সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প-০৭:  বৃদ্ধাশ্রম : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
৪ অক্টোবর ২০১৯ ২১:২৪

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২০:০১

 

আমার নাম নীলিমা নীলাদ্রী। ভাবছেন নামের তো খুব বাহার আছে।  আরও একটি বাহারী নাম আছে আমার।  সেটি বলছি, আর একটু পরে। 
বয়স হয়েছে। থাকি আগারগাঁও বৃদ্ধাশ্রমে। নির্ঝঞ্চাট মানুষ। খেতে ইচ্ছে হলে খাই। না হলে পুরনো স্মৃতি আওরাতে আওরাতে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।  আজ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর আপনারা যে কি মনে করে আমাকে স্মরণ করেছেন, জানি না। প্রথমে রাজী হইনি। কিন্তু ঐ যে মিষ্টি সাংবাদিক ছেলেটা রিজভি, ওকে ফেরাতে পারলাম না। ওর নামের সাথে আমার প্রিয় একটা নামের মিল রয়েছে। 
তবে একটা শর্ত জুড়ে দিলাম। আমাকে প্রাণখুলে কথা বলতে দিতে হবে। যুগ যুগ ধরে বুকে পাথর বেঁধে সত্য গোপন করে এক বিষাক্ত শরীর নিযে জীবনের শেষ বেলায় টেনে টেনে চলছি। চল্লিশতম স্বাধীনতা দিবস আজ। এ সভায় আরও অনেকে বক্তব্য রাখবেন। কেউ রেখেছেন। 
স্বাধীনতা! 
কিসের স্বাধীনতা? কার স্বাধীনতা? বলতে পারেন কেউ, সত্যি করে? সামান্য গুঞ্জন উঠলো সভায়। পরে তা থেমে গেল। 
সেই কবে? কতদিন আগে? 
আমার একটা সুন্দর অতীত ছিল। বাবা-মা, বড় ভাই রিপন আর ছোট ভাই ছোটন। বাবা সরকারী বড় চাকুরি করেন। বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে নতুন চাকুরীতে ঢুকেছে। ছোটন এসএসসি দেবে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। ভাইয়ার বন্ধু বাবলুর সাথে মন দেয়া নেয়া ছিল অনেক আগে থেকেই। 
ওদের বাড়ী আর আমাদের বাড়ি কাছাকাছি ছিল। বাবুল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাকে খুব আদর করতেন তারা। 
আমি নাকি অপূর্ব সুন্দরী ছিলাম।
পটল চেরা চোখ, দীঘল কালো চুল। মিষ্টি হাসিভরা লাবন্য মাখা মুখ। বাবুলতো অনেক সময় দুষ্টুমী করে বলতো- একেবারে কালীদাসের নায়িকা!
মা আদর করে কখনো নিলা, কখনো নীলু বলে ডাকতেন। আর বাবা, একেবারে নীলাদ্রী বলেই ডাকেতন। নীলাদ্রী তার প্রিয় নাম। হয়তো একসাগর নীল স্বপ্ন বুনেছিলেন আমাকে নিয়ে। 
খুবই ফ্যাশন সচেতন ছিলাম। বাবা টাকা দিতেন ভাইয়া দিতেন, আর মা তো আছেনই। যখন যা কিনবার প্রয়োজন অর্থের অভাব হোত না। 
নতুন ডিজাইনের ড্রেস আমিই পড়তাম সবার আগে। এ জন্যে বুঝতে পারতাম, বান্ধবীরা অনেকেই মুখে কিছু না বললেও মনে মনে হিংসা করতো। বাসায় ফিরে ছোটনের সাথে এসব নিয়ে রশিকতা করতাম। 
কি সুখেই না দিন কাটছিল আমাদের। বাবলুর সাথে ঘনিষ্ঠতা দুই পরিবারের সবাই জানতেন। দিনে দিনে আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও গাঢ় হতে থাকলো। একদিন শুভক্ষণে ভাইয়ার মাধ্যমেই প্রথম বাবলু আমাদের বিয়ের প্রস্তাবটা দেয়। দ্বিমতের কিছুই নেই। উভয় পক্ষের সম্মতিতেই ঘটা করে বিয়ে হোল আমাদের। বাবুল একমাত্র সন্তান হওয়ায় শাশুগী মা আমাকে মেয়ের মতই আদর করতেন। 
বিয়ের দু’মাসের মধ্যেই আমার গর্ভে সন্তান এল। বাবলু খুশীতে আত্নহারা। নতুন অতিথীর জন্য কি করবে না করবে, কত যে উচ্ছাস তার। এরই মধ্যে হঠাৎ করে আমেরিকা থেকে পি.এইচ.ডি করার চিঠি এল বাবলুর। এটা আরেক আনন্দ। 
