সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

শাপলা ঢাকা জলকন্যা (পর্ব-০১) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১ নভেম্বর ২০১৯ ২২:২৮

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২০:৩৫

 

আঙিনায় খড়ের গাদার পাশে ঘুটো কুড়াতে কুড়াতে আনমনা হয়ে যায় হাসনা। চারপাশে বরষার নতুন পানি। সোঁদা মোদা গন্ধ। দুধেল গাভীটা বাছুরটাকে পরম আদরে জীহ্ব দিয়ে চেটে চেটে সোহাগে সোহাগে ভরে দিচ্ছে যেন। মাতৃত্বের সুখ যে পশুদের মধ্যেও একই রকম, তারই প্রমান মেলে এতে। হাসনা ঘুটোর টুকরিটা সরিয়ে দিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ে। অতীতের কত কথাই না মনে পড়ে আজ। এইতো দু’তিন মাস আগেও তার জীবনটা অন্য রকম ছিল।

সুখে সুখে ভরা ছিল। কতই না স্বপ্ন ছিল। তার ছোট্ট সংসার একদিন ছেলে মেয়ের কোলাহলে মুখরিত হবে। ফরিদ আলী বড় ব্যবসায়ী হবে। সংসারে কোন অভাবই থাকবে না। এ রকম স্বপ্নইতো দেখতো ফরিদ আলী। অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে হাসনা। বাবা মার একমাত্র সন্তান। কলজার টুকরা। বাড়ীর আঙ্গিনায় হাস্নাহেনার ঝাড়। জোৎস্না রাতে ফুলের সুবাসে বাতাস মৌ মৌ করে। এমন রাতেই হাসনার জন্ম। তাই জমিরুদ্দিন আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিল হাসনা হেনা। জমিরুদ্দিন গৃহস্থ।

জমিজমা ভালই ছিল। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করতো। জমিরুদ্দিন একটু ভাল ঘরে বিয়েসাদী দেয়ার   ইচ্ছায় মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাসনার পড়াশোনায় মন নেই।

স্কুলে যাবার সময় হলেই আগে আগে চলে যায় গোয়াল ঘরে গরুর ময়লা আবর্জনা ফেলতে। নয়তো পুকুর ধারে ছোট জালি হাতে চিংড়ী ধরতে। কিংবা দুপুর হলে সাথীদের নিয়ে বিলের এপাড় ওপাড় সাঁতরিয়ে শাপলার মালা গেঁথে ডালা ভরে শাপলা নিয়ে আসতো। হাসনা জানে জমিরুদ্দিন শাপলার তরকারী খুব পছন্দ করে।

ডালি ভরে সেদিন শাপলা এনেছিল হাসনা। আসলে শাপলার নাম করে বিলের ধারে যাওয়াটাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। একই গাঁয়ের ছেলে ফরিদ আলী। এপাড়া, আর ওপাড়া। একসাথে খেলতে খেলতেই বড় হয়েছে। একসময় কখন যে কিভাবে নিজেদেরকে এক স্বপ্নের বাঁধনে বেধে ফেলেছে কেউ জানে না। ফরিদ আলী সাঁতার কেটে কেটে শাপলা তুলে হাসনার সারা শরীর জড়িয়ে ডালা ভরে দিয়েছিল। জমিরুদ্দিন এ বাড়ী সে বাড়ী চারদিকে খুজে হাসনাকে না পেয়ে বারান্দায় বসে রাগে ফুসছিল। ইস্কুলে যাওয়া বাদ দিয়্যা মিয়াড়া কনে যায়, তার খোঁজ কি খালি আমি একলাই করবো?

আমরা চাষাভূষার মানুষ। চৌদ্দ পুরুষে ল্যাহাপড়া জানে না। উয়্যার দোষ দিয়্যা কি হবি। খালি খালি বকাবাজি কর। যাও, এহন পুকুর থেক্যা মাছটাছ ধরব্যার পার না কি, দেহ। রাধার তরকারি নাই। হাসনার মা’র কথা শেষ না হতেই হাসনা শাপলা ফুলের এক বিচিত্র সাজে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ধপাস করে শাপলার ডালা রাখে। উজ্জ্বল শ্যামলা হলেও টানা টানা চোখের চাউনি, কোমড়ে শক্ত করে শাড়ী পেঁচিয়ে বাধা, গলায়, কানে, বাহুতে, কোমড়ে, শাপলার মালা দিয়ে জড়ানো। ভেজা শাড়ী কিশোর শরীরটাতে লেপটে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ঠিক যেন জলপরী জল থেকে পৃথিবীতে উঠে এসেছে।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে, সমস্ত রাগ পড়ে যায় জমির উদ্দিনের। হাসনা ভয়ে কাঁপতে থাকে। বাজান, আইজক্যা মাফ কর‌্যা দ্যাও। আর ইস্কুল কামাই করবো না, এই তুমার পা ধর‌্যা কচ্ছি। আরে আওে, করিস কি! পাগল কুনহার। তোরে কি আমি কুন সমায় মারি? না, গালি গালাজ করি? আয় আমার কাছে আয়। আমার জলপরী।

দেখছো, হাসনার মা, আমার মা ডারে ফুলের সাজে কি সোন্দর লাগতিছে। ঠিক য্যান পরীর লাহান। হাসনার মা জমিরুদ্দিনের রাগ পড়ে যাওয়ায় অবাক হয়। মিয়াড়ারে, খুব বালবাস না? ইডা আবার কি কলি তুই। দশটা না পাঁচটা না, একটাই মাত্র মিয়া আমার। আমার কলজার টুকরা। ছাওয়ালই কত্ত আর মিয়াই কও,আমার হাসুই সব। না, সবসুমায় তো- দ্যাখ হাসনার মা। বকাবাজির কতা কবি না। পড়াল্যাহার জন্য ছাড়া, আমি কুন সময় হাসনারে শাসন করি নাই। গেরামে এহন ইস্কুল হইছে। কত ছাওয়াল মিয়া পড়ব্যার যায়।

আমরা মূর্খ মানুষ বিদ্যাবুদ্ধি নাই। অহন মিয়ারাও দ্যাশ চালায়। তাই হাসনারে ইট্টু ল্যাহাপড়া শিখ্যাব্যার চাইছিলাম। আট কেলাস তো পড়ছে। এহন বাল একটা ছাওয়াল দেখ্যা বিয়্যার চিন্তা কর। যাও গোসল কর‌্যা আস। মাছ আর ধরা লাগবিনন্যা। শাপলার তরকারিই আজক্যা চলবিনি।

এমন সময় গাভীটা হাম্বা হাম্বা করে ডেকে ওঠে। চমকে ওঠে হাসনা। বাছুরটাকে আদর করছে। হাসনার দু’চোখ জলে ভরে ওঠে। এমন হোল কেন? তার জীবনটাই এমন দুর্বিসহ কেন হোল? কত স্বপ্ন ছিল তার। একটা সুন্দর সংসার। একটি, দুটি ছেলে মেয়ে।

খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা। এর বেশী তো চায়নি কিছু। দেখতে শুনতে খারাপ ছিল না হাসনা। বড় বড় ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতো। পাশের গ্রামের জোতদারের বড় ছেলে তো হাসনার টানা টানা চোখের চাউনিতে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। জমিরুদ্দিনও এ প্রস্তাবে একপায়ে খাড়া ছিল। এত ভাল ছেলে হাসনার সোভাগ্য। শিক্ষিত ছেলে। শহরে চাকরী করে। জমিরউদ্দিন ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু বাধ সাথে হাসনা। মায়ের কাছে মনের সমস্ত কথা খুলে বলে। মা, আমার সব কথাই তুমারে কইছি।  মি যা করবার কর। অন্যখানে বিয়া দিলি আমি কিন্তুক বিষ খায়া মরবোনে। না না এমন কথা ভুলেই মনে  আনবিনা ব্যাটা। আত্নহত্যা মহাপাপ। তুই না লেহাপড়া জানা মিয়া। আমার সোনা, আয় আমার বুকের মধ্যি আয়। তুই কোন চিন্তা করিস না। আইজই আমি তোর বাজানরে সবকিছু খুল্যা কবনে। আমার মনে হয় উনি অমত করবিনানে। যে কথা সেই কাজ। রাতে ঘুমাবার আগে হাসনার মা জমিরুদ্দিনকে সব কথা খুলে বলে। প্রথমে জমিরুদ্দিন একটু আমতা আমতা করলেও পরে রাজি হয়ে যায়। মেয়ের সুখের জন্য সে সব কিছু করতে পারে।

তাছাড়া ফরিদ আলীর গ্রামে খুব সুনাম আছে। সেও বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। নির্ঝাঞ্চাট সংসার। হাসনা সুখেই থাকবে। সাতদিনের মধ্যেই কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। অনেক ধুমধাম করে হাসনার বিয়ের কাজ শেষ হলো। খুব সুখেই তাদের দিন কাটছিল। ফরিদ আলী ছোট খাট ব্যবসা করে। বিয়ের পর তার ব্যবসার দিন দিন উন্নতি হচ্ছিল। এজন্য ফরিদ আলী হাসনাকে আরও বেশী আদর করতো। চুপ চুপ করে হাসনার জন্য সুগন্ধি তেল, চুড়ি, মালা, এসব সখের জিনিস এনে দিত। হাসনা খুব খুশী হতো। একদিন ফরিদ আলী মস্তবড় একটা কাগজের মোড়কে কি যেন এনে হাতে দেয় হাসনাকে। হাসনা বুঝতে পারে না। ব্যাস্ত হয়ে পড়ে, ওটাতে কি আছে, জানবার জন্য। কও না, কি আনছ? তুমি খুল্যাই দেহ না, কি আনছি। হাসনা ঝটপট খুলে দেখে, কি সুন্দর একটা বাচ্চা মাইয়ার ছবি। আমার এই রকম একটা মাইয়া চাই, বুঝলা?

হাসনা লজ্জ্বায় ফরিদ আলীর বুকে মুখ রাখে। এভাবেই ওদের দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন কি থেকে কি হয়ে গেল। ফরিদ আলীর মা আলেয়া বিবি একটু খিটখিটে মেজারের মহিলা ছিল। বিধবা মা ছেলেকে অনেক কষ্ঠে মানুষ করেছেন। হাসনার এমন আহল্লাদীপনা, সে মোটেই সহ্য করতে পারতেন না।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top