সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

একাকীত্ন : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০২০ ০৬:১২

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৯

 

আগারগাঁও নিউ কলোনী সারিবদ্ধ চারতলা, পাঁচতলা ফ্ল্যাট।  এ ফ্লাটেরই একটি ফ্লাটে বাস করেন জাকির সাহেবের পরিবার।  ছোট ছিমছাম সংসার।  স্ত্রী পারুল একটি বিদেশী কোম্পানীতে চাকুরী করে।  একমাত্র সন্তান, মেয়ে এম এ পাশ করার পর বিয়ে হয়ে বিদেশে সংসার করছে। একটি নাতি হয়েছে পারুলের। সব মিলিয়ে সুখের সংসার।  মেয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার পর পারুল খুব একাকী হয়ে যায়। কাজের বুয়া মনোয়ারার কাছে সুখ দুখের কথা বলে কিছুটা সময় কাটে অবসরে।  

ছুটা বুয়া। সব কাজ একবেলায় শেষ করে দিয়ে যায়।  পারুল তাই প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে প্রয়োজনীয় কাজ বুয়াকে গুছিয়ে দেয়।  এগারোটার মধ্যে যা কিছু কাজ সম্ভব, সব কাজ।  এরপর অফিস চলে যায় পারুল।  এমনি গতানুগতিক ভাবেই কাজের বুয়াদের নিয়ন্ত্রন করে সে।  অফিসেও তার খুব সুনাম। কলিগসহ পিয়ন, দারোয়ান সবাই খুব সম্মান করে তাকে। সবারই সুখ দুখের সাথী সে।  বিপদে সাধ্যমত সাহায্য করেন। সুখের সময় খুশী হন।  

সামনে ঈদ। পারুল রমজানের শুরুতেই লিষ্ট তৈরী করেন। ঈদে কাকে কি উপহার দেবেন তারই তালিকা।

সবার আগে নাতির নামটি লেখে। রাইম। বুকটা সুখের বাতাসে বেলুনের মত ফুলে ওঠে।  এরপর বাকী আত্নীয় স্বজন।  সবশেষে বুয়ার তালিকা।  এই তালিকাটি পারুল খুব মনোযোগ দিয়ে তৈরী করে সবসময়।  যাকাত ফিত্রা পাওয়ার পূর্ন অধিকার এদের।  এরা গরীব।  প্রতি বছর এই একটি দিনে ওরা কিছু পাওয়ার আশা করে।  পারুল তাই ঈদে তার বুয়ার পরিবারের সকলের জন্য জামা কাপড় কেনে। তেল সাবান, চুড়ি দুল ইত্যাদি।  এছাড়া দুধ সেমাই, পোলাও মাংসের জন্য আলাদা কিছু টাকা বকশিস দেয় বুয়াকে।  এসব আগে থেকেই গুছিয়ে ফেলে পারুল।

ঈদ এসে গেল। আগেরদিন পারুল তার বুয়া মনোয়ারাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। এতকিছু পেয়ে মনোয়ারা বেজায় খুশী।  আশাতীত জিনিস পেয়েছে সে।  ঈদের পরদিন তোমার ছুটি।  পারুল হেসে বলে। মনোয়ারা উচ্ছাসে কেঁদে ফেলে। পারুলকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। এর আগে সে অনেক বাসায় কাজ করেছে। ভালমন্দ তারাও দিয়েছে। কিন্তু এ রকম ভাল মানুষ সে খুব কম দেখেছে। আল্লাহ আপনাকে সুখী করবেন খালাম্মা। আমার মা নাই। আপনি আমার মায়ের মত। এই রকম আশীর্বাদ পারুল, তার সব বুয়াদের কাছ থেকেই পেয়ে আসছেন। এই আশীর্বাদের পরিপূর্ন তৃপ্তিতে যে বিপুল শান্তি আছে, সে শান্তির বিশাল তৃপ্তি, পারুলের অন্তরকে জুড়িয়ে দেয়। দেহ মনকে শীতল করে তোলে।

ঈদের পারদিন। সকাল বেলা পাশের ফ্লাটের হায়দার সাহেবের স্ত্রীর চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় পারুলের। প্রতিনিয়তই এ ঘটনা ঘটে। কাজের বুয়া নিয়ে ঝগড়া বিবাদ। বুয়াদের সাথে একেবারেই ভাল ব্যবহার করেন না মহিলা। কদিন পরই বুয়া চলে যায়। আজও নিশ্চই বুয়া আসে নাই। হায়দার সাহেবকে চিৎকার করে বলছে যাও, বস্তিতে গিয়ে দেখ, ঐ বদমাইশ বেটি কি করছে! ঘাড় ধরে নিয়ে এস।

বেচারা, গো-বেচারা। কী আর করেন। স্ত্রীর হুকুম বরখেলাপ করলে উপায় নেই। আলনা থেকে শার্টটা টেনে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে বস্তিতে যায় বুয়ার  খোজে। এই বস্তিতেই পারুলের বুয়া মনোয়ারাও একটি খুপড়ি ঘরে বাস করে। স্বামী রিক্সা চালায়। চার ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। হায়দার সাহেব বস্তিতে ঢোকে বুয়ার খোজ করতে। সবাই তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকে। এক বৃদ্ধা আঙ্গঁল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বুয়ার ঘর। বাচ্চারা সব কান্নাকাটি করছে।বুয়া জ্বরে কাতরাচ্ছে। ঘরে কোন খাবার নেই।  ঈদের দিন, সেমাই, পোলাও দূরের কথা, ভালমন্দ কিছুই রান্না হয় নাই। অথচ, পাশেই মনোয়ার ঘরে ঈদের পরদিন ও মহাউৎসব চলছে। ছেলেমেয়েরা নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনোয়ারা পোলাও মাংস রান্না করছে। সব কিছুই পারুলের দেয়া। সবার কাছে মনোয়ারা গর্বের সাথে তার বিবি সাহেবের প্রশংসা করছে। হায়দার সাহেব এ দুশ্য দেখে খুব লজ্জ্বিত হন।

স্ত্রীর দুব্যবহার তাকে কঠিন ভাবে পীড়া দেয়। একই ফ্লাটের বাসিন্দা দুই পরিবার। জাকির সাহেবের স্ত্রীর আচরনের সাথে, তার স্ত্রীর আচরন এর আকাশ- পাতাল পার্থক্য। বাসায় ফিরতেই স্ত্রী গরমভাবে হায়দার সাহেবকে জিজ্ঞেস কওে, কি হোল? বুয়ার কি খবর? বেঈমান আসলো না কেন? ঈদের কাপড়  চোপড় নিয়ে পরদিনই চম্পট। হায়দার সাহেব স্থির থাকতে পারেন না। চিৎকার করে বলে ওঠেন-চুপ! নিজের ভালটাই বুঝতে শিখেছ। গরীব দুখীদের ভালমন্দটাও বুঝতে চেষ্টা কর। বেলকুনীতে দাঁড়িয়ে সব কথাই শুনছিলেন পারুল। খুবই  নরম হৃদয় তার। মনে মনে ভাবে, মানুষ এত কঠিন হয় কী করে। অঢেল  সম্পদের কিছটা গরীব দুখীদের বিলেিয় দিলে ক্ষতি কি? কাজের বুয়া। সেই তো আমাদের সংসারের প্রথম দরদী বন্ধু। ওদের কিছু দিলে আল্লাহ্ বেশী খুশী হন। পারুল এই কথা গভীরভাবে বিশ্বাস করে। একটি মাত্র মেয়ে বিদেশ যাবার পর যে একাকীত্ব ক্ষনে ক্ষনে পারুলকে আনমনা করে তালে, প্রতি বছর ঈদের সময় এইটুকু দান খয়রাতের তৃপ্তি তাকে সব  ভুলিয়ে দেয়।

প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষ করে দেয়ালে টানানো মেয়ের বিয়ের ছবি, ছোট বেলার ছবিগুলির তিকে তাকিয়ে হৃদয়ের সুপ্ত আনন্দটুকু ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করে পারুল।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top