ক্যারিয়ারের। 
কিন্তু আমার মনটা কেমন আনচান করতে লাগলো। বাবলু আদর করে বোঝালো- এইতো ক’টা দিন নীলু, বেবী হয়ে গেলেই দু’তিন মাসের মধ্যে তোমাকে নেবার ব্যবস্থা করবো। 
তোমার ফাইনাল পরীক্ষাটাও শেষ হয়ে যাবে। 
সত্যিই তো! এই ফাঁকে অনার্স ফাইনালটা শেষ হয়ে যাবে। বাবলু চলে গেল। 
প্রেগন্যান্টের বিষয়টা আগেই জানাইনি কাউকে। হঠাৎ গা গুলিয়ে বমি করে ফেললাম একদিন। বাবা মা, শাশুড়ী-শ্বশুর বাবা আনন্দে উৎফুল্ল। ডাক্তার এল। 
আমি মা হতে চলেছি। জেনে ফেললো সবাই। 
একদিন ঘর আলো করে নিলাদ্রী পুত্র সন্তানের মা হোল। মহা ধুমধাম করে আকীকা দিলেন ছেলেকে সবাই মিলে। বাবলু ছেলের নাম পাঠিয়ে দিল। রিজভী। সবাই ঐ নামেই ডাকতে শুরু করলো। আমি কিন্তু মনে মনে একটি আলাদা নামে আদর করতাম ছেলেকে।   সে নাম কেউ জানেনা। তবে মাঝে-মধ্যে শাশুড়ী মা হঠাৎ করে জানতে চাইতেন তুমি ওর কি নাম রেখেছ মা? না মা, আদর করে কত নামই তো বলি। 
শাশুড়ী মা আর কিছু বলতেন না। দেখতে দেখতে খোকা এক বছরে পা দিল।
আধো আধো কথা বলে। ইতোমধ্যে আমি অনার্স পাশ করেছি। 
এমনি নিস্তরঙ্গ সুখের জীবনে দেশে বিক্ষুদ্ধ বাতাস বইতে শুরু করলো। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। তার মধ্যেও কি উচ্ছাস-আবেগেই না দিন কাটছিল আমাদের। 
হঠাৎ চারদিকে গুলির শব্দ। সবাই আতঙ্কিত। এর মধ্যে ফোন এলো। বাবলু ছেলের ছবি দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। 
এত আতঙ্কিত জীবনের মধ্যেও বাবলুকে ছবি পাঠানোর জন্যে একদিন বিকেলে ক্যামেরাম্যানকে ডেকে সবাই মিলে খোকার ছবি তুললাম। 
ছবি তোলা শেষ হলে, সবাই মিষ্টি মুখ করছে, এমন সময় হঠাৎ চিৎকার উঠলো মিলিটারী আসছে। মিলিটারী, মানুষজন দিশেহারা। 
সবাই নিজ নিজ বাড়ীর দিকে দৌড়াতে লাগলো। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। বড় ভাইয়ার পোষ্টিং ঢাকায়। ক’দিন হলো চাকরিতে জয়েন করেছে।
বাবা কেবলই অফিস থেকে বাসায় ফিরেছেন। শ্বশুর বাবা ও শাশুড়ী মা খোকার সাথে ছবি উঠাবে বলে আমাদের বাসায় এসেছেন। 
গুলির শব্দে খোকা চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। এমন সময় বিকট আওয়াজ করে একটি জিপ আমাদের বাড়ির সামনে এসে থামলো।
শ্বশুর বাবা ও শাশুড়ী মা হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। বাইরের গেট দিয়ে খোকাকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে থাকেন। 
আমাকে ও ছোটনকে জড়িয়ে ধরে মা দোয়া পড়তে লাগলেন। কে যেন বলছে, হ’সাব এইতো এইডাই নিলীমাগো বাড়ী। বহুত খুবসুরৎ দেখতে। 
আমার গা কাঁপছে থরথর করে। 
এমন সময় দরজায় লাথি। 
বাবা দরজা খুলতে গেলেন। মা জড়িয়ে ধরে বললেন নাগো, দরজা খুলনা, মেরে ফেলবে আমাদের সবাইকে। 
আরো জোরে লাথি মারতে থাকলো দরজায়। বাবা এবার খুলে দিলেন দরজা। লুঙ্গি পরা কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। অদুরে জীপের পাশে দু’জন মিলেটারী। আমাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে জিপে তুললো। জোড়াজুড়ি করলাম। লুঙ্গি পরা একজনকে চিনে ফেললাম- কৃষ্ণ?
হ’ রাধা।
চিনছো আজ?
তোর এই কাজ? তুই না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস?
তাই কি?
হিন্দু বলে তুই আমাকে একদিন অপমান করেছিলি, মনে আছে? প্রেমে বাধা দিয়েছিলি?
তার প্রতিশোধ? 
