সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (চতুর্থ পর্ব) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ২০:৫২

আপডেট:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ২১:০৭

 

ওদের কাছে ইমেইল পাঠিয়ে বিছানায় গেলে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে আশিকার। পরক্ষণে ঘুম কেটে যায়। চোখ বড় করে তাকালে মশারীর চারপাশে দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় মশারীর চারদিকে জমে উঠেছে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া সেই দৃশ্য আবার স্মৃতির বালুকাবেলায় ভেসে ওঠে। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সমুদ্রের সৈকত দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক অসাধারণ এডভেঞ্চার। ভাবতে গেলে আশিকার ঘুম উধাও হয়ে যায়। ঘুমের রেশও থাকেনা।

আশিকার খালাতো ভাই বাবুল ওর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে এমন একটি প্রোগ্রাম করেছিল যে টেকনাফ থেকে সমুদ্র সৈকতে হেঁটে কক্সবাজার যাবে। দেখবে সমুদ্রের নানা দৃশ্য। একথা শুনে ওর মা নূরবানু উচ্ছসিত হয়ে বলেছিল, দারুণ প্রোগ্রাম করেছিস। তোদের সঙ্গে আমি আর তোদের বাবাও যাব।
- হ্যাঁ, মা চলো চলো। জীবনের এমন আনন্দ পেতে -
- শুধু আনন্দ না রে ছেলে, এমন একটি ভ্রমণ করতে পারলে আমার জীবন ধন্য হবে।
- হাঁটতে পারবেতো মা? কষ্ট হবে না।
- হাঁটতে পারব। কষ্ট একটু হতে পারে। সেজন্য ভেবেছি বড় একটা চাদর নিয়ে যাব। কষ্ট লাগলে বালুর উপর চাদর বিছিয়ে কিছ্ক্ষুণ শুয়ে থাকব। আবার উঠে হাঁটতে শুরু করব।
- সমুদ্র সৈকতে অনেক পাথর আছে। বসতে চাইলে পা মেলে বসে থাকতে পারবে।
- আহারে সোনা, এমন বেড়ানো জীবনে পাইনি। আমি হামিদা বুবুর কাছে যাব। দেখি সে যেতে চায় কিনা।
- আশিকাতো লাফালাফি করবে যাওয়ার জন্য। ওকে তুমি চিনতো।
- হ্যাঁ, চিনব না কেন? আমিতো এটাও ভাবি যে ওর মতো মেয়ে দুটো হয়না। আমার জন্য একটা রিকশা ডাক। আমি এখনই বের হব।

বাবুল রিকশা ডেকে আনলে নূরবানু বোনের বাসায় চলে আসে। আশিকা বাসায় নেই। হামিদা বানু দরজা খোলে।
- কেমন আছিস বুবু?
- ভালোই আছি।
- তোর জন্য একটা সুন্দর খবর নিয়ে এসেছি।
- বল, বল। ভেতরে আয়।
- ভেতরে আর ঢুকবনা। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
- তাহলে কি বলবি বলে ফেল?
- আমরা ঠিক করেছি টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত হেঁটে যাব সমুদ্র সৈকত দিয়ে। তুই কি যাবি?
- যাব, যাব। দারুণ ভ্রমণ হবে। কবে যাবি?
- বুবু ডেট ঠিক করে এসে তোকে আবার জানাব। দুলাভাই, আশিকা যাবে?
- হ্যাঁ, সবাই যাবে। এমন ভ্রমণ জীবনে আর কি পাব?
- ঠিক আছে, তাহলে আমি যাই।

নূরবানু যে রিকশায় এসেছিল সে রিকশায় উঠে পড়ে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে দেখে রিকশা ছেড়ে দেয়নি।

মায়ের কাছ থেকে শোনা খবরটি আশিকা একটুও ভোলেনি। ভ্রমণের কোনো কিছু হলেই তা ওর স্মৃতির পাতায় ভাসতে থাকে। নীল-সবুজের রঙে জ্বলজ্বলে করে। কখনো তা হারিয়ে যায় না। আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের দৃশ্যপট। প্রায় ত্রিশজন সঙ্গী গিয়েছিল সেখানে। যে এই ভ্রমণের কথা শুনেছে তার আগ্রহের সীমা ছিলনা। যেজন্য সংখ্যা এত বেড়েছিল। এত বেশি নারী-পুরুষ দেখে আশিকার প্রথমে মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু হামিদা বানু যখন বলল, এত লম্বা পথ হাঁটাতো সহজ কথা না। বেশি লোক থাকলে ভালো হবে। যদি কোনো বিপদ-আপদ হয় সবাই মিলে সাহায্য করব। ধর, হাঁটতে হাঁটতে কেউ একজন পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাল তখন একজন-দুজন থাকলে এইসব অবস্থা সামাল দেয়া কষ্টকর হয়। সেজন্য যারা যারা যেতে চেয়েছে আমি কাউকে না বলিনি। নূরবানুও তাই করেছে।

- আচ্ছা মা ঠিক আছে। এটা আমার একদম অন্যরকম ভ্রমণ হবে। সাগরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাব, চিন্তা করলেই মাথায় ফূর্তি ভরে যায়। হাঁটতে তোমার কোনো কষ্ট হলে তুমি আমাকে বলবে।
- দেখা যাবে। সবকিছু গুছিয়ে নে।
- তোমার জন্য বড় চাদরটা নেব তো?
- হ্যাঁ নিবি। 

অশিকা হাসতে হাসতে বলে, তোমার সঙ্গে আমিও শুয়ে থাকব মা। আমার ইচ্ছা মাটিতে কান পেতে রাখলে পানির কলকল ধ্বনি আমার কানে ঢুকবে। জানো আমি খোঁজ নিয়েছি যে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সৈকত পঁচাত্তর থেকে আশি কিলোমিটার।
- এত কথা বলে আমাকে ভয় দেখাইসনা। আমি যাবই। তোর বাবাও সঙ্গে থাকবে।
- তোমাকে ভয় দেখাব কেন মা? তোমার মানসিক প্রস্তুতির জন্য বললাম। শুনে তুমি আনন্দ পেলে না?
- হ্যাঁ, পেয়েছি রে।
- আমরা হাঁটতে হাঁটতে একদিকে সমুদ্র দেখব, আর একদিকে পাহাড় আর বনরাজি দেখব। আমাদের আনন্দের সীমা থাকবেনা।
- হ্যাঁ, ঠিকই, বুকভরা আনন্দ পাব। যা তিনটা ছোট ব্যাগ গুছিয়ে ফেল।

আশিকা তালি বাজাতে বাজাতে নিজের ঘরে যায়। ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলে, জীবনের আনন্দ এভাবে বেঁচে থাকার সৌরভ হয়।

বাবুল তিরিশজনের জন্য এক বাসে টিকেট কাটে। এই যাত্রার জন্য আরও পাঁচদিন অপেক্ষা করতে হবে। নইলে এক বাসে একসঙ্গে এতগুলো টিকেট পাওয়া যাচ্ছিলনা। পাঁচ দিন বসে থাকতে হবে শুনে আশিকার ছটফটি বাড়ে। একবার ভাবে, ও একাই চলে যাবে টেকনাফ। ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করবে। শাহপরি দ্বীপে ঘুরে বেড়াবে। শাহপরি দ্বীপ দেশের শেষ ভূখন্ড, তারপর সমুদ্রের শুরু। পরে ভাবে, না থাক দরকার নেই। এতবড় একটা দলে যোগ দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ অন্যরকম হবে। বান্ধবী শীলা যোগ দিয়েছে। ওর সঙ্গে নানামুখী আড্ডায় সময় কাটবে।

তারপর নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা শুরু হয়েছিল। তুমুল হাসিতে, গল্প-কথায় ভরে গিয়েছিল বাসের যাত্রা। আশিকা এমন একটি বাস-যাত্রা এর আগে পায়নি। কতবারই তো কতদিকে গেছে। এবারই এত মানুষ একসঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভালো লাগছে ভাবতে যে এ এক ব্যতিক্রমী যাত্রা। মনে মনে বলে, বাবুল তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

বিকেলে টেকনাফ পৌঁছে যায় বাস। যে যার হোটেলে চলে যায়। ঠিক করা আছে যে হোটেলে সকালের নাস্তা খেয়ে সবাই চলে আসবে সৈকতে। আশিকা মা-বাবাকে তাড়া দিয়ে রেডি হয়। সমুদ্র-সৈকতে তখনও কেউ আসেনি, ওরাই সবার আগে এসেছে। আশিকা মাকে বলে, মা আমি একটু দৌড়াদৌড়ি করি।

আতিকুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে বলে, না রে মা আগেই দৌড়াদৌড়ি করবিনা। টায়ার্ড হয়ে যাবি। অনেকটা পথ তো হাঁটতে হবে।
- টায়ার্ড হব না বাবা। একটু যাই?
হামিদা বানু শান্ত কন্ঠে বলে, না রে মা, তুই আমাদের কাছে থাক। তুই দূরে গেলে আমার মন খারাপ হবে।
- তাহলেতো যাবইনা। চলো সমুদ্রে পা ভেজাই।
আশিকা বাবা-মায়ের হাত ধরে পানির ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জোয়ারের জলে তিনজনই দাঁড়িয়ে থাকে। ঢেউ এসে পায়ে গড়ায়। ধাক্কা লাগে, যেন পানির সঙ্গে বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ঢেউ যেন বলতে চায়, নেমে আস আরও ভেতরে। ডুবে যাও সমুদ্রে। দেখ সমুদ্র কীভাবে তোমাকে নীল আকাশ ছুঁইয়ে দেবে। আশিকা নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকে বিস্তৃত পটভূমিতে। এমন দৃশ্য আগে কখনো সমুদ্রে পা ডুবিয়ে রেখে দেখা হয়নি। বাবা-মা দুজনে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
হামিদা বানু আতিকুরকে বলে, আশিকাকে পরীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে সমুদ্রকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে ও বাড়ি যাবে। পাড়ে গিয়ে বলবে, ওরে সাগর তোকে নিয়ে আমি ঘরে যাব। 
আতিকুর হো-হো করে হসে। হাসতে হাসতে বলে, তুমিও মেয়েটার মতো পরী হয়ে যাচ্ছ।
- আমিতো পরী না, আমি পেত্নী।
- তাহলে আমি কি ভূত? 
- তাইতো ভূতই হবে।

দুজনে খলবলিয়ে হাসতে থাকে। আশিকা তাকিয়ে থাকে বাবা-মায়ের দিকে। বুঝতে পারেনা বাবা-মায়ের হাসির উৎস কী। ওকে নিয়ে নয়তো? হতেও পারে। দেখতে পায় ওদের যাত্রা-সঙ্গীরা সবাই বেরিয়ে এসেছে। 

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (তৃতীয় পর্ব)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top