সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প-০৪;  খোঁজ : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:৫১

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২০:২১

 

ড্যানীর মনটা আজ খুব খারাপ। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে গ্রান্ডফাদার মারা গেলেন।

জীবন দিয়ে জর্জ টমাস ভালবাসতেন ড্যানীকে।

ড্যানীও গ্রান্ডফা’ ছাড়া যেন কিছুই বুঝতো না। তার জীবনের স্বপ্ন সাধনা সবই যেন গ্রান্ডফা’কে নিয়েই। পৃথিবীর সবরকম আদর স্নেহেই যেন গ্রান্ডফা তাকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল।

কিন্তু মারা যাবার আগে জর্জ টমাস ড্যানীকে কাছে টেনে যে কঠিন সত্যকথাটি বলে গেলেন, ড্যানী তাতে দিশেহারা। তার এতদিনের ভাবনা চেতনা সব যেন অন্য রকম হয়ে গেল।

অনেক কথা চেপে রেখে বুকটা পাথর হয়ে গেছেরে! মাঝে মাঝেই গ্রান্ড ফা এই কথাটি কেন যে কলতেন। এখন ড্যানী তা বুঝতে পারছে। এতবড় সত্যটাকে গ্রান্ড’ফা কেন চেপে রেখেছিল এতদিন? ড্যানী কিছুই ভাবতে পারে না।

দু’চোখ পানিতে ভরে যায়। আজ সে একেবারেই অসহায়। তুমি কেন নিজেকে এত অসহায় ভাবছ ড্যানী? আমরা কি তোমার কেউ নই? ড্যাড্ তোমার কি হয়েছে? ড্যানীর স্ত্রী মেরী ও মেয়ে লারা এসে পাশে বসে।  গ্রান্ড’ফা কেন এতদিন এসব কথা আমাকে বলেননি। বলেত পার মেরী? হয়তো সে ভেবেছে, তুমি কষ্ট পাবে, তাই। কিন্তু...এখন যে আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছি।

কোন কষ্ট নয়। চল আমরা বাংলাদেশে যাই। ওখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। আমরা সবাই মিলে তোমার মাকে খুঁজে বের করবো। সত্যি বলছো? সত্যি বলছি ড্যানী।  পারবে আমার মাকে খুঁজে বের করতে?

নিশ্চই। চেষ্টা করতে দোষ কি? পৃথিবেিত কত কঠিন কাজইতো মানুষ করে।

মেরী তুমি জাননা। আজীবন জেনে আসছি, আমার মা বাবা বেঁেচে নেই। অথচ দেখ, কি অদ্ভত আমার জন্ম পরিচয়।  গ্রান্ড’ফা যখন এসব কথা আমাকে বলছিলেন, মনে হচ্ছিল তিনি বুঝি যুদ্ধের মাঠে বসে কথা বলছেন।  তোকে অনেকবার বলতে চেয়েছি, মাই চাইল্ড।

কি বলতে চেয়েছ গ্রান্ড ফা? মাঝে মাঝে তুমি কি যেন বলতে চাও, অথচ বলনা।

আজ বলবো তোকে। বলতেই হবে। নইলে, একজনার কাছে বড় অপরাধী হয়ে থাকবো আমি। তাকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে।

সে কে গ্রান্ড’ ফা? তোর মা।  কি বলছো তুমি গ্রান্ড’ ফা? বিশ্বেস হচ্ছে না তো! না হবারই কথা।  সবকিছু খুলে বল।  বড় দুঃখীনি, অসহায় এক নারী । তোর জন্মদাত্রী মা।  কোথায় আমার মা? বেঁচে আছেন এখনো? হয়তো আছে। হয়তো বা নেই।  কোথায় থাকে সে বল তুমি গ্রান্ড’ফা! আমি তাকে খুঁজে বের করবো। পারবি তুই তাকে খুঁজে বের করতে? পারব, বল তুমি।

বাংলাদেশের এক অজয়পাড়াগাঁয় থাকে সে। আমার ডায়েরীতে তার নাম ঠিকানা লেখা আছে মাই বয়। আমেরিকায় তোর জন্ম নয়। তুই এক বাঙ্গাঁলী নারীর গর্ভে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছিস।

কি অদ্ভুত সব কথা বলছো গ্রান্ড’ফা! অদ্ভুত শোনালেও কঠিন সত্যি এ ইতিহাস। তখন ১৯৭১ সাল।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিকতার দায়িত্বে ছিলাম আমি। সে সময় স্বাধীনতার সংগ্রামে সারাদেশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।  বোমা বারুদ, গোলাগুলি চলছে পাকসেনাদের সাথে বাঙ্গাঁলীদের। গ্রামের  লোকজন ছুটে পাল্লাচ্ছে জীবন বাঁচাতে। শহর থেকে ছুটেছে।  শুধু মানুষ, মানুষ, আর মানুষের মিছিল। পাকবাহিনী ছেলেদের গুলি করে মারছে। আর মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে নিজ নিজ ক্যাম্পে।

