সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ঘাটিয়াল (পর্ব তিন): মহি মুহাম্মদ


প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০১৮ ০৮:৫৩

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ১৪:২৫

 

অভয় ঘাটিয়াল হয়ে গেল।

ধুত্তেরি! এটা কোনো কাজ!

এর চেয়ে ভালো আর কিছু তার ভাগ্যে জুটবে না। এই ভেবেই সে চাকরিটা শুরু করল। সে ঘাটের মানুষ পারাপার করতে থাকল। এই ঘাটের মাধ্যমেই অভয়ের পরিচিতি বাড়তে থাকল। মেয়েরা অভয়কে পছন্দ করে বেশি। বেশ ন¤্র-ভদ্র ছেলে। কাউকে কোনো কটুক্তি করে না। এভাবেই সে জামেলার সঙ্গে পরিচয় লাভ করে। জামেলার তিনকুলে কেউ ছিল না। অভয় তাকেই অভয় দিয়েছে। এত বেশি মুগ্ধ করে জামেলাকে কেউ বলল, অভয় মনে  জামেলাকে ‘জুম্মা তাবিজ’ করেছে।

সে রাতে অভুক্ত মেয়েটিকে খাওয়ার সময় দিল না অভয়। তার আগেই তার হাত ধরে টানতে শুরু করল। অনতিদূরেই মানুষের কোলাহল ছুটে আসছে। কারণ অনেকেই অভয় আর জামেলার ব্যাপারটি টের পেয়ে গেছে। ধর্মের রব উঠেছে। হাতের কাছে পেলে রেহাই  নেই। মেয়েটি বলল, কারা আহে?

অভয় বলল, সমাজ।

মেয়েটির কাছে দুর্বোধ্য মনে হল। সে আবার জিজ্ঞেস করল, ক্যান আহে?

অভয় বলল, আমরা পাপ করছি। ওরা বিচার করবে। নাইলে সমাজে ঘোর অমঙ্গল, ঘোর অমঙ্গল নামবে।

মেয়েটি বলল, ওরা তো আমারে খাওন দেয় নাই। ফুক্কিমাইরা দেহে নাই! তয় মারব ক্যান?

ওরা যে কিল মারনের গোসাঁই!

হা হা হা। অভয় হেসে উঠল। উয়ারা সমাজ লাগে। উয়াদেরকে খাওয়াইতে হয়। উয়ারা সমাজপতি। উয়ারা আছে বইলে সব সুন্দর আছে। উয়ারা এ পৃথিমীর ইজারাদার হইছে। উয়াদেরকে ভগমান দেখাশোনার ভার দিয়েছে।

মেয়েটা বলল, হু তুই জানস। বেশি জানস। ওরা বেবাকতে কুত্তার ছাও।

ওরকুম নাই বলিস। ভগমান গোস্বা কইরবে।

গোষ্ঠী কিলাই তোর ভগমানের।

ততক্ষণে লোকজনের শোরগোল কাছেই চলে এসেছে। তাই বাঁচতে হলে দেরি করা চলবে না। এদিকে আবার বৃষ্টি। গালাগাল দিলে তো বৃষ্টি যাবে না। রাতের অন্ধকারে মুষুলধারায় বৃষ্টি ঝরে। অভয় জামেলাকে দুহাতে কাঁধে তুলে নেয়। তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলল। তারপর ছুটতে শুরু করল। সমাজ থেকে দূরে! ধর্ম থেকে দূরে!

 

জামেলা অভয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বৃষ্টির রাতে কোথায় নিয়ে যাবে ওকে। ঘাটিয়ালের কেইবা আছে। এদিকে জামেলার ভয় হয়। শেষ সম্বল বিক্রির বেশ কিছু টাকা ছায়ার পকেটে আছে। এ কথা তো ঘাটিয়াল জানে না। ঘাটিয়ালের তো কোনো বাড়ি নেই। ও একসময় বাজারে থাকত। ওর বাবা রাখাল মুচি। অস্থায়ী ছাপড়া তুলে থাকতো। বাজারেই লাত্থি গুতো খেয়ে বড় হয়েছে। তার পর কিভাবে যেন নদীর ঘাটের ইজারাদার ইউছুফ সওদাগড়ের নজরে পড়েছে। কম টাকায় এসে কাজ নিয়েছে। খেয়ে দেয়ে এত কম পয়সায় ঘাটিয়ালের কাজ আর কেউ করবে না। তাই অভয়কে অভয় দিয়ে ইউছুফ সওদাগর রেখে দিয়েছে। এ কথা জামেলা জানে। তাই অভয়ের সঙ্গেই ঘরের স্বপ্ন দেখেছে জামেলা। কিন্তু ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত না জিরিয়ে হাঁটতেই হল ওদের। ভোরের দিকে এক অচেনা জায়গায় এল ওরা। চারদিকে মানুষের আনাগোনা। দোকানপাট খুলছে। একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা-রুটি খেল ওরা। তারপর থেমে থাকা একটা গাড়িতে উঠে বসল। জামেলা বলল, কই যাই?

অভয় বলল, টাউনে।

এরপর জামেলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল। তার চারপাশের আকাশ একদিন কেমন বদ্ধ ছিল। আজ যেন আকাশ অনেক বিস্তার লাভ করেছে। তারপর সারারাতের ক্লান্তি দূর করতে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল। পরম যতেœ জামেলার মাথাটা অভয় তার কাধে স্থাপন করে নিল। বাস চলতে শুরু করল। কিন্তু কিছুদূর না যেতেই জামেলার সকালের চা-রুটি অভয়ের কাধে গলগলিয়ে বের হয়ে এল। দুঃখ ভরা চোখে জামেলা দেখল, অভয় কিভাবে এই নোংরাগুলো পরিষ্কার করছে। মনে মনে সে শতবার অভয়ের দাসি হয়ে পায়ের ধূলো কপালে ঠেকাল। মনে সে আওড়াল সে তাকে অনেক ভালোবাসবে।

শহরে একটা ঘিঞ্জি এলাকায় এসে উঠল। একটা মেয়েলোক যাকে অভয় পিসি পিসি ডাকছিল। বেশ ছুরতি মহিলা। জামেলা বুঝতে পারছিল না কেন অভয় এই মহিলাকে পিসি পিসি ডাকছিল। হাতে গোনা কয়েকটা দিন বেশ খেয়ে পেরই কেটে গেল জামেলার। জামেলা এখন আরো অনেক বেশি অভয়ের প্রতি অনুরক্ত হয়েছে। নিজেকেও জামেলা আয়নায় দেখেছে। পরিবর্তন সহজেই বোঝা যায়। পিসিটা চোখে কাজল আর কপালে টিপ দিতে শিখিয়েছে। এমনিকি নামটাও জামেলা থেকে জলিতে রূপান্তরিত করেছে। সবকিছু মিলিয়ে জামেলার মন্দ মনে হচ্ছে না। তবে এই বাড়িতে বড্ড লোকের আনাগোনা।  একটা কথা জামেলার মাথায় ঢুকছে না। কেন, কি কারণে, একই ঘরে থেকে অভয় জামেলার শরীরে হাত দেয়নি! এটা ভেবে জামেলা কোনো কূল কিনারা পেল না। তবে যেদিন সে টের পেল তার পেটিকোটের গোপন পকেটে আর কোনো টাকা অবশিষ্ট নেই সেদিন অভয়কে সন্দেহ করে মনে মনে একটা প্রস্তুতি সে নিতে লাগল। কিন্তু সন্ধ্যা পার হলেও সেদিন থেকে অভয় আর ফিরে আসেনি। সে ঘরে ফিরে এল সেই পিসি।

জলি, আমাকে তুমি পিসি ডাকতে পারো। জামেলা চোখ তুলে দেখল। এক অচেনা ষণ্ডা মতো একটা লোক মালতি পিসির পিছু পিছু ঘরে ঢুকেছে।

পিসি তাকে সব বুঝিয়ে বলল। অভয় তাকে বিক্রি করে গেছে। এখন সে এ পিসির কেনা দাসী। এই ষন্ডা লোকটা এই এলাকার বড় ভাই। জামেলার সঙ্গে প্রথম এই বড় ভাই-ই থাকবে। তারপর সে অন্য কাস্টমারের হতে পারবে। জামেলা যেন কোনো ঝামেলা না করে। যদি ঝামেলা হয়, তাহলে তার লাশ পড়ে থাকবে। পিসি এই বলে বিদায় নিল। পিসি বেড়িয়ে গেলে ষণ্ডা বড় ভাইটি দরজা বন্ধ করল। জামেলার কোনো সাড়াশব্দ হল না। পিসি অনেক সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

হয়তো দাঁড়িয়েই থাকতো কিন্তু কেউ যেন তাকে ডাক দিল, মালতি পিসি ইদিকে এসো।

 

মহি মুহাম্মদ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top