দেশে বেড়াই, সাজেকের পাইলিংপাড়ায় : সালেক খোকন
প্রকাশিত:
২ জুন ২০২০ ২৩:১০
আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:১৫

‘রাস্তাটা চলে গেল পাহাড়ের বুক চিরে। কাঁচা পথে লালমাটির ধুলো। পা জড়িয়ে যাচ্ছিল তাতে। খানিক এগোতেই পথটা হয়ে যায় দুর্গম। একপাশে তখন খাড়া গিরি খাত। পা পিছলে পড়লে গন্তব্য কোথায়, খালি চোখে তা ঠাওর করার উপায় নেই। ভারসাম্য রাখতে একমাত্র ভরসা পাহাড়ি বাঁশের লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসি চূড়ায়। এখানেই দেখা মিলল গ্রামটির। নাম ‘কোয়াংলাকপাড়া’। সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়ার গ্রাম এটি। কাছের ‘কোয়াংলাক’ ছড়া থেকে পানযোগ্য পানি সংগ্রহ করে এ গাঁয়ের মানুষ। তাই ছড়ার নামেই হয়েছে গায়ের নাম ‘কোয়াংলাক’।
পাহাড়ের চূড়ায় কোয়াংলাকপাড়ায় পা পড়তেই নজরে আসে বড় বড় বেশকিছু কালো পাথর। খোদাই করা তারিখ লেখা তাতে। কারা লিখেছে এটি? আমাদের গাইড সুপর্ণ জানাল, সে ব্রিটিশ আমলেরও আগের কথা। লুসাই ও পাংখোদের রাজত্ব ছিল এখানটায়। সে আমলের কয়েকজন ধর্মযাজকের স্মৃতির উদ্দেশে রাখা হয়েছিল পাথরগুলো। ছিয়াত্তর বছর বয়সী পাহাড়িদের হেড ম্যান চো মিং খানও জানালেন তেমনটি।
হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি জুয়েল নেই। পাথরগুলোর ওপর সমতল একটি জায়গা খুঁজে নিয়েছে সে। সেখান থেকে চারপাশ দেখছে অবাক নয়নে। আমরাও পা বাড়াই। আহা! যেন আকাশের ওপর কোনো স্বপ্নপুরিতে চলে এসেছি। অতঃপর চোখ পড়ে পাহাড়ের পাদদেশের গ্রামটিতে।
এ পাহাড়ের পেছন দিকটা যেন অন্য দুনিয়া। সবুজ প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে। বড় বড় গাছ। কিন্তু তার গোড়ার দেখা মেলা ভার। দূর পাহাড়ের গাঁয়ে চলছে জুম চাষ। ধাপ ধাপ করে মাটি কেটে তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ি পথ। সে পথ দিয়ে নকাই (ঝুড়ি) নিয়ে উঠে আসছে আদিবাসী নারীরা। পাহাড়ের ঢালে বাঁশের মাচাঘর। প্রকৃতিবান্ধব এই মাচাঘরগুলো প্রকৃতিজন ত্রিপুরাদের।
বড় বড় পাহাড়ি কাশফুল ফুটেছে এদিক-ওদিক। বাতাসে শরীর দুলিয়ে ফুলগুলো যেন আমাদেরই স্বাগত জানাচ্ছে। কাশফুলের পেছনে অনেক নিচে ছবির মতো একটি আদিবাসী গ্রাম। কয়েকটি শিশু খেলছিল উঠোনে। হঠাৎ পাহাড় কাঁপিয়ে ডাকতে থাকে হরিণ। কাঁপন ধরায় আমাদের মনেও। ভিন্ন জাতির মানুষদের জীবন প্রবাহের ছোঁয়া পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে।
