সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

বাঙ্গালীর সার্বজনীন লোকজ উৎসব: শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১১ এপ্রিল ২০২০ ০৬:২২

আপডেট:
১১ এপ্রিল ২০২০ ২০:৩৪

 

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম সাম্প্রদায়ের লোক বাস করে। তারা প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। এসব ধর্মীয় উৎসব সার্বজনীন নয়। যে সকল উৎসব উদাপনের মাধ্যমে বাঙ্গালী সংস্কৃতি ঐতিহ্যের সার্বজনীন রূপ প্রকাশ পায়, তাকেই সার্বজনীন উৎসব বলা যেতে পারে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে আমরা যারা জনগোষ্ঠী রয়েছি, তারা বংলা নববর্ষে বর্ষবরণ উৎসব উৎযাপনের মাধ্যমে বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সার্বজনীন রূপটি প্রকাশ করি। সব মতের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে “বাংলা নববর্ষকে” স্বাগত জানাই। এ সময় গ্রাম বাংলার লোক সংস্কৃতিকে ধারন করে বাঙ্গালী জাতি দেশাত্ববোধ চেতনায় উজ্জীবিত হয়। এ কারণে বাংলাদেশে নববর্ষ বরণ উৎসবকে বাঙ্গালীর প্রধান সার্বজনীন উৎসব বলা হয়।

নববর্ষের উৎসবের সাথে পৃথিবীর জাতির সম্পৃক্ততা আছে। কিন্তু বাঙ্গালীর নববর্ষের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। প্রাচীন যুগ থেকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ নববর্ষকে বার্ষিক একটি উৎসব হিসেবে পালন করে আসছে এবং এতে বাঙ্গালী সভ্যতা যৌক্তিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে অবশ্যই। বাংলাদেশে শহরে নগরে গ্রাম-গঞ্জে বর্ষ বরণকে কেন্দ্র করে পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেমন- * বৈশাখী মেলা *হালখাতা *পূন্যাহ অনুষ্ঠান *হলী খেলা ইত্যাদি। এ সকল অনুষ্ঠানে গ্রামবাংলার তথা শহরাঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষের মিলন ঘটে। যা বাঙ্গালী সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে “বাংলা নববর্ষকে বরণ করার লক্ষ্যে বৈশাখী গান, নাচ, নাটক, পুথিঁপাঠের আসর, পান্তা-ইলিশ, পিঠা খাওয়া, নতুন পোশাকে সজ্জিত হওয়া, মঙ্গলশোভাযাত্রায় অংশগ্রহন ইত্যাদি ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিকে বেগবান করেছে। তাই বাংলা নববর্ষে বাঙ্গালী জাতির প্রথম ও প্রধান সার্বজনীন উৎসব।

এ ছাড়া ও যেমন: ফল উৎসব: বৈশাখের আমেজ শেষ হতে না হতেই চলে আসে জৈষ্ঠ্যমাস। এ মাসকে মধুমাস বলা হয়। কারণ মিষ্টি মধুর অনেক ফল পাওয়া যায় এ মাসে। সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায় জৈষ্ঠ্য মাসে। এমন দিনে বিচিত্র ফলের মধুগন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। জৈষ্ঠ্য মাসের ফলের তালিকা এতই দীর্ঘ যে সবার পছন্দের কিছু না কিছু ফল তখন বাজারে থাকবেই। যাদের ফল কেনার সামর্থ নেই তারও এ মৌসুমে বঞ্চিত হয় না। প্রত্যেকটি বাড়িতে কোন না কোন ফলের গাছ থাকে। যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আতা, বাঙ্গি, তরমুজ, জামরুল, আনারস, বেল, ফুটি, বহড়া প্রভৃতি। এ সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাধরনের ফল নিয়ে ফলোৎসব এর আয়োজন করে। অনেক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে ফল উৎসব পালন করে বাঙ্গালীরা।

বর্ষা উৎসব: বিদ্যুৎ ও গুরুগম্ভীর বজ্র নির্নাদের মধ্যে দিয়ে সূচিত হয় বর্ষার শুভাগমন। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকল। শহুরে বাঙ্গালী জীবনে বর্ষা তেমন ভালো করে উতযাপিত না হলেও গ্রাম গ্রামে এর আমেজ ঠিকই ছড়িয়ে পড়ে। দুকুল ছাপিয়ে উপচে পড়া নদীতে নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের মেলা, মানুষের মাঝে এক আনন্দঘন মুহূর্ত সৃষ্টি করে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়ে। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৪ কি.মি. উত্তরে নিভৃত পল্লী সদর উপজেলার আকচা গ্রামের নৈসর্গিক পরিবেশে স্থাপিত জীবন বৈচিত্রের যাদুঘর লোকয়ন চত্বরে প্রতিবছর অনুষ্ঠীত হয় বর্ষামঙ্গল উৎসব।

এই অনুষ্ঠানে বৃষ্টির প্রত্যাশায় ব্যাকুল মানুষেরা উপভোগ করেন পরিবেশিত বর্ষার গান ও কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে। মেঘের গুরুগুরু গর্জনে দর্শক-শ্রোতা উল্লসিত হয়ে ওঠে। অনুষ্ঠান শেষে এখানে গ্রামীণ ঐতিহ্যনুযায়ী কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে প্রতিবছর আষাঢ় মাসের প্রথম শুক্রবার রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন বর্ষা উৎসব পালন করতে আসে। রাখাইনদের কাছে বর্ষা উৎসব একধরনের বনভোজন ও পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যম। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে অনেক দিনের অদেখা স্বজনের দেখা মেলে। এ উৎসব পালনের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি বেড়ে যায়।

নবান্ন উৎসব: নবান্ন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যাউৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয় নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণাতীতকাল থেকে বাঙ্গালীর জীবনে পয়লা অগ্রহায়ণকে বলা হয়ে থাকে বাৎসরিক সুদিন। এদিনকে বলা হয় নবান্ন। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্র্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকমের খাবার। বাড়ির আঙ্গিনা নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে। নবান্নের প্রাণ গ্রামীণ মেলা। নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো মেলা।

হরেক রকমের দোকান নিয়ে বসে গ্রামীণ মেলা। তবে গ্রামীণ মেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না শহরে ব্যাপকভাবে আয়োজিত হয়। এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা পুতুল, মাটির জিনিসপত্র, আর বসে বাউল গানের আসর। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে গ্রামে-শহরে সব শ্রেণির মানুষের ঢল নামে। নাচ আর গানে মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গন। প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে আত্নহারা হয়ে ওঠে বাঙ্গালী মানস। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে ঢাকায় রমনার বটমূলে ও এর সংলগ্ন এলাকাকে সাজানো হয় গ্রামীণ আদলে। পুরো অনুষ্ঠানে থাকে বাঙ্গালীয়ানার ছাপ।

পিঠা উৎসব: পিঠা বাঙ্গালী সমাজে বিশেষ আদরনীয়। এ ছাড়াও আত্নীয় স্বজন ও মানুুষে মানুষের পারস্পরিক সম্পকের বন্ধনকে আরো দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পিঠা- পুলি আয়োজনের উৎসব সর্বশেষ ভূমিকা পালন করে। আদিকাল থেকেই বাংলায় হেমন্ত ঋতুতে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল উঠলে আয়োজন করা হতো পিঠা উৎসব। এই ধারাবাহিকতা চলত শীতকাল পর্যন্ত। তবে শীতের সাথেই পিঠার সম্পর্ক নিবিড়। এই পিঠা বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের যে কোন উৎসবে আনন্দে মিশে আছে রকমারি পিঠা।

বসন্ত উৎসব: বাঙ্গালীর জীবনের সাথে একাকার হয়ে আছে বসন্ত। বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙ্গালী পালন করে পহেলা ফাল্গুন বসন্ত উৎসব হিসেবে। এ উৎসব এখন সব বাঙ্গালীর উৎসব। এই উৎসবটির একটি ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে। মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গননা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪ টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে ঢাকায় বসন্ত উৎসব উতযাপন করার রীতি চালু হয়।

সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্ধসঢ়;যাপন পরিষদের আয়োজনে বসন্তের নাচ গান ও কবিতার আয়োজন করে আসছে প্রতিবছর। বাঙ্গালীর জীবনে নবপ্রাণের ছোঁয়া দিতে দিনটির কোন বিকল্প নেই। তাইতো তরুণ-তরুণীরা নব বসন্ত রঙে নিজেকে সাজাতে বা রাঙাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। পোশাকে ঋতুরাজকে ফুটিয়ে তুলতে মেয়েরা পরে বসন্তী শাড়ি, খোপায় থাকে হলুদ ফুল। ছেলেরা পরে হলুদ পাঞ্জাবি। এই ঋতুতে ফুলে ফুলে সাজতে শুরু করে প্রকৃতি। শীতের বিবর্ণতা কাটিয়ে গাছে গাছে নতুন পাতা গজাতে শুরু করে। বাঙ্গালীর এই দিনটিকে বরণ করে নিতে নানারকম বর্ণিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চারকলার বকুলতলায় প্রতিবছর জমে ওঠে বসন্ত উৎসব।

চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবঃ বাংলা বছরের সমাপনি মাসটি চৈত্র। চৈত্রের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। আমাদের লোকাচার অনুযায়ী এদিনে বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে, যা বাঙ্গালী জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনের সূর্যাস্তের মধ্যে দিয়ে, কালের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে যায় একটি বঙ্গাব্দ। বাংলাদেশের মানুষ সহবস্থানে বসবাস করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তাই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সমাজবদ্ধ আচার অনুষ্ঠান একই সাথে পালন করে থাকে। বাঙ্গালী এই দিনটিতে বেশকিছু লোকাচার মূলক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। যেমন, নীল পূজা বা চড়কপূজা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, শেষ প্রস্তুতি চলে হালখাতার। এদিনে একদিকে যেমনি থাকে নতুন বছরকে বরণ এর প্রস্তুতি, অন্যদিকে আরেকটি বছরকে বিদায়ের উৎসব। এভাবেই বাঙ্গালীর জীবনে ঋতু-বৈচিত্রে ভরা বাংলাদেশে, সারাটি বছর নানারকম লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুষমা মাধুর্য্য ঘুরে ঘুরে আবর্তিত হয়।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top