সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প-১০; “স্বপ্নের আত্নহনন” : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৬ অক্টোবর ২০১৯ ০২:১৯

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ১৯:২৯

 

“ওদো, ওদো- ওথুতু দ্যাক, ওদো আমাল দামাই।  ওথুতু, আমাল ওথুতু অবি। ম্যালা আদল কব্বো।
আমাল থুতু হবি হুঁ.........”।  ডিসেম্বর মাস।  বিজয়ের মাস।
বাইরে কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। কুয়াশায় ঢাকা সারা প্রকৃতি। এমন কুয়াশাচ্ছন্ন আলো আধারী দিন মোটেই ভাল লাগেনা কনিকার।  ফজরের নামায পড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছটফট করছিল কনিকা। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪২ বছর পর আজ আবার হঠাৎ করে কেন মনে পড়লো একজন অসহায় বাক প্রতিবন্ধি মেয়ের কথা? বার বার কানে বেজে ওঠে ওপরের কথাগুলো।  
যার প্রকৃত অর্থ দাঁড়ায় “ঐ যে, ঐ যে খুকু দ্যাখ, ঐ যে আমার জামাই (স্বামী)। ও খুকু, আমারও খুকু হবে। অনেক আদর করবো। আমার খুকু হবে, হুঁ........“। হাতে চুমো দিয়ে পেট নেড়ে নেড়ে বলতো বাক প্রতিবন্দি সখিনা।

দীর্ঘ ৪২ বছর। যুগের হিসেবে সাড়ে তিন যুগ মুক্তিযুদ্ধের সময় কতইবা বয়স ছিল কনিকার। বড়জোড় ১১/১২ বছর। কিন্তু কনিকার মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। ডাগর ডাগর চোখের অসহায় সখিনার কথা ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারে না কনিকা। প্রতিবছর ডিসেম্বর এলেই সখিনার কথা নতুন করে মনে পড়ে যায়। ওই কথাগুলো সারাক্ষন কানে বাজতে থাকে। ও কি বোঝাতে চেয়েছিল কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে?

কনিকা আজও তার অর্থ খুজে বেড়ায়। স্মুতির পাতা উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে বারবার। সখিনার মা, কাজ করতো কনিকাদের বাসায়। কনিকার বাবা তখন পাবনা সদর হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। কাছাকাছি ছিল সখিনাদের বাড়ী। কনিকারা থাকতো কোয়ার্টারে।

অপূর্ব সুন্দরী ছিল সখিনা। কিন্তু বাক প্রতিবন্ধী। তারপর মৃগীরোগী। মৃগীরোগীদের নাকি আগুন পানিতে আকর্ষন থাকে। যুবতী মেয়ে সখিনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না সখিনার মায়ের।

কনিকাদের কোর্য়াটারের পাশেই ছিল বিরাট শান বাঁধানো পুকুরে। কতবার যে সখিনা আগুন কিংবা পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। কনিকার বাবা পরম স্নেহে সখিনার চিকিৎসা করেছেন।

বয়স অনুপাতে সখিনা ছিল শিশুর মত সরল। আচার আচরন সবই ছিল শিশুসুলভ। তাই বয়সে বড় হলেও সখিনার সাথে কনিকার সখ্যতা ছিল খুব মায়া দিয়ে  জড়ানো।

কনিকার খেলার সাথী ছিল সখিনা। আর কেউ না বুঝলেও সখিনার অস্পষ্ট তোতলা ভাষার সব কথাই বুঝতে পারতো কনিকা। সখিনা আদর করে কনিকাকে থুতু (খুকু) বলে ডাকতো। মনে পড়ে-

স্বাধীনতার পর নিখোঁজ সখিনাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধার করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। সে তখন সন্তান সম্ভবা।

পাড়ার লোকজন কে অবুঝ প্রতিবন্দী সখিনা পেট দেখিয়ে আঙ্গুল উচিঁয়ে কোন একজন লোককে ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইতো। সে তার স্বামী। লোকজন সোড়গোল করে উঠতো। সঙ্গে সঙ্গে সখিনাকে জোড় করে বাড়ীর মধ্যে টেনে নিয়ে যেত তার মা। আতঙ্কে কাঁপতে থাকতো।

যে লোককে ইঙ্গিত করতো বারবার সখিনা, সে ছিল সখিনাদের খুব ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাপের বয়সী জ্ঞাতি চাচা, বদর বাহিনীর কমান্ডার রমজান আলী। লুটের টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। ঐ শয়তানের সহায়তায়ইতো রাজাকাররা সখীনাকে তুলে দিয়েছিল পাকসেনাদের হাতে।

বাধা দেয়ায় মাছ বিক্রেতা সখিনার দরিদ্র বাবা ও ছোট ভাইকে গুলি করে নৃশংস ভাবে বেয়নেটের খোঁচায ক্ষত বিক্ষত করে মেরে ফেলেছিল। রমজান আলীকে সখিনার মা আপন ভাশুর হিসেবে সম্মান করতো। পরম আদরের স্বামী ও ছেলের কবর দিতে পারে নাই।

প্রতিবেশীদের সাথে অসহায় সখিনার মা সর্বস্ব হারিয়ে উন্মাদের মত প্রাণ বাঁচাতে ভিটামাটি ছেড়েছিল।

যাবার আগে স্পষ্টই দেখেছিল মুখোশপড়া অতি সমোঝদার ভাসুর রমজান আলীকে তার কইলজার টুকরা অবুঝ সখিনাকে পাকসেনাদের গাড়ীতে তুলে দিতে। সংগে সেও গিয়েছিল গাড়ীতে।

স্বাষীনতার পর সমাজপতি সেজে বিরাট পাঁচতলা বাড়ীতে দু’তিনটি বউ নিয়ে বীরদর্পে সভাসমিতি করে চলছেন। এই বিশিষ্ট গুনী মানুষটিকে সখিনা ইঙ্গিত করে সবাইকে তার স্বামী হিসেবে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কী সব্বনাশ!এ সবের জন্য সখিনার মা একদিন বেদম পিটিয়েছিল সখিনাকে সে সময়।

সখিনার মাকে কনিকার মা এজন্যে খুব বকেছিলেন। কনিকার স্পষ্ট মনে পড়ে, এরপর বেশ কদিন তাদের বাসায় কাজে আসে নাই সখিনার মা। সখিনাকে না দেখে কনিকা ছটফট করেছিল খুব। বাসায় কাউকে না জানিয়ে একদিন সকালে সখিনাদের বাড়ী চলে যায় কনিকা। উঠোনে পা রাখতেই, গুমড়ে গুমড়ে কান্নার আওয়াজ শোনা যায় ঘুরের মধ্যে।

কনিকা দৌড়ে ঘরে ঢোকে। চমকে উঠে। সখিনার নিস্তেজ দেহ রক্তে ভিজে পড়ে আছে মেঝেতে। পাশেই সদ্য প্রসূত চাঁদের কনার মত ফুটফুটে মেয়ে। সেও নিস্তেজ, নিথর। কনিকা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যায় বাসায়।তার বাবা তখন হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে কনিকা। সব শোনার পর কনিকার বাবা চলে যান সখিনাদের বাড়ী। আশেপাশের লোকজন বলে মৃত সন্তান প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছে সখিনা।
কনিকার বাবা, সখিনা ও তার শিশুকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখে, কনিকাকে নিয়ে দ্রুত চলে আসেন বাসায়।

রূমে ঢুকেই কনিকার মাকে ডেকে বললেন সখিনা ও তার শিশুকে গলাটিপে মারা হয়েছে। হতভাগী!

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কনিকার বাবা মা দুজনেই। কনিকা চিৎকার করেছিল আরো জাড়ে। সংগে সংগে মুখচেপে ধরেছিলেন তার বাবা মা। কিন্তু কেন?

কনিকা এসবের মানে তখন বুঝতো না। কারণ খুজতো সারাক্ষণ। বড় হওয়ার সাথে সাথে কনিকার বিবেককে দংশন করতে করতে ভিমরুলের হুলের মত ফুটে ফুটে এসব স্মৃতি নিস্তেজ হয়ে যায় এক সময়। কিন্তু তারপরেও কেন যেন জীবনের অন্ধচাকায় ঘুরতে ঘুরতে বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়েও যেন পড়ে না সখিনার স্মৃতি। ক্ষনে ক্ষনে বিশেষ দিনে, বিশেষ মুহুর্তে ঘুরপাক খায়।

টিভিতে ঘোষিত হচ্ছে, “কাদের মোল্লার ফাঁসী কার্যকর। কনিকা ফিরে আসে বর্তমানে।

ছোট বয়সে যা বুঝতে পারে নাই, আজ পরিপক্ক ও পরিনত বয়সে কনিকা স্পষ্টই বুঝতে পারে, সখিনার অস্পষ্ট ভাষার ইঙ্গিঁত। আসলে, সখিনার ঐ জ্ঞাতিচাচা বদর বাহিনীর লিডার, রমজান আলীই প্রথম তার সতীত্ব হরন করে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয় তাকে। অবুঝ সখিনা তাই ঐ বদমাইশ, শয়তানকেই স্বামী হিসেবে আগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতো। টিভিতে আনন্দধ্বনি, প্রজন্ম একাত্তর আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ছে। সমস্বরে ঘোষিত হচ্ছে “কাদের মোল্লার ফাঁসী কার্যকর, জয় বাংলা”।

কনিকার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে উষ্ণ অশ্রু। এত আনন্দ উল্লাসের মাঝেও মনের অজান্তেই উচ্চারিত হয়- হায় স্বাধীনতা! হায় দুর্ভাগা দেশ!

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top