সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

ফেরার পথে মেঘ (শেষ পর্ব) : রোকেয়া ইসলাম


প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৩৮

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২১:০৫

 

ভুঞাপুর বাজারে গিজগিজ করছে লোকজন। সরু রাস্তায় ঠাসাঠাসি যানবাহন আর রাস্তার দু’পাশের ভাসমান দোকানপাটে। সব মিলিয়ে একটা ঘিঞ্জি এলাকা। 
    ঘন দোকানপাট পেরিয়ে ফাঁকা অবস্থান দেখে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ায়। “রমজান মিষ্টান্ন ভান্ডার” থেকে কিছু দই মিষ্টি কিনে নেয় মামার বাড়িতে যারা আছে তাদের জন্য। দোকান থেকে বেরুবার উপক্রম করতেই চোখে পড়ে স্বচ্ছ প্যাকেটে বাঁধা ময়দা আর চিনির তৈরী গজা। ছোটবেলায় কত খেত মনে হতেই কেনে কিছুটা।
    -আপা এই যে বাহাদীপুর রেলষ্টেশন। আপনে যাবার পর এটা হইছে। এলাকার মানুষ যে কি খুশি, কি আর বলবো।
    -এ্যাই, থামাও থামাওতো।
    গাড়ীটা নিরাপদে সাইড করার পর পায়েল নামে। রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে। কে যেন বলেছিল বাংলাদেশের সব গ্রাম মূলতঃ একই রকম দেখতে। অনেকদিন ও  বাংলাদেশকেই দেখার মত করে দেখেনি। নিবিড় গ্রাম দেখা হয়না কতদিন!
    সড়কের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে দু’পাশে তাকায়। বহুদূর একই রকম লাগে। কিছুটা ব্যাতিক্রমও চোখে পড়ে। পায়েলের মায়ের নাকি রেললাইন দেখলেই দূরে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করতো।
    ও দেশে এসেছে প্রায় তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে একবারও নিবিড় করে মায়ের কথা মনে হয়নি। অথচ ও আশ্রয় নিতে যাচ্ছে মামার বাড়ীতে। আবদ্ধ মনটাকে মুক্ত হাওয়া লাগাতে যাচ্ছে নানার গ্রামে কবর জেয়ারতের উপলক্ষে।
    বুকের গভীর অস্পষ্ট একটা ছায়া ভেসে উঠে।
    হঠাৎ দূরে চোখ যায় পায়েলের। একটা গাছের ছায়ায় একজন বৃদ্ধা একা একা কথা বলছে। আওয়াজটা কানে আসছে তবে শব্দ অস্পষ্ট। এগিয়ে যায় পায়েল।
    -কি গো বড়লুকের ঝি, কি দেখবার আইসুন?
    পায়েলের গতি থামিয়ে দেয় বৃদ্ধা। দৌঁড়ে আসে ষ্টেশন লাগোয়া দোকানের কিশোরটি।
    -ম্যাডাম, হ্যার কইলাম মাথায় গন্ডোগুল আছে। বেশী কতা কবাইন না য্যান হ্যার লগে।
    কিশোরের কথা শেষ হবার আগেই দৌড়ানি দেয় বৃদ্ধা কিশোরটিকে।
    -ঐ গুলামের ঘরের গুলাম, ক্যারা কইছে আমার মাথায় গন্ডগুল? তর মাথায় বিজলা কিরা, তর চইদ্দো গুষ্ঠির মাথায় গুয়ের কিরা। তরে তোর মামুয়ে পয়দা করছে।
    বলেই হা হা করে হাসতে থাকে।
    পায়েল কিংকর্তব্যবিমুঢ় দাঁড়িয়ে থাকে।
    -হুনুইন গো মা-সকল, আমার মাথায় কইলাম কুনই গন্ডগুল নাই। অহন কইনচে আপনে এইহানে আইসুন ক্যা। উপুজেলা ভূমি অফিস থে আইসুন?
    একটু দম নেয় বৃদ্ধা, মৃদু পায়ে পায়েলের দিকে এগিয়ে আসে।
    -র‌্যালপত বানাবাইন, মারকেট বানাবাইন, তাই আমাগো বাপ-দাদার জমি লাগবো?
    -রেলপথ, মার্কেট হলে তো তোমাদেরই ভাল। দেশ এগিয়ে যাবে, মানুষের উন্নতি হবে।
    -বুঝছি গো বুঝছি, আপনে উপুজেলার হেই বেডি অপিসার। রেজেষটি অপিসের হেই বেডি আপনে। আমার এই বুইড়া আঙ্গুলের ছাপ নিছিলাইন।
    -শুনুন, বসুন এখানে। আমার কথা শুনুন।
    -কি কবাইন কইন?
    -আমি পায়েল, আপনি যাদের কথা বলছেন, আমি তাদের কাউকেই চিনি না। তারাও আমাকে চেনে না।
    -হাচা কইতাছুইন তো? কইথথে আইসুন আপনে?
    -আমেরিকা থেকে বেড়াতে এসেছি।
    বৃদ্ধা তার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে নিরিক্ষণ করতে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে প্রকৃতির শিক্ষা অনেক কার্যকর।
    -বসুন, এই আমার কাছে বসুন।
    পায়েল আর বৃদ্ধা পাশাপাশি উঁচু ঢিবির উপর বসে। ব্যাগ খুলে ফোন বের করে মজনুকে ফোন দিয়ে খাবারের প্যাকেট আর পানির বোতল দিয়ে যেতে বলে।
    খাবারের প্যাকেটটা খুলে বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে দিতেই হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। এবার পানির বোতল খুলে এগিয়ে দেয়।
    -রুজা রইছি। আইজ আমার হশুরের মিরিতু দিন। মুন্সি খিলামুনা গো। আমিই রুজা রইছি।   
    মজনুর হাতে খাবারের প্যাকেট আর পানির বোতল ফিরিয়ে দেয় পায়েল।
    বৃদ্ধাকে কারণহীনভাবেই ভাল লাগতে শুরু করে। বৃদ্ধা পায়েলের দিকে তাকায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে অনবরত কথা বলতে থাকে। কোন কথাই বুঝতে পারে না পায়েল। শুধু বাবা শব্দ ছাড়া।
    কু ঝিকঝিক, কু ঝিকঝিক শব্দে সাপের মত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে ট্রেন। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে বৃদ্ধা। বড় বড় মাটির ঢেলা তুলে ঢিল দিতে থাকে ট্রেন লক্ষ করে।
    -ঐ হারামী টেরেন, আমার হশুরের ভিটা ফিরাইয়া দে। ফিরাইয়া দে, ফিরাইয়া দে....... 
    ট্রেনটা কাছাকাছি আসতেই বিকট শব্দ লুকিয়ে ফেলে বৃদ্ধার অসহায় আক্রোশের হৃদয় ছেঁড়া শব্দগুলো। দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকে বৃদ্ধা।
    -ম্যাডাম হইরা আহুইন। হইরা আহুইন। ক্ষেপছে, পাগলি ক্ষেপছে।
    ডাকছে কিশোরটি। লম্বা লম্বা পা ফেলে দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে পায়েল।
    -কে এই মহিলা?
    কিশোরের বাবা দোকানে বসে আছে। কথা বলে সে-
    -পাগলী একহান। এইহানে হ্যার বাড়ী আছিল। জমি আছিল। এ্যাকোয়ারে পড়ছে ব্যাবাক। হেই শুকে মাথা গ্যাছে আউলাইয়া।
    -টাকা দেয়নি ওদের?
    -দিছে তো, সরকারী রেটে দিছে। হ্যার পোলার ভুঞাপুরে একখান বাড়ী করছে, ভ্যান চালায়, গরু কিনছে। হ্যাগো দিন যায় একভায়। মায়েরেও চালায়।
    -তাহলে?
    -বুঝলাইন না? ময়া (মায়া) ছুডুকালে বিয়া হইয়া এই বাইত (বাড়ীতে) আইছিল। এইহানেই ব্যাবাকতা। হেই দিন তো এই দিনের নাহাল কডিন আছাল না! 
    হশুরের ভিটা তো এইডা। হ্যাগো কব্বরও আছিল এইহানে। ট্যাহা দিয়া কি ময়া কিনুন যায়গো।
    দোকানী খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বদ্ধ দোকানের ভেতর থেকে।
    -বুড়ি মইদ্দে মইদ্দে আহে। হারাদিন গইর পাইড়া কান্দেকাটে, শাপাশাপি করে। হাইঞ্জাকালে ফিরা যায়। কেউ কিছু সাধলেও খায় না।
    পায়েল তাকিয়ে থাকে সামনে যেখানে বৃদ্ধ মাটিতে গড়াগড়ি করছে চিৎকার দিতে দিতে।
    -আমার হাউড়ির গাছের বাতাস ফিরাইয়া দে, ফিরাইয়া দে। নতুন একটা গাছের নিচে বৃদ্ধা।
    পৃথিবীর সব টাকা একত্র করলে কি বৃদ্ধার এই সামান্য চাওয়া পূর্ণ হবে?
    ওদের ষোল ডেসিমেলের জমিতে তৈরী হবে মাল্টিষ্টোরিড বিল্ডিং। তিন তলা অবধি মার্কেট, বাকী সাততলা আবাসিক। অত্যাধুনিক জীবন যাপন করবে মিতু আর কাকলি। ওরাও কি এমনি করে কাঁদবে টাইলস্ মেঝেতে গড়াগড়ি করে? একটা বকুল গাছের জন্য?
    আহাঃ কত সামান্য চাওয়া! জীবনে সেই চাওয়াটাও কেন পূর্ণ হয় না?!
    -ম্যাডাম চলেন, দেরী হইয়া যাইতাছে।
    মজনু দাঁড়িয়ে আছে পেছনে।
    গাড়ী চলছে দু’পাশের সারিবদ্ধ গাছের ছায়াময় পথের ছায়া ভেঙে ভেঙে। কখনও রোদ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছায়া। আবার কখনও নিরিহ ছায়া চাউর হয়ে বসছে প্রখর রোদের শরীরে।
    মিতু আর কাকলির অসহায় অভিমানের সরব মুখটার ভেতরের গভীর বেদনা পায়েলের বোধকে উস্কে দেয়। ওদের চাওয়া কি খুব বেশী? ওরা ওদের স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চায়। এতে পৃথিবীর কার কি ক্ষতি। থাকুক না ওরা ওদের মত। ইমতিয়াজ আহমেদকে জানিয়ে দেবে পায়েল ওর অপারগতার কথা। পরে কোন এক সময় আবার নতুন করে চুক্তি করবে।
    আচ্ছা, আপাতত একতলার ছাদে ছোট করে রুম তুলে দিলেও অনেকটাই সমস্যার সমাধান হয়। নিচ তলার ভাড়ার টাকায় কোনমতে দিন পার করতে পারবে।
    ইমতিয়াজ আহমেদকে ফোন করবে বলেই ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে। সাথে সাথেই বেজে ওঠে আলমের ফোন নম্বর। পায়েলের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কি করবে এখন............?
    গত কয়েকটা দিন ভূমিদস্যু আলমের ফোনের অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে একা একাই। আবার বেজে ওঠে পায়েলের ফোন, কাকলি ডাকছে ওকে। 
    -হ্যালো
    -পায়ের তুই কোথায়? আলম তার লোকজন নিয়ে আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ধমকাচ্ছে। তুই কোথায়? ফোনটা কেটে দেয় পায়েল। এখনও অনেকটা কাজ বাকী।
    গাড়ী ছুটছে আলো ছায়ার পথ ভেঙে ভেঙে..............  

 

রোকেয়া ইসলাম
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top