ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (নবম পর্ব) : সেলিনা হোসেন
প্রকাশিত:
১০ মার্চ ২০২১ ১৯:৪৭
আপডেট:
১০ মার্চ ২০২১ ২০:১৬
আশিকা ঘরে ঢোকে। জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। দূর আকাশের নীলাভ আভায় ওর দৃষ্টি জ্বলে ওঠে। যেন ও পাহাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে আকাশ। কেমন করে যে বেঁচে থাকার সূত্র এমন রঙিন করে নিতে পারে এটা নিজের কাছে নিজেরই আনন্দ। নিজের ভাবনায় মোহিত হয়ে আকাশ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারেনা। আপন মগ্নতায় জানালার পাল্লায় মাথা ঠেকিয়ে রাখে। একসময় পড়ার টেবিলে এসে বসে। সামনেই ওই কাগজটি আছে যাদের নিয়ে ও বান্দরবানে বেড়াতে যাবে তাদের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর। কাগজটার উপর চোখ রাখলে আন্দোলিত হয় ভ্রমণের চিন্তা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন বন্ধু একজোট বেঁধে সময়-সুযোগ মতো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টি আশিকাকে বেশি মাতিয়ে রাখে। ও সবাইকে বলে, বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হওয়ার আগে আমি দেশের কোনা-কাপচা সব দেখতে চাই। কারো কাছে যেন বলতে না হয় যে আমি দেশের অমুক জায়গাটি দেখতে পাইনি।
সুলেখা বলে, তোর এম্বিশন আকাশচুম্বী। কীভাবে যে ম্যানেজ করবি তুই জানিস।
- পারব, পারব। ইচ্ছা থাকলে তার উপায় হয়।
সুলেখা খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে বলে, বনেবাদাড়ে তো একলা যেতে পারবিনা।
- সেটা পারব না। আমিও জানি। সেজন্য জোট বেঁধেছি।
- ভালোই করেছিস। আমাদের উপকার হয়েছে। আমারও ঘোরার ইচ্ছা আছে কিন্তু তোর মতো এমন তোলপাড় করা ইচ্ছা না। সুযোগ পেলে যাব, সুযোগ না পেলে মন খারাপ হয় না। এবার যে পাহাড়ি এলাকায় যাচ্ছি এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি কোনোদিন বান্দরবান-রাঙামাটির দিকে যাইনি। এমন অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ আমি মিস করব না। আমরাতো সামনের সপ্তাহে যাব। আমাদের অন্যরা সবাই তৈরি আছেতো?
- আছে নিশ্চয়ই। কালকে সবাইকে ফোন দেব। বাসে আমরা বান্দরবান পর্যন্ত যাব। তারপর ওখানে গিয়ে ঠিক করব আলীকদম উপজেলায় কীভাবে যাব।
- এটা একটু অনিশ্চিত হবে না? এখনই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত যে কীভাবে যাব।
- এত কথা বলিস না তো। আমরা গিয়ে দেখি ওখানে কি ধরণের ব্যবস্থা আছে। ওরাওতো যাতায়াত করে।
- যদি পাহাড়ি পথে হেঁটে যেতে হয়? আমরা কি ওদের মতো হাঁটতে পারব? ওরা জন্মের পর থেকে ওই পথে হাঁটাহাঁটি করে।
- থাম, থাম। ওদের সঙ্গে তুলনা করিসনা। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। যতটুকু পারব হাঁটব। না পারলে ফিরে আসব।
আশিকা থামিয়ে দেয় ওকে। ও নিজেও চুপ করে যায়। এভাবে ভাবলে ভ্রমণের আনন্দ নষ্ট হয়ে যাবে। তারচেয়ে আনন্দের জোয়ারে ডুবে থাকা উচিত। আশিকাকে বলে, বাড়ি যাই। আমি রেডি থাকব। যেদিন বলবি কোথায় জড়ো হতে হবে সেখানে চলে আসব।
- ঠিক আছে, যা দু’তিন দিন পরে দেখা হবে।
সুলেখার সঙ্গে কথার স্মৃতি নিয়ে ও গুনগুন করে। গুনগুনিয়ে গাওয়া গান ওর আনন্দের উৎস। গানের লাইন মনে না থাকলেও গাইতে থাকে। তাতে ও আনন্দ হারায়না। সেদিন টেবিলের ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল তিনদিন পর শুক্রবার।
পরদিন যাওয়ার জন্য বাসে সবার টিকিট কেটে তৈরি হয় আশিকা। সবাইকে খবরটা ফোন করে জানায়। গুলিস্তান থেকে বাসে উঠতে হবে। সুলেখার হাসির রেশ ফুরোয়না। হাসতে হাসতে বলে, তুই আমার আজীবনের বন্ধু থাকবি আশিকা। তোকে আমি ছাড়বনা। জড়িয়ে রাখব বুকের সঙ্গে।
- হয়েছে হয়েছে থাম। আনন্দ প্রকাশ করবি আমরা যখন ভ্রমণ শেষ করে আসব।
অন্যরাও ফোন করে সময়মতো বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার কথা বলে। সবার কন্ঠস্বরে উচ্ছাসের জোয়ার ধ্বনিত হয়।
- তোকে আমাদের ভালোবাসারে আশিকা। তোর মতো আর কাউকে পাইনি।
- হয়েছে থাম। এত কথা বলতে হবে না। সময়মতো পৌঁছাবি তোরা। কেউ যেন বাদ পড়িসনা।
সবাই একসঙ্গে বাসে ওঠে পরদিন। হাসি-তামাশায় জমে ওঠে চলমান বাস। অন্য যাত্রীরা ওদের হাসি-তামাশা উপভোগ করে। নিজেরাও হাসে। বান্দরবানে এক অন্যরকম যাত্রা এই প্রথম উপভোগ করে সবাই। বয়সী যাত্রী মিনহাজ বলে, বান্দরবানে কোথায় থাকবে তোমরা?
আমরা ঘুরতে এসেছি। আমরা শহরে থাকবনা। পাহাড়ে যাব। বনে-বাদাড়ে ঘুরব।
- পাহাড়ে তো রাতে থাকবে না?
- না, না থাকব না। কেমন করে থাকব?
আশিকার প্রশ্নে সবাই হাসে। হাসতে হাসতে নির্দিষ্ট সময়ে আলীকদম উপজেলায় পৌঁছে যায় ওরা। আদুূপাড়ায় যাওয়ার ব্যবস্থা কি তা জানতে আসিফ কাউন্টারে যায়। বাস কাউন্টারের পাশাপাশি এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থাও আছে। জিপে করে যাওয়া যাবে আদুপাড়ায়। তারপর বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। জিপ চালক একজন মুরং। তার নাম থাংপু। যুবক ছেলে। হাসিখুশি। আসিফকে বলে, আমার সঙ্গে চলেন। যেখানে যাবেন আমি সেই এলাকা চিনি। আপনাদের সঙ্গে গেলে আমারও ভালোলাগবে।
থাংপু জিপ নিয়ে এসে রাস্তার মাথায় দাঁড়ায়। সবাই উঠে বসে। আশিকা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে। এই সিটে বসলে সামনের দৃশ্যটি চমৎকার দেখা যায়। কোনো কিছু আড়াল হয় না।
শুরু হয় যাত্রা। পাহাড়ি জনপদের রাস্তার নতুন অভিজ্ঞতার আনন্দে সবাই উচ্ছ্বসিত। প্রত্যেকের মুখ থেকে ঝর্ণার মতো কথা বেরুচ্ছে। গড়িয়ে পড়ছে কথার অবারিত জল। কেউ গান গাইছে দু’চোখ ভরে চারদিক দেখছে। উচ্ছ¡সিত হয়ে গাছ, ফুল, পাখি ইত্যাদি নিয়ে উছ্বাস প্রকাশ করছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে গেলে আশিকা জোরে জোরে বলে, দেখ, দেখ কি সুন্দর ফুল ফুটেছে গাছটায়-
- হ্যাঁ, দেখলামতো।
- এই গাছটি আমি ঢাকায় বা অন্য কোনো শহরে দেখিনি। এমনকি আমি দেশের যেসব ছোট ছোট জায়গায় গিয়েছি সেখানেও দেখিনি।
- বাব্বা তুইতো একটা ভবঘুরে মেয়ে। তোর দেখা না হলে আমরা কোন ছার? আমাদের সামনে তো সবকিছুই নতুন আশিকা।
- তুই সবসময় আমাকে আক্রমণ করে কথা বলিস আসিফ। আর কখনো এভাবে কথা বলবি না। আমি একদম মানবনা।
- রেগে যাচ্ছিস কেন? এটা আক্রমণ হলো? আমিতো তোকে প্রশংসা করলাম। অসাধারণ বাবা-মা পেলে সব ছেলেমেয়ের দেখার দিক খুলে যায়। যেদিকে তাকায় সেদিকেই নিজের দেখা খুঁজে পায়।
- হয়েছে আর বক্তৃতা দিতে হবে না।
- তুই তো আক্রমণ করে কথা বললি। আক্রমণ কত ধরণের হয় তা জানিস?
- জানব না কেন? একশবার জানি। বেশি কিছু বোঝানোর মাতবর হতে হবে না তোকে।
- সুহাস রাগত স্বরে বলে, এই তোরা চুপ কর। এত সুন্দর জায়গায় এসে তোরা আজেবাজে কথা শুরু করেছিস। মোটেই ভালোলাগছেনা।
- হ্যাঁ, আমাদেরও ভালোলাগছে না। সবাই মিলে একসঙ্গে বলে।
- দেখ দেখ কত বড় একটা বনমোরগ। আশিকা হাসতে হাসতে বলে।
- আমরা আগেই দেখেছি। ওটা রাস্তায় ছিল। জিপের শব্দে পাহাড়ের ভেতরে চলে গিয়েছিল। আবার বেরিয়ে এসেছে।
- ওর পালকের রঙটা সবুজের মধ্যে ফুল হয়ে ফুটে আছে। মোরগটি সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। দারুণ লাগছে।
জিপ ততক্ষণে এগিয়ে যায়। পাকা সড়ক। স্বচ্ছন্দ গতিতে চলে যাচ্ছে জিপ। মাঝে মাঝে পাহাড়ের উুঁচ-নিচু পথ আর দু’পাশের অপূর্ব নিসর্গ যেন এক অন্য পৃথিবী। আশিকা দুপাশে তাকিয়ে আপ্লুত হয়ে যায়। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে আলীকদম উপজেলার আলীর সুড়ঙ্গের কথা। এ সম্পর্কে ও জেনে এসেছে, কিন্তু সুড়ঙ্গ কোথায় তা এখনও জানতে পারেনি। কাউকে জিজ্ঞেস না করলে নিজের পক্ষে খুঁজে দেখাতো সম্ভব না। সবুজ বনরাজী ওকে বিষণ্ণ করে। ও চারদিকে তাকিয়ে স্বস্তি খোঁজে। একসময় উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, বেশ একটা দৃশ্য দেখা হচ্ছে। বেঁচে থাকা ধন্য হয়ে গেল।
- এমন দৃশ্য তুই নিশ্চয় আগে কোথাও দেখিসনি। না রে আশিকা?
- না, দেখিনি। যখন যেখানে যাই সেটা আমার কাছে নতুন হয়ে ওঠে। আমি পুরনো স্মৃতি মনে করে দেখার সৌন্দর্য নষ্ট করিনা। যখনই দেখি তখনই মনে হয় এ এক নতুন দৃশ্য। দেখার মাত্রাকে আমি জড়ো করে রাখিনা রে সুহাস।
চলবে
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (তৃতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (চতুর্থ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (পঞ্চম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (ষষ্ঠ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (সপ্তম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (অষ্টম পর্ব)
বিষয়: সেলিনা হোসেন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: