তুনের রক্ত মাংসেই তো তীলে তীলে জন্ম নিয়েছে এ শিশু! জয়তুনতো স্বাধীনতার টকটকে লাল সূর্যের মতই প্রোজ্বল। স্বামীসহ পরিবারের সকলেইতো তার শহীদ হয়েছেন!

বিজয় দিনে দিনে বড় হতে থাকে। কছিমুদ্দিনের সাহায্যে জয়তুন শিকারীর মতই হিংস্র রোষানলে জ্বলে জ্বলে বিজয়কে লালন পালন করে। বিজয় এখন টগবগে জোয়ান পুরুষ। পাঠান, পাঞ্জাবীর মত উচুঁ, লম্বা, উদ্দীপ্ত শরীর। চেহারা দেখলেই জন্মের স্বাক্ষরতা যেন সহজে ফুটে ওঠে। বিজয়ের এমন বলিষ্ঠ টাগরা দেহ দেখে কছিমুদ্দিন তাকে তার পাহাড়াদার নিযুক্ত করে। কখনো কোন কাজে ব্যাঘাত ঘটলেই দাঁত খিঁচিয়ে বলে ওঠে শালা, জারুয়া পাঠানের বাচ্চা, ইঁহ্..... শরীর তো না, য্যান ক্ষ্যাপা কুত্তা। বিজয়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ করতে পারে না। মায়ের মুখে জন্মতিহাস সব জেনেছে। মাঝে মাছে নিজের জীবনের প্রতি ধিক্কার আসে। কাজে কর্মে, পাড়া প্রতিবেশীরাও পান থেকে চুন খসলেই জন্মের খোঁটা দেয়। অসহ্য যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করে। একদিন জয়তুনকে বলে-মা, চল আমরা দুরে কোন গেরামে চল্যা যাই।

কই যাবি বাজান? যেহানে আমার জন্মের খবর কেউ জানে না মা। যে যাই কউক বাজান, আমি আছি না? আমি তোর মা। ঐ রাজাকার কছিমুদ্দিনের একদিন চরম বিচার হবি। তুই দেহিস, উয়্যার চরম বিচার হবিই হবি। বিজয় আর কোন কথা বলে না। জয়তুন শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। বিজয় ও ধীরে ধীরে ক্রুদ্ধ সিংহের মত হিংস্র হতে থাকে। সুযোগ আসে একদিন। 

কছিমুদ্দিনের ছেলে মাঈনুদ্দিন একদিন মদ গাঁজা খেয়ে অনেক রাতে ঘরে ফিরে পাহাড়ায় না পেয়ে বিজয়কে ‘জারুয়ার বাচ্চা’ বলে গালি দিয়ে গালে কষে এক চড় বসিয়ে দেয়। বিজয়ের রক্তমাংস টগবগ করে ওঠে। ক্ষুধার্ত বাঘের মত গর্জে ওঠে। অপেক্ষায় থাকে। দিনের আলো ফুরিয়ে আসে। রাত গভীর হয়। অমাবস্যার কাল রাত। অন্ধকার। চারিদিক নিরব নিস্তব্দ। সারা গাঁয়ের সবাই ঘুমিয়ে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই।

বিজয় পা টিপে টিপে, কোমরে ধারালো ছুড়ি গুঁজে অতি সন্তর্পনে এগুতে থাকে। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। কছিমুদ্দিনের ঘরের পাশে এসে কোমর থেকে ছুড়িটা বের করে শরাৎ করে। চকচক করে ওঠে রাতের অন্ধকারেও। এক পা দু’পা করে এগুতে থাকে। জানালাগুলো বন্ধ। তবে দরজাটায় সামান্য ফাঁক রয়েছে। শালা মাঈনুদ্দিন মদ গাঁজা খেয়ে গভীর রাতে বাড়ী ফেরে। কছিমুদ্দিন তাই ছেলের জন্যে দরজাটা সব সময় চাপিয়েই রাখে।

বেহুশ মাইনুদ্দিনের দরজা লাগাবার মত হুশজ্ঞান থাকে না। সারারাত ঘরের দরজা এমনি চাপানো অবস্থাায়ই থাকে। বিজয়ের এসব জানা। বিজয় ক্রুদ্ধ মেজাজে ছুড়ি হাতে দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। মা....। চিৎকার করে ওঠে বিজয়। জয়তুন ধারালো বটি হাতে রক্তাক্ত শরীরে। রাক্ষুসীর মত দাঁড়িয়ে আছে। সারা বিছানা রক্তে ভাসা। কছিমুদ্দিনের গলা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন। জিহ্বা বেরিয়ে আছে। চক্ষু উৎপাটন। কি বিভৎস দৃশ্য।

বিজয় কাঁপতে থাকে। মা, এ তুমি কি করলে? আমি না করলে, তুইতো করতি। তুই ক্যা খুনী হবি বাজান? এই সময় টলতে টলতে মাতাল মাইনুদ্দিন ঘরে ঢোকে। জয়তুন ও বিজয়কে এভাবে দেখে চিৎকার করে ওঠে, শালা জারুয়ার বাচ্চা আমার বাপকে খুন করছস? 

...খুন....খুন।

বিজয় একলাফে গলা চেপে ধরে। জবাই করার জন্য উদ্দত হতেই, জয়তুন বিজয়ের হাত থেকে ধারালো ছোড়াটি কেড়ে নেয়। উন্মুত্ত জয়তুন লাঞ্চনা, গঞ্জনার রোসানলে রক্তপিপাসু পশুর মত হিংস্র হয়ে ওঠে। এককোপে মাইনুদ্দিনের ধরের অর্ধেক কেটে ফেলে। মাইনুদ্দিন গোঙ্গাঁতে থাকে। ফিনকী মেরে রক্ত ঝরে। মনে পড়ে যায় তার অতীতের স্বামী হারানো নৃশংস ঘটনা। জয়তুন আরও ক্রুদ্ধ হয়। ছুড়ি দিয়ে টান মেরে মাথা আলাদা করে ফেলে।

হতবিহবল বিজয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা কছিমুদ্দিনের শান বাঁধানো পুকুরে নেমে পড়ে। ছুড়ি বটি পুকুরের মাঝখানে ঢিল মেরে ফেলে দেয়। বর্ষার ভরা পুকুরে তিরতির করে তলিয়ে যায়। দুজন সাড়া শরীরের রক্ত ধুয়ে মুছে ঘরে ফেরে। সারা রাত বৃষ্টি হয় মুষলধারে।

ভোর বেলা গ্রামে হৈ চৈ পড়ে যায়। জোড়া খুন...জোড়া খুন...।

এই....এই...নামো তোমরা। থানায় এসে গেছি। কনষ্টেবলের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে জয়তুনের। মা.... নাম এইখানে। বিজয় মায়ের হাত ধরে নামায়।

হাতকড়া পড়া জয়তুন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে বিজয়কে। অরা আমার বিজয়কে সারাক্ষণ জারুয়া কয়া গালিগালাজ করে। ক্যা.... আমার বিজয় জারুয়া হবি ক্যা? আপন মনেই বিড়বিড় করে জয়তুন। কোর্টে জয়তুনের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জয়তুন হরহর করে জীবনের আদিঅন্ত সমস্ত কিছুর বর্ণনা দেয় অকপটে। মুক্তিযুদ্ধের এক জলন্ত ইতিহাস। বিচারক জজ সাহেব সমস্ত কাহিনী শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান।

অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন। চিকচিক করে ওঠে দুচোখের কোন। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বড়ভাই, বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। রাজাকাররা তাঁর ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। একমাত্র আদরের ছোট বোন বিধবা। জয়তুনের মধ্যে যেন সে তার বোনের প্রতিচ্ছবিই দেখতে পান।

হুজুর...!

এ যেন তারই বোনের ব্যাকুল আকুলতা। জয়তুনের ডাকে চমকে ওঠেন জজ সাহেব। হুজুর, আমার সব কথাই তো শুনলেন। এহন আপনিই কন হুজুর, আমার বিজয় কি জারুয়ার বা”চা? ক্যা, আমি তো যুদ্ধে আমার জেবনের সবকিছুই হারাইছি হুজুর। মা, বাপ, স্বামী, ভাই, সবাইরে। মুক্তিযুদ্ধে আমি নিঃস্ব হইছি। আমি কি মুক্তিযোদ্ধা না? বিজয়ের শরীলে, দুশনের রক্তের সাথে আমার রক্তও তো আছে হুজুর?

তয় বিজয় ক্যা জারুয়া হবি? সে তো যুদ্ধের সন্তান হুজুর! জয়তুন চিৎকার করে বলতে থাকে। জজ সাহেবও এক অজ পাড়াগাঁয়ের অবুঝ সহজ সরল জয়তুনের মুখ থেকে এত বড় সত্য কথাটি শুনে স্তব্দ হয়ে যান। সবাই যাকে জারজ সন্তান বলে ধিক্কার দেয়, ঘেন্না করে, আসলে সে তো মুক্তি যুদ্ধেরই সন্তান। নানা অত্যাচার অবিচার, ধিক্কার, অবহেলায় দিনে দিনে জয়তুন ও বিজয়ের হৃদয় হিংস্র থেকে হিংস্র হতে হতে আজকের এই পরিণতি। কিন্তু আইনতো তার নিজস্ব গতিতেই চলে।

জজ সাহেব তার বিচার কর্ম চালিয়ে যান। আদালতের চার দেয়ালে যেন ঝংকৃত হয়-হুজুর, সে তো মুক্তিযুদ্ধের সন্তান।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top