ওদের সহযোগিতার জন্য বেঈমান রাজাকার আলবদর বাহিনী গড়ে উঠছে গ্রামে গ্রামে। ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।  মুক্তিবাহিনী সন্দেহে যে কোন যুবক ছেলেকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। বিভৎস মানুষের লাশ পড়ে আছে রাস্তায়।  শিয়াল কুকুর টানাটানি করছে। মাটিচাপা দেয়ার লোক নেই। সে এক বিভীষিকাময় দুশ্য।  একটানা নয় মাস যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয় বাংলাদেশ নামে।  স্বাধীন স্বার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বিকৃতি পায়। লোকজন যে যার ঘরে ফিরে আসতে লাগলো।  মুক্তিবাহিনীরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে মা বোনদের খোঁজ করতে লাগলো।  

আমিও ছিলাম যে সময় ওদের সাথে। একটি ক্যাম্পের পাশে হঠাৎ একটি মেয়ের কান্না শুনে থমকে গেলাম। বিবস্ত্রবস্থায় জড়ো-সড়ো হয়ে বসে আছে। আমার গায়ের জ্যাকেটটি ছুড়ে দিলাম। জড়িয়ে নিল গায়।  ফুট-ফুটে সুন্দর একটি মেয়ে। ঠিক যেন মুন। পাশবিক অত্যাচারে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ। ঝাঁকড়া চুলের রুক্ষতায়ও ওর লাবন্য শেষ হয়ে যায়নি।  ডাগর ডাগর চোখগুলিতে আতঙ্কের ছাপ। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

ভয় পেও না বোন। আমরা তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি। ভয়ে ও কুঁকড়ে গেল।  অভয় দিয়ে বললাম- তোমার বাড়ী কোথায়? বেশ ক’বার জিজ্ঞেস করার পর বললো-আমার কুন বাড়ীঘর নাই। এই দ্যাশডাই এহন আমার বাড়ী।  এক মুক্তিযোদ্ধা ভাই এগিয়ে এল।  কেডারে, হাস্না না? কেডা? মানিক বাই? হ’, হ,। চিনছস হাস্না? না, না। আমি হাস্না না। হাস্না মর্যা গ্যাছে।  কেউ মরে নাই হাসু। চল, তোমাকে আমি গেরামে নিয়া যাব।  না, না। সেহানে তো আমার আর কেউ নেই। সবাই আমারে ঘেন্না করব। টিটকেরী মারবো। আমার প্যাডে বাচ্চা। তুমরা মার্যা ফ্যাল আমারে। ঐ বন্দুকটা দিয়া গুলি কর মানিক বাই। গুলি কর। কান্নায় ভেঙ্গে পরে হাস্না।

তুমার কিচ্ছু হয় নাই হাসু। চল, আমার সাথে চল।  মুক্তিযোদ্ধা ভাইটি হাস্নাকে গ্রামে নিয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু হাস্নার সেখানে ঠাঁই হোল না। বিদ্রƒপ আর অপমানে অতিষ্ট হয়ে উঠলো হাস্না।  এক সময়ের চঞ্চল প্রাণবন্ত কিশোরী হাস্না ধিকৃত হোল সমাজে। খেলার সাথীরা সবাই দূরে সরে গেল। সবাই বাঁকাচোখে তাকায় আড়াল থেকে। যেন মহাপাপ করেছে হাস্না।

পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছে বাপ, চাচা, ভাই। বিধবা মা রছিমন মুখ থুবরে পড়ে থাকে ভিঠে মাটিতে। কেউ খাবার দিলে খায়। না দিলে উপোষ।  তিন ছেলের পর বড় প্রিয় এই মেয়ে হাস্নার জন্ম। আদরের ধন। স্বামী, ছেলের মত মেয়েও মারা গেছে ভেবেছিল রছিমন।  রছিমন আজো ভুলতে পারে না সে দৃশ্য। চোখের সামনে রাজাকাররা তিন ছেলেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেল।

বাধা দেয়ায় স্বামী রজব আলীকে গুলি করে মারলো। ঘরের পালা হাঁস মুরগীর মত দাপিয়ে দাপিয়ে মারা গেল রজব আলী। মুখে এক ফোঁটা পানিও দিতে পারে নাই রছিমন।  হাস্নাকে নিয়ে গেল গাড়ীতে উঠিয়ে। চিৎকার করে সবাইকে ডাকল। কেউ বাধা দিতে সাহস পায় নাই। তারপর থেকে রছিমন জানে হাস্না মারা গ্যাছে। হঠাৎ হাস্নাকে দেখে চমকে ওঠে।

কি সর্বনাশ! আমার কইলজার টুকরা ফুটফুটা চাঁদের আলো হাসুর এ কি অবস্থা। শোকে ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠে রছিমন।  তোরে ম্যারা ফ্যালে নাই ক্যা? তুই অহনো বাঁচ্যা আছিস ক্যা? মরবার পারিস নাই?

মা, মাগো...।  হাস্না দৌড়ায়ে যায় মায়ের কাছে।  রছিমন সরিয়ে দেয়। হাস্নার পেটের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচিয়ে বলে-

সড়। আমার সামন থেক্যা চল্যা যা? তোর প্যাড দ্যাখলে আমার ঘিন্না লাগে। যা তুই, আমার চক্ষের সামনে থেক্যা চল্যা যা একবারে। হ, হ, তুই গেরাম ছাড়্যা যেহানে ছিলি এ্যদ্দিন, সেহানে চল্যা যা হাসু। মুখ দেহাবি ক্যামনে? ছি। রছিমনের সাথে গ্রামের আরও কয়েকজন মহিলা যোগ দেয়।

রছিমন কইলজার টুকরা হাসুকে তাড়িয়ে দেয় চিৎকার করে। উচ্ছৃঙ্খল কিছু মহিলা থুঁ থুঁ দেয় হাস্নার গায়ে। ধাক্কা মারে হাস্নাকে।  অসহায় হাস্না রাস্তায় পড়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে সবাইকে। কেমন অচেনা, সব চেনা মানুষগুলি।  ড্যানীকে এসব কথা বলতে বলতে থেমে যায় জর্জ টমাস।

তারপর? তারপর কি হোল গ্রান্ডফা? দূরে দাঁড়িয়ে আমি সব দেখছিলাম।  হাস্নার অসহায় মুখ দেখে বড্ড মায়া হোল আমার। বললাম- আমার সাথে যাবে হাস্না? ও যেন বেঁচে থাকার আশ্বাস পেল।

এরপর আমি হাস্নাকে নিয়ে চলে এলাম ঢাকায়। সে আমাকে বাবার মত শ্রদ্ধা করতো।  একমাস পর একটি ক্লিনিকে তোর জন্ম হোল। আর একটি মুখ। আমার আর এক নাম ডন। হাস্না এই নামের সাথে মিল রেখে তোর নাম রাখলো ড্যানী।

কিছুদিন পর হঠাৎ সেই মুক্তিযোদ্ধা ভাই মানিক এল হাস্নার খোঁজে। হাস্নাকে বিয়ে করেত চাইলো। হাস্না কিছুতেই রাজী হয় না।  অনেক বোঝানোর পর একশর্তে রাজী হোল। আমাকে বললো- আমার ছেলেডারে তুমি তুমার দ্যাশে নিয়া তারে লেহাপড়া শিখায়া মানুষ করবা।  তুমি আমার বাপের লাহান। আমারে কতা দাও!

আমি হাস্নাকে কথা দিয়েছিলাম মাইচাইল্ড। তোকে নিয়েই তাই জীবনটা কাটালাম।  এতবড় ঘটনা, এত বছর ধরে কেন তুমি চেপে রেখেছিলে, গ্রান্ড ফা? হাস্না যে আমাকে আরো বলেছিল-মৃত্যুর আগে ছাড়া তুমি আমার ড্যানীকে তার জন্মইতিহাস বলবা না। ও য্যানো সব শুন্যা আমারে ঘেন্না না করে।

এখন বল। তুই তোর মাকে কখনো ঘেন্না করবি না? বল বল ড্যানী...। গ্রান্ড ফা... গ্রান্ড ফা....।  এভাবেই জর্জ টমাস ড্যানীকে সব জানিয়ে চলে যায় ওপারে! ড্যানী...! উঁ! ড্যা! ড...! বল মাই বেবী।  মেরী ও লারা সব ঘটনা শুনে ড্যানীকে বলে-চল আমরা সবাই বাংলাদেশে যাই।  লারা ড্যানীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে-ড্যাড্ আমরা সবাই মিলে গ্রান্ড মামকে খুঁজে বের করবো।

এরপর একদিন মেরী ও লারাকে নিয়ে ড্যানী দুর্দান্ত সাহস আর উৎসুক মন নিয়ে গর্ভ ধারিনী মায়ের খোঁজে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে আমেরিকা থেকে বিমানে রওয়ানা হয়।  বিমানে উড়ে আসে ড্যানী বাংলাদেশে।

সবুজ সোনার দেশ! গ্রান্ডফা’র মুখে জেনেছে, সহজ সরল এ দেশের মানুষ। ড্যানী গ্রান্ডফা’র ডায়েরীতে লেখা ঠিকানা ধরে এগুতে  থাকে।  আজ দীর্ঘ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে, ড্যানী তার মায়ের খোঁজ পাবে কি? ড্যানীর সুপ্তমনের অনাকাঙ্খিত, অতৃপ্ত বাসনা, মাকে দেখার গভীর আকুলতা সত্যি হবে কি?

ধন্য তুমি স্বাধীনতা!  ধন্য বাংলাদেশ!

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top