সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

ফেরার পথে মেঘ (১ম পর্ব) : রোকেয়া ইসলাম


প্রকাশিত:
৯ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৪

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ১৪:০৯

 

কথা ছিল মামা সাথে আসবে, হঠাৎ একটা জরুরী কাজে আঁটকে গেল তাই আসতে পারেনি। ওকে একাই আসতে হল। ঠিক একাও নয় সাথে আছে মামার খুব বিশ্বস্ত সহচর মজনু। পায়েল যে গাড়িতে যাচ্ছে সেটাও মামার।

মামা পায়েলের বিষয় নিঁখুতভাবে দায়িত্ব পালন করছে। সেই দায়িত্বে কতটুকু স্নেহ আছে মনে মনে খুঁজতে থাকে। কেন এতো বছর পর ও’ মামার কাছ থেকে স্নেহ খুঁজছে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। রক্তের সম্পর্কের মাঝে স্নেহ খোঁজাটাও কি অপরাধ নয়? স্নেহ মমতার মত অবর্ণনীয় অছোঁয়া অনুভবীয় বিষয়ে খুঁত খোজার প্রয়োজনটাই বা কোথায়? ওর কি খুব বেশী স্নেহ মমতার প্রয়োজন? নিজেকে এতোটা অসহায় মনে করছে কেন ও’ কি নেই ওর? বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশে বসবাস করছে দীর্ঘকাল।

পায়েলের বাবাও ছিল থানা পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা। গ্রামে উত্তরাধিকারী হিসেবে পেয়েছিলেন অগাধ ধানী জমি। তার ছিল প্রচন্ড নাক উঁচু স্বভাব। তার চেয়ে নিচে অর্থবিত্ত এবং সম্মানের মাপকাঠিতে দাঁড়ানো মানুষকে খুবই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। কোন প্রকার সহযোগিতা দূরে থাক, যোগাযোগই রাখতেন না। যোগাযোগ না রাখা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে পায়েলের একমাত্র মামাও ছিল সর্বাগ্রে।

সেদিনের প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাবা বেঁচে থাকলে আজ বোধ হয় মামার সাথেই রাখতেন সবচেয়ে বেশী যোগাযোগ কথাটা মনে হতেই প্রশ্ন জেগে উঠে, ও কেন এতো বছর পর এলো মামার বাড়ীতে? ওরা তিন বোন- মিতু, কাকলি আর পায়েল। বাবার নাক উঁচু স্বভাব পুরোটাই পেয়েছে মিতু। নিজের চেষ্টায় নিজের ভেতর নাক উঁচু স্বভাবের বীজ বহুগুণে ফলিয়েছে মিতু।

বাছাবাছি করতে করতে মিতুর বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়। কাকলিরও তেমনি অবস্থা। বাবা মারা যাওয়ার পর পায়েল নিজের পছন্দে বিয়ে করে আমেরিকা চলে যায়, স্বামীর চাকুরীসূত্রে। ওর মা পরে মারা যান। পঞ্চাশ পেরিয়ে বুড়ো হদ্দ বেকার একজনকে বিয়ে করে উঁচু নাক কেটে পুরোপুরি বোঁচা হয়ে যায় মিতু। কাকলির আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি।

বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ দু’বোন নিঃশ্বেষ করে ফেলেছে দীর্ঘদিনে। থাকার মধ্যে আছে শুধু মেইন রোডের উপর ষোল ডেসিমেলের একতলা বাড়ি।

    আমেরিকা থেকেই খবর পায় বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বলটুকু দখল করার পাঁয়তারা হচ্ছে। দখল যারা করার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের সামনে মিতু ও কাকলি ঝরা পাতার মত উড়ে যাবে। 

আমেরিকাতেই পরিচয় হয় ফিরোজ মৃধার সাথে। ফিরোজ মৃধাই যোগাযোগ করিয়ে দেয় ইমতিয়াজ আহমেদের সাথে। পায়েলও সুদীর্ঘ নিরবতা ভেঙে তার বাবার তরফের দু’একজন প্রভাব প্রতিপত্তিশালী আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে তবেই এবারের দেশে আসা।

মিতু ও কাকলি বিষয়টায় একেবারেই রাজি নয়। হাল ছাড়েনা পায়েল। এই বয়সে মাসকাবারী সংসার খরচের টাকা কত আর টানা যায়? ওর বাবার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বোনদের সাথে আলোচনায় বসে। তারা কিছুটা গররাজি করায়।

পায়েল সময় নষ্ট না করে আহমেদ বিল্ডার্সের কাছে প্লট হস্তান্তর করে, বোনদের সাথে নিয়েই।

এ’কদিনে দিন রাতের পার্থক্যের সমস্যাটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। সব কাজ নির্বিঘ্নে মিটে যায়। মাথা থেকে মাখন সর্বস্ব বাড়িটা হাত ছাড়া হবার দুশ্চিন্তা থেকে একেবারে মুক্ত। মিতু এবং কাকলিকে আর টাকা পাঠাতে হবে না। নিজে দেশে এলে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে। সব মিলে নির্ভার মনে সুস্থির ঘুম হয় পায়েলের।

ভোরের আলো তখনও পৃথিবীতে পৌঁছায় নাই। কাকলির চিৎকারে জেগে হুড়মুড় করে দরজা খুলে বাইরে আসে পায়েল। মিতু আর কাকলি খুব করুণভাবে বিলাপ সুরে কাঁদছে, উঠোনের পাশে বকুল গাছটা জড়িয়ে।

পায়েল চিনতে পারে গাছটা। এটা মায়ের হাতে লাগানো গাছ। বাবা মারা যাবার পর লাগিয়েছিল এটা। দরজা খোলার শব্দে ওরা পায়েলকে দেখে নিষ্পলক বিদ্রুপের চোখে তাকিয়ে থাকে। ওদের শান্ত করার জন্য সিঁড়িতে পা দেবার উপক্রম করতেই কাকলী খেকিয়ে ওঠে, ‘তোর আর ডেভেলপারের মাঝে কোন তফাৎ নেই’।

অভিমানে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে নিঃসাড় বসে থাকে পায়েল। অনেকক্ষণ পর মনে হয় এ বাসাটা ওর না। এ শহরটাও নয়। বুকের ভেতরটা প্রচন্ড শুন্য হয়ে যায়, কেন এই ছুটে আসা? কোথায় যাবে, কোথায় যাবে? ভাবতেই মামার কথা মনে হয়। ব্যাগ গুছিয়ে ডেভেলপারের সই করা কাগজগুলোসহ সোজা মামার বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়। 

    সারাটা পথ একবারও মনে হয়নি দীর্ঘ অযোগাযোগের পর মামা ওকে কিভাবে গ্রহণ করবে। শুধু মনে হয়েছে কয়েকটা দিন নিজের করে আপন আলয়ে সুস্থির আশ্রয়ের প্রয়োজন ওর। যেটা একমাত্র মামাই দিতে পারবে।

    বলরামপুরে নানা-নানীর কবর জেয়ারত করতে চায় শুনে মামার চোখে মুখে চমক থাকলেও তিনি নিয়ে যেতে রাজী হন। হঠাৎ কাজে আঁটকে যাওয়াতে তারই নিঁখুত ব্যবস্থাপনায় পায়েলকে পাঠায়।

    -আপা মির্জাপুর পার হয়ে গ্যাস নেব তখন নাস্তা করতে পারবেন।

    ড্রাইভারের কথায় চমকে তাকায়।

    -সকাল সকাল বাইর হইছি তো তাই জ্যামে আটকায় নাই গাড়ি।

    “যানজট” এই বিষয়টার সাথে কোনদিনই পরিচয় ছিল না পায়েলের। দেশে এসে এই বিষয়টার ভয়াবহতা টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। ওর থোক বরাদ্দ সময় থেকে খুচরো খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেকটাই।

    -সামনে ভাল একটা রেস্তোরা আছে, থামাবো ঐখানে?

    -গ্যাস নিয়ে নাও। খাবার আছে টিফিন কেরিয়ারে।

গাড়ি সি.এন.জি ষ্টেশনে ঢুকতে ঢুকতেই পায়েল শুনতে পায় মজনু বলছে,

    -ম্যাডামের সব দিকেই নজর। সবার জন্যই নাস্তা পানি গুছাইয়া দিছে।  পায়েলের বুকের নিবির জলাশয়ের মাঝখানে ছোট্ট একটা ঢিল পড়ে। তরঙ্গায়িত হয়ে শুস্ক পাড় অবধি পৌঁছায় জলের ছোঁয়া। রাবনা বাইপাসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নাস্তা পর্ব শেষ করে পায়েল। হাতের বাম দিয়ে ঢুকে গেলেই শহর।

মামা বোধহয় মিতু আর কাকলির বিষয়টা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন, মজনুকে তেমনি নির্দেশনা দেয়া।

 -আপা, শহরের ভেতর দিয়ে যাবেন না বাইপাস দিয়ে যাব?

 -শহর নয়, অন্যপথে চল।

বাইপাসে উঠে যায় গাড়ি। একদম অচেনা পথ। কবে হল এই পথ! মনে হয় বেশ কয়েক বছরের পুরোনো পথ এটা।

পায়েলের বুকের ভেতর অভিমানে আদ্র হয়ে যায়। দু’দুটো মূর্খ আবেগ সর্বস্ব মানুষ। ওদের জন্যই যেতে হচ্ছে এই ঘুর পথে। আরে বোকারাম- শিউলি গাছ, বকুল গাছ, কাঁঠাল গাছ ধুয়ে কি পানি পান করবি? আর সে পানিতে কি পেট ভরবে? বাসায় যে ওয়াসার লাইনের পানি আসে, সেটাই পান কর না। বিল’তো দিতেই হয়। আবার বলে কিনা এই বাড়ীতে ওদের শৈশব কৈশোরের সুবাস উড়ে বেড়ায়। আরে এবার যা হল না তাতে প্রতিটা রুমে নামী কোম্পানীর দামি এসি লাগাতে পারবি। রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে সুবাস নিতে পারবি, যে ব্র্যান্ড চাস সেই ব্র্যান্ডের।

বিকেল পাঁচটায় গ্যাস দেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সাবধানী ড্রাইভার সিলিন্ডার পূর্ণ করে নিতে এলেঙ্গা সি.এন.জি ষ্টেশনের লাইনে দাঁড়ায়। দীর্ঘক্ষণে পায়েলের তলপেট ভারী হয়ে গেছে। ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজেকে ভারমুক্ত করে অনেকক্ষণ ধরে। সুস্থির হয়ে বসে এবার।

চলবে..



রোকেয়া ইসলাম
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top