সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

উপন্যাস; শাপলা ঢাকা জলকন্যা (শেষ পর্ব) : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৫ নভেম্বর ২০১৯ ২১:৩৬

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ১৯:২৪

 

ফরিদ নিব্যার চালিউ উআর মা নিবিনা নে। অর মা একডা জাত শয়তান, ইবলিস। অরে আমি কুনদিনও দেখব্যার পারি নাই। হিংসুটে এক বজ্জাৎ মিয়ালোক। শুধু তোর জন্যি.....
মা, থাউক ঐসগল কতা, আমার নসিবে যা ছিল তাই অইছে। 
এই সময় জোড়ে মেঘ গর্জ্জন করে ওঠে, বিজলী চমকায়। 
মা মেয়ে দৌড়ে ঘরে ঢোকে। 
বাইরে ঝম ঝম বৃষ্টি পড়ছে।
বাতাস এর বেগ ও খুব।
বিজলী চমকাচ্ছে আর সাথে সাথে মেঘের ভয়ঙ্কর ডাক।
আকাশ ভেঁেঙ্গ টিনের চালে বুঝি হুরমুর করে পড়ে।
চালাঘর উঁড়িয়ে নিয়ে যাবে নাকি। 
হাসনা কাঁথা মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে দুই কানে আঙ্গুল দিয়ে আল্লারে ডাকতে থাকে। 
হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয় একটা ক---ড়া---ত। 
মনে হয় পুরনো বটগাছটা ভেঙ্গে পড়লো। 
হাসনা লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। 
জানালা খুলে দেখার চেষ্টা করলো।
বিজলী আলোতেই বোঝা গেল, সত্যি সত্যিই গাছটা ভেঙ্গেঁ পড়েছে। 
বুকটা আরো মোচড় দিয়ে উঠলো। 
দিনে দুপুরে, রাত বিরাতে, জোৎস্নারাতে বুড়ো বটগাছটার নীচে ফরিদ আলীর সাথে কত গল্প করেছে হাসনা।
কত কালের পুরনো গাছ। 
কত ঝড় হয়।
আজকের ঝড়ে গাছটা ভাঁঙ্গলো ক্যান?
আমার ফরিদের তো কিছু হয় নাই?
ফরিদ কি সত্যি সত্যিই আবার বিয়া করবো?
ফরিদ আমারে ভূলব্যার পারছে?
কিন্তু.... আমি তো পারতেছি না। আমি কি করবো?
হাসনা ছটফট করতে থাকে। 
ঘুম আসে না। 
বৃষ্টির বেগ কমে গেছে।
কত কথা মনে পড়ে।
ক্ষেতে বৃষ্টি হলেই ফরিদ গলা ছেড়ে গান ধরতো।
বেসুরো গলার গানও হাসনার খুব ভালো লাগতো।
গান শেষ হলে, হাসনাকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করতো কেমুন লাগলো, কইলা না?
বালো না। শিয়াল বিলাই পালাইবো। 
কি কল্যা? বলেই হাসনারে আরো কাছে টানতো। 
হাসনারে কখনো বকাঝকা করে নাই। 
অথচ ঐ দিন ফরিদ এত রাগ করলো ক্যান?
আর মা’রে তো ও ভাল করেই চেনে।
এতদিনেও কি ফরিদের রাগ পড়ে নাই?
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে হাসনা। 
সকাল হয়। 
গাঁয়ের লোকজন উপরে পড়া বটগাছটার কাছে ভীড় করে।
কেউ কেউ আফসোস করে- আহা কত দিনের পুরনো গাছ।
কতলোক এর ছায়ায় বসেছে। 
বাপদাদার স্মৃতি চল্যা গেল। 
হাসনাও ভাবে, আমারও কত স্মৃতি আছে এইখানে। 
তাও কি শ্যাষ হয়া গ্যাল আইজ?
কোন স্মৃতিই শ্যাষ হবি না।
আবার আমরা গেরামের ব্যাক লোক মিল্যা আর একটা বটগাছের চারা এইখানে লাগায়া দেব। 
কিভাবে বাপ!
কিডা কলিরে এই কথা!
সবাই ঘুরে তাকায়।
ফরিদ আলি চুপ করে দাঁড়য়ে আছে। 
ব্যাডা তুমি কইছো? তুমার প্রস্তাবডা খুবই সোন্দর বাজান। আমরা এই গাছ লাগাব্যার দায়িত্বটা তুমারেই দিলাম বাজান। এই তোমরা সবাই কি কও? রাজী সবাই?
সব লোক সমস্বরে বলে হ, আমরা সবাই রাজী?
হাসনা যেন স্বপ্ন দেখছে। 
হাসনাকে দেখে ফরিদ আলী পা বাড়ায়।
হাসনা কাঁপতে থাকে।
হঠাৎ ঝটকা টান মেরে কে যেন ফরিদকে সড়িয়ে দেয়। 
হাসনা চমকে ওঠে। দেখে, ক্ষীপ্ত বাঘিনীর মত হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফরিদের মা।
যেন ক্রদ্ধ থাবায় আছড়ে ধরবে হাসনাকে।
মাগো, বলে আঁচলে মুখ ঢেঁকে দৌড়ে বাড়ী চলে যায় হাসনা। 
চোখে মুখে পানি ঢালে।
মাথা ঝিম ঝিম করে। 
পৃথিবীটা যেন দুলতে থাকে।
বদনার নালি দিয়ে মাথায় পানি ঢালে। 
হাসনার মা দৌড়ে আসে। 
জমিরুদ্দিন  বুঝতে পারে সব।
দূর থেকে সে সব লক্ষ্য করেছে।
দীর্ঘশ্বাস নেয়। 

মারে, কইরে মা আমার কনে গেলি? হাসু, হাসু মা।
ভোরবেলা জমিরুদ্দিন জোড়ে জোড়ে ডাকে হাসুকে। 
হাসু শুনেও না শোনার ভান করে বিছানায় পড়ে থাকে মুখ থুবরে। 
গতকালকের কথা ভুলতে পারে না কিছুতেই। 
ফরিদ তো তার তেমনই আছে।
ফরিদের চোখে মুখে সেই আগের ভালবাসাই দেখেছে হাসু।
ফরিদতো তাকে দেখে, কাছে আসতে চাইছিল। 
হয়তো কিছু কইতো। 
কি কইতে চাইছিল?
মাগো, আমি কই কি, চল আইজ আমরা বাপ বেডি মিল্যা মরিচ ক্ষ্যাতে যাই। বর্ষার পানি আইতে শুরু করছে। ক্ষ্যাত ডুব্যা গেলি সব মরিচ গাছ মর‌্যা যাবি মা। চল্ মরিচ তুল্যা আনি। জমিরউদ্দিন মেয়েকে বলে। 
বাজান আমার বাল লাগতিছে না। তুমি যাও। মারে সাথে নিয়্যা যাও। 
তর মা গেলে দুপুরের রাধা কেডা রাধবো?
আমিই রাধুমনে। যাও।
আইচ্ছা মা। আইজ তাইলে আমরা মজা কর‌্যা খাবনে। আমার মা’র হাতের রান্না এহেবারে আমার মায়ের মতই। 
জমিরুদ্দিন মেয়ের কষ্ট অনুভব করে।
হাসুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। 
কাঁধে গামছাটা জড়িয়ে টুকরি হাতে ক্ষেতের দিকে পা বাড়ায়। 
বাবা মা কেউ বাড়ীতে নাই। 
হাসু রান্নাঘরে রান্না বসায়।
একা একা আপন মনে কতকিছু ভাবে।
কোন কথার আগামাথা নাই। 
বারবার একই ভাবনা, ফরিদ আইলেও তো পারে। 
রাগের মাথায় কি কইছে আমি তো সব ভুল্যাই গেছি।
তুই ভুললি কি হবিরে হাসু, আমি তোরে ভুলে নাই। ও হাসু, কি ভাবতিছিস এতো সইয়ের কথায় চমকে ওঠে হাসু।
উ...! কিডা...... সই তুই কহন আইছিস। 
কুন্ সময়। দেখি তুই গালে হাত দিয়া তরকারী রান্ধা করতিছিস্।
কুনদিকে তর খেয়াল নাই। এত ভাবিস না তো হাসু। আমি তরে একটা পাামর্শ দিব্যার আইছি। শুনলে তর বালই হবি। 
কি পরামর্শ!
শোন্ রমজানের সাথে তো আমার...
হ, বুঝছি। আমার বিয়ার পয়গাম নিয়া আইছ না?
আমি ফরিদরে ভুলবার পারব নানে সই। 
আরে আরে, কানতিছিস ক্যা? আমি এমনি তোরে কল্যাম। হাসু, তুই ইট্টু হলিও লেহাপড়া করছিস। 
সবই বুঝব্যার পারিস। জেবনডা এইভাবে নষ্ট করিস না। তোর দেখলি আমার খুব খারাপ লাগেরে। ফরিদ এর মা একটা আস্তা শয়তান। ফরিদ ভাই কী করবি ক’। কাইলক্যা রজমানের সাথে অনেক কথা কইছে। আফসোস করছে খুব। 
কি কইছে সই?
কইছে তার মা তার ভাগ্নি কাকলীর সাথেই ফরিদের বিয়া দিব। সামনের সপ্তায় দিন তারিখ ঠিক করবো। 
না, না সই। তুই রমজান ভাইরে বুঝাইতে ক। আমি পাগল হয়্যা যাব। হাসু ডুকরে কাঁদতে থাকে। 
সই.....। আমারে তুই ফরিদের সাথে দেখা করব্যার ব্যবস্থা কর‌্যা দিব্যার পারবি? রমজান ভাইরে ক’ না ইট্টু। 
উঠানে দাঁড়িয়ে রমজান সব কথা শুনছিল।
সে বাধ সাধলো। 
না না, হাসু বইন। এই কাম আমি করব্যার পারবনানে। ফরিদের হাত পা শেকল দিয়ে বাধা। অর মা একটা আস্ত ডাইনী। আমারে শুদ্ধা খায়া ফেলবো। তারেচে বইন আমি তুমার বাল একটা প্রস্তাব আনছিলাম। 
রমজান ভাই, আমি কি কর‌্যা তোমাগরে বুঝাবো। আমারে মাফ কর‌্যা দাও....। 
বুঝছি বইন। কুনদিন তুমার মন বদলাইলে নিজের ভাই মনে কর‌্যা মমতাজরে জানাইও। 
আসি সই। মন খারাপ করিস না। 
মমতাজ এর প্রথম বিয়ে প্রেম করে হয়েছিল।
এক বছরের মাথায় তালাক দেয় মমতাজকে।
শাশুড়ী ননদের অত্যাচারে শান্তশিষ্ঠ মেয়েটি আজ বড়ই তুখোড়। 
হাসু, মমতাজের কথাবার্তার ধরন দেখে অবাক হয়।
রমজান ও খুব ভাল মানুষ। মমতাজ এর সব জেনেশুনেই বিয়ে করছে। 
মমতাজ ও রমজানের একসাথে চলা হাসুর মনে শান্তি আনে।
সই এর সুখ দেখে নতুন করে সুখের স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করে। 

গতকাল সই মমতাজ কে স্বামীর সাথে একসাথে দুইজনকে হাসিখুশী দেখে হাসুর মনটা আরও অস্থির হয়ে ওঠে ফরিদ আলীর জন্য। 
মমতাজের প্রথম ঘর ভেঙ্গে গেছে।
শাশুড়ী দর্জাল ছিল।
প্রেমের বিয়ে ছিল ওরও।
স্বামী ভাল মানুষ হলেও ভাই-বোন, মায়ের কারণে ভাল থাকতে পারে নাই। 
তারইমত-
একদিন ভালবাসার স্বামী মিথ্যে প্ররোচনায় তালাক দিয়ে দিল মমতাজকে। 
মমতাজ একরোখা মেয়ে। 
প্রতিবাদী।
গাঁয়ের সমস্ত লোকের সামনে চিৎকার করে বলেছিল- “ঐ বদমাইশ মাইয়ালোক আমার সংসার ভাঙ্গা দিল। আমার স্বামী নির্দোষ, অসহায়, মা বানের কথা না শুনলে অরে খুন কর‌্যা ফেলবি। অয় বউ এর জন্যি খুন হবি ক্যা?
অ্যা....? বউর জন্যি খুন হবি? এ দুইনায় কুন পুরুষ ব্যাডা বউ এর জন্যি খুন অইছে? নাকি কেউ বউএর জন্য খুন করছে? দ্যাখছ্যান কেউ? খামাখা বউরে ভালবাস্যা খুন হবি ক্যা? বরং তালাক দিলি, সাপেও মরব, লাঠিও থাকব। মানে বুঝছেন হগলে নিশ্চই। বউ এর জন্যি খুন করলি, জেল অইব, ফাঁসী হইব। আর তালাক দিলি জেবন ও বাঁচব। নতুন আর একখান বউও পাইব।”

শেষের কথাগুলো মমতাজ খুব ঘেন্নার সাথে বিকৃতমুখে বলেছিল। চিৎকার করে আরও বলেছিল- “অয় আমারে তালাক দিয়া বিয়া করব আর একখান। আমিও করুম। আপনারা সমাজের বড় মানুষগুলো দেখবেন। এই দজ্জাল বাড়ীর বউ কয়ডা টেকে। আর আমার সংসারও দেইখ্যান, টেকে নাকি।” 
মমতাজ সাহসী মেয়ে। 
প্রতিবাদ করে তালাক নিয়ে চলে এসেছিল। 
ঠিকই নতুন সংসার করছে।
আর তার স্বামীর  নতুন বউও গ্যাছে। 
আগের শশুর বাড়ীর লোকের সামনে দাপটে চলাফেলা করে নতুন স্বামীকে নিয়ে।
একটা এনজিওতে ছোটখাট কাজ করে।
রমজান ব্যবসা করে। 
বাবা মা নেই। 
দুই ভাই বোন।
বড়বোন ও বোনের জামাই খুবই ভাল। 
মমতাজকে নিজের বোনের মত দেখে। 
সুখী সংসার। 
বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাসু মমতাজের সংসার এর কথাই ভাবছিল।
আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসে। 
না, আর এভাবে থাকা যায়না। 
আমি নিজেই যাব ফরিদের কাছে।
ফরিদ সেদিন রাগের বশে সব করছে।
ও মন থেক্যা আমারে তালাক দেয় নাই।
আমি যাব অর কাছে। 
হাসু মনে মনে স্থির করে, আর দেরী নয়। 
আজ রাতেই বাবা মা ঘুমিয়ে পড়লে, চুপ চুপ করে যাবে ফরিদের কাছে। 
এ গ্রাম আর ও গ্রাম।
হেটে গেলে সামান্য পথ।
কিন্তু এখনতো বর্ষা কাল। 
চারদিক থৈ থৈ পানি। 
তাতে কি?
হাসু গাঁয়ের মেয়ে।
নৌকা বাইতে জানে। 
নৌকা নিয়ে ফরিদের কাছে যাবে। 
যাবেই আজ রাতে। 
হাসু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। 

গভীর রাত। 
চারদিক শুনশান। 
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক।
মাঝে মাঝে বর্ষায় ডোবা বেতের ঝাড়ে ডাহুক-ডাহুকীর ডাক। 
ডিমে তা দিচ্ছে হয়তো। 
হাসু শাড়ীর আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে এগুতে থাকে ঘাটের দিকে। 
ঘাটে অনেক ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা বাঁশের খুটির সাথে দড়ি দিয়ে। 
চারদিক থৈ থৈ পানি।
টলমল করছে।
হাসু পানিতে চেয়ে দেখতেই মনের অজান্তেই উজ্জ্বিবিত হয়।
কি সুন্দর চাঁদ উঠছে। 
জোৎস্না রাত। 
এতক্ষণ কিসের ঘোর ছিল দু’চোখে?
খেয়ালই করে নাই হাসু। 
জোৎস্নার আলোতে হাসু অদুরে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।
“কি রে হাসু, কি ভাবতাছস এত? আর দেরী ক্যান। যা সিদ্ধান্ত লইছস, সেই ভাবে আগাইয়া যাও। 
ফরিদরে তোর মনের কথা জানা তাড়াতাড়ি। 
হ’ হ’ ঠিকই কইছো। 
তয় আর দেরী ক্যান?
না, না আর দেরী না। অহনই যাইতাছি।” 
হাসু মাথা ঝারা দিয়ে, একটা ডিঙ্গি নৌকার দড়ি খুলে বৈঠা দিয়ে পানি কেটে কেটে এগুতে থাকে ফরিদের বাড়ীর দিকে।
বৈঠার ঘায়ে পানিতে চাঁদের প্রতিবিম্বটা কেমন কেটে কেটে ঢেউয়ের সাথে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। হাসু গভীর ভাবে দেখে চাঁদের কাটা কাটা খন্ড খন্ড প্রতিচ্ছবি। 
ধীরে ধীরে কখন যে হাসু ফরিদের বাড়ীর কাছে এসে গেছে টেরই পায়নি।
হাসু ডিঙ্গিটা একটা গাছের সাথে বাঁধে।
এখন অনেক রাত্রি। 
ফরিদ হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এখন।
ঐ তো টিনের ঘরটা চাঁদের আলোয় চকচক করছে।
বিয়ের পর হাসুকে এই নতুন ঘরেই তুলেছিল ফরিদ।
ঘরের পাশেই বড় বড় দুইটা আম গাছ।
গাছ ভরা আম ছিল।
আমের মৌসুমে বিয়ে হয়েছিল হাসুর। 
মাঝরাতে পাকা আম টিনের চালে পড়তেই হাসু ভয়ে জড়িয়ে ধরেছিল ফরিদকে। 
কত স্মৃতি মনে পড়ছে আজ নতুন করে। 
ও পাশে পাকা কুয়া।
কুয়ার পাশ ঘেঁসে হাসু আর ফরিদ দু’জনে মিলে একটা বক ফুলের গাছ লাগিয়েছিল।
কয়েক দিনেই তরতর করে বেড়ে উঠেছিল গাছটি।
হাসুদের বাড়ীতেও অনেক বড় একটা বক ফুলের গাছ ছিল। বক ফুল দিয়ে ডালের বড়াখেতে বড়ই সুস্বাদু। 
ফরিদ শাশুড়ীর হাতে এই বড়া খেয়ে খুব মজা পেয়েছিল।
পড়ে শাশুড়ীই তাকে ঐ চারাটি দিয়েছিল।
হাসু অবাক হয়, বক ফুলর গাছের দিকে তাকিয়ে।
থোকা থোকা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে গাছটি।
বর্ষার মৌসুমে ফুল ফোটে। ফুলের ভারে গাছটা হেলে গেছে একদিকে।
ফরিদ যে কি। 
একবারও দেখে নাই গাছের এ বেহাল অবস্থা। 
ঠিক আছে সকাল হলেই দু’জনে আবার ঠিক করে দেবে গাছটি। 
কিন্তু ....... ডিঙ্গিতে বসে বসেই এতকিছু ভাবে হাসু।
কিভাবে যাবে এতদিন পর হঠাৎ করে এত রাতে ফরিদের ঘরে?
ঘরে যদি আর কেউ থাকে?
না, না আর কে থাকবে ফরিদের সাথে?
হাসু ডিঙ্গি থেকে নামে। 
গা’টা যেন ছমছম করে।
কাঁপতে থাকে শরীর।
হাসু, একপা, একপা করে এগুতে থাকে ফরিদের ঘরে। 
পেছনের জানালা দুটি আগের মতই খোলা। 
শিরশির করে মিষ্টি বাতাস ঢোকে দখিনের এই জানালা দিয়ে।
জানালার পাশেই ঘুমানোর খাট।
হাসুর বাবা, বাড়ীর কাঠাল গাছের কাঠ দিয়ে খাটটি বানিয়ে দিয়েছিল হাসুকে বিয়ের সময়। 
জানালার কাছাকাছি যেতেই চমকে ওঠে হাসু।
ফিস ফিস করে কার সাথে গল্প করছে ফরিদ এত রাতে?
এখনো ঘুমায়নি ফরিদ? 
হাসুর সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে থরথর করে।
আস্তে আস্তে জানালার কাছে এগিয়ে যায়। 
ফরিদ বিয়ে করছে। 
বউ কে বাহুবন্ধী করে মিষ্টি মিষ্টি গল্প করছে।
হাসুর সাথেও তো এভাবেই গল্প করতো ফরিদ। 
তবে কি সব স্বপ্লই ধূলীসাৎ হয়ে গেল হাসুর? 
সারা শরীর দুলতে থাকে হাসুর। 
অবশ হয়ে যায় দেহ। 
টলতে টলতে ডিঙ্গি নৌকায় ওঠে।
চার দিক অন্ধকার।
ইশান কোনে কালো মেঘ।
বিদুতের ঝলকানি। 
ঝড় উঠবে হয়তো।
কোন দিকে ভ্রক্ষেপ নেই হাসুর।
পানির বুকে সজোরে বৈঠা ফেলে।
ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ হয়। 
ফরিদ জোড়ে বলে ওঠে, ক্যাডারে? ক্যাডা ঘাটে? এতরাইতে ঘাটে ক্যাডা?
হাসুর বুকটা আর্তনাদ করে ওঠে।
ফরিদের কন্ঠস্বর বিষাক্ত তীরের মত তার বুকটাকে ক্ষত বিক্ষত করে।
ফিনকী দিয়ে রক্ত ঝরে যেন।
হাসু দ্রুত বৈঠা টানে। 
হঠাৎ ঝড় ওঠে প্রচন্ড। 
বকফুলের গাছটি কড়াৎ করে ভেঙ্গে পড়ে। 
ফরিদ আলী হারিক্যান নিয়ে ঘরের বাইরে আসে। 
সঙ্গে নতুন বউটিও। 
সে বলে লও, ঘরে লও। কিছু না। বাতাসে বকফুলের গাছডা পর‌্যা গ্যাছে। 
হাসু তখন অনেক দুরে চলে গেছে ফরিদের বাড়ী থেকে।
ফরিদ কিছুই বুঝতে পারলো না।
ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। 
বৈঠায় কোন কাজ হচ্ছে না।
হাসু বৈঠা রেখে দেয় ডিঙ্গির পাটাতনে।
পানিতে শাপলা ফুল ফুটে আছে। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।
হাসু দু’হাত ভরে টেনে টেনে তুলতে থাকে শাপলা। 
আপন মনে মালা গাঁথে।
সাড়া শরীর শাপলার মালায় জড়িয়ে ফেলে।
বাতাসে ডিঙ্গি দুলতে থাকে এপাশ ওপাশ। 
কোন দিক ভ্রক্ষেপ নেই হাসুর। 
শাপলা তুলছে আর মালা গাঁথছে।
হাতে, গলায়, পেঁচিয়ে নেয় শাপলার মালা।
একসময় হঠাৎ করে একটা দমকা বাতাসে ডিঙ্গিটা উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়। 
হাসু টাল সামলাতে পারে না। 
গভীর পানিতে পড়ে তলিয়ে যায় বর্ষায় ভরা পানিতে গড়া সাগরের বুকে। 
চারদিকে শুধু পানি আর পানি। 
একূল ওকূল দেখা যায় না। 
ডিঙ্গিটি ধীরে ধীরে ভাসতে থাকে।
বাতাসে দোল খেতে খেতে ফরিদের বাড়ীর পাশেই ভাসতে থাকে। 

নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। 
হাসুর মৃত লাশটিও ফরিদের বাড়ীর অদূরে কচুরী পানার সাথে ভেসে আটকে থাকে। 
ভোর রাতের ঝড়ে ওলট পালট করে দেয় গ্রামের ঘর বাড়ী, গাছপালা। 
দূরন্ত এ ঝড়। 
কঠিন, নির্মম এক কাহিনী হয়ে গেল এবারের এই ঝড়। 
ভোর বেলা ফরিদ আলীর নতুন বউ খালাতো বোন কাকলী আর সে দুজনে বকফুল গাছটিকে ঠিকঠাক করতে যায়। 
গাছ ভরা সাদা ফুল। 
ফরিদের বুকটা ধপধপ করে। 
মোচড় দিয়ে ওঠে শরীর।
কাকলী ফুল ছিড়ে ডালায় ভরতে থাকে। 
ফরিদের মনে হয় ঔইতো হাসু পটপট করে ফুল গুলি ছিঁড়ে কোচড় ভরছে আর মিটমিটি হাসছে। 
কি দ্যাখতাচ? তুমাওে, মা’র মত আমি বকফুলের ডালের বড়া খাওয়াবো। কি সুন্দর ফুল, দ্যাখছো?
আয় তোর খোপায় একটা লাগায়া দেই। 
এই.... কি হয়ছে তুমার?
ফরিদ আলী চমকে ওঠে কাকলীর কথায়।
পুরনো দিনের কথা মনে হলে কোন হুশ থাকে না তার।
কি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়।
চোখে খালি হাস্নাকে দেখে।
হাস্না ভেবে ফুল হাতে কাকলীরে বলে, আয় তোর খুপায় একটা ফুল গুজ্যা দেই। খুব সুন্দর দেখাবি। 
যাও--- কি যে কও। মাথায় চুলতো আউলা ঝাউলা। কেউ যদি দেখ্যা ফ্যালে। 
কাকলী শাড়ীর আঁচল দিয়ে লজ্জায় মুখ। ঢাকে ফরিদের হুস হয়। 
বকফুলের ডালা ঘরে রেখে, ঘাটে গোসল করতে যায় কাকলী ও ফরিদ দু’জনেই। 
হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে কাকলী। কচুরী পানার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে চিৎকার করতে থাকে
লাশ! লাশ! মরা মাইনষের লাশ!
কস কি? কই, কুনখানে?
ফরিদ আলী লাফ দিয়ে সাঁতার কেটে লাশের কাছে যায়। 
ওরে আল্লা..... একি সর্বনাশ করলিরে....... এ লাশ যে হাস্নার। তার পরানের প্রতিমা হাসুর।
ফুলে ড্যাব ড্যাব হয়ে গেছে। 
সারা শরীর শাপলার মালা দিয়ে জড়ানো। 
ফরিদ আলীর মুহুর্তে সমস্ত স্মৃতি এসে খুবলে খুবলে খায়।
কচুরীপানা দুহাত দিয়ে সরিয়ে শাড়ীর আঁচল ধরে পরম যতেœ লাশটি টেনে আনে ঘাটে।
কিছু দুরেই ডিঙ্গি নাওখানা যেন ব্যঙ্গ করতে থাকে দুলতে দুলতে।
এ তুই কি করলি হাসু?
ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে ফরিদ আলী। 
তোর বাপ মা’র কাছে কুনো সারা না পায়াইতো মার সাথে জেদ কর‌্যা কাকলীরে বিয়া করছি হাসু। আমি মন থেক্যা এ বিয়া করি নাই হাসু। হাসুরে...... হাসু..... 
ইতিমধ্যে গ্রামের অনেক লোক জমে গ্যাছে। 
হাসু-ফরিদের ব্যাপরটা গ্রামের সবাই জানে। ফরিদকে সবাই স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে। 
মুহুর্তে খবর ছড়িয়ে যায় সারা গ্রামে। 
হাসুর বাবা জমির আলী ও মা কেবলই ফজরের নামাজ আদায় করে হাঁস মুরগীর ঘর খুলতে যাবে, এমন সময় কে একজন চিৎকার করতে করতে জমির আলীর সামনে আছড়ে পড়ে। 
ও জমির ভাই, তুমার কি সব্বনাশ অইছে, জান কিচ্ছু?
অ্যা, কও কি বাই? কি সব্বনাশ অইছে আমার?
সব শোনার পর সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় হাসুর মা। 
হাঁস মুরগী কর-কর, প্যাক-প্যাক শব্দ তুলে তার শরীরের উপর দিয়ে ঝাপটা মেরে চারদিক ছড়িয়ে পড়ে।
আশপাশের মহিলারা হাসুর মা’কে পাঁজা করে বারান্দায় শুইয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকে। 
জমির আলী .....মা... মা গো .....বলে ডাকতে ডাকতে চিৎকার করে চলে যায় ফরিদ আলীর বাড়ীতে।

শাপলার মালায় ঢাকা হাসুর মিষ্টি মুখ খানা যেন বিদ্রুপ করছে গ্রামের সবাইকে। হাসু যেন বিচিত্র ভঙ্গিতে সবাইকে বলে, “বাজান, তুমরা কেউ আমার মনের খবর রাহ নাই। এই গেরামের কেউ আমার কথা বুঝবার পারে নাই। কেউ আমার আর ফরিদের ব্যাপারটার কুনো সুরাহা করব্যার চেষ্টা কর নাই।” 
জমির আলী হাসুর লাশের উপর পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
লোকজন ধরাধরি করে লাশের পাশ থেকে সরিয়ে নেয়। 
নৌকায় হাসুর লাশ তোলা হয়।
ফরিদ আলী বৈঠা বেয়ে সে নৌকা নিয়ে যায় হাসুদের বাড়ীতে।
আজ আর ফরিদের মা কোন বাধা দেয় না ফরিদকে।
লাশের সাথে ফরিদের মা’ও যায় হাসুদের বাড়ীতে। 
গ্রামের শত শত নারী পুরুষ চোখের পানি ফেলে। 
হাসুর মা বারবার মুর্ছা যায়। 
জমির আলী জ্ঞান ফিরে একমাত্র সন্তান হাসুর শোকে পাথর হয়ে গ্যাছে। 
আঙিনায় শোয়ানো লাশের চারদিকে বিলাপ করতে থাকে হাসুর খেলার সাথী ছোট বেলার পরশী সইয়েরা। 
ফরিদ আলী নিস্পলক চেয়ে থাকে হাসুর শাপলা পড়া লাশের দিকে। তার জলপরী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আর বিলঅপ করতে থাকে-
এ তুই কি করলি হাসু? তর বালোবাসা আমার বালোবাসারে কাইড়া নিয়া গ্যাল। আমি তো মানুষ দেহানো বিয়া করছি হাসু। তোর বাড়ীর কাছে যায়া কত লুকায়া লুকায়া আমি চোখের পানি ফেলছি হাসু। তুই কিছুই জানিস নাই হাসু। আমার কইলজাডার কষ্ট কেউ দেখবার পারে নাই, কুঝবারও পারে নাই। 
লোকজন সরিয়ে নেয় ফরিদকে। 

লাশ সৎকারের জন্য আয়োজন চলে। 
কিন্তু চারদিক তো বর্ষার পানিতে ডোবা। 
করবস্থানও ডুবে গ্যাছে। 
এক চিলতে মাটি নাই কোথাও খালি। 
গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব ও গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ সিদ্ধান্ত নেন, শরীয়া মোতাবেক লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হবে। 
শেষ পর্যন্ত তাই করা হোল। 
সাদা ধবধবে কাপড়ে ঢাকা হাসুর লাশ কলার ভেলায় তোলা হোল। 
ফরিদ আলীর অনুরোধে লাশ ভাসিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তাকে দেয়া হোল। বর্ষার মাঝ দরিয়ায় লাশ ভাসিয়ে দেয়া হবে। 
ফরিদ আলী হাসুর লাশে কলাগাছে তৈরী ভেলা বৈঠা দিয়ে ঠেলে নিয়ে যায় মাঝ দরিয়ায়। ফাঁকে ফাঁকে শাপলা তুলে হাসুর লাশের উপরে ঢেকে দেয়।
ভোরের ফোটা শাপলাগুলি যেন খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে, একেকটা ফুল যেন একেকজন হাসু। 
ফরিদ আলী চেয়ে থাকে নিষ্পলক। 
কলার ভেলা ভেসে যায় দুর থেকে দূরে। 
শাপলার মালা জুড়িয়ে হাসুযেন হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নেয় ফরিদের কাছ থেকে। 
ফরিদ আলী বৈঠা বেয়ে তিরতির করে পানি কেটে কেটে চেয়েদেখে আর এগিয়ে যায় বাড়ীর দিকে। 
বারবার পেছন ফিরে চায়। 
না, আর দেখা যায় না হাসুকে বয়ে নেয়া কলার ভেলাটি। 
পূবের আকাশে সূর্যের লাল আভা মুছে গেছে। 
রোদের কিরন লাগে গায়। 
ফরিদ আলী গামছা মাথায় দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
ভেলাটি দেখার চেষ্টা করে। 
না, একেবারেই দেখা যাচ্ছে না ভেলাটি। 
ফরিদ আলী খুজতে থাকে প্রানপণে।
আর এক পলক দেখতে ইচ্ছে করে প্রিয় মুখটির লাশের ভেলা।
দিনের শুরুতে সূর্য্যরে আলোক রশ্মিতে ভেসে ওঠে হাসুর মিষ্টি মুখখানা।
দরিয়া জোড়া বিশাল শাপলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে শাপলার মালা জড়িয়ে, হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নেয় ফরিদের কাছ থেকে। দিগেন্ত মিলিয়ে যায় সব।
ফরিদ আলী ঘরে ফেরে। 
আবার শুরু হয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রতিকূলতাকে দূরে ঠেলে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখা। 
বয়ে চলে, ঠুকরে খাওয়া, ঘুনে ধরা এক স্বপ্ন হারানো নিরন্তর জীবন। 

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top