গুলশানের 'জঙ্গি' হামলা নিয়ে ফয়সাল দেবজি’র বিশ্লেষণ
প্রকাশিত:
৪ জুলাই ২০১৯ ১৯:২৪
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৬

ঢাকায় গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরায় হামলার পূর্ণ হয়েছে তিন বছর। এই হামলা নিয়ে নিয়ে নানামূখী সংবাদ, ব্যাখ্যা, আলোচনা, পর্যালোচনা লক্ষ্য করা গেছে। এবং নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার ভূমিকা জনগণকে সত্য ঘটনা জানবার সুযোগ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ায় জনমনে স্থান করে নিয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা করেছেন ‘ল্যান্ডস্কেইপস অব দ্য জিহাদ’খ্যাত লেখক ফয়সাল দেবজি। তিনি বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট অ্যান্টোনিস কলেজে’র সম্মানিত ফেলো এবং সেখানে তিনি মডার্ন সাউথ এশিয়ান হিস্ট্রির রিডার। হামলার পরপরই ‘ডিনাইং ইসলাম ইন ঢাকা’ নামের এই লেখাটি ‘লস এন্জেলেস রিভিউ অব বুকস’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের মত একটি গরিব দেশ, যার একটি বিশাল প্রবাসী শ্রমিকগোষ্ঠী রয়েছে আবার একইসাথে আন্তর্জাতিক নানা ব্যাপারের সাথে যুক্ত উৎসাহী এলিটশ্রেণীও আছে, এমতাবস্থায় তারা আন্তর্জাতিক হালচালে যেকোন ধনী দেশের চাইতে সরব থাকে। বৈদেশিক ব্যবসা, মানবিক সাহায্য এবং উন্নয়ন যখন কোন সমাজে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে, তখন সে জাতি গ্লোবালাইজেশনের একদম সামনের সারিতে অবস্থান না করলেও, গ্লোবালাইজেশনের দিকেই হয় তাঁর সমগ্র পথ চলা। পহেলা জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজানে ঘটে যাওয়া সেই নির্মম হামলার ফলে এই ‘বৈশ্বিক-বাস্তবতা’কে আরেকবার প্রকট হয়ে হাজির করল। আর্টিজানে তখন আটকে পড়া ইউরোপিয়ান আর লাতিন আমেরিকান শেফ, কুটনীতিক, সাহায্যকারী সংস্থার লোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এনজিও এক্টিভিস্ট এবং শিক্ষানবিশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সম্ভ্রান্ত পরিবারের সেই হামলাকারীরা সবাই এককথায় গ্লোবাল সিটিজেন। অনেকটা মনে হয়, ঢাকা-আক্রমণ তাদের কাছে একটা রেন্ডম চয়েজ ছিল। এই আক্রমণে সেখানে জিম্মি লোকজন বলেন কিংবা আক্রমণকারীদের দলের কথাই ধরেন, তাদের কারোর মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে কোন ‘লোকাল’ ব্যাপার কাজ করে নাই।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, মিলিট্যান্ট ইসলামের এই বৈশ্বিক রুপ ঢাকায় যে বর্বরতা দেখিয়েছে সেটা কেবল ঢাকাতে আটকে থাকেনি। এটা নানাভাবে দাতা-সংস্থাগুলোর অন্ধকার দিকটিও দেখাতে চেয়েছে, যেইসব সংস্থার অনেক লোক সেদিন খেতে এসেছিল হোলি আর্টিজান রেস্তোরায়। হামলাটির ফোকাস ছিল হয়ত সারাবিশ্বে বিরাজমান অবিচার-অন্যায় আর বেইনসাফির বিরুদ্ধেও। এছাড়াও, এই অাধা-ডজন বাংলাদেশী তরুণ যারা জিহাদী-জজবা নিয়ে এই উচ্চপদস্থ লোকদের হত্যা করতে এসেছিল তাদের কাছে আরো একটি প্রেক্ষাপট ছিল। সেটা হচ্ছে, লোকাল-জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ রাজনীতির অনুপস্থিতি। ঠিক অনুপস্থিতি নয়, এইটা এখন অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এসব এনজিও-কর্মী এবং এই ‘জঙ্গি’রা উভয়ই বর্তমান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে কাজ করছে এবং এরা এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে একরকম অবজ্ঞা করে সেগুলোকে খারিজ করে দেয়। সাথে যোগ হয়েছে কতৃত্বপরায়ণ সরকার, যে তার বিরোধীপক্ষকে নির্মূল করতে জানমাল বিলিয়ে দিচ্ছে, যেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং রাষ্ট্রটি দিন দিন বিরাজনীতিকরণের দিকে পতিত হচ্ছে। কখনো কখনো এই ধরনের সহিংস রাজনীতি একটি প্রাথমিক পর্যায়ে মেনে নেওয়া যায় অথবা খুব আত্ম-বিধ্বংসী হয়। এই সহিংসতার ভাষাই বলে দেয় যে তারা আসলে একটি সরকারকে সরিয়ে সেখানে সুশাসন স্থাপন করতে চায়, যেটা বাংলাদেশের এই কতৃত্বপরায়ণ সরকারের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। অথবা যেহেতু এই ‘মিলিট্যান্ট রাজনীতি’ মুসলিম বিশ্বের পক্ষে লড়াই করাকে গুরুত্ব দেয়, ফলে মুসলিমদের এইভাবে সব জায়গায় মার খাওয়াটাকে তারা মৌলিক জায়গা থেকেই রাজনীতি-বিরোধী মনে করে।
মিলিট্যান্ট ইসলামের এই বৈশ্বিক রুপ ঢাকায় যে বর্বরতা দেখিয়েছে সেটা কেবল ঢাকাতে আটকে থাকেনি। এটা নানাভাবে দাতা–সংস্থাগুলোর অন্ধকার দিকটিও দেখাতে চেয়েছে, যেইসব সংস্থার অনেক লোক সেদিন খেতে এসেছিল হোলি আর্টিজান রেস্তোরায়। হামলাটির ফোকাস ছিল হয়ত সারাবিশ্বে বিরাজমান অবিচার–অন্যায় আর বেইনসাফির বিরুদ্ধেও। এছাড়াও, এই অাধা–ডজন বাংলাদেশী তরুণ যারা জিহাদী–জজবা নিয়ে এই উচ্চপদস্থ লোকদের হত্যা করতে এসেছিল তাদের কাছে আরো একটি প্রেক্ষাপট ছিল। সেটা হচ্ছে, লোকাল–জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ রাজনীতির অনুপস্থিতি। ঠিক অনুপস্থিতি নয়, এইটা এখন অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এসব এনজিও–কর্মী এবং এই ‘জঙ্গি’রা উভয়ই বর্তমান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে কাজ করছে এবং এরা এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে একরকম অবজ্ঞা করে সেগুলোকে খারিজ করে দেয়। সাথে যোগ হয়েছে কতৃত্বপরায়ণ সরকার, যে তার বিরোধীপক্ষকে নির্মূল করতে জানমাল বিলিয়ে দিচ্ছে, যেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং রাষ্ট্রটি দিন দিন বিরাজনীতিকরণের দিকে পতিত হচ্ছে
চিহ্নিতকরণের সংকটঃ
যদি পুরো ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে চলমান বামধারার অক্যুপাই মুভমেন্টগুলো কিংবা ডানপন্থীদের অভিবাসন-বিরোধী আন্দোলনগুলো গ্লোবালাইজেশনের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে মিলিট্যান্ট ইসলাম গ্লোবালাইজেশনের পক্ষের একটি আন্দোলন হতে পারে। আর যাই হোক, গ্লোবালাইজেশন-বিরোধী আন্দোলনগুলো মূলত শ্রেনী-জাতির হারিয়ে যাওয়া রাজনীতিকে নতুন প্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করে, সেখানে মুসলিম সন্ত্রাসবাদ রাজনৈতিক নানা উপাদানে যেমন রাষ্ট্র, মানুষ অথবা বিবাদে নিজেকে হাজির রেখেও ঐ গ্লোবালাইজেশন-বিরোধী আন্দোলনের উল্টোটা করে। এভাবে তারা একটা রাজনীতিহীন সমাজ আদায় করতে চায় যেখানে তারা তাদের আসমানী আইন চালু করতে পারে। অপরিবর্তনীয় এবং সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে যে আইন। আসলে, ইসলামিস্ট এবং এবং মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো রাষ্ট্রের ব্যাপারে, রাষ্ট্রের রাজনীতির ব্যাপারে সবসময়ই এক ধরনের সন্দিহান থাকে। এই একটি ব্যাপারে তাদের লক্ষ্যের ক্ষেত্রে, তাদের মধ্যে একটা সাদৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া তাদের দুটি গ্রুপের সব এজেন্ডাই আলাদা। সেটা যেকোন স্বৈরাচারি রাষ্ট্র থেকে নয়া-লিবারেলিজম দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র (মালয়েশিয়া, টার্কি) পর্যন্ত।
গ্লোবালাইজেশন-পীড়িত নানা ব্যাপারের মতই, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ অনেকসময় জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঞ্চলটিকে একরকম পাশ কাটিয়ে যায়। এর প্রেক্ষাপটগুলোও রাতারাতি জায়গাবিশেষে বদলে যায়। ফলে আল-কায়েদা কিংবা আইএসের আন্দোলন কি আসলে একটি গ্লোবাল রাজনীতির ধারা চায় নাকি রাজনীতির সকল সম্ভাবনার ধ্বংস চায়, তাঁর কোন খোলাসা হয় না। তাদের সকল কাজে এক ধরনের দোটানা লক্ষ্য করা যায়। সন্ত্রাসবাদ কিংবা যেকোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, তারা সবসময় সংখ্যায় বিশাল এমন আর্ত-জনগোষ্ঠী যেমন দক্ষিণের নিপীড়িত জনতা কিংবা মুসলিম কওমের নাম নিতে বাধ্য থাকে। ফলে তারা রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে থাকে কারণ তারা তাদের শরীরে কোন রাজনৈতিক গন্ধ উপভোগ করে না। মানবতার জয়গান গাওয়া আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো যেমন তাদের ডোনার ছাড়া কারো কাছে জবাবদিহিতা দিতে বাধ্য থাকে না, তেমনি মিলিট্যান্ট ইসলাম যে আর্তপীড়িত জনগোষ্ঠীকে সাহায্যের কথা আমাদের শোনায়, সেসব জনগোষ্ঠীই হয়ত এই সহায়তা কবুল করে না।
ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক লুক বল্ট্যান্সকি এই সমস্যাটিকে দূরবর্তী কোথাও দুর্ভোগের কোন সচিত্র ব্যাপার যখন মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যেটি সবসময় একটি মানবতাবাদী পদক্ষেপ নিতে আহবান জানায় এই দুর্ভোগের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই ধরনের দুর্ভোগের যখন কোন আপাত সমাধান দেখা যায়না কিংবা করা হয়না তখন দর্শকের এই অত্যাচার-দর্শন এক নতুন চিন্তায় পরিণত হয়। এই অত্যাচার-দর্শন তাকে তাঁর নিজের অপরাধবোধ, সমব্যাথা আর ভাবালুতার জন্য নানা পরীক্ষা-সমালোচনার খোঁজ করে। এবং খুব সহজে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে কতশত উপায়ে তারা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্যাক্রিফাইস করছে। হয়ত সময়, টাকা এবং তার জ্ঞান-দক্ষতা দিয়ে কিংবা অস্ত্র বা সন্ত্রাসের মাধ্যমেও তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এইটাই হয়তবা এই ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সবচেয়ে শক্তিশালী রেসপন্স হয়ে দেখা দেয়। এই আলাপ বিশেষভাবে সত্য হয়ে ওঠে যখন ভিক্টিম কোন এবস্ট্রাক্ট ব্যাপারের মধ্য থেকে উঠে আসে। মানে যখন আক্রান্ত-জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত হওয়ার পেছনে কোন রাজনীতি গর-হাজির থাকে যেমনটা দেখা যায় মানবতা কিংবা মুসলিম উম্মাহর ক্ষেত্রে। নিজেকে একেবারে নিঃশেষ করে দেবার যে তামান্না তারা করে থাকে, সেই তামান্নাটুকুই আক্রান্ত ব্যক্তি আর তাঁর মধ্যকার দূরত্ব। কিন্তু প্রকৃত রাজনীতির হাজিরা না থাকায়, তাদের এই ধরনের উদ্যোগ এক ধরনের গভীর আত্মরতির জন্ম দেয়। ফলে আজকের মিলিট্যান্ট ইসলামের সৈন্যরা সবাইকে একরকম বাধ্য করছে তাদের মত করে এই দুর্ভোগকে ছড়িয়ে দিতে। যেন ভিক্টিম-দর্শকের এই কমিউনিটিকে দৃশ্যমান করতে সে একরকম মরিয়া হয়ে উঠে।
হান্না আরেন্ডট (Hannah Arendt) তালাশ করেছিলেন এমন ভায়োলেন্সের যার সাথে অত্যাচারিতদের প্রতি সমবেদনা মিলে কিভাবে ফ্রেঞ্চ রেভ্যলিউশনে নিজেদের স্যাক্রিফাইজ করে দিচ্ছিল লোকজন। এবং এমন ভায়োলেন্সের ইতিহাসের শুরুটা ঐখান থেকেই। তাঁর মতে, এটি তখন একটি ‘সামাজিক প্রশ্ন’ ছিল। যেটা ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল বিশাল অসাম্য, দারিদ্র্যতা আর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে জেগে উঠা সমবেদনা আর এর পিকিউলার সব ভায়োলেন্ট আইডেন্টিফিকেশনের মাধ্যমে। তারা এর মাধ্যমে দুর্ভোগের বাস্তবতাকে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাধান করতে চেয়েছিল। যাইহোক, সে বিশ্বাস করত এই ‘সামাজিক প্রশ্ন’টাকে রাজনৈতিকভাবে হাজির করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আর রাজনৈতিক বিশ্বাসকে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু আজ, গ্লোবালাইজেশনের আইডেন্টিফিকেশনের সাথে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এমনকি বিপ্লব এর পরিসর থেকে এই দুর্ভোগ অনেকটা হাওয়া হয়ে গেছে বলে মনে হয়। এখন এই দূর্ভোগ খালি দেখা যায় অরাজনৈতিক সন্দেহবাদীদের চাইতেও জঘন্য এপ্রোচ হিসেবে কিছু অমীমাংসিত নৈতিক-সামাজিক ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে।
গ্লোবালাইজেশন পরবর্তী রাজনীতিঃ
এর সহিংসতার ভয়াবহতা টের পেয়ে, গান্ধী এই ধরনের গ্লোবাল আইডেন্টিফিকেশন বা একীভূত-করণের একজন গুরুত্বপূর্ণ সমালোচক ছিলেন। তিনি বারংবার কোন কাজকে মানবতার নামে করা বা বলাকে অস্বীকার করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানবতার নামে কাজ করে এমন দাবী করা উদ্যোগগুলো অনেক বেশি ঔদ্ধত্ব আর আত্মমগ্নতায় ভরপুর থাকে এবং এই ধরণের উদ্যোগকে তিনি পলিটিক্যালি অসম্ভব মনে করেন। যদিও তিনি ইউনিভার্সালিটির আইডিয়াকে অগ্রাহ্য করেন নাই। তিনি মনে করতেন, উদাহরণ হিসাবে, অহিংসাই কেবল বিশ্বব্যাপী বিস্তার হইতে পারে। কিন্তু এইধরনের ব্যাপার সম্ভব কেবলমাত্র ব্যাক্তিগত উদাহরনের ক্ষেত্রে, সেটিকে লক্ষ্য হিশাবে ধরে কাজ করতে গেলে ফল উল্টো হতে পারে। যার কারণে অহিংসার এই প্রজেক্টটি ছড়িয়ে দেয়ার বদলে সেটিকে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এই বন্ধ করার পক্ষে গান্ধী সাফাই গেয়েছিল এক নতুন আইডিয়াকে সামনে এনে। তিনি বলেছিলেন, ওশানিক (Oceanic) সার্কেলের কথা। যেই সার্কেলের মাধ্যমে একটি গ্রামে চর্চিত আত্মনিয়ন্ত্রণকে জেলায়, প্রদেশ এবং জাতি নির্বিশেষে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হবে, কোন কেন্দ্রীয় কতৃপক্ষ ছাড়াই।
অহিংসা বিষয়ে গান্ধীর যে ভিশন এবং যে চর্চার কথা তিনি বলেছেন যেখানে কোন সেন্ট্রাল কতৃপক্ষের দরকার হবে না, মনে হচ্ছে ইসলামিক মিলিট্যান্সি আমাদের এই সময়ে সেই পথ ধরেই হাটছে। কিন্তু গান্ধীর মতে, এই পথের মিল স্যাক্রিফাইসের এক রুপ থেকে আরেক রুপে বদলে যাওয়াকে হয়ত সমর্থন করত। তিনি হয়ত ভাবতেন, সব চিন্তার কমন ভাল দিকগুলো দিয়ে যেকোন ধরনের অমঙ্গলকে চিরতরে ধ্বংস করা যায়। আরেকভাবে বলতে গেলে, মহাত্মা হয়ত এই জঙ্গিদের সবকিছু চিরতরে বিলিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে যে নায়কোচিত ব্যাপার আর আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায় তা খুব ভাল বুঝতে পারতেন। কেননা তাঁর সময়ে এই ধরনের মিলিট্যান্সির নানা ঘটনা থেকেই তিনি এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি হয়ত দেখাতে চেষ্টা করতেন যে এই ধরনের ঘটনার একটি মহিমান্বিত অহিংস দিক আছে। যাই হোক, এটি অহিংস হতে পারে যখন এই স্যাক্রিফাইস পলিটিক্যালি বাস্তব কোন কিছুর সাথে জুড়ে দেওয়া যায়।
একজন বাংলাদেশি–তরুণ ফাইয়াজ যে এখন ঢাকায় সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচিত। সে সেই ভয়াল রাতে বান্ধবীদের ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন এবং শেষমেষ সেখানেই মারা পড়েন। যদিও সে ছাড়া পাওয়ার আশায় কুরআনের নানা আয়াত শুনিয়েছিল হামলাকারীদেরকে (ঘটনার পরপরই যদিও বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া বিচ্ছিন্নভাবে তাকে হিরো বানানোর প্রকল্প নিয়েছিল– অনুবাদক)। ইসরাত আখন্দ নামে এক তরুণীর ঘটনা তো তার চেয়েও চাঞ্চল্যকর। সে নিজেকে মুসলিম বলতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ছাড়া পাওয়ার সুযোগ নিতে অস্বীকার করেন। এইখানেই গান্ধীবাদী স্যাক্রিফাইসের কথা উঠে আসে, যেখানে সন্ত্রাসবাদীদের বিপরীতে এই স্যাক্রিফাইসের মহিমা দেখানো হয়েছে। ফলে ইশরাত আখন্দ যখন গ্লোবাল আইডেন্টিটি হিশাবে মুসলিম পরিচয়কে অস্বীকার করেন, তখন তিনি আসলে মুসলিম হিসেবে নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করেন
একটা উপায় আছে যার মাধ্যমে যেকোন স্যাক্রিফাইসের নায়কোচিত ভূমিকাকে পলিটিক্যালি গুরুত্ববহ করা যায়। সেটা হচ্ছে কাউকে কোন অনুভূতি বা পরিস্থিতি দেখিয়ে সে কত অনিরাপদ তা বুঝতে শেখানো এবং এতে তার দায়িত্ব বিষয়ক একটি উপদেশমালা হাজির করা। আবার এও হতে পারে যে এই ধরনের দুর্ভোগে কেউ কেউ ঊদাস বা নির্বিকার থাকতে পারে, কেননা এতে তো কারো হাত নাই। এই ধরনের মানসিকতা গান্ধীর দায়িত্বের হাতবদলের আইডিয়ার সময়ে এতটা লক্ষ্য করা যায়নি। এটি এমন একটি মানসিকতা যা মানবতাবাদের স্পিরিটের সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারের বিরুদ্ধে কাজ করে। যেটাকে হান্নাহ’র মত গান্ধীও মনে করতেন এই মানসিকতা ভায়োলেন্সকে নানাভাবে উৎসাহ দেয়। গান্ধী সবসময় দুরের ভিক্টিমদের থেকে কাছের প্রতিবেশীর দায়-দায়িত্বকে বেশি প্রাধায় দিতেন। তিনি তাই, শিল্পায়নের ফলে আগত নানা প্রযুক্তির ব্যাপারে খুব ক্রিটিক্যাল ছিলেন। যেমন, রেলওয়ের ব্যাপারে, যেটা পাবলিককে তাঁর এলাকা-প্রতিবেশির দায়দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচবার একটি উপায় হয়ে দাড়িয়েছে বলে তিনি মন করতেন। এবং এইভাবে তাঁর মধ্যে মানবতার মত কিছু এবস্ট্র্যাক্ট ব্যাপার ঢুকে পড়ে।
উৎসঃ দ্যাজবান
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: