সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

সখী ভালবাসা কারে কয় : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১২:১৬

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৭

 

একটু আগেও মনটা ফুরফুরে ছিল অনুপমার। প্রবাসী মেয়ের সাথে গল্প করেছে প্রাণ ভরে। মেয়ের সংসারের গল্প। নতুন সংসার। বিয়ের পরপরই বিদেশ চলে গেছে।  ভালমত রান্নাবান্নাও শেখেনি মেয়ে। ফোনের মধ্যেই নানা পদের রেসিপি বলে দেয় অনুপমা মেয়েকে।  পৃথিবী কত যে বদলে গেছে।  আগে কতজনের ছেলে মেয়েই বা বিদেশ যেতে পারতো। কেউ গেলে, আত্নীয় পরিজনদের মাঝে বিরাট আলোচনা শুরু হতো- ওই অনুকের মেয়ে বিদেশ যাচ্ছে।  
কত ভাগ্যবান মা-বাবা। মুকের ছেলে, কি সৌভাগ্য।  এমনি মুখরোচক গল্প অনুপমা’র পরিবারেও ঘটেছিল।
অনুপমা তখন একেবারেই ছোট।  শৈশব শেষ হয়নি।  দূরন্ত স্বভাবের ছিল।

ছোট খালামনির মেয়ে রুমানা। রুমাপু বলে ডাকতো অনুপমা। কি যে আদর করতো অনুপমাকে। অনুপমাও রুমাপু বলতে পাগল। সেই রুমাপুর একদিন বিয়ে হয়ে গেল। সবেমাত্র বিশ্ব বিদ্যালয়ের পড়া শেষ হয়েছে। সহপাঠি তার প্রবাসী ভাইয়ের জন্য বান্ধবী’কে পছন্দ করেছে।  সুন্দর চেহারার রুমা’পুর যেন ভাগ্য খুলে গেল।  কিন্তু তাহলে কি হবে।  বাবা-মার দুঃচিন্তা বেড়ে গেল আরো।  সবাই চিন্তিত।  রুমা’পু চুপচাপ। অনুপমার সাথেও কথা বলে না খুব একটা।  চঞ্চল অনুপমা আনন্দে লাফাতে থাকে। রুমানার কাছে ঘুরঘুর করে।

 ও রুমা’পু বিদেশ গেলে আমাকে ভুলে যাবে বুঝি? কে বলছে পাগলী? রুমানা অনুপমাকে কাছে টেনে আদর করে চুমো দেয় কপালে।  সেই চুমোর পরশ যেন আজও আবেশে ভিজিয়ে দেয় অনুপমাকে।  কী যে ধুমধাম করে বিয়ে হলো রুমা’পুর।  রুমা’পুর বিয়ে ছিল সে যুগের আলোচিত বিয়ে।  ছেলে কানাডার নাগরিক। অনেক ধনী।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।  এর বেশী কিছু বুঝবার মতো বয়স তখন হয়নি অনুপমার। যখন কৈশোর পেরিয়ে অনুপমাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, সে সময় একদিন মায়ের মুখে রুমাপুর বিয়ে নিয়ে উদ্বিগে কথা জেনে ছিল অনুপমা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছেলের খপ্পরে যেন না বুঝে পা না বাড়ায়।

মা বারবার সাবধান করে দিতেন।  রুমা’পু ভাল গান করতেন।  অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন। ডিস্টিক্ট চ্যাম্পিয়িন হয়েছেন। আন্তঃ স্কুল পুরস্কার আরও কত ধরনের। বড় কোন ভাই না থাকায় বিশ্বস্ত এক তোতো মামাকে ছোট  খালামনি রুমা’পুর অভিভাবক এর মত সংগে পাঠাতেন। খালু চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত। তিনি এ ব্যাপারে কিছু মনে করতেন না। কিন্তু বিধি বিমুক।  টিন এজ আবেগপ্রবন রুমা’পুকে নিয়ে একদিন হঠাৎ করেই ঐ তোতো মামা উধাও হয়ে গেলেন। রুমা’পুর জীবনটা কালিমায় ভরে দিয়ে প্রায় তিন মাস পর ফিরিয়ে দিলেন তাকে।  এসব কথা জানার পর অনুপমা রাতে কেঁেদছিল অনেক। পরে আবার আশ্বস্ত হয়েছিল মা’র কথাতেই।

শিক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত খালু রুমা’পুর জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খোলাখুলি বলেছিলেন বর পক্ষকে। বিদেশী কালচারে বড় হওয়া ছেলে এসব ঘটনাকে আমলই দেননি। ছেলের বাবা-মা তাই বিনা দ্বিধায় রুমাপুকে তাদের পরিবারে বরন করে নিয়েছিলেন। মা’পুর সুখী সংসার।  ফুটফুটে দু’টি মেয়ে। ব্রিলিয়ান্ট। কানাডাতেই মানুষ। স্বামী ভাগ্য রুমা’পুর।
সোনায় সোহাগা সে। এসব কথা কত কত বছর ধরে শুনে আসছে অনুপমা।  আজ অনুপমার মেয়েই প্রবাসে সংসার করছে।  অনুপমা মধ্যবয়সী এখন।  রুমা’পু তো বৃদ্ধের ঘরে পাড়ি দিচ্ছে।  কত কত যুগ ধরে রুমা’পুর গল্প শুনে আসছে সবার কাছে।
এক সুখী জীবনের গল্প।
কিন্তু আজ হঠাৎ করে একটি ফোনে, একি কঠিন কথা শুনলো অনুপমা?
রুমা’পুকে প্রানের চেয়েও ভালবাসে অনুপমা।
একথা সবাই জানতো।
আজ জীবনের এই মধ্য বয়স পর্যন্ত বন্ধু বান্ধব স্বামী, সন্তান কার না কাছে রুমা’পুর গল্প করে নাই অনুপমা।
এ সংসারে রুমা‘পু যেন অনুপমার অহংকার।
ছোট খালামনি তাই অনুপমাকে এ দুঃসংবাদটি না দিয়ে থাকতে পারলেন না।
প্রবাসী মেয়ের সাথে কথা বলে ফুরফুরে মেজাজে অনুপমা গুনগুন করে গান করছিল- আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে, দেখতে তোমায় পাইনি, আমি দেখতে তোমায় পাইনি......
হঠাৎ টেলিফোনের কর্কশ শব্দে বুকটা কেঁপে ওঠে অনুপমার.... হ্যালো..হ্যালো...কে বলছেন? .....ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা কান্না জড়িত কন্ঠে ছোট খালামনি বলেন... অনু....অনু... তোর রুমা’পুর সুখের সংসার ভেঙ্গেছে। রুমা’র স্বামী আর একটা বিয়ে করেছে। ছোট খালামনির কান্না ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।
অনুপমা স্থির বসে থাকে রিসিভার হাতে।
পুরুষরা কি এ রকমই হয়?
ভন্ড, প্রতারক??
প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় কত না নারী নির্যাতনের খরব দেখা যায়।
ভালবেসে বিয়ে কওে সেই ভালবাসার রানীকে পরকীয়া সন্দেহ করে চোখ উপরে ফেলা, এসিডদগ্ধ করা, হাতের কব্জি কেটে ফেলা- কত না বিভৎস রূপ অত্যাচারের!!
এতো গেল জীবিত ভালবাসার অপমৃত্যু।
বেঁচে থেকেও মৃত্যু যন্ত্রণায় মৃত্যুর জন্য দিন গোনা।
নির্যাতনের আরও কত নৃশংস রূপ।
নির্যাতন করে মেরে ফেলেও ক্ষান্ত নন অনেক স্বামী।
তারা ভালবাসার মানুষটিকে খুন করে গুম করে টুকরো টুকরো করে পৈশাচিক দানবের মত।
সে ক্ষেত্রে রুমাপুর স্বামীকে দরদী-ই বলা যায়।
তিনিতো রুমা’পুকে খুন করেন নাই।
আর একটা বিয়েই না হয় করেছেন।
শিক্ষিত ভদ্র প্রতারক!
চাকরী শেষ করে দু’বছর ধরে ঢাকায় ফ্ল্যাট করার নাম করে ফ্লাট কিনে, রীতিমত বিয়ে করে নতুন সংসার করছেন।
ইতিমধ্যে একটি সন্তানের বাবাও হয়েছেন।
সহজ সরল রুমা’পু এসব কিছুই বুঝতে পারেন নাই।
জীবনের শেষ দিনে স্বামীর সাথে নিজ জন্মভূমিতে এসে জীবন কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে দিন গুনছিলেন।
ছোট ননদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী, যিনি ঘটকালি করে বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, ঘটনাটি সেই জানিয়েছে রুমা’পুকে।
রুমা’পুর এতদিনের তিলে তিলে গড়া স্বপ্নের সংসার দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল।
তার স্বপ্নের আদর্শ স্বামীটির প্রকৃতরূপ শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে গেল এত ন্যাককারজনক ভাবে?
বার্ধক্য-জরা, প্রেম-ভালবাসা, সুখ-দুখের স্মৃতি, কোন কিছুই কি পুরুষকে চিরন্তন ভালবাসার শেকলে বাঁধতে পারে না? রোধ করতে পারে না তার বেপরোয়া পশুত্ব লালসাকে?
কটা দিন-ই আর বেঁচে থাকতো রুমা’পু?
গর্ব ও খুশীর মনটা বৃদ্ধ ছোট খালামনি’র শেষ জীবনটাকেও ক্ষত বিক্ষত করে দিল।
খালু গত হয়েছেন ক’বছর হোল।
এরপর থেকে খালামনি রুমা’পুর কাছেই থাকতেন বেশী।
তার চোখের সামনে মেয়ের এমন সর্বনাশ!
এর চেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কি হতে পারে?
তবে কি রুমা’পু পোড়াকপালী?
সুখ এসেও পালিয়ে যায় ঘরে থেকে?
সুখের তো কোন আকার নেই, রূপ নেই।
সুখ- সে তো অপরূপ এক ভালবাসার রূপক।
সুখ ক্ষণস্থায়ী।
কষ্ট সারাজীবনের।
এতই যদি বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তবে কেন ছেলেবেলার কলঙ্ককে মুছে দিয়ে রুমা’পুকে বিয়ে করে সমাজে দেবতুল্য প্রমান করেছিলে নিজেকে? আপন মনেই রুমানার স্বামীকে প্রশ্ন করে অনুপমা।
ঘৃনায় র্জজরিত অনুপমা অবচেতন মনে নিজেকে প্রশ্ন করে- তবে কি আমার স্বামীও ভালবাসার মুখোশ পরে আছে? রী রী করে ওঠে মনটা।
কই গো, খাবে না?
হঠাৎ এমন মিষ্টি ডাকে থমকে তাকায় অনুপমা।
স্বামী শান্তনু কায়সার কি সহজ সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুপমার দিকে।
এস, খাবে চল।
দুর্বোধ্য ভালবাসার নিখাদ বিশ্বাস নিয়ে দু’জনে এগিয়ে যায় খাবার টেবিলে।
পরম যত্নে শান্তনুর প্লেটে এটা ওটা তুলে দেয় অনুপমা।
রুই মাছের মুড়োটা অর্ধেক করে অনুপমার প্লেটে তুলে দেয় শান্তনু।
অনুপমা স্থির চেয়ে থাকে।
কি দেখছো এত! খাও না। দাও, কাঁটা বেছে দিচ্ছি।
শান্তনু অনুপমাকে এভাবেই নানা সময় নানাভাবে আদর করে।
শান্তনুর মুগ্ধ আচরনে অনুপমার সমস্ত সন্দেহ, তথাতীত যন্ত্রণা, দুঃখ-বেদনা নিমিষে বিলীন হয়ে যায়।
অনুপমা, যার যার জীবনের অলিখিত নিয়তির নির্মমতা’কে মেনে নিয়ে আপন মনেই আবারো গুন গুর করে- “আমারমত সুখী কে আছে,
আয় সখী আয় আমার কাছে
সখী ভালবাসা কারে কয়
সেকি কেবলই যাতনাময়..............।”
আসলে, ভালবাসা কখনো মোহময়ি বসন্ত।
আবার কখনো বা বৈরী বাতাস।
অনুপমার এরকমই মনে হয়।



শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top