পাইলিংপাড়ার ত্রিপুরা গ্রামটিতে যখন পৌঁছি, তখন মধ্য বিকেল। আদিবাসীরা ফিরছে জুম থেকে। চিরমালা ত্রিপুরা ও কজরী ত্রিপুরা ব্যস্ত কাজে। জুম থেকে আনা কাঁচা হলুদগুলো তাঁরা শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন উঠোনে। দু-একজন নারী আপন মনেই তাঁত বুনছেন নিজেদের জন্য। রিয়াজের দৃষ্টি পাহাড়ি হ্যাচিং বা আদার দিকে। জাহাজের খবর না নিলেও আদার খবর তার চাই-ই চাই। পাহাড়িরা বলে তাদের সুখ-দুঃখের কথা। জানায় দূর ছড়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করার কষ্টের কথাও।
এই গ্রামের দুই পাশে গিরি খাত। সামনে এগোতেই অনেক নিচে আরেকটি পাহাড়ের চূড়া। সেখানেও আরেকটি গ্রাম। পাহাড়ের পেছনের পাহাড়গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড়ি হরিণের চিত্কার, অজানা পাখির ডাক, বাতাসের মৃদুমন্দ শব্দ আর আদিবাসীদের খ্রাঁর (ঢোল) বাদ্যিতে একাকার হয়ে যাই।
জুয়েল ব্যস্ত ছবি তোলায়। রিয়াজ চুটিয়ে গল্প করছেন গ্রামের কারবারি (প্রধান) নলো কুমার ত্রিপুরার সঙ্গে। একটি মাচাঘরের বারান্দায় পা ঝুলিয়ে খবর নিচ্ছে ‘হুঁকো’ বা জুমচাষের। জুমক্ষেতে একই সঙ্গে কিভাবে ‘মছ থাইনছু’ (মরিচ), সিপুই (তিল), মাই কন (ভুট্টা), ধান, হলুদ লাগানো হয়—সে কাহিনী শুনছে সে।
রাতের খাবার হবে এই গ্রামেই। মেন্যু—আদিবাসী ব্যাম্বো চিকেন। জুমের সময়কার খাবার এটি। এর মধ্যেই সুপর্ণ দা লোক পাঠিয়েছেন বিশেষ ধরনের বাঁশ কেটে আনতে। একটি বন মোরগ রাখা ছিল আগে থেকেই।
জুমক্ষেতের ঘরকে ত্রিপুরারা বলে ‘গাইলিং’। জুম ফসল যখন পেকে যায় তখন বন্য প্রাণীর মাধ্যমে ফসল নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। ফলে সে সময় থেকেফসল তোলা পর্যন্ত আদিবাসীদের জুমের পাহাড়েই কাটাতে হয়। তখন তাদের রান্নার পাত্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে বাঁশ।
আমাদের সামনেই বিশেষ কায়দায় বাঁশ কেটে তার মধ্যে ঢোকানো হয় মাংস আর মসলা। অতঃপর কলাগাছের পাতা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মুখগুলো। কয়লার আগুনের তাপে বেশ কিছুক্ষণ রেখে দেওয়া হয় বাঁশগুলো। খাবার সময় হুকনি মাই বা জুম ভাতের সঙ্গে গরম গরম পরিবেশন করা হয় বাঁশের ভেতরকার রান্না করা মাংসগুলো। ইস্, ভাবলে এখনো জিবে জল আসে। রাত বাড়ার আগেই পা বাড়াই আমাদের অস্থায়ী আবাসস্থল ‘জলবুক কটেজ’-এর পথে। চূড়া থেকে শেষবারের মতো দেখি আদিবাসী গ্রামটিকে।
বেড়ানোর তথ্যাদি:
সাজেক রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় হলেও যাতায়াতে সুবিধা খাগড়াছড়ি দিয়ে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যেতে পারেন সড়ক ও আকাশ পথে।
বাসে যাওয়া:
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হয়ে সাজেক যাতায়াত সহজ। তাই প্রথমেই খাগড়াছড়ি আসতে হবে। খাগড়াছড়িগামী বেশিরভাগ বাসগুলো ছাড়ে কলাবাগান, কাকরাইল ও আরামবাগ থেকে। এসি বাস (ভাড়া ৯০০-১১০০টাকা): সেন্টমার্টিন পরিবহন, শান্তি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ। নন-এসি বাস (ভাড়া ৫২০-৬০০টাকা): এসআলম, সেন্টমার্টিন পরিবহন, প্লাটিনাম ট্রাভেলস, শ্যামলী এসপি, শান্তি পরিবহন, শ্যামলী এনআর প্রভৃতি। টিকিট কাটুন অনলাইনে: www.shohoz.com (হটলাইন: ১৬৩৭৪), www.busbd.com.bd (হটলাইন: ১৬৪৬০),www.saintmartinparibahan.com (হটলাইন: ০১৭৫৫৫৭৫২৩৪, কলসেন্টার: ০১৭৯০২৭৬৬৮৬)।
বিমানে যাওয়া:
চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে নেমে সড়ক পথে খাগড়াছড়ি হয়ে যেতে হবে সাজেকে।
বিমানের টিকিট কেনা:
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস:
অনলাইনে টিকিট কাটতে: www.biman-airlines.com হটলাইন: ০১৭৭৭৭১৫৬১৩-১৬, ০২-৮৯০১৬০০ এক্সটেনশন ২৭১০/২৭১১
নভো এয়ার:
অনলাইনে টিকিট কাটতে: www.flynovoair.com, হটলাইন: ১৩৬০৩
ইউ এস বাংলা এয়ারলাইনস:
অনলাইনে টিকিট কাটতে: usbair.com, হটলাইন: ১৩৬০৫, ৯৬৬৬৭১৩৬০৫, ০১৭৭৭৭৭৭৮০০-৮০৬
রিজেন্ট এয়ার ওয়েজ:
অনলাইনে টিকিট কাটতে: www.flyregent.com, হটলাইন: ১৬২৩৮, (+৮৮০) ৯৬১২৬৬৯৯১১
পরামর্শ:
আভ্যন্তরীণ বিমান ভ্রমণে আপনার টিকিটের সাথে টিকিটে উল্লেখিত একই নামের একটি ছবিযুক্ত জাতীয় পরিচয় পত্র বা পাসপোর্ট বা অফিস আইডি বা শিক্ষার্থী আইডি প্রয়োজন হবে।
কোথায় থাকবেন?
সাজেকে থাকতে একাধিক কটেজ রয়েছে। তবে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়া ভাল।
০১। সাজেক আর্মি রিসোর্ট ( ভাড়া ১০০০০-১২০০০ টাকা): ০১৮৫৯০২৫৬৯৪, ০১৭৬৯৩০২৩৭০, ০১৮৪৭০৭০৩৯৫, ফেসবুক পেইজ: : sajekarmyresort
০২। সামপারি রিসোর্ট ( ভাড়া ৩০০০-৩৫০০টাকা): ০১৮৩৫৫৩৮০৮৩, ০১৮২০১৮০৭৫০ ফেসবুক পেইজ: Sampari Resort
০৩। মেঘ মাচাং রিসোর্ট ( ভাড়া ৪০০০-৪৫০০টাকা): ০১৮২২১৬৮৮৭৭, ফেসবুক পেইজ : Megh machang
০৪। জুমঘর ইকো রিসোর্ট ( ভাড়া ৩০০০ টাকা): ০১৮৮৪২০৮০৬০, ফেসবুক পেইজ : Jumghor eco Resort,sajek
০৫। মেঘ পুঞ্জি রিসোর্ট ( ভাড়া ৩০০০-৩৫০০টাকা): ০১৮১৫৭৬১০৬৫, ফেসবুক পেইজ : MeghpunjiResort
০৬। ঝিঁ ঝি পোকার বাড়ি (২৫০০টাকা): ০১৮৬৯১৫৭৬৬৬, ফেসবুক পেইজ : Jhi Jhi Pokar Bari
০৭। অবকাশ উকো কটেজ ( ভাড়া ৩০০০টাকা): ০১৮৪৪১৭২৪৯২, ফেসবুক পেইজ : Abakash Eco Cottage, Sajek
০৮। রুলুই রিসোর্ট ( ভাড়া ৪০০০-৫০০০টাকা): ০১৬৩২০৩০০০০, ফেসবুক পেইজ : Ruilui Resort
০৯। সাজেক হিল ভিউ রিসোর্ট ( ভাড়া ২৫০০-৩৫০০টাকা): ০১৮৭৮৭৪৫৮৪৩, ফেসবুক পেইজ : Sajek Hill View Resort
১০। ম্যাডভেঞ্চার রিসোর্ট ( ভাড়া ২৫০০-৩০০০টাকা): ০১৮৮৫৪২৪২৪২, ফেসবুক পেইজ : Madventure Resort - Sajek
১১। রুন্ময় রিসোর্ট ( ভাড়া ৪৫০০-৫০০০ টাকা): ০১৮৫৯০২৫৬৯৪, ০১৭৬৯৩০২৩৭০, ০১৮৪৭০৭০৩৯৫, ফেসবুক পেইজ: : runmoyresort
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়া:
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হয়ে সাজেক যেতে হয়। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। শহরের শাপলা চত্বর থেকে চাঁন্দের গাড়ি (জিপ গাড়ি) রিজার্ভ নিয়ে (১২-১৫জনের) সাজেক যাওয়া যাবে। যাওয়া আসাসহ দুইদিনের জন্য ভাড়া ৮০০০ টাকা। তবে খরচ কমাতে আপনি চাইলে অন্য গ্রুপগুলোর সাথেও যেতে পারেন। মনে রাখতে হবে দীঘিনালায় সকাল ১০টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। কেননা ১০টায় সব গাড়িগুলো এসকোর্ট করে সেনাবাহিনী সাজেক পৌঁছে দেয়। আবার যারা থাকবে না তাদের গাড়ি বিকেলে এসকোর্ট করে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া সাজেকে যাওয়ার অনুমতি নেই। কেউ সকালে মিস করলে তাকে বিকেলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।
কখন যাবেন?
বর্ষা, শরৎ ও হেমন্তে সাজেকে মেঘের খেলা দেখতে অপরূপ লাগে। এছাড়া সারাবছর সাজেকের প্রকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে।
সর্তকতা :
সাজেক যাওয়ার উঁচু-নিচু ও আঁকা-বাঁকা পথ বেশ বিপদজনক। বর্ষায় পাহাড়িপথ চলতে সর্তক থাকতে হবে। জিপের ছাদে ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ। অনুমতি ছাড়া আদিবাসীদের ছবি তুলতে যাবেন না। নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই জাতীয় পরিচয় পত্র সঙ্গে নিবেন। দীঘিনালায় আর্মি ক্যাম্পে নাম লেখাতে জাতীয় পরিচয় পত্রের প্রয়োজন হবে।
অনুরোধ:
আদিবাসী সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখানো ও আচরণে আন্তরিক থাকুন। শুস্ক মৌসুম ছাড়াও পার্বত্য এলাকায় পানির সমস্যা রয়েছে। তাই পানি ব্যবহারে মিতব্যায়ি হবেন। সাজেকের পাহাড়ি এলাকায় চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, বিস্কুট ও চানাচুরের প্যাকেট, পলিথিন প্রভৃতি যেখানে সেখানে না ফেলে পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক থাকুন।
জরুরী প্রয়োজন ও নিরাপত্তায়:
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্য পেতে : ৯৯৯
সরকারের স্বাস্থ্য সেবার কল সেন্টার:১৬২৬৩
বাংলাদেশ রেলওয়ে কল সেন্টার: ১৩১
জাতীয় তথ্য বাতায়নের কল সেন্টার: ৩৩৩
ওসি (বাঘাইছড়ি থানা): ০১৫৫৭৪৯৮৬৪৪
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (বাঘাইছড়ি উপজেলা): ০১৫৫৭৬৭৬২১১, ০১৭১৮৬৮৯৩১১, ০৩৭১৫৬০০১
ছবি ও তথ্য : সালেক খোকন
লেখক ও গবেষক
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: