সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প-০৩:  চাঁদনী : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:৪৪

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২০:২৫

 

গ্রামের নাম ছোনদহ। ছোট্ট একটি গ্রাম। সাজানো গোছানো।

ছোনের ছাউনী দেয়া নারকেল পাতা কিংবা পাটের শোলা দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট ঘর।  সহজ সরল এ গাঁয়ের মানুষ।  কখনো কেউ বেড়াতে গেলে অতি দরিদ্র একটি বাড়ীতেও মুড়ি-চিড়া, নারকেলের নাড়– দিয়ে অতিথী আপ্যায়ন করে তারা।  তার সংগে থাকে চালের গুড়োর রুটি হালুয়া আর মুরগীর ঝোল মাংস। বন্ধু নিরবের মুখে এসব লোভনীয় গল্প শুনে শুনে আবীর এর খুব এই গ্রামে যাবার ইচ্ছে হোত।

যেন রূপকথার গল্প।  একদিন সত্যি সত্যিই আবীরের সে সুযোগ এল। নিরব হঠাৎ করে আবীরকে অনুরোধ করলো তাদের সেই স্বপ্নপূরীতে যাবার জন্য।  কিন্তু আবীর কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, নিরবের বাবা মৃত্যু শয্যায়। অথচ সে নিজে না গিয়ে কেন আবীরকে অনুরোধ করছে?

প্লিজ আবীর, তুই অমত করিস না। নিরব এ সময় তোর বাবার কাছে তোকেই যেতে হবে। তোরই থাকা বেশী  প্রয়োজন তার কাছে। তুই যাবি কিনা বল। না হলে অন্য ব্যবস্থাা করতে হবে আমাকে।  স্বাধীনতার পর থেকে নিরব ও আবীর একসাথে চাকুরী করছে। আবীরের জেদ সম্পর্কে জানা আছে নিরবের। শেষে কিনা এই বয়সে সম্পর্ক নষ্ট হবে।

ঠিক আছে আমিই যাব।

থ্যাঙ্ক দোস্ত। দেখবি আমাদের গ্রামটা তোর কত ভাল লাগে। শুধু ভাল লাগবে না একটি পরিবারকে।

মানে?

তুই সাংবাদিক। গেলেই বুঝতে পারবি। স্যার কি ভাবতিছেন এত? উঁ! রিকসায় উঠলেন। খালি কল্যান ছুনদাও যাব্যান। রিকসার টুংটাং আওয়াজ ভালই লাগছিল।  জোৎস্না রাত্রি। মৃদুমন্দ বাতাস।  রিকসাওয়ালার কথা শুনে মনে হোল-তাইতো, কার বাড়ী যাচ্ছি তাতো বলা হয়নি ওকে! হঠাৎ রিকসাওয়ালা মিষ্টি দরাজ কন্ঠে গান জুড়ে দিল। ও আমি কি চাইলাম, আর কি পাইলাম, সখী এই ভব সংসারে রে....

তোরে আমি না পাইলাম
না হইলাম গৃহমুখীরে।
এ জেবনে আর বুঝি হায়
সুখের দেখা পাব নারে
ও আমি কি চাইলাম
আর কি পাইলাম সখী
এই ভব সংসারে রে.....

তোমার মনে এত কষ্ট কেন ভাই?

অ্যা? কিছু কল্যান স্যার আমাক?

এত সুন্দর রাতে এমন মন উদাস করা গান গাইছ ক্যান?

না, না, স্যার, এ্যাম্বাই.... (এমনি)। স্যার আগে কুনদিন এই গেরামে আর আইছ্যান? আপনেরে নতুন দেখতিছি তো?

এ গ্রামে আজই প্রথম এলাম। তবে গ্রামে আমি অনেক গিয়েছি চাকরীর প্রয়োজনে।

আপনি কি চাকুরী করেন স্যার?

খবরের কাগজে, খবর সংগ্রহ করি।

এ্যা? স্যার আপনি সামবাদিক?

হ্যা। সাংবাদিক।

আমার একখান খবর ছাপাইব্যান স্যার?

তোমার আবার কি খবর?

না, মানে এই গেরামের খবর। এক্কেবারে সত্যি ঘটনা স্যার।

তাই নাকি?

হ’ স্যার। স্যার আপনি মুক্তিযুদ্ধ দ্যাখছেন? বল কি? মুক্তিযুদ্ধ দেখব না মানে? আমি তো মুক্তিযোদ্ধা! তাই নাহি? তাহলি তো আরো বালো হলো স্যার। ঘটনাটা ঐ সময়ের। এই গেরামের ঘটনা।  তাই বুঝি? হ স্যার। শুনবেন? নিশ্চয়। বল তুমি। আবীর নড়েচড়ে বসলো। রিকসাওয়ালা বলে চললো। তখন স্যার এরহম পাকা রাস্তা, কারেন্টের আলো ছেল না এই গেরামে। কাঁচা রাস্তা ছেল।  অন্ধকার। সন্ধে হলিই শিয়াল ডাকতো হুক্কাহুয়া কর‌্যা। কিরাসিন বাতির আলো জ্বলতো ঘরে ঘরে।  এই গিরামের এক চাষার ছাওয়াল সুরুয।

আর এক চাষার মিয়া চাঁদনী। চাঁদের মতই রূপ ছেল তার। গরীবের ঘরে জন্ম হলিউ রূপের জন্য বাপ মা সখ কর‌্যা চাঁদনী কয়া ডাইকতো। খুব চঞ্চল ছেল স্যার। স্যার, আমার কথা শুনতিছ্যান? হ্যা, হ্যা, শুনছি বল।  সারাদিন চৈ চৈ কর‌্যা সারা গাঁও ঘুরে বেড়াত চাঁদনী।  আর সুরুয মাঠের কাম কাইজ শ্যাষ কর‌্যা বাঁশী বাজাতি বাজাতি গরু নিয়া ঘরে ফিরতো সন্ধ্যা বেলা।

এই বাঁশীর সুর চাঁদনীর মন কাড়ছিল স্যার। বাঁশীর সুর শুনলেই চাঁদনী ছুটে আসতো। মিটা কর‌্যা জিগাইত- সুরুয বাই, তুমার সুর এত মিডা ক্যা?

সত্যি কইছিস?

সত্যি, না তো মিছা নাকি? কইয়াই ছুট।

এইরকম ছুটাছুটির খরব সারা গেরামের ব্যাবাক মানুষ জান্যা ফেললো একসময়।

গেরামের পেরেম বালবাসা বড়ই কঠিন স্যার।

তাই বুঝি?

হ’ স্যার। সবাই চাঁদ সুরুযের বিয়ার ব্যাপারে খুশী হলিউ এক ফেরেপবাজ শয়তান বাধ সাধলো।

কে সে? এ গেরামের চেয়ারম্যান।  দোর্দন্ড প্রতাপ তার।  বড়ই বদমাইশ লোক। তার হুকুম ছাড়া এ গেরামে কেউ পেরেম কর‌্যা বিয়া করবার পারবো না। কড়া হুকুম তার।

সুরুয এ হুকুম মানলো না।  তার এ অন্যায় কথার বাধা পাড়ি দিয়া যেদিন চাঁদনীর সাথে বিয়ার দিনক্ষন ঠিক হলো, হঠাৎ ঐ সুময় খবর আইলো- রেডিওতে, শ্যাখ মজিবর নাহি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য দ্যাশবাসীদের ডাক দিছে। দ্যাশের অবস্থাা খুব খারাপ। খুব বড় গন্ডগোল হবি।

গেরামের মানুষ ভয়ে পালাবার লাইগলো। তারপর, চাঁদ সুরুযের বিয়া আর হইল না স্যার।

তারপর কি হলো? গেরামের অনেকেই যুদ্ধে গেল। তাগর সাথে সুরুযও গেল যুদ্ধে। চাঁদনী ঘাবড়ায়া গ্যাল।

তুমার সাথে আবার কবে দেখা হবি? যদি আমরা মর‌্যা যাই? ছি, ছি, এমন কথা কোস ক্যা চাঁদ? দ্যাশ স্বাধীন হলি আমাগর বিয়াত ঐ শয়তানডা আর কোন কিচ্ছু করব্যার পারবি না নে। দোয়া করিস, তাড়াতাড়ি য্যান আমরা দ্যাশ ডারে স্বাধীন কইরব্যার পারি।  ছোড মানুষ তো, কান্দ্যা কান্দ্যা আকুল হলো চাঁদনী। বিদায়ের সুমায় অর সহজ সরল ভাসা ভাসা চোখের কান্না, আইজও সুরুযের মনে ঝড় তোলে স্যার। অন্তরডা দুমড়ে মুচড়ে ফালাফালা করে দেয়।

পরে ওদের বিয়ে আর হয়নি বুঝি? না স্যার। দ্যাশ ঠিকই স্বাধীন হইছে। বড় বড় নেতারা আরো বড় অইছে। কুটি কুটি ট্যাহার মালিক অইছে। তারা নাকি বড় মুক্তিযোদ্ধা।  আর সুরুজ তো চাষাভুষার ছাওয়াল, ছোড মুক্তিযোদ্ধা। না হইলো সে কুটি টাকার মালিক। না অইল তার চাঁদনীর সাথে বিয়া।

বিয়ে হোলনা কেন ওদের?

ঐ যে কল্যাম না, গেরামে একডা শয়তান শকুন ছেল? বুড়া শকুন। ঐ শকুনডা চাঁদনীরে পাকবাহিনীর হাতে ধর‌্যা দিছিল স্যার!

সে নাকি গেরাম রক্ষা করব্যার জন্য এ কাম করছিল। সে রাজাকার আল বদরের বড় নেতা হইছিল ঐ সুমায়।  শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান।

চাঁদনীরে পাকি শকুনরা খাবলাইয়া খাবলাইয়া খাইছিল। বলতে বলতে রিকসাওয়ালা হঠাৎ রিকসাটা অন্য রাস্তায় ঘুরিয়ে নেয়।  একি, রিক্সা কোথায় নিয়ে যাও? কাঁচা রাস্তায় যাচ্ছ ক্যান? ও দিকতো অন্ধকার।

ওরে বাবা, বিশাল বাঁশঝাড়। রিক্সা ঘুরাও। এ...ই...রিক্সা, ঘুরাও।

ভয় পাব্যান না স্যার। আপনে না সামবাদিক।

তাতে কি? চাঁদ সুরুযের গল্পটার শ্যাষটুকু না শুনলে, কাগজে ছাপব্যান ক্যামনে? স্যার, এই বাঁশ ঝাড়টার মধ্যেই চাঁদনীর ছিন্নভিন্ন বেবস্ত্র লাশ পাওয়া গেছিল।

সেই দিন ছেল ১৪ ডিসেম্বর। দ্যাশ স্বাধীনের ঠিক দুইদিন আগে।  আর লাশটা পেরথম সুরুযের চোখেই পড়ছিল স্যার। রিক্সাওয়ালা হাউমাউ করে কেঁেদ ফেলে।

আবীরের চোখেও জল আসে।  চাঁদের আলো বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে বাতাসের শিরশির শব্দে বাঁশ পাতায় দোল খেয়ে খেয়ে, রিক্সাওয়ালার চোখে মুখে ছিটকে ছিটকে পড়ে। আবীর দেখে, রিক্সাওয়ালা বাঁশ ঝাড়ের পাশে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।

স্যার, আপনারে কষ্ট দিলাম। না, না, ঠিক আছে।

এই পথ দিয়া গ্যালেই মনে কয়, চাঁদনী বুঝি ঐ খানে দাঁড়ায়া আছে। গেরামের ব্যাবাক মানুষ এই পথে গ্যালে এইখানে আস্যা থমকে দাঁড়ায়।  সুরুয কিভাবে চাঁদনীর লাশ দেখেছিল?

মাঝে মাঝে অপারেশনের আগে পলায়া মাথাল মাথায় কাচি হাতে ছেঁড়া লুঙ্গিঁ পর‌্যা কামলা সাজ্যা চাঁদনীর সাথে দেহা করতো সুরুয এইখানে। চাঁদনী অনেক গোপন খবর দিত মুক্তিযোদ্ধাদের। সে খবর বহু অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছে।  ঐ রাজাকার শকুন জানতে পারছিল সে কথা। এরপরই পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয় চাঁদনীরে। অরা অত্যাচার করে বেবস্ত্রভাবে মার‌্যা ঝুলায়া রাখছিল একটা মোটা বাঁশের সাথে এই বাঁশ ঝাড়ে।

সেদিন রাতে দেখা করব্যার আস্যা চাঁদনীর লাশ দেখ্যা চিৎকার করার সাহাসটুকুও ছেল না তার।

দুইদিন পরই দ্যাশ স্বাধীন হলো।  আইজ চাঁদনী নাই। চাঁদনী রাইত আছে স্যার। কেমন ফকফকা জ্যোস্না। আইজক্যার তারিখটাও ১৪ ডিসেম্বর।

তাই তো! স্যার, কি অদ্ভুতভাবে এইদিনে আপনের সাথে আমার দ্যাখা হয়া গ্যাল। গাঁও গেরামের গল্প! আপনার কাছে কয়া ইট্টু হালকা হলাম আর কি। স্যার, গল্পডা ছাপাইব্যান তো?

নিশ্চয়! নিশ্চই ছাপাবো।  আচ্ছা, তুমি ঐ শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যানের নামটা কি বলতে পার?

পারবো না মানে? কন্ কি স্যার? কি নাম ঐ শয়তানটার? স্যার, যুদ্ধের সময় রেডিওর মধ্যে জল্লাদের দরবার শুনছেন না? হ্যা, হ্যা, খুব শুনেছি। জল্লাদের দরবার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হোত।

ঐ বুড়া শকুনডার নাম, সেই আগায় খাঁন পাছায় খাঁন “খাঁন মোহাম্মদ জমিরুদ্দিন খাঁন।”

অ্যাঁ, কি নাম বললে? শয়তানডারে চেনেন নাকি স্যার? আবীর স্তব্দ হয়ে যায়।  কোনো কথাই বলতে পারে না।  এই বুড়ো শকুনটাই তবে, নিরবের বাবা? কিন্তু...... নিরবতো মুক্তিযোদ্ধা। অফিসে একজন প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে পরিচিত।  স্যার, ও স্যার শুনতিছ্যান?

উঁ...। বল শুনছি। এই বদমাইশডার ছাওয়াল কিন্তুক মুক্তিযোদ্ধা। আমাগো নিরব ভাই। বড় বাল মানুষ। নিরব ভাইয়ের ডাকেই তো সুরুয যুদ্ধে গেছিল।  গেরামের ব্যাবাক জুয়ান ছাওয়ালগরে এক কর‌্যা দল বাঁধ্যা যুদ্ধে গেছিল। দ্যাশ স্বাধীন হলো।

নিরব বাই ঘরে ফির‌্যা দ্যাখলো, বাপ তার সবচে বড় দুশমন। বুকের মধ্যে বন্দুকের নাল ঠ্যাকায়া গুলি কর‌্যা মারব্যার গেছিল বাপকে। মায়ের বাধা পাওয়ায় গুলি করে নাই। কিন্তুক....।

কিন্তু কি? বাপের কীর্তিকলাপের কথা শুন্যা, ক্ষোভে, লজ্জায়, ঐ যে গেরাম ছাড়্যা চল্যা গ্যাছে, কুনদিন আর সে এ গেরামে আসে নাই। শুনত্যাছি, এহন ঐ ব্যাডা মৃত্যুশয্যায়।

খবরের পর খবর দিয়াও ছাওয়ালের আনব্যার পারতেছিনা। মরার আগে শালা নাহি ছাওয়ালের কাছে মাফ চাবি।  স্যার, নিবর বাইও নাহি সামবাদিক। সেও ঢাকায় থাহে। তারে চেনেন স্যার? উঁ...। রিক্সা ঘুরাও।

ঘুরাব ক্যা স্যার? কার বাড়ী যাব্যান, কিছুই তো কল্যান না? গেরামতো শ্যাষ পেরায়।  এরপর আর এক গেরাম। জোড়গাছা। তুমি আমাকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছ, সেখাইনেই নিয়ে চল।  কন কি স্যার? এহন তো অনেক রাইত!

হোক যত রাত। আমি যেতে পারব। আচ্ছা, তুমি ঐ মুক্তিযোদ্ধা সুরুযকে চেন? হ’ স্যার চিনি। এ গেরামের ছোড বড় এমন কেউ নাই যে তারে চেনে না।  সুরুয এখনো বেঁচে আছে? হ’স্যার। সুরুয অহনো বাঁচ্যা আছে। না বাঁচ্যা থাকলি, স্বাধীনতার এত বছর পরে, আপনার মত মানুষের সাথে তার দেখা হতো ক্যামনে?

অ্যা..... তবে কি... তুমিই সেই! রিক্সার টুং টাং শব্দে, রিক্সাওয়ালা আপন মনে আবার গেয়ে চলে-

ও... আমি কি চাইলাম... আর কি পাইলাম... ওরে... এই ভব সংসারে....!!

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top