সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

বেওয়ারিশ : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২২ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৩৭

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ১৯:১৪

 

কি অদ্ভুত মানুষের জীবন। এই তো সেদিনের কথা। আমার একটি নাটকের রিহার্সেল ছিল।  সে এলো না।  মানে আসতে দেরী হচ্ছে।  ফোনের পর ফোন। মোবাইল বন্ধ।  রিহার্সেল বন্ধ। মূল চরিত্রটি ছিল তার।  সবাই বিরক্ত। আমিও।  অবশেষে তিনি এলেন।  করজোড় করে ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে ক্ষমা চাইলেন।  

কি বলবো দাদা, রাস্তায় এতই জ্যাম.... থাক, থাক চুপ থাকুন। সমম্বরে বললো সবাই।  তিনি মিষ্টি হাসি চেপে রিহার্সেল শুরু করলেন। রিহার্সেলে দেরী হলেই তার বানানো নানা অজুহাত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেন।  সবাই জানে, নাটকের লোকজন বিশেষ করে।  আমার কর্তার বন্ধু।  সে কারণে তার ব্যক্তিগত অনেক কিছুই জানি আমি।  

প্রায় বিশ বছর ধরে স্ত্রী পক্ষাখাত গ্রস্থ। শয্যাশায়ী।  বড় ছেলে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্নহত্যা করেছে।  বৌ এর দেখ্ ভাল্ তাকেই করতে হয়। নূন আনতে পান্তা ফুরায়।  অবশেষে ছোট ছেলে ও বৌকে নিরূপায় হয়ে রংপুরে নিজ বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন।  ছেলে ছোটখাট চাকুরী করে ক্লিনিকে মায়ের চিকিৎসার খরচ চালায়। বলছিলাম আমাদের একজন নাট্য প্রেমিকের কথা।  জাতিতে হিন্দু।  খাবার খেতেন মুসলমানদের বাড়ীতে গোগ্রাসে, নিঃসঙ্কোচে।  তার কাছে কোন জাত-ধর্ম বিভেদ ছিল না।  বিভ্রান্ত জ্বালাময়ী জীবনে এত দগ্ধতার মধ্যেও সুখের হাসিভরা কথা শুনে আমি অবাক হয়ে ভাবতাম “বাহিরে যার হাসির ছটা, ভিতরে তার চোখের জল”।  মনে প্রানে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করতাম ও ভাল বাসতাম।  দাদা বলে ডাকতাম। খুশী হতেন খুব।

বাংলা একাডেমীতে ২১ শে বই মেলা চলছে। আমি মেলার মাসে বেতারে কোন নাটকে থাকি না বা নাটক করি না সংগত কারনেই। মেলা নিয়ে ব্যস্ত।স্টলে থাকি।  আমার কর্তার নাটকে তার রির্হাসেল ছিল সেদিনও।  কর্তার মেজাজ তুঙ্গে।  সব আর্টিষ্ট এসে গেছেন। তিনি আসেন নাই।  ফোনের পর ফোন। 
জবাব এল দাদার, শরীরটা ভাল নেই। এই একটু পরেই আসছি।  কর্তার খাশ জবাব- আসার আর দরকার নেই। শরীর যখন খারাপ শ্মশানে যান। শ্রাদ্ধ খাব।

ফোনের মধ্যেও একগাল হাসি।  ছোটবেলার বন্ধু।  যত কঠিন বকাঝকাই করূক না কেন আমার কর্তা, সে কখনো তা আমলই দেন না। এর মধ্যে উপস্থিত দুজন শিল্পী শামসুল ইসলাম ও তাহ্মীনা ব্যক্তিগত ভাবে বাবা ও মেয়ে। তারা বললেন, আজ প্রায় দু’মাস হোল উনি যাত্রাবাড়ী আমাদের বাসায় থাকেন। আসলেই উনি অসুস্থ। এক সাথেই আমরা রওয়ানা হচ্ছিলাম। হঠাৎ সে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

আমার বড় ছেলে ও বৌ কে বলছি, ডাক্তার দেখাতে।
এসব কথা বলতে বলতেই সামসুল ভাইয়ের বাসা থেকে ফোন এল বাবা, তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এস, ডাক্তার এসেছিলেন। কাকু মারা গেছেন। 
উপস্থিত সকলেই হতভম্ব।  আমার কর্তা বাকরুদ্ধ। ফোনে বকাবকির জন্য অনুতপ্ত। বইমেলা থেকে আমি বাসায় ফিরছি।  রাস্তায় ফোন।  ভয় পেয়ে গেলাম।

কর্তার ফোন।  ভারী গলায় বললেন্ “দিলীপ আর নেই”। আমি স্তম্ভিত।  দিলীপ রায়। আমাদের দিলীপ দা। বাসায় এলাম।  রিহার্সেলে উপস্থিত সব শিল্পীর ভীড়।  কিছুই বললো না কেউ আমাকে।  সবাই গাড়ী রিজার্ভ করে রওয়ানা হলেন যাত্রাবাড়ী, লাশের সুরৎহাল করতে। কিছুক্ষন আগে যিনি একজন দুঃখী হাস্যজ্জ্বল মানুষ ছিলেন, তিনি এখন আর মানুষ নন।  শুধুই লাশ।  মৃত্যুর দু’মাস আগে ভাড়া বাড়ীতে ভাড়ার টাকা বাকী ছিল বলে, তাকে বাড়ীওয়ালা তার আসবাবপত্র কেড়ে রেখে, বাড়ী থেকে বের করে দেন।  শিল্পীদের কোন জাতকূল নেই।  তারা শুধুই মানুষ।  আশ্রয় দেন একজন বিবেকবান ধার্মিক মুসলমান পরিবার।  শামসু ভাই বলে ডাকি আমরা। জাত শিল্পী।  

জানা যায়, কিছুদিন আগে কোন এক ইমাম সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হতে। বোধ করি মহান আল্লাহ্তা’য়ালা তার আকুতি শুনেছিলেন। তাই একজন মুসলিম পরিবারেই তার মৃত্যু হলো, তাদের হাতেই শেষ পানিটুকু, মুখে দেবার পর। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। 
রংপুরে যথন তার মৃত্যু সংবাদ দেয়া হলো, হিন্দু বন্ধুদের। এমন কি তার ছেলে ও আত্নীয় স্বজনদের কেউ লাশ নিতে রাজী হলেন না। বললেন, বেওয়ারিশ  লাশ হিসেবে সৎকার করতে।  আমার কর্তা ও শিল্পী বন্ধুরা চাঁদা তুলে অবশেষে, লাশ পাঠিয়ে দিলেন রাত তিনটায় তার জন্মভূমি রংপুরে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এর গাড়ীতে। যেন ঘুমন্ত মানুষটি প্রিয় জন্মভূমিতে রওয়ানা হলো।  

সকাল দশটায় পৌছে গেল।  লোকে লোকারন্য।  ইতিমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে।  লাশের গাড়ী পৌছা মাত্র রংপুর শহরের সাধারণ মানুষ ও নাট্য শিল্পীরা যার অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের। তাদেও সহযোগিতায় সসম্মানে লাশটির শেষকৃত্য সম্পন্ন হোল।  দু’চারজন আত্নীয় স্বজনের সাথে ছোট ছেলে বিলাপ শুরু করলো। কেউ কেউ কিছু আর্থিক সাহায্য করতে চাইলো। লাশের সঙ্গে থাকা আশ্রয়দাতা শিল্পী শামসু ভাই গলা ফাটিয়ে ধমক দিলেন, একদম চুপ। কেউ মায়াকান্না দেখাবে না। সে তো একজন বেওয়ারিশ লাশ। করুনার পাত্র নন। 
কান্না থেমে গেল। মুসলমান বন্ধুরাই তার যাবতীয় সৎকার্য্যরে ব্যয় ভার বহন করলেন। তার নামে একটি পদক ও ঘোষনা করা হয়েছে।  “দিলীপ পদক”
স্বার্থান্বেষী আত্নীয় পরিজন এর দুর্ব্যবহারে হয়তো আড়াল থেকে, দাদার পূন্যময় অশরীরী আত্না এখনো মুখ টিপে হাসে। 

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top