ছালছাবিল : সিরাজুল ইসলাম জীবন


প্রকাশিত:
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৪৬

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:৫২

 

গতিই জীবন। গতির উৎস কীসে? এ প্রশ্নের জবাব ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হয়। আমার জীবনে গতি হয়ে এল---ছালছাবিল। ছালছাবিল প্রতিনিয়তই আমার সব ধারণাকে পাল্টে দিয়ে একটার পর একটা বিস্ময় জন্ম দেয়। জীবনের অতি নাটকীয়তা ছালছাবিলের সংস্পর্শে এসেই উপলব্ধি করলাম। তাই তো উগ্র সুখের সৈকতে আমার এখন নিয়ত হাঁটাহাঁটি। 

 

ছালছাবিল বাতাসের মতো। বাতাস হয়েই সে আমার ইন্দ্রিয়ে ধরা দেয়। প্রথম পরিচয়েই ও আমাকে চমকে দিল। আমার কথা ওকে  মোহাবিষ্ট করে। আমি জানি আমার শক্তি অপরিসীম; আমার কথার ধরনে রস ও রঙ আছে, আছে মাদকতা। ছালছাবিল আমাকে আবিষ্কার করে ছাড়লো। ও বয়সে আমার অনেক ছোট, কিন্তু বুদ্ধিমত্তার ছাপ স্পষ্ট। ছোট বয়সেই ওর ধ্যান-ধারণা অনেক পরিণত। ছালছাবিল বাপ-মায়ের একমাত্র আদুরে মেয়ে তাই ওকে বললাম, বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হলে জীবনে অনেক ভোগান্তি আছে।

 

ও চমকে ওঠে বললো, "কী রকম?"  

"প্রথমত বাবা-মায়ের কোনো পাত্রই পছন্দ হয় না। পরবর্তীতে একটা অথর্ব স্বামী কপালে জুটে। দেখো ছালছাবিল, প্রত্যেক পিতামাতাই মেয়ের কল্যাণ চায়, কিন্তু কীসে যে কল্যাণ সেটা সবসময় তারা বুঝতে পারেন না। অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়।"

 

ও আমার কথায় সায় না দিয়ে পারলো না। ধীরে ধীরে আমি তার নিকট স্বপ্নপুরুষ হয়ে উঠলাম। ক্রমশ ছালছাবিলও আমার স্বপ্নমানবী হয়ে উঠলো। একরাতে কথা প্রসঙ্গে বললো, "আমি কিন্তু আপনাকেই বিয়ে করবো।"

 

ওর সাহস ও আত্মবিশ্বাস দেখে বিস্মিত হলাম। ভাবলাম---এ কোনো সাধারণ মেয়ে নয়, নিশ্চয়ই তার মধ্যে একটা অসাধারণ সত্ত্বা আছে। আমি ওর প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ বা না কোনোটাই বললাম না। বাঙালি নারীর শামুকপ্রবণতার চিহ্নও ওর মধ্যে নেই। আমার অতীত ধারণা পাল্টে গেল। একদিন একটা বিব্রতকর প্রশ্ন করে বসলো ছালছাবিল, " আচ্ছা আপনি কি বিবাহিত?"

 

আমি ওকে পরে জানাবো বলে সময় নিলাম। মিথ্যা বলা আমার স্বভাবে নেই, তাই কিছু দিন পর ও যখন আবার এ প্রশ্নের জবাব জানতে চাইলো তখন সত্যি সত্যি বলে ফেললাম, "আমি বিবাহিত।"

 

ছালছাবিল কেঁদে ফেললো। ওর কান্নায় আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, "তবুও আমি আপনাকেই বিয়ে করবো, কী করবেন না?"

 

আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পরে ওকে বললাম, "স্রষ্টার উপর ছেড়ে দিই ছালছাবিল, আমরা তো শুধু চেষ্টা করতে পারি।"

 

ও আমার কথায় সম্ভবত খুশি হতে পারেনি। সত্যিই বিস্ময়কর চরিত্র ছালছাবিল। সে-দিনের পর থেকে জীবনের সব ঘটনাই ওকে জানিয়েছি। যে-কথা কোনোদিন কাউকে বলিনি সে-কথাও। আমাকেও ছালছাবিল অকপটে তার সব না বলা কথা জানাতে কার্পণ্য করেনি। আমাদের ঘনিষ্ঠতা ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। পরে ওকে বিয়ে করার সম্মতি দিলাম। ছালছাবিল আমার জীবনকে সীমাহীন রঙে রাঙিয়ে তুললো। রূপ-গুণের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে ওর মধ্যে। অতি ভাগ্য ছাড়া এমন মণি-মাণিক্য পাওয়া সম্ভব নয়। আমি কান পেতে ওর কথা শুনি---কখন সময় গড়িয়ে যায় টেরই পাই না। আমার কথাও ছালছাবিল গুণমুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনতে ব্যাকুল। আমি ওকে অনবরত কবিতা শোনাই। মাঝে মাঝে গানের কলিও আওড়াতে হয়। প্রথমদিকে আমি জানতাম না যে ছালছাবিলও ভালো গান গাইতে পারে। পরবর্তীতে সেই-ই আমাকে বেশি বেশি গান শোনাত। ও ভালো নৃত্যশিল্পীও। সময় সুযোগ মতো ওর সব নৃত্যকলা শুধু আমার জন্যেই জমা রেখেছে বললো। মাঝে মাঝে মনে হতো---আমি স্বপ্ন না বাস্তবের বাসিন্দা? মাত্র সতেরো বছরের ছালছাবিল আমার সারা জীবনের কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে। সবার জীবনেই ভালোলাগা এবং ভালোবাসার সীমাহীন উদ্দামতা আসে, কিন্তু ছালছাবিল আমার জীবনে এমন উদ্দামতা নিয়ে আসে---ভয়-শঙ্কা একেবারেই তুচ্ছ মনে হলো। একবার ওকে বললাম, "তোমাকে নিয়ে নির্বাসনে যেতেও রাজি আছি।"

 

ছালছাবিল ভীষণ খুশি হলো। আমি যে ওকে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসতাম তা ও জানতো। আমাকেও সে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসতো। ও সবসময় গল্প শুনতে চাইতো। আমার শৈশবের গল্প, কৈশোর-যৌবনের নানা অভিজ্ঞতা ওর সঙ্গে শেয়ার করতাম। আমার দুরন্ত শৈশবের স্মৃতি বলতে বলতে কণ্ঠ ধরে আসতো, কিন্তু ওর শুনতে ক্লান্তি ছিল না। আমি গ্রাম-শহর মিলিয়ে বড় হয়েছি। ছালছাবিল শুরু থেকেই শহরের বাসিন্দা। তাই সে গ্রাম-জীবনের বিভিন্ন স্মৃতি-কথা শুনে দারুণ মজা পেতো। আমার স্কুল পালানোর গল্প, সারা রাত মাছ ধরার অভিজ্ঞতা, গাছের ডালের ঝুলন নৃত্যকলা, গ্রাম-পুকুরের ডুব সাঁতারের কাহিনি শুনে ও ভীষণ আবেগতাড়িত হতো। এ প্রসঙ্গে ওর একটি বাক্য আমাকে এখনো নাড়া দেয়, "আপনি এত দুষ্ট ছিলেন কেন?"

 

ছালছাবিল হঠাৎ একদিন ভীষণ  রাগের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর একদম স্বাভাবিক হাসি হাসলো এবং বললো, "আপনার সঙ্গে একটু ঝগড়া করতে চাইছিলাম, কখনো ঝগড়া হয় না তো তাই।"

আমি বললাম, "তোমার সঙ্গে জীবনেও ঝগড়া হবে না ছালছাবিল।"

 

তারপর থেকে আমরা মাঝে-মধ্যে পাতানো ঝগড়া করতাম। ওর মুখের ভাষা আমার কাছে মনে হতো মধু-বৃষ্টি। ছালছাবিল অপ্রতিরোধ্য গতিতে বয়ে চললো আমার জীবন মরুপথের দুপাশে ফুল ফুটিয়ে। একদা বললাম, "তুমি আমার স্বর্গসুখ তাই না? "

"হ্যাঁ।"

"আচ্ছা তুমিও কী আমার মতো সুখানুভূতি পাও?"

"আপনার চেয়ে অনেক বেশি পাই।"

"ছালছাবিল তুমি আমার একটা নাম দাও না।"

 

ও আমার নতুন নাম রাখলো---ফেরদৌস। এ নামের তাৎপর্য ব্যাখা করেও শুনালো। ছালছাবিলের নিকট আমি দুনিয়ার স্বর্গ হয়ে আবির্ভূত হলাম। আমাকে মাঝে মাঝে ছালছাবিল স্বপ্ন দেখে, আমিও। একরাতের স্বপ্নবিলাস ওকে আরো বেশি আমার প্রতি কাতর করে তোলে। ও বললো, "গত রাতে আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি এবং এরপর থেকে সত্যি সত্যি আপনি আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন।"

আমি বললাম, "স্বপ্নটা কী রকম?" 

 

ও কিছুটা ইতস্তত করে পরে বলবে জানালো। কিছুদিন পর ঠিকই বললো, "জানেন আমি বাসা থেকে পালিয়ে আপনার কাছে চলে আসি। এরপর আমরা বিয়ে করি। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিই। পরবর্তীতে আমাদের ঘরে একটা পুত্র-সন্তানের জন্ম হয়।"

 

আমি মনে মনে ভাবলাম---তুমি আমাকে অনেক কাঁদাবে ছালছাবিল। এত ভালোবাসা আমার কপালে সইবে না, ঠিকই আমাকে রিক্ত করে ছাড়বে, তখন কী হবে আমার? দিনের পর রাত, রাতের পর দিন আমার পৃথিবী শুধুই ছালছাবিলকে ঘিরে। ও আমাকে ঘুম পাড়ায় আবার ঘুম থেকে জাগায়। জীবনে একবারও ওর প্রতি বিরক্তি আসেনি। আমার প্রতিও ওর কখনো বিরক্তি আসতে দেখিনি। আমাদের ভাবের রসায়ন এতটা সুদৃঢ় হলো যে, শুধু অবধারিত মন্দভাগ্য ছাড়া আমাদেরকে আর বিচ্ছিন্ন করে কে?

 

ছালছাবিল আমার চেতন থেকে কখনোই হারায় না। মাঝে মাঝে ও হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি আমার জীবনে সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওকে ছাড়া জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আকস্মিক ছালছাবিল আবার হাজির হয়। আমারও বাঁধভাঙা জোয়ার আছড়ে পড়ে। ওকে বললাম, "আজ তোমার নিকট অভিনব কিছু প্রত্যাশা করি, যে অভিজ্ঞতা তোমার-আমার জীবনে প্রথম।"

ছালছাবিল আমাকে বললো, "চোখ বন্ধ করেন।"

 

আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। কথা মতো চোখ বন্ধ করলাম। ছালছাবিল আমাকে অবাক করে দুগালে দুটো চুমু খেলো। প্রতিদানে আমি চারটি চুমু খেলাম। ওর সীমাহীন অনুভূতিকে সম্মান করতে পেরে আমার জীবন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠলো। ভালোবাসার এমন অনুভূতির তুলনা এ-জীবনে কোনোদিন পাইনি, হয়তো পাবোও না। এ ধরনের নিখুঁত অনুভূতির অভিজ্ঞতা জীবনে কখনো দুইবার হয় না। 

 

কোনো এক মধ্য রাতে ও আমাকে ছাদের উপর ডেকে তুললো। ওখানটা নির্জন। আকাশে অজস্র তারাফুল। এত আবেগ ছালছাবিলে মধ্যে আগে কখনো দেখিনি। ও নিজেকে উজাড় করে দিতে চাইছে। গভীর রাতে নীরব-নির্জনতার সুযোগে নিজেকে অনন্ত প্রত্যাশার সাগরে নিয়ে এল। আমাকে এই প্রথম 'তুমি' সম্বোধন করে বলতে মতামত চাইলো। আমি দ্বিমত করিনি। আড়ষ্টতার কোনো চিহ্নও নেই ওর ভাষায়। দুর্দান্ত সাহসী ছালছাবিল। ঘটনাবহুল সে-রাত আমি কালের ফ্রেমে বাঁধাই করে রেখেছি। আমার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বাঁধা থাকবে শুধু একটি রাতকে ঘিরে তারকা বেষ্টিত চাঁদের মতো। ও বললো, "তোমাকে আমি এখন বিয়ে করবো ফেরদৌস, এভাবে আমার আর ভালো লাগে না।"

ও নিজেই আমাকে 'কবুল' পড়তে বললো। আমি বললাম 'কবুল।'

এরপর আমিও ওকে অনুরূপ বললাম। ছালছাবিল তিনবার বললো, 'কবুল---কবুল---কবুল। '

 

সাক্ষী থাকলো শুধু আকাশ আর বাতাস। ছালছাবিল আমাকে নিয়ে উড়ে চললো মধুচন্দ্রিমার দিগন্ত প্রসারিত উদ্যানে। স্বপ্নের কথা শোনালো অনেক। ওর নতুন অতিথি দরকার। অনাগত স্বপ্নফুলের নামও আমরা রাখলাম---রওনক।

 

দুই মাস পর...।

 

আমি অনবরত জেগে আছি। ছালছাবিল অনবরত ঘুমিয়ে। হয়তো ট্যাবলেট খাওয়া ঘুম। আমি এর কিছুই জানি না। আমি অনবরত মৃত্যুযন্ত্রণায় অস্থির। পৃথিবী এখনো বাতাসশূন্য হয়নি। কিন্তু আমার বাতাস মানবী ছালছাবিলের নিদ্রা ভাঙবে কবে জানি না। আমার আপাদমস্তক কেবল বিধ্বস্ত রানাপ্লাজার মতো বিরামহীন আর্তনাদ করে ওঠে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top