সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৩ আগস্ট ২০২২ ০১:০৬

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:৩৮


- এটা আমিও আগে দেখিনি রে। বাবা বলেছে পাকবাহিনী গানবোটে করে আসবে। ওরা তাহলে আমাদের এলাকায় ঢুকতে শুরু করেছে। আয় আমরা বাড়ি যাই। আয় দৌড়াই।
বীথিকা আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়। বাবাকে খবরটা জানাতে হবে যে মিলিটারি আমাদের এলাকায় ঢুকেছে। ও ভাইদের হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল হরেন্দ্রনাথ। মেয়েকে দৌড়াতে দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে। ওর সঙ্গেতো ছেলেরা আছে। তাহলে কোনো খারাপ খবর শুনতে হবে না। বীথিকা ওদের নিয়ে ফিরে আসছে। বাতাসে উড়ছে ওর চুল। ওর পেছনে আছে নদী আর চারপাশে সবুজ গাছ-গাছালী। হরেন্দ্রনাথের সামনে একটি অপরূপ দৃশ্য নয়ন জুড়িয়ে দেয়। নিজেকে বলে, আমার মাতৃভূমি। মাতৃভূমির স্বাধীনতা চাই। বঙ্গবন্ধু আপনাকে লাল সালাম। প্রণাম জানাই আপনাকে। আপনি পাকিস্তানের জেলে সুস্থ থাকেন। স্বাধীন দেশে ফিরে আসবেন আমাদের কাছে।
একটু পরেই ফিরে আসে বীথিকা। ছোট ছেলেরা বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তিনজনই চেঁচিয়ে বলে, বাবা, বাবা, আজকে নদীতে নতুন নৌকা দেখেছি। একদম অন্যরকম। নৌকায় যারা ছিল তাদের হাতে বন্দুক ছিল।
- থাম, বাবারা, থাম। মারে তুই কি দেখেছিস?
- না, বাবা, আমি যখন গিয়েছি গানবোট তখন অনেক সামনে চলে গেছে। আমি এর জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এসেছি বাবা। ওরা আমাকে দেখেনি।
- ভালো করেছিস। ভগবান, আমাদের রক্ষা করবে। চল, ভেতরে যাই।
সবাই মিলে ঘরে ঢুকে। মায়ারাণী এসব খবর শুনে বলে, আমার মনে হয় ওরা শুধু একা থাকবে না। বাঙালিরাও ওদের সঙ্গে ভিড়বে।
- এসব কথা এখন বলোনা। ভুলে যেওনা যে আমরা হিন্দু। এসব কথা শুনলে আমাদের আশেপাশের মুসলমানরা আমাদের ছাড়বে না।
- অনেকেতো ভারতে চলে যাচ্ছে। আমরাও চলে যাই।
- তাহলে কি আমরা শরণার্থী হব? বীথিকা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে।
- দুজনেই মাথা নেড়ে সায় দেয়।
মা বলে, এখানে পাকবাহিনীর ঝামেলার মধ্যে না থেকে আমরা শরণার্থী শিবিরে কষ্ট করে থাকব। ওখানেতো কেউ আমাদেরকে প্রাণে মারবেনা। আমার একটি মেয়ে তিনটি ছেলেকে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে চাই। ওরা যেন বাবা-মায়ে ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়।
- আমি মেয়ে। এখানে থাকলে আমার বিপদ বেশি। আমি এখানে থাকব না। কিন্তু আমাদের বাড়িঘরের কি হবে?
- চারদিক বন্ধ করে রেখে যাব।
- যদি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়?
হরেন্দ্রনাথ বলে, দিতে পারে। যদি দেয় আমাদের কিছু করার থাকবেনা। দেশ স্বাধীন হলে আমরা পোড়া ভিটায় ঘর তুলব।
- বাবা ঠিক বলেছ, তাহলে আমাদের নতুন ঘরে স্বাধীনতার থাকা হবে। নতুন মাটিতে নতুন বাড়ি।
তিনভাই লাফিয়ে ওঠে, নতুন বাড়ি, নতুন বাড়ি। আমরা নতুন বাড়িতে থাকব।
ওরা লাফাতে লাফাতে চেঁচিয়ে ওঠে, ওই যে দেখ নতুন নৌকা যাচ্ছে।
সবাই মিলে ভদ্রা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনটি গানবোট নিয়ে পাকিস্তান আর্মির সেনারা যাচ্ছে। হরেন্দ্রনাথের মনে হয় তারা জায়গা জরিপ করছে। এরপরে আক্রমণ করবে। এমন একটি ধারণা নিয়ে হরেন্দ্রনাথ সবাইকে নিয়ে ঘরে যায়। ছেলেদের বলে, তোরা আর কখনো এদিক-ওদিক যাবিনা। ওই যে নৌকা দেখেছিস ওর মধ্যে মিলিটারি আছে, বন্দুক আছে। মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলবে ওরা।
- কেন? কেন মেরে ফেলবে বাবা? তাহলে আমরা এখন থেকে আর নদীর ধারের দিকে যাবনা। নৌকাতো নদী দিয়ে আসবে।
- ওটা নৌকা না। ওটাকে গানবোট বলা হয়।
- গানবোট? আচ্ছা আমরা মনে রাখব। এখন থেকে গানবোট বলব।
- ঠিক আছে। এটাও একটা শেখা তোদের।
- দিদি আমাদের শেখা হলো না কেন?
- ওরে আমিও জানতামনা। বাবার কাছ থেকে শিখেছি।
- আমরা এখন কি করব?
- চল, রান্নাঘরে যাই আমরা। মায়ের কাছে বসি।
চারজন রান্নাঘরে ঢুকে পিঁড়ি টেনে বসে পড়ে। মায়ারাণী জিজ্ঞেস করে, কিছু খাবি তোরা?
- হ্যাঁ, মা খাব।
- পিঠা ভেজেছি। নে, পিঠা খা।
মায়ারাণী ওদের দিকে ভাজা পিঠার বাটি এগিয়ে দেয়। বীথিকা বাটি হাতে নিয়ে বলে, বাবাকেও ডাকি। বাবাও পিঠা খাবে।
- এখানে ডাকতে হবে না। এখানে বসার জায়গা নাই। তোরা বারান্দায় যা।
- তুমিও চলো মা। আমরা সবাই মিলে খাব। খুব মজা হবে।
- হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক।
বলতে বলতে বাটি থেকে একটা পিঠা তুলে একলাফে রান্নাঘর থেকে নেমে যায় নিরঞ্জন। কৃষ্ণপদ আর অমলও তাই করে। তিন ভাই দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় বসে। হরেন্দ্রনাথকে ডাকে।
- বাবা, বাবা আমাদের সঙ্গে বসতে আস। আমরা এখন পিঠা খাব। মায়ের বানানো পিঠা আমাদের মন জুড়িয়ে দেয়।
হরেন্দ্রনাথ বারান্দায় এসে বসে।
- কি রে ময়নারা তোরা পিঠা খাওয়ার জন্য -
- পাগল হয়ে গেছি। সবাই মিলে না খেলে মজা লাগেনা। মা আসবে, দিদি আসবে। ততক্ষণে ওরা দেখতে পায় মায়ারাণী আর বীথিকা থালাভর্তি পিঠা নিয়ে আসছে। ছেলেদের সামনে রাখলে ওরা খেতে শুরু করে।
- মজা, মজা। মায়ের আশীর্বাদ। নিরঞ্জন বাবার মুখের কাছে একটি পিঠা ধরে বলে, খাও বাবা। আমার হাতে খাও।
কৃষ্ণপদ মায়ের মুখে দেয়। অমল দেয় বীথিকাকে। ওদের হাত থেকে পিঠা খেয়ে বীথিকা বলে, এবার আমি সবাইকে খাওয়াব। কেউ নিজের হাতে পিঠা তুলবেনা।
বীথিকা সবাইকে পিঠা খাইয়ে দিয়ে ভাইদের বলে, চল আমরা বাইরে থেকে হেঁটে আসি।
তিন ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে হরেন্দ্রনাথ চিন্তিত দৃষ্টিতে মায়ারাণীর দিকে তাকায়। মায়ারাণী অবাক হয়ে বলে, তুমি কি ভাবছগো?
- অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। মিলিটারি গানবোট নিয়ে ঢুকেছে আমাদের এলাকায়। নদীতে ঘোরাঘুরি করে চলে গেছে। কবে আক্রমণ করতে আসবে কে জানে?
- তাহলে আমরা ভারতে যাওয়ার জন্য গুছিয়ে ফেলি। আমরা দুজনে মরে গেলে যাব, কিন্তু ছেলেমেয়েদের মৃত্যু দেখতে পারবনা।
- মায়ারাণী তুমি অনেক বড় কথা বলেছ। চল আমরা শরণার্থী হব।
বীথিকা আর তিন ছেলে দৌড়ে ঘরে ঢুকে বলতে থাকে, মিলিটারি ঢুকেনি, কিন্তু ঘরে ঘরে আগুন লাগাচ্ছে গ্রামের মানুষেরা। দাউদাউ আগুন জ¦লছে চারদিকে। মাগো কেউ কেউ বলছে, যারা আগুন দিচ্ছে এরা সবাই পাকিস্তানিদের দালাল। ঘরে আগুন দেয়ার আগে ওরা ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট করে।
- আমরা কালকেই ভারতে চলে যাব।
হরেন্দ্রনাথ সায় দিয়ে বলে, আমিও তাই চিন্তা করেছি। এখন যাই, একটা নৌকা ঠিক করে আসি। তোমরা খাবারদাবার আর কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও।
- বাবা, আমরা তোমার সঙ্গে যাব।
- আয়, আমার হাত ধর। এদিক-ওদিক দৌড়াবিনা তোরা।
- না, আমরা দৌড়াবনা বাবা। তোমার হাত ধরেই থাকব। তোমার হাত আমাদের শক্তি।
তিন ভাই একসঙ্গে কথা বলে। খলখলিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে ঘাসের ওপর পা দাপায়। হরেন্দ্রনাথ ওদের উচ্ছ¡াস দেখে বেশ আনন্দ পায়। দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে হচ্ছে এই চিন্তায় তার মন খারাপ ছিল। ছেলেদের হাসিতে মন ভালো হয়ে যায়।
নদীর ঘাটে দাড়িয়ে একজন মাঝির সঙ্গে কথা হয় হরেন্দ্রনাথের। অজয় মাঝি জিজ্ঞেস করে, কতদূর যাবেন কাকু?
- ভারতে যাব। আমাদের এখানে ঘরবাড়ি জ¦ালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে।
- হ্যাঁ, চলে যান। দেশ স্বাধীন হলে ফিরবেন। আমি আপনাদের নিয়ে যাব। আপনাদের চারটা নদী পার হতে হবে- ভদ্রা, শিবসা, ইছামতি, বুড়িগোয়ালিনী।
- হ্যাঁ, আমিও জানি চারটা নদী পার হতে হবে।
- কখন রওনা করবেন?
- কালকে সকালে। তুমি এখানে থাকবে। আমরা এখানে আসব।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। অজয় মাথা নেড়ে বলে, আমার ভাড়াটা ঠিকমতো দিবেন। আমিতো নৌকার ভাড়া দিয়ে ভাত খাই।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ পাবে। ভেবোনা। আমি তোমার ভাড়া আলাদা করে রাখব। ভাড়া নিয়ে একটুও চিন্তা করবেনা।
- আচ্ছা। আমি সকালে এখানে এসে বসে থাকব।
তিন ছেলে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে বলে, আমাদেরকে একটু ঘুরিয়ে দেন। বাবা টাকা দিয়ে দিবে। অমল বাবার হাত টেনে ধরে বলে, বাবা তুমিও চল।
হরেন্দ্রনাথ ছেলেদের নিয়ে উঠে বসে। ওদের ইচ্ছাপূরণ করতে ভালোবাসে সে। কখনো ছেলেমেয়েদের বিরূপ করেনা। অজয়কে বলে, অল্প একটু ঘুরে তুমি ঘাটে লাগাও।
অজয় এপাশে-ওপাশে চক্কর দিয়ে ঘাটে চলে আসে। তিন ছেলে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়াতে শুরু করে। হরেন্দ্রনাথ ওকে পাঁচ টাকা দিয়ে নেমে যায়। ছেলেরা পেছন ফিরে যখন দেখে বাবা অনেকদূরে ওরা আবার দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বাবার হাত ধরে।
বাড়ি ফিরে দেখতে পায় মা-মেয়ে কাপড় গুছিয়ে নিয়ে পোটলা বানিয়েছে। পাশে আর একটি পোটলা রাখা আছে। হরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করে, এটার মধ্যে কি নিয়েছ?
- শুকনা খাবার। চিড়া-গুড়-মুড়ি এইসব।
- এইরকম আরও দুইটা পোটলা বানাও। আমাদেরতো চার নদী পার হয়ে যেতে হবে। সময় লাগবে। ছেলেরা যেন খিদায় কাঁদে না।
- ঘরে যা ছিল তাই পোটলা বেঁধেছি। তুমি আরও কিছু কিনে আন।
- সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনই যাই।
হরেন্দ্রনাথ বেরিয়ে যায়। দোকান থেকে চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট ইত্যাদি অনেক কিছু কিনে নিয়ে আসে। তিনভাই ছুটে যায় বাবার কাছে। পোটলাটা নিয়ে বলে মা গুছিয়ে দাও এই পোটলা আমাদের কাছে থাকবে। মায়ারাণী ওদের দিকে তাকিয়ে হাসে। চারটি নদী পার হয়ে কত দুর্গম পথে যেতে হবে ছেলেদের চিন্তায় এসব নেই। ওদের বোঝার বয়স নেই। ওরা মায়ের কাছে পোটলাটা দিয়ে বলে, বাবা বোধহয় অনেককিছু কিনেছে মা। আমাদেরকে দেখাও।
- দরকার নাই। খুব সুন্দর করে বেঁধে দিয়েছে যে খুলবনা। নৌকায় ওঠার পর তোদের কাছে রাখিস।
- আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা -
ওরা উঠোনে ছুটোছটি করে বারান্দায় উঠে বাবাকে ঘিরে বসে। মায়ারাণী বড় এক পাতিল ভাত রান্না করে বীথিকাকে বলে, এগুলোকে পান্তাভাত বানাব। নৌকায় বসে দুপুরে ও রাতে খেতে হবে।
- হ্যাঁগো মা, ঠিকই আছে। বেশি করে লবণ নিয়ে নিচ্ছি, আর কাঁচামরিচ। তরকারি না থাকলে মরিচ-লবণ দিয়ে পান্তা খাব আমরা। একদিকে নদীর পানিতে ভেসে যাওয়া, আর একদিকে ভাতপানিতে পেট ভরানো। দারুণ হবে। নতুন রকমে দিন কাটবে।
খিলখিলিয়ে হাসে বীথিকা।
(চলবে)...........

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top