ব্যাংকে নগদ টাকার তীব্র সংকট
প্রকাশিত:
২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:১৯
আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ০৩:৪৬

খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সংকট তীব্র হয়েছে। এ অবস্থা বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকই তারল্য সংকটে পড়ে ঋণ বিতরণ সংকুচিত করেছে। চাহিদা অনুযায়ী আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। আবার খেলাপি হওয়া ঋণও আদায় হচ্ছে না। ফলে সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট তরল সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে সাত মাসে ব্যাংক খাতের তরল সম্পদ ৬ শতাংশ বা ১৫ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা তারল্য সংকটের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে আগ্রাসী ব্যাংকিং বা সামর্থ্যের অতিরিক্ত ঋণ প্রদান। গ্রাহকরা বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সরকারি ব্যাংকে সংরক্ষণ করছে। সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে গ্রাহকরা। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ সঠিকভাবে আদায় না হওয়ায় ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো একদিকে আগের মত আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। অন্যদিকে আসন্ন রমজান উপলক্ষে পণ্য আমদানিতে নিয়মিত ডলার কিনতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা নগদ টাকা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়ার হারও (ঋণ প্রবৃদ্ধি) কমেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২.৫৪ শতাংশ। গত কয়েক বছরের মধ্যে ঋণ প্রবৃদ্ধি এত কমতে দেখা যায়নি। অথচ ব্যাংকগুলোতে এখন নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রাবাজার থেকে ধার করার প্রবণতাও বেড়েছে ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বছরজুড়েই বেশিরভাগ ব্যাংক ধার করে চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআরআর (নগদ জমা) ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ সঞ্চিতির হার) জমা রাখতে পারছে না। বেশ কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না।
তথ্যে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতের মোট তরল সম্পদ থেকে সিআরআর ও এসএলআর এ দুটি আবশ্যক ন্যূনতম তরল সম্পদ সংরক্ষণের পরিমাণ বাদ দিলে উদ্বৃত্ত তারল্যের হিসাব পাওয়া যায়। গত জানুয়ারি শেষে ব্যাংকগুলোর সিআরআর ও এসএলআর বাবদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা মোট তরল সম্পদ থেকে সিআরআর ও এসএলআরের অর্থ বাদ দিলে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। এই উদ্বৃত্ত তারল্য বর্তমান ব্যাংক খাতের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে মনে করছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা।
গত বছর এপ্রিলে ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতাদের দাবির মুখে সিআরআর ১ শতাংশ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্য বাড়লেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে আবারও তারল্যে টান পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত জানুয়ারি শেষে দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল) কাছে তরল সম্পদ ছিল ৮৩ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকের তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোরর তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর ২৪ হাজার ১৯ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতের তারল্য সংকটের পেছনে খেলাপি ঋণকেই দায়ী করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। খেলাপি ঋণ সঠিকভাবে আদায় না হওয়ায় এ খাতে তারল্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহেল আহমেদ বলেন, বর্তমান সময়ে ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ।
সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ মনে করেন, তিনটি কারণে আজকের এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলোর বেপরোয়া ঋণ বিতরণ, আস্থাহীনতায় গ্রাহকরা বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সরকারি ব্যাংকে সংরক্ষণ করা। এছাড়া সুদ হার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝোঁক ও খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিলকরণ। এসব কারণে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
আন্তঃব্যাংক সুদ হার বাড়ছে: নগদ টাকার সংকটে কলমানি মার্কেটেও বেড়েছে সুদের হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কট বেড়ে যাওয়ায় গত ৩রা এপ্রিলে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ১০.৫০ শতাংশ সুদে টাকা ধার নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর আগে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছিল ৯.৭৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানত সংগ্রহের গতি খুবই কম। আমানত সংগ্রহ কম এবং ঋণ বাড়ার কারণে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় গ্রাহকরা এখন ব্যাংকে টাকা রাখছেন কম। যে কারণে সংকট প্রকট হচ্ছে। তিনি বলেন, এ সমস্যার সমাধান করতে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। ওই টাকায় নতুন ঋণ দিতে হবে।
ঋণ পাচ্ছে না গ্রাহক: কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ ব্যাংকে তারল্য বা নগদ টাকার সংকট চলছে। সব ব্যাংক নতুন করে ঋণ না দিয়ে আদায়ের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারি খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৭০ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় শেষে ঋণ ছিল ৮ লাখ ৬২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। এ হিসেবে এক বছরে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ১২৪ কোটি টাকা।
সম্প্রতি সরকারের একশ দিন উপলক্ষ্যে এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানায়, খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া সুবিধার ফলে ঋণ খেলাপিরা ও দুর্বল ব্যাংকগুলো আরও উৎসাহিত হবে এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারল্য সংকট দেখা দেবে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য যখন ব্যাংকের কাছে অর্থ চাওয়া হবে, তখন ব্যাংক যদি অর্থ দিতে না পারে তাহলে আমাদের বিনিয়োগ এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১০ লাখ ১৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারি-বেসরকারি খাতে মোট ১০ লাখ ৮৭ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণ ছিল ৯ লাখ ৭০ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, অনেকেই আগ্রাসী ব্যাংকিং করছে। অর্থাৎ সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে। হাতে নগদ কোনো ক্যাশ রাখেনি। অনেক ব্যাংকে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার ওপরে চলে গেছে। ফলে টাকার সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মানলে এই সমস্যায় পড়তে হতো না বলে মনে করেন তিনি।
উৎসঃ মানবজমিন
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: