সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২৬ অক্টোবর ২০২২ ০১:০৯

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:৩৬


খালিদা প্রতিদিন আনজুমকে বর্ণমালা শেখায়। সময় ভালোই কাটে। মেয়েটি অল্প সময়ে শিখে ফেলেছে সব বর্ণমালা। পাশাপাশি শিখেছে সংখ্যা এক থেকে একশ পর্যন্ত। বর্ণমালাগুলো এমনভাবে মুখস্থ করেছে যে, গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারে। কোনো ভুল করে না। হাতের লেখাও সুন্দর। খালিদা নিজেকে বলে, একে বর্ণমালা শিখিয়ে আনন্দ পেয়েছি। ওকে বকতে হয়নি। গায়ে হাত দিতে হয়নি। বড় হলে ও নিজের মতো করে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারবে। তোজাম্মেলও পাশে বসে ওর শেখার আগ্রহ দেখে খুব খুশি হয়।
রাতে বিছানায় একান্ত হয়ে ওঠে। খালিদা বলে, বুঝে গেছি যে আমার গর্ভের সন্তান পাব না। আল্লাহ আমাদের আর একটি দিয়েছেন। ওকে এমনভাবে আপন করব যে, যেন ও মায়ের কথা মনে না করে।
-ওকে তো এখনও বলা হলো না যে ওর মা মরে গেছে।
-থাক, ও যতক্ষণ জিজ্ঞেস না করবে ততক্ষণে ওকে কিছু বলার দরকার নেই।
-ও কিন্তু এখন অঞ্জনকে বলছে না যে মাকে দেখতে হাসপাতালে যাব।
-ও নতুন জামাকাপড়, নানা রকম খেলনা পেয়ে এই বাড়িতে ওর নতুন যাত্রা শুরু করেছে। তাই পেছনের কথা ওর মনে আসছে না।
-কিন্তু মা তো ওর শুধুই পেছন না?
-যাই হোক, বাদ দাও এসব আলোচনা। দেখা যাক ও কী করে। ওকে ওর মতো থাকতে দাও।
একগাদা খেলনা পেয়ে ওর দিন অন্যরকম হয়ে গেছে। নিজের ঘুমানোর জন্য একটি ঘর আছে। ও নিজের মতো নিজের ঘরে কিংবা বৈঠকখানায় সারাদিন কাটায়। খালিদা নিজের সময়মতো ওকে নিয়ে বসে। এখন ছড়া আর গল্পের বই পড়া শিখছে। কী সুন্দর সুন্দর বই এনে দিয়েছে ওকে অঞ্জন। গল্প আর ছড়ার সঙ্গে আঁকা ছবি দেখে ও বিস্মিত হয়। পেন্সিল দিয়ে নিজের খাতায় ছবি আঁকার চেষ্টা করে। আঁকিবুঁকিতে ভরিয়ে তোলে খাতার পৃষ্ঠা। দৌড়ে গিয়ে খালিদাকে বলে, মা দেখতো কেমন হয়েছে?
-বাহ, ভালোই তো হয়েছে। তোকে রংপেন্সিল কিনে দেব, তাহলে আঁকা আরও সুন্দর হবে।
-বা-বা আমি রংপেন্সিল পাব কবে? কবে মাগো?
-দেখি অঞ্জনকে বলব। ও যেদিন আনতে পারে সেদিন নিয়ে আসবে।
-কালকেই আনতে হবে।
-অঞ্জন বাসায় আসুক বলব ওকে।
-কালকে আনার জন্য আমি ভাইয়ার পায়ে ধরব।
-যা, বাইরে বাগানে গিয়ে খেলে আয়। রাস্তায় যাবি না।
আনজুম একছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। জারুল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে আরও ফুলগাছ আছে। সব গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট ডাল ধরে ঝাঁকায়। গানের মতো করে বলে, আয় পাখি আয় রে- ফুল নিয়ে যাই রে-। এক গাছের ডাল ঝাঁকিয়ে আর এক গাছের কাছে যায়- ফুল টেনে গন্ধ শোঁকে। ছোটাছুটি করতে থাকে বাগানে। খালি পায়ে সবুজ ঘাসের ওপর দৌড়াতে ভীষণ আনন্দ পায়। অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে। ক্লান্ত হয় না। আকাশে শরতের নীলাভ মেঘ স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তার করে রেখেছে।
আনজুমের ছোটাছুটির সময় অঞ্জন এসে দাঁড়ায় গেটের সামনে। হাঁটতে হাঁটতে এসেছে। হেঁটে এসে রাস্তার দু’পাশের ছবি মনে গেঁথে যায়। আজকে অমিয়া ছাড়া মনের ভেতরে আর কিছু নেই। সব দৃশ্য অমিয়ার আড়ালে পড়ে গেছে। প্রেমের চিত্র এভাবে আচ্ছন্ন করেছে ওকে। আজ ওর কোনো ক্লান্তি নেই। হেঁটে আসার সবটুকুই ছিল প্রেমের উৎসব।
বাগানে আনজুমকে দেখে থমকে যায়। ওকে একদিন নিয়ে যেতে হবে আজিমপুর কবরস্থানে। কয়েকটি দিন যাক, এখনই বলার দরকার নেই। মেয়েটি কাঁদবে এমন দৃশ্য দেখার ইচ্ছা হয় না ওর। আনজুম নাকের সামনে লাল জবা ফুল ধরে রেখেছে। পাতার আড়ালে ঢাকা পড়েছে ওর চেহারা। ও অঞ্জনকে দেখতে পাচ্ছে না। অঞ্জন বাগানে ঢুকে চারদিক ঘুরে আসে। এভাবে ঘোরা ওর প্রবল ভালো লাগা। আজকে এই ভালো লাগায় যুক্ত হয় অমিয়ার সৌরভ। মাথার ওপর শরতের নীল মেঘ ভেসে বেড়ায়। ও মাথা পেছনে হেলে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। মনে হয় মেঘ নয়, আকাশজুড়ে ভেসে আছে অমিয়া। ও মৃদুস্বরে বলতে থাকে, ও আমার প্রেয়সী তোমার ছায়া সবখানে। শরতের রোদছায়ায় আমার নতুন জীবনের সূচনা হলো।
তখন আনজুম দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।
অঞ্জন ওর মাথায় হাত রেখে বলে, কি রে ফুলের সঙ্গে খেলা শেষ হয়েছে?
-না, শেষ হয়নি। আরও খেলব। ফুল আমার বন্ধু আমি যখন বস্তিতে ছিলাম তখন ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলতাম।
-তাহলে এই খেলাটা অন্যরকম না?
-হ্যাঁ, একদম অন্যরকম। গাছ আর ফুলের সঙ্গে খেলা। আগের খেলার চেয়ে এই খেলাটা অনেক আনন্দের। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘাসের ওপর ঘুমিয়ে থাকব।
-তাই মনে হয়? ভালোই তো। কোনো কোনো দিন দুপুরবেলা গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকবি।
-আচ্ছা, আচ্ছা।
খুশিতে লাফালাফি করে আনজুম। বাগানের চারদিকে দৌড়াতে শুরু করে।
অঞ্জন আবার আকাশের দিকে তাকায়। বলে, তোমাকে মেঘের মাঝে দেখতে পাচ্ছি। তুমি এখন কী করছ অমিয়া?
তারপর হাসতে শুরু করে। এভাবে নিজের অনুভবের টানাপোড়েন কি ঠিক হচ্ছে? পরে মনে হয় একলা থাকার সময়ে অমিয়াকে কাছে পাওয়ার তো এটাই পথ। এই অনুভব ধরে রাখতে হবে। নিজের মানসিক দিকের স্বাচ্ছন্দ্য গড়ে তোলা। প্রেমের স্বপ্নকে ফুলের বাসরঘরে শারীরিক স্পর্শ দেওয়া। অঞ্জন বাগানে আর দাঁড়ায় না। ঘরে ঢোকে। দেখতে পায় কাজরিকে। ওকে জিজ্ঞেস করে, মা কই, বাবা কই?
-শোবার ঘরে।
-কখন ঘুমাতে গেল?
-ভাত খেয়ে।
-এখন আমাকে ভাত দে, কাজরি। আনজুম খেয়েছে?
-হ্যাঁ খেয়েছে।
-ঠিক আছে ও খেলুক। আমি ভাত খাই। হাত-মুখ ধুয়ে আসি।
বাথরুম থেকে ফিরে টেবিলে এলে ও দেখতে পায় আনজুম টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বলে, আমিও তোমার সঙ্গে ভাত খাব।
-তুই খাসনি?
-খেয়েছি একটু। তোমার সঙ্গে খেলে আমার পেট ভরে যায়। নইলে মনে হয় আমি সারাদিন কিছু খাইনি।
-আয়, আয়, হাত-মুখ ধুয়ে আয়। বাথরুমে যা।
আনজুম এক দৌড়ে বাথরুমে যায়।
কাজরি ভাত-তরকারি নিয়ে আসে।
-কী রান্না হয়েছে রে?
-বোয়াল মাছ, করল্লা ভাজি, ডাল, বেগুনের ভর্তা।
-ওহ্, বোয়াল আমার প্রিয় মাছ। এজন্য মা প্রায়ই বোয়াল মাছ কেনে।
-আর একটি থালা দে আনজুমের জন্য।
-ও তো খেয়েছে।
-তাতে কি, আমার সঙ্গে আবার খাবে। ছোট মানুষ একটু একটু খায়। এতক্ষণ বাগানে দৌড়াদৌড়ি করেছে তো, তাই খিদে পেয়ে গেছে।
-বাথরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে চেয়ার টেনে বসে আনজুম। কাজরি ওর সামনে একটি থালা এনে দেয়। ও উচ্ছ¡সিত হয়ে বলে, ভাইয়া কাজরি বুবু আমাকে অনেক আদর করে। একবারও বলেনি, তুই এই বাড়িতে থাকতে পারবি না, চলে যা।
-এই এইসব কথা বলবি না।
কাজরি ওর প্লেটে ভাত দেয়। অল্প ভাত খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাবা-মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কাতে থাকে আনজুম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পায় না। তখন চিৎকার করে কেঁদে বলে, মা দরজা খোলো। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বের হয় না।
অঞ্জন ধমক দিয়ে বলে, এদিকে আয় কুকড়ি। থাপ্পড় খাবি। বাবা-মাকে ডিস্টার্ব করছিস কেন? খবরদার আর দরজা ধাক্কাবি না।
আনজুম টেবিলের কাছে দৌড়ায়। দু’হাতে চোখের পানি মোছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি তোমার কাছে কুকড়ি না আনজুম?
-তুই আমার কাছে দুটোই। কখনো কুকড়ি, কখনো আনজুম।
-কেন?
-আমি যে তোকে অনেক আদর করি। বল তো তুই গান শিখবি না নাচ শিখবি?
-দুটোই শিখব। গানও গাইব, নাচও করব।
-সামনের জানুয়ারিতে তোকে স্কুলে ভর্তি করা হবে।
-কোন ক্লাসে?
-কেজিতে। আমাদের বাড়ির কাছে যে কেজি স্কুল আছে ওখানে। তুই মায়ের কাছ থেকে এ বি সি ডি শিখেছিস না?
-হ্যাঁ, সব শিখেছি। ওয়ান-টু-থ্রি-ফোরও।
-বাব্বা, তুই তো একটা পফ্ফিত মেয়ে হবি দেখছি।
-পফ্ফিত কী ভাইয়া? ভাইয়া আমার মা কেমন আছে?
-শান্তিতে আছে।
-কবে মাকে দেখতে যাব?
-আগে স্কুলে ভর্তি হবি, তারপরে। মাকে বলবি যে পড়ালেখা শিখছিস।
প্রবল খুশিতে হাসতে হাসতে ও নিজের ঘরে চলে যায়। খাতা নিয়ে সে মেঝেতে বসে পড়ে। ছবি আঁকবে। পেন্সিলের দাগে ভরে যায় খাতা। তখন মনে হয়, মাকে আজকে আবার বলতে হবে রংপেন্সিলের কথা। একসময় মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখজুড়ে ঘুম জড়িয়ে আসে।
ভাত খেয়ে নিজের ঘরে চলে যায় অঞ্জন। মনে করে বাবা-মা ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।
ঘরের ভেতরে দু’জনে বিনোদনের সময় সৃষ্টি করেছে। এভাবে নিজেদের উপভোগের মাত্রার জন্য শুধু রাতের অপেক্ষায় থাকে না। তোজাম্মেল সবসময় বলে, রাতের অন্ধকারে গৎবাঁধা শারীরিক উপভোগ আনন্দের রেশ কমিয়ে দেয়। নিজেদের ইচ্ছাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তলিয়ে দেব না। আমরা চঞ্চল যুবক-যুবতী হব। আমাদের জীবন এভাবে হাঁটবে। বড় শ^াস টেনে বুকভরা শ^াস চারপাশে ছড়িয়ে দিতে দিতে আমাদের যাত্রা হবে।
-হয়েছে, অনেক কথা বলে ফেলেছ। তবে তোমার এই চিন্তা আমারও পছন্দ। হিজিবিজি সময় থেকে কেটে রাখা সুন্দর সময়। ভালোবাসা তোমাকে।
-আমারও ভালোবাসা তোমাকে। আমরা এই ভালোবাসার সমুদ্রে সাঁতার কাটি। আমাদের জীবন এভাবে কাটল। দেখো আল্লাহ কীভাবে আমাদের কাছে একটি শিশু পাঠিয়ে দিলেন। কী সুন্দর বাচ্চাটি। মেধাবী-
-আমিও এটা নিয়ে খুব ভাবছি। আমাদের আর সন্তান হবে না। আমরা এখন থেকে সন্তানের কথা ভেবে মিলিত হব না। নিজেদের আনন্দ ধরে রাখার জন্য শরীর তৈরি রাখব।
-বাহ, সুন্দর কথা।
তোজাম্মেল গভীর আবেগে জড়িয়ে রাখে খালিদাকে। দাম্পত্য জীবনের সাতাশ বছরের সময়ে তাদের কোনো বড় ধরনের সংকট হয়নি। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ তীব্রভাবেই ছিল। কোনো ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ হয়নি কখনো। আজকের এই শারীরিক উপভোগ দু’জনকেই মিলনের মগ্নতায় ডুবিয়ে রাখে।
তোজাম্মেল ভাবে, জীবন সুন্দরই কাটল। ছেলেটি ডাক্তার হয়ে বের হলে সুখের সীমা পূর্ণ হয়ে যাবে। আর কিছু বাকি থাকবে না।
খালিদা ভাবে, দেশের বেশিরভাগ নারীর জীবনে শান্তি থাকে না। সংসারে পুরুষের অত্যাচার নারীর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, কিন্তু তোজাম্মেলের সঙ্গে তার জীবন শান্তিতে কেটেছে। মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাটি হলেও পরে তা মিটমাট হয়ে গেছে। দু’জনে দু’জনকে কখনো বেশি কষ্ট দেয়নি। এখন আনজুমকে বড় করে তোলা হবে তার বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন।
দু’জনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ থাকে। উপভোগের নিস্তব্ধতা ঘরজুড়ে বসন্ত বাতাস বইয়ে দিচ্ছে।
দু’জনেই শুনতে পায় আনজুম দরজায় টুকটুক শব্দ করছে। দু’জনেই হাসে। খালিদা বলে, মেয়েটিকে বাড়িতে এনে অঞ্জন আমাদের ঘরের শূন্যতা কাটিয়ে দিয়েছে। আমি ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞ।
তোজাম্মেল হাসতে হাসতে বলে, আমি এখন আমাদের ঘরে পুত্রবধূ চাই।
-আমিও চাই। পুত্রবধূ ঘর আলো করে দেবে। অঞ্জন যদি একটি ডাক্তার মেয়ে পছন্দ করে তাহলে আমার ভালো লাগবে।
-আমারও ভালো লাগবে। দেখা যাক আমাদের ছেলে নিজের ভালোবাসার মানুষকে কীভাবে জীবনের ছায়ায় নিয়ে আসবে। ও যাকে পছন্দ করবে আমরা তাকেই মেনে নেব। আমরা কোনো আপত্তি করব না।
-ও আমাদের ভালোবাসার পুত্রবধূ হবে।
এভাবে দু’জনে স্বপ্নের ছায়ায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে।
অঞ্জন আর অমিয়ার প্রেম দু’জনকে আচ্ছন্ন করে। ভালোবাসার মুগ্ধতা কত নিবিড় হতে পারে এই অনুভব দু’জনের ছত্রছায়ায় আবেগের মাত্রা ভরিয়ে রাখে।
এক দিন অমিয়া বলে, তুমি পাস করে বেরিয়ে গেলে আমার পড়ালেখা-
-থাক, থাক, এসব কথা বলবে না। আমি তো পাস করে তোমার আগে বেরিয়ে যাব। তাই বলে আমাদের প্রেম শেষ হয়ে যাবে না। তোমাকে আমি গভীরভাবে ভালোবাসি অমিয়া। তোমার পড়লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তারপরে বিয়ে!
-উহ, তুমি তো একটা দারুূণ ছেলে। আমিও তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসি। আমৃত্যু আমার ভালোবাসায় ছেদ পড়বে না। দু’জনে মিলে সুন্দর সংসার করব।
-মাঝে মাঝে আমরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাব অমিয়া। তোমার ক্লাসের ফাঁকে অথবা যেদিন কলেজ ছুটি থাকবে সেদিন।
-আমিও তাই চাই। আমি ঘুরতে ভালোবাসি। দু’জনে মিলে ঠিক করব কোথায় কোথায় যাব।
-কাছাকাছি কোথাও যাব। দূরে কোথাও না। ঘণ্টা তিন-চার কোথাও কাটিয়ে আসব।
-ঠিক বলেছ। দূরে কোথাও গেলে আমার বাবা-মা রেগে যাবে। সেজন্য যেখানেই যাই বাবা-মাকে বুঝিয়ে যেতে হবে।
-ঠিক আছে আমরা সেভাবে দিন ঠিক করব। সময় ঠিক করব। তোমার বাবা-মা রেগে যাবেন এমন কোনো ঘুরে বেড়ানোতে আমরা যাব না।
অমিয়া হেসে আপ্লুত হয়। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অঞ্জনের দিকে। অঞ্জনের মনে হয় এই মুগ্ধ দৃষ্টি প্রেমের নীলাভ আকাশ- শরৎ ঋতুর রোদছায়া। এখন এই প্রেমের সময়ে চলছে শরৎকাল। এই সময়ে প্রকৃতি মানুষের মন স্নিগ্ধ রাখে। অঞ্জন অমিয়াকে বলে, যতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে ততক্ষণ আমার চোখের পাতা পড়বে না।
অমিয়া বলে, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে, চলো আমরা রমনা পার্ক থেকে ঘুরে আসি। রমনা পার্ক আমার প্রিয় জায়গা। যখন তখন যেতে পারি বলে আমি এখানে একা একা অনেক সময় কাটাই। ভালো লাগে গাছের ছায়ায় বসে থাকতে।
অঞ্জন খুশি হয়ে বলে, ঠিক আছে, চলো যাই। শরতের রোদছায়ায় প্রেমের ফুল ফুটে উঠবে।
-তুমি কবিতা লিখলে পারতে।
-তুমি চাও আমি কবি হব?
-দেরি করে ফেলেছ। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করতে।
-তুমি চাইলে এখনও পারব। ডাক্তার হব, কবিও হব। চলো রিকশায় উঠি।
দু’জনে এসে নামে আর্ট কলেজের কাছে। ওই গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। পার্কের সবুজের ছায়ায় হেঁটে যায়। মাথার ওপরে শরতের নীলাভ আকাশ। মাঝে মাঝে ওরা হাত ধরে। আশপাশে লোকজন দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয়। সুযোগ বুঝে আবার ধরে। তখন গুনগুনিয়ে রবীন্দ্রসংগীত ভেসে ওঠে অমিয়ার কণ্ঠে- ‘আকাশে আজ কোন চরণের আসা-যাওয়া- বাতাসে আজ কোন পরশের লাগে হাওয়া।’
গান শুনে অঞ্জন বলে, তুমি গান গাইতে পার, এ তো আমার জানা ছিল না।
-আমি গান শিখিনি। ‘গীতবিতান’ আমার প্রিয় বই। অবসরে আমি গানগুলি পড়ি আর নিজের মতো করে গুনগুনিয়ে গাই। রেকর্ডে শুনে সুর ঠিক রাখার চেষ্টা করি।
-বুঝতে পারছি আমাদের জীবন গান আর কবিতার জীবন হবে। আমরা এ জায়গা থেকে কোনো দিন সরে যাব না।
অমিয়া তখন আবার গুনগুনিয়ে অন্য গানের পঙ্ক্তি গায়- ‘অনেক দিনের আমার যে গান- আমার কাছে ফিরে আসে- তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে।’
-বাহ সুন্দর। তুমি কি পুরো ‘গীতবিতান’ মুখস্থ করেছ?
-প্রশ্নই ওঠে না। এত গান মুখস্থ করা কি সম্ভব? যেগুলো গাইতে ইচ্ছা করে সেগুলো কিছু মুখস্থ করেছি। তাও সব লাইন একসঙ্গে মনে থাকে না। চলো আমরা ওই ছোট্ট ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসি। অনেক হাঁটাহাঁটি করলাম।
-হ্যাঁ, একটুক্ষণ বসে তারপরে আমরা ফিরে যাব। যাওয়ার আগে-
কথা শেষ করে না অঞ্জন। যাওয়ার আগে কী?
অমিয়া বলে, কথাটি শেষ করলে না যে? যাওয়ার আগে আর কোথাও দাঁড়াব?
-না, ছোট্ট করে একটি চুমু দেব। আমার গানের রানীকে।
-অমিয়া ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে গুনগুনিয়ে গায়- ‘সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি নন্দনফুলহার, তুমি অনন্ত নববসন্ত অন্তরে আমার\ নীল অম্বর চুম্বননত, চরণে ধরণী মুগ্ধ নিয়ত, অঞ্চল ঘেরি সঙ্গীত যত গুঞ্জরে শতবার\’
অঞ্জন নিজেও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে অমিয়াকে গভীর চুম্বনে ভরিয়ে দেয়। পার্কের সবুজ ছায়ায় শরতের বাতাস স্নিগ্ধতার পরশ বুলায়।
চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top