টানাহ্যাচড়া করে জীপে তুলে নিল আমাকে। মা-বাবা ও ছোটন আর্তনাদ করতেই ব্রাশফায়ার করলো শয়তানরা। গাড়ী ষ্টার্ট দেবার পর দেখলাম, ইটের সারির মত বাবা মার গায়ের উপর ছোটনের মাথাটা ঢলে পড়লো। কাঁপতে কাঁপতে বাবা-মাও থেমে গেল। 
বুঝলাম সবাই চলে গেল। 
তারপর আবার স্টেনগানের আওয়াজ ঠ্যা, ঠ্যা, ঠ্যা। 
চোখের সামনে তিনটি দেহ মাটিতে লুটিয়ে। 
হঠাৎ মনে হোল আমি অন্ধ। 
কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। সজ্ঞানে ছিলাম কিনা জানি না। 
কিছুক্ষণ পর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিপটা থেমে গেল। কৃষ্ণ হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে নামালো। 
আমি কেঁেদ ফেললাম। 
কৃষ্ণ সোহাগ ভরে বললো, বাধা, ভয় পেয়ো না। ওরা তোমাকে যত্ন করেই রাখবে। 
নিলীমা একগাল থুথু ছিটেয়ে দিল কৃষ্ণর মুখে। 
দাড়ি রেখে মুসলমান সেজেছিস?
বিশ্বাস কর রাধা। আমার আর কোন উপায় ছিল না। হিন্দু বলে চোখের সামনে পুরো বাড়িটা জ্বালিয়ে দিল। মেরে ফেললো সবাইকে। তখন মনে ধিক্কার জাগলো।তুইও তো আমাকে হিন্দু বলে ভালবাসায় বাধা দিয়েছিলি। 
তাই মুসলমান পরিচয়ে রাজাকারের খাতায় নাম লেখালাম। ওরা আমাকে মারে নাই, একটা শর্তে। তোকে যদি ধরিয়ে দিতে পারি। 
বাহ! ভালবাসার কি গভীরতা। 
মনে হয়েছিল সে দিন, কৃষ্ণ অনুতপ্ত। কিন্তু ঐ অনুতপ্তে আমার কি?
বুঝতে পারলাম নিকটস্থ রাজশাহী সেনানিবাসে এসেছি। হয়তো ইতরামী আপেক্ষাকৃত কম হবে। কিন্তু আমাকে যে রুমে থাকতে দেয়া হোল সেখানে প্রায় আরও ৭/৮ জন মেয়ে। 
ওরা নাকি সবাইকে ল্যাংটা করে একে একে একেক জনকে ধর্ষন করে। এক মধ্যবয়সী মহিলার প্রলাপ শুনে এগিয়ে গেলাম। মাগো, তোমাকে তো অনেক শিক্ষিত আর ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা তো দোযখ। 
মার মুখটা ভেসে উঠলো। দু’গাল গড়িয়ে পানি এল। 
রাত্রি গভীর হোল। 
একি ভয়াবহ দৃশ্য!
মায়ের সামনে মেয়েকে, মেয়ের সামনে মাকে। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। 
একজন এসে এক টান মেরে কামিজাটা ছিড়ে ফেললো। পিশাচের মতো হাসি দিয়ে আমার সযত্নে লালিত নারীত্বের অপমৃত্যু ঘটালো। এরপর সংখ্যা মনে নেই, কতজনের দ্বারা যে ধর্ষিত হয়েছি। হঠাৎ একদিন কৃষ্ণের কথা খুব মনে পড়লো। পরে জেনেছিলাম, আমাকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়ার পর রাজাকারেরাই ওকে মালাউন বলে মেরে ফেলেছে। 
আমার কোন বোধশক্তি ছিল না। কৃষ্ণের জন্য কোন মায়াই হলো না। প্রতিদিন এত ঘৃণ্য দৃশ্য দেখছি। একদিন রাতে একটি চিৎকার শুনে উঠে বসলাম। 
চোখ দুটি অন্ধ হলো না ক্যান? খোদাকে ডাকলাম। আমাদের রূমেরই এক কোণায় চার-পাঁচজন উন্মক্ত পশু একটা মেয়েকে টেনে নিয়ে সবার সামনেই ধর্ষন করলো। 
যুদ্ধের নটি মাস এভাবে কত যে বর্বরোচিত পশুত্বের তান্ডবলীলা দেখেছি। ভুলে গেলাম আমার খোকার কথা। বাবলুর কথা। সে তো ভালই আছে বিদেশে। 
প্রতিদিন পালা করে অত্যাচার চালাতো আমার উপর। মনে মনে ভাবতাম-হায়রে কালীদাস, তুমি জানলেও না, তোমার সুন্দরী নায়িকার উপর কি পৈশাচিক নির্যাতন চলছে। বাবলুও জানছে না তার নিলুর কি দশা। 
শরীরে আর সহ্য হচ্ছিল না। 
একদিন গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়লাম। আমি কুমিল্লা মিলিটারী হাসপাতালে গেলাম। ওখানে বেশির ভাগই মেল নার্স। তবে কয়েকজন বাঙ্গালী ডাক্তারও দেখলাম। 
তার মধ্যে মহিলা ডাক্তারও ছিলেন। ভয়ে কারো নাম জানবার চেষ্টা করিনি। হঠাৎ কে যেন মৃদুকন্ঠে করলো, নীলাদ্রী। 
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। ফ্যকাশে মুখ, মলিন। বড় বড় চোখের, ডাক্তারদের পোষাক পরে টেটোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে। চেনবার চেষ্টা করলাম। 
হঠাৎ করে মুখ থেকে বেরুলো বীনা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেত চাইলাম। ইশারায় নিষেধ করলো। এক সঙ্গে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়েছি। 
বীনা মেডিক্যালে চান্স পেল। আর আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বীনাদের বাড়ি পাবনায়। আর আমার বাড়ি রাজশাহী।
পাবনায় বাবার পোষ্টিং থাকায়, এডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেছি। সেই থেকে বীনা আমার ঘনিষ্ট বান্ধবী। আজ আবার ঘনিষ্ঠতা। 
পৈশাচিক ঘনিষ্ঠতা।
দিনে ডাক্তার, আর রাতে পশুদের কাছে সতিত্ব নির্বাসন। এখানে এক ঘরে প্রায় বিশজন মেয়ের থাকার ব্যবস্থা। একদিন রাতে এক ফাঁকে বীনা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। 
ওর বাবা, মা দুজনেই ডাক্তার ছিলেন। আমার বুকের ভেতর মুখ রেখে বীনার সে কি কান্না। দীর্ঘদিন পর এই প্রথম আমার দু’চোখ গড়িয়ে পানি এল। 
নীলু, আমাকে ওরা রাস্তা থেকে জিপে টেনে তুলে নিয়ে এসেছে। বাড়ির কেউ জানে না। বাবা মা বেঁচে আছেন কিনা, বাবুর্চী রহমান চাচু, কিছুই জানিনা। ওরা হয়তো ভেবেছে মরে গেছি। মরে কেন গেলাম নারে নীলু?
চাইলেই কি আর মরা যায় পাগলী। আমিই কি মরতে পেরেছি? অন্যেরা সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল। আস্তে করে  বীনা বললো, এখানে কথা বলাও মানা। বীনা চলে গেল। 
অনেক রাতে একজন আমাদের মত, আর একজন একেবারে কচি মেয়ে, ষোল সতেরো বয়স হবে ওদের খুব আর্তচিৎকার শুনলাম। 
চমকে তাকালাম। দু’জনই চিৎকার করছে, মেরে ফেল আমাগো। আর সহ্য করতে পারতেছি না। তাকিয়ে দেখলাম উন্মক্ত পশুদের তান্ডব লীলা। ওরা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। 
ভোর হতেই চিকিৎসার জন্য পাঠানো হলো। পরে জানতে পেরেছিলাম, ওরা দুবোন ছিল। বড়বোন অন্তসত্তা ছিল, আর ছোটবোনের টি.বি ধরা পড়েছিল। তাই দু’জনকেই গুলি করে মেরে ফেলেছে। 
কষ্ট হলো না ওদের জন্য। 
বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। 
নভেম্বরের প্রথম দিকে খুব গুলির আওয়াজ শুনতাম। বুঝতে পারতাম না, কারা জয়ী হচ্ছে। এরপর লক্ষ্য করলাম কেমন একটা ব্যস্ততা ও সন্তস্ত্রভাব পাক শয়তানদের মধ্যে। গোলাগুলির শব্দও বেশী শোনা যায় না। এমন সময় হঠাৎ ভোর রাতে প্রচন্ড এয়ারক্রাফট-এর শব্দ। 
একটু পরেই দ্রুম দ্রাম বোমা পড়া শুরু হলো। সমস্ত শরীর কাঁপছে। 
মরেও যেন বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা। 
বীনাকে জড়িয়ে ধরলাম। ও তখনো ডাক্তারী ইউনিফর্ম পরা। কম্বল দিয়ে জড়িয়ে আমরা দু’জন যেন একাত্ন হয়ে গেলাম। ভয় নেই। বীনা বললো। 
পরপর ক’দিন বোমা পড়তে থাকলো। তারপর কেমন যেন চুপচাপ। মনে হোল বিমান শেষ। যুদ্ধও শেষ। পাকিস্তানী সৈন্যরা কেমন অস্থির। মুখ শুকনো। দুরে কামানের শব্দ। 
মাঝে মাঝে রেডিওতে অস্পষ্ট একই কথা কানে আসে। বোঝা যায় না। 
বীনা বললো, দাঁড়া ওদের কাছে রেডিও আছে। আমি কৌশলে জেনে আসি। 
কিছুক্ষণ পর বীনা দৌাড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো- “জয় বাংলা”। 
নীলু। আমরা মুক্ত, স্বাধীন।
সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর। 
সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়াজী আত্নসমর্পন করেছে ভারতীয় ও মুক্তিফৌজের যৌথ নেতৃত্বের কাছে। এরপর আমাদেরকে একদিন একটি ট্রাকে করে সেনানিবাস থেকে ঢাকায় নিয়ে গেল। 
আসবার সময় ট্রাকের পেছনে প্রায় ত্রিশজন মেয়ে, দলামলা হয়ে বসে আছি। কেউ লুঙ্গি পরে, কেউ মুক্তিফৌজের দেয়া শার্ট, পাজামা। 
সুন্দরী বলে, ওরা আমাকে সালোয়ার কামিজ সরবরাহ করতো। আর বীনাকে দিত ডাক্তারী পোষাক। 
উপরে খোলা আকাশ। 
মুক্ত বাতাস। 
নিশ্বাস ভরে মুক্ত দেশের স্বাদ নিলাম। ইচ্ছে হলো একটু বাইরে দেখবার। ঠেলেঠুলে এক সাইডে যেয়ে বীনা আর আমি দুচোখ মেলে তাকালাম রাস্তার দিকে। সাইন বোর্ডে দেখলাম টাঙ্গাইল। 
টাঙ্গাইলের কাছাকাছি রাস্তার মোড় নিতেই অনেক মহিলা-পুরুষ। ছেলে-বুড়ো, এমনকি পাঁচ সাত বছরের শিশুরাও আমাদেরকে দেখিয়ে সমস্বরে চিৎকার করলো- দেখছোস, ট্রাক ভরা বেশ্যা মাগীরা যাচ্ছে। খানকীমাগীরা বেবাক, অজাত, কূজাত।  
বীনাকে আবার জড়িয়ে ধরলাম। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ইচ্ছে হোল, ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে অকৃতজ্ঞ বেঈমানদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে গলাটিপে ধরি। 
পরে ভাবলাম, ওদের কি দোষ! আসলেই আমরা আজ বেশ্যা। মৃত। 
অবশেষে দুপুরের দিকে আমরা ঢাকা পৌছালাম। ধানমিন্ড পূর্নবাসনকেন্দ্রে নেয়া হোল আমাদের। ওখান থেকে বলা হলো, কেউ ইচ্ছে করলে নিজ বাড়িতে যেতে পারো। 
খোকার জন্য বুকের ভেরতটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার খোকা কেমন আছে? বেঁচে আছে তো? আমার অনল!
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর মত চারদিকে ক্যামেরার ফ্লাশ লাইট জ্বলতে লাগলো। ছবির পর ছবি তুলছে সাংবাদিক রিজভী। 
নিলাদ্রী অকপটে বলেই চলছে তার এত দিনের জমানো ক্ষোভের ইতিহাস। 
পূনর্বাসন কেন্দ্রে অনেকের কাছ থেকেই ঠিকানা নিয়ে বাড়ীতে খবর দেয়া হোল। 
অনেকের আত্নীয় স্বজন খবর পেয়ে ছুটে এল। বেশীর ভাগই সঙ্গে নিল না মেয়েদের। পরে নিয়ে যাবে বলে গেলেও তারা আসেনি আর। 
ওরা যে অসূচি আজ সমাজে। 
বেশ্যা। 
জীবিত লাশ একেকজন। আমিও তার একজন। কেউ এল না আমাকে নিতে। 
ভাবলাম, ভাইয়াও বেঁচে নেই তা হলে!
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ভাইয়া এল। মুখভরা দাড়ি, লম্বা চুল। মুক্তিফৌজ। 
জড়িয়ে ধরলো। প্রাণ খুলে দু’ভাই বোন কাঁদলাম। ভাইয়ার সাথে নিউমার্কেট গেলাম। একটা রেষ্টুরেন্টে বসে দু’জনে গোগ্রাসে পছন্দের খাবার খেলাম। 
দু’জনেই দু’জনের এতদিনের জমানো কথা টুকটাক বললাম। ভাইয়া কিছু সালোয়ার কামিজ কিনে দিল। বললো, তোর যা পছন্দ তাই নে। 
আমি হেসে বলাম, তোর যা খুশী তাই কিনে দে ভাইয়া। মনে মনে ভাবলাম একসময়ের ফ্যাশনেবল নিলাদ্রী তো মরে গেছে কবেই। সন্ধ্যের দিকে পূনর্বাসন কেন্দ্রে ফিরে এলাম। বীনা দৌড়ে এল। 
কোথায় ছিলি নিলু?
ভাইয়াকে দেখে চমকে উঠলো। খুশীও হোল। ভাইয়া বললো, তোমরা দুজনই তৈরি থেক। আগামী কাল বিকেলে আমরা রাজশাহী রওয়ানা হব। ফেরার পথে পাবনায় তোমাকে নামিয়ে দেব। 
বীনা খুব খুশী হলো। হঠাৎ কি ভেবে বলে উঠলো না না নীলু, তোরা যা। বাবা এলে বাবার সংগে যাব। 
বুঝতে পারলাম বীনার অভিমান। একমাত্র সন্তান। বাবা-মার কলিজার টুকরা। তারা না এল যাবে না। মনে মনে ভাবলাম তারা বেঁচে আছেন কিনা আল্লাহ জানেন। 
পরদিন ভাইয়ার সঙ্গে বাড়ী ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময় সকাল দশটার দিকে কয়েকজন ভদ্র মহিলা এলেন আমাদের সাথে আলাপ করতে। 
যাদের কেউ নেই পরিবারে বেঁচে থাকাবস্থায়। নিতে আসেনি কেউ বা খোঁজ করেনি এখনো, তাদের যার যার যোগ্যতানুযায়ী চাকুরীর ব্যবস্থা তারা করবেন। 
নিরাপদে থাকার ব্যবস্থাও করবেন। তাদের এসব কথা শুনে হঠাৎ কেমন যেন বিজাতীয় একটা রোষানল আমাকে অস্থির করে তুললো। 
এঁরা নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন। তাই বড় বড় আশ্বাস দিয়ে আমাদের করুনা করতে চাইছেন। হয়তো তারাও সংগ্রাম করেছেন, তবে সফল হয়েছেন। কিন্তু ..... আমি কি পেলাম?
আত্নহত্যা করবার মত সুযোগও তো ছিল না আমার। সেদিন যারা রক্ষা করতে পারেনি, আজ কেন তারা আদর দেখাতে আসছে? 
পরে স্থিরভাবে চিন্তা করলাম, না একটা পরিচয় তো আমার আছে। বাবলু বিদেশে। শ্বশুর শাশুড়ী, আমার খোকন, আমার পরম ভালবাসার ধন অনল, ওরা যদি বেচে থাকে!
ভাইয়াতো আছেন!
আমার সিদ্ধান্তের কথা শুনে একজন ভদ্রমহিলা, আমার নাম ঠিকানা সব লিখে নিলেন। কেন, তা জানি না। 
এখন ভাবি সেদিন যদি উনি আমার ওটুকু না লিখে নিতেন, তাহলে হয়তো আমি চিরকালের মতই হারিয়ে যেতাম। 
ভাইয়ার সাথে অনেক আশা ভরসা নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা হলাম। প্রথমেই আমাদের বাড়িতে এলাম। শূণ্য ভিটা। হঠাৎ ক্রাচে ভর করে হাসু চাচা একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। 
মাগো কেমন চেহারা হয়েছে দু’ভাই বোনের?
কাঁদতে কাঁদতে বললাম-তোমার কথা বল। 
চোখের সামনে সবাইকে মেরে ফেললো। তোকে তুলে নিয়ে গেল। একে একে সবাইকে কবর দিলাম কোনরকম। এরপর মুক্তিফৌজে চলে যাই। গুলিতে পাটা হারিয়েছি। 
ইতোমধ্যে আশপাশ থেকে পাড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে আসে। কৌতুহলী দৃষ্টিতে অনেকেই তাকিয়েছিল। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভাইয়া বললো-
চল, তোর শ্বশুর বাড়িতে।
আধা মাইলের দুরত্ব।
রিক্সায় দু’জনে উঠলাম।
দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। 
হঠাৎ রিক্সাওয়ালা বলে উঠলো-হালার পুতরা মা-বইনগো ইজ্জতের আর কিছু বাকী রাহে নাই। বলে হি হি করে হাসতে লাগল। মনে হলো ফিরে আসি। আরও কত কী যে শোনার বাকী আছে। তবুও গেলাম, খোকার টানেই। কলিংবেল টিপতেই শাশুড়ী মা খোকাকে কোলে নিয়ে দরজা খুললেন। আকাশ থেকে পড়লেন মনে হয়। 
ও...তুমি বেঁচে আছ মা?
মনে হলো খুশীর চেয়ে অবাকই হলেন বেশী। মনে পড়লো বেশী করে মা-বাবা ও ছোটনের কথা। কত খুশীই না হতো তারা। 
শাশুড়ীর কোল থেকে খোকাকে কেড়ে নেয়ার মত কোলে নিলাম। এই ক’মাসে বেশ বড়সড় হয়ে গেছে। নাদুস নুদুস। আমার গলাচেপে ধরে কান্না শুরু করলো। যেন কত অভিমান। এতদিন কোথায় ছিলে মামনি। কথা বলতে শিখলে হয়তো, এ প্রশ্নই করতো সে। 
শ্বশুর বাবা আরো বুড়িয়ে গেছেন। তসবীহ হাতে এগিয়ে এলেন। সালাম করলাম। তেমন আবেগ এর কিছু দেখলাম না। 
খোকনের কান্না দেখে শাশুড়ী বললেন-অনেকদিন দেখে না তো। তোমাকে চিনতে পারছে না। দাও, আমার কোলে দাও। একরকম কেড়েই নিয়ে নিলেন। 
আমার দু’চোখ গড়িয়ে পানি পড়লো। কিছুই বলতে পারলাম না। এই ক’মাসে সবকিছুই যেন অতি অচেনা হয়ে গেছে। দু’দিন এভাবেই ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। 
বাবলুর অভাব বুঝতে পারলাম গভীরভাবে। শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করা মাত্রই সানন্দে বললেন-তোমার কোন খোঁজ না পেয়ে বাবলু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমাদেরকে ওর কাছে আমেরিকা নিয়ে যাবে। ভিসা পাঠানোর জন্য চেষ্টা করছে। 
বুকটা কেঁপে উঠলো তাহলে তো বাবলুর কাছেও আজ আমি মৃত। আমার আর কিছুই রইলো না। ধিক্কার এল এবার জীবনের প্রতি অন্য রকম। 
জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত এইবার নিলাম। খোকনকে প্রাণ ভরে আদর করে চুমোয় চুমোয় ভরে দিলাম ওর কোমল শরীরের সবখানে। ঘুমিয়ে গেল আদর পেয়ে। ভাইয়া আমাকে রেখেই কর্মস্থলের খোঁজে ঢাকায় চলে গেছে। 
কিছুই জানলো না সে। ঐ দিনই সুযোগমত রাতের অন্ধকারে খোকনকে শাশুড়ীর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমি অজানা অন্ধকার জীবনের পথে পা বাড়াবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। 
চোখের জলে বুক ভিজিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন করলাম এই লাল সবুজ রক্তখচিত পতাকা। 
ওই পতাকা অর্জনে কি আমার মত মেয়েদের কোনই অবদান নেই?
আজ পথে পথে কত শহীদ মিনার। 
কতো পথ-ঘাট-কালভার্ট-সেতু উৎসর্গিত হচ্ছে শহীদদের নামে। শহীদের পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তানরা কতো রাষ্ট্রীয় সহায়তা সহানুভূতি পাচ্ছে। 
সম্মান পাচ্ছে। 
কিন্তু আমরা কোথায়?
আমি নিলাদ্রী, শুরুতেই বলেছিলাম, আমার আর একটি বাহারী নাম আছে। 
সে নামটি হলো ‘বীরাঙ্গনা’ বুঝতেই পারছেন সবাই এতক্ষণে। 
কেন, একজন বীরাঙ্গনার নামে কি একটি সড়কও হতে পারে  না? তারা মরে কি শহীদ হয়নি? জীবিত থেকেই বা কি!
চলে এলাম আবার সেই পূর্ণবাসন কেন্দ্রে। ভাগ্য ভাল ছিল। এসেই নাম ঠিকানা রাখা সেই আপুর সাথে দেখা হয়ে গেল। সবকিছু শুনে আদর করে মায়ের মত বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, চিন্তা কোর না। আল্লাহ আছেন। 
সত্যিই উনি আমাকে একটা ভাল চাকুরির ব্যবস্থা করে দিলেন। থাকার ব্যবস্থাও করলেন। ভাল বেতনের চাকুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীটার মূল্য পেলাম তবু।
অফিসের পরিবেশও ভাল। কিন্তু যতাদিন যেতে লাগলো, ততই যেন তিক্ততা বেড়ে গেল। সবাই খুব কৌতুহলী হয়ে উঠলো আমার সম্পর্কে। 
বিশেষ করে পুরুষগুলো বেশী। কেউ কেউ বিয়ের প্রস্তাবও দিলেন। এভাবেই একদিন আমার সত্য পরিচয়টা কেউ কেউ বুঝে ফেললেন। 
এতে একটা ফল হোল, আমার সম্পর্কে আর কেউ কৌতুহলী ভাব দেখাতো না। 
কিন্তু আমি তো আমার মনের কথা চেপে চেপে জীবনের সব লালিত স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে বোবা একটা যান্ত্রিক মানুষ হয়ে গেলাম। 
যে বেতন পাই, খেয়ে দেয়ে প্রচুর টাকা জমা থাকে। 
কি করবো এত টাকা।
কে আছে আমার?
এ ভাবেই অবসর গ্রহণের সময় চলে এল। অফিসের সবাই আমাকে শ্রদ্ধাভরে ফেয়ারওয়েল দিল। এতদিনে জানতে চাইলো। আমার জীবনের কিছু কথা। বলতে পারলাম না এতদিনেও। 
করজোড়ে মাফ চেয়ে বিদায় নিলাম। 
এতকিছুর পরও বেঁচে যখন আছি, বেঁচে তো থাকতে হবে। সন্ধান পেলাম একটা বৃদ্ধাশ্রমের। আগারগাঁও। 
ওখানে পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করে থাকার ব্যবস্থা করলাম। 
সবাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। 
একেকজনের জীবনের একেকটা বিচিত্র ঘটনা প্রতিনিয়তই শুনি। ভালই কাটছিল দিনগুলো। অনেকেই জানতে চাইতো আমার কথা। 
বলতে পারতাম না। 
একেকবার মনে হত চিৎকার করে বলি সবাইকে এক নির্বাসিত বীরাঙ্গনার কাহিনী। পারিনি। 
কিন্তু হঠাৎ করে ওই সাংবাদিক রিজভী কেন যে গেল আমার কাছে। ওকে ফেরাতে পারলাম না। স্বাধীনতার কথা জানতে চায় ও। 
এই প্রজন্মের ছেলে। 
চোখে মুখে আকুতি। 
অনলের মুখটা ভেসে উঠলো ওর নামটা শুনে। হঠাৎ সাংবাদিক রিজভী দৌড়ে এসে নিলীমা নিলাদ্রীকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো মা, তুমি আমারই মা। আমিই তোমার সেই অনল। সভার লোকজন সমন্বরে করতালি দিয়ে বরণ করলেন নিলীমাকে। 
অনল মাকে নিয়ে যাবার জন্য জোড় করলো। নিলীমা নিরুত্তর। সাংবাদিক রিজভীর কপালে চুমো দিল ভাবলেশহীনভাবে। 
এতকাল পর এলি খোকা?
চল তুমি আমার কাছেই থাকবে। 
তাতো আর হবার নয় সোনা। 
কেন? আমি বিয়ে করেছি। তোমার দু’টো নাতীও আছে। 
আর কে আছে?
আর তোমার বৌমা। 
আর?
আরতো কেউ নেই মা। দাদা ভাই, দাদী মা, কেউ-ই বেঁচে নেই। মারা যাবার আগে তোমার সব কথা আমাকে বলে গেছেন। অনেক খুঁজেছি তোমাকে। সম্ভাব্য অনেক জায়গায়। 
কেউ তোমার সন্ধান দিতে পারেনি। অবশেষে, পত্রিকায় এই বৃদ্ধাশ্রমে একজন মুক্তিযোদ্ধা মহিলা থাকেন, জানার পর ছুটে গেলাম। 
তুই ছাড়া আর কেউ আমার সন্ধান করেনি? অকপটে প্রশ্ন করলো নিলীমা। 
রিজভী বুঝতে পারলো, বাবার কথা জানতে চান মা। বললো-আর একজন তোমাকে অনেক খুজেছিল। না পেয়ে চলে গেছেন। 
কে সে?
বিমূর্ত মূর্তির মত প্রশ্ন করে নিলীমা। 
বাবা, বাবলু চৌধুরী। অনেকদিন দেশে ছিলেন। তোমাকে না পেয়ে দাদাভাই আর দাদীমার কাছে আমাকে রেখে আবার চলে যান আমেরিকায়। 
তারপর?
ওখানে নাকি এক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছেন। আর কিছু জানি না। 
আমার আর কিছুই জানার নেই অনল। তুই আমাকে মা বলে ডেকেছিস, মাতৃত্বের স্বীকৃতিটুকু তো পেলাম। আমার আর কিছু চাই না বাবা। 
সম্মিলিতভাবে সভায় সমস্ত সাংবাদিক, সুধীজন অনেক অনুরোধ স্বত্বেও নিলীমা রাজী হলেন না অনলের সাথে যেতে । 
সমস্ত নারীত্বের বিনিময়ে আর কিছু না পাই, বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতাটুকুতো পেয়েছি। শকুন যেমন মৃত পশুকে ঠুকরে খায়, কিবা দিন কিবা রাত্রি, সেই শকুনের দোজখ থেকে আজ এই বার্ধক্যের ঘরে এসে ঠেকেছি। 
শরীরের ক্ষত শুকিয়ে যায়। বিবেকের ক্ষত থেকেই যায়। 
আপনাদের কাছে আজ চল্লিশ বছর পর যে সম্মানটুকু পেলাম, তাই নিয়ে আমি বৃদ্ধাশ্রমে আমার শেষ নিঃশ্বাসটুকু যেন শেষ করতে পারি সেই দোয়াই করবেন আপনারা। 
নাই বা পেলাম জাতীয় পতাকা। নাইবা পেলাম যুদ্ধজয়ীর পূর্ন স্বীকৃতি। 
একজন যুদ্ধজয়ী বীরাঙ্গনা রূপে এই বাংলার ছোঁয়াটুকু নিয়ে তো পথ চলতে পারছি এখনো। 
এটাই আমার জয়। 
আমার অহংকার।
আমার পরিপূর্ণতা।  

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top