এক অরণ্য, যমজ নদী : ডঃ সুবীর মন্ডল


প্রকাশিত:
১৯ আগস্ট ২০২০ ২২:৪৬

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:০৭

 

স্কুলে পুজোর ছুটি হলো। কেজো জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি। পুজোর লম্বা ছুটিতে সবাই আত্মহারা ও পুলকিত। এ যেন বন্ধনহীন মুক্ত জীবনের উল্লাস। আমাদের কয়েক জনের নেশা প্রতি বড় ছুটিতে বাইরে যেতেই হবে। বিদদার চায়ের দোকানের, চায়ের আড্ডায় গন্তব্যের ঠিকানা নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড়। সবার একটাই প্রশ্ন, এবার আমাদের গন্তব্যস্থল কোথায়? পাহাড়, সমুদ্র, নাকি রহস্য রোমাঞ্চে ভরা জঙ্গলে। অবশেষে ঠিক হলো প্রকৃতির স্বর্গভূমি সুন্দরবন। বহু কবি -সাহিত্যিকদের কাছে চিরদিনের অত‍্যন্ত প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ও একবার এসে ছিলেন। আমি আত্মমগ্ন হয়ে কবি গুরুর কবিতায়। "দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপর/ একটি শিশির বিন্দু"। সবাই হঠাৎ করে বলল, স‍্যার আপনার দেশের বাড়ি যেহেতু সুন্দরবন, আমরা এবার সুন্দরবনে তিন দিনের জন্য ঘুরতে চাই। আপনি আয়োজন করুন। সহকর্মীদের ভালোবাসা ভরা আব্দার মন না চাইলেও, মেনে নিতে হলো।

ঠিক হলো বিজয়দশমী পরে কোজাগরী লক্ষী পুজোর দিন সবাই ভোর পাঁচ টার মধ্যে শিয়ালদহ স্টেশনের ৮নম্বর প্লাটফর্মে সমবেত হব। আমি সপ্তমীর দিন বিরাটীতে চলে আসি এবং আসন্ন ভ্রমণের জন‍্য একটা নিখুঁত পরিকল্পনা করে নিই। অবশেষে যাত্রার শুভদিন গত বছর, ২০ সেপ্টেম্বর ,শুক্রবার সাড়ে পাঁচ টার, সময় শিয়ালদহ (উত্তর) স্টেশনে সবাই নিরাপদে এসে গেল, খাতড়া থেকে রাতের ১০টার বাসে। আমি ৬-১২র হাসনাবাদ লোকালের টিকিট কেটে মিলিত হলাম। সবাই যেন যুদ্ধ জয়ের স্বপ্নে বিভোর। এর আগে আমি ছাড়া কেউ ভয়ঙ্কর জল-জঙ্গল, রহস্যে ,রোমাঞ্চে ভরা সুন্দরবনে পদচারণ করেনি। একটু গরম কফি খেয়ে ট্রেনে চাপলাম। বেশি ভাগ মানুষের ই ধারণা-সুন্দরবন যেতে গেলে দক্ষিণ ২৪পরগনণা দিয়ে আসতে হয়। কিন্তু উত্তরের সুন্দরবন (বসিরহাট মহকুমার অন্তভুক্ত) যাওয়ার একটি জনপ্রিয় প্রধান প্রবেশ পথ হাসনাবাদ। দক্ষিণের সুন্দরবন বলতে যে নামগুলো মাথায় আসে তা হলোঃ (১) সজনে খালি, (২) সুধন‍্যখালি, (৩) দোবাঁকি, (৪) নেতাধোপানি। কিন্তু উত্তরে ছড়িয়ে আছে (১) রায়মঙ্গল,বড়কলাগাছি, কালিন্দীর মোহনা, (২) কুরেনদী, (৩) জিরো পয়েন্ট, (৪) ঝিঙাখালি, (৫) বুড়িরডাবড়ি, (৬) বাগনা, (৭) কুমিরমারি, কাটোয়া ঝুড়ি, (৮) হরিখাল, (৯ )মরিরঝাঁপি, পাখির আলয় এবং (১০) বাংলাদেশের সুন্দরবন।

সাগরের বৈভব নিয়ে বিরাজমান রায়মঙ্গল। সুন্দরবনের বৃহৎনদী। তিন দিন হারিয়ে যাওয়ার সন্ধানে পাড়ি দিলাম অপরূপ আরণ্যক প্রকৃতির মাঝে, যেখানে উপচে পড়া ভিড় আমাদের আনন্দকে নষ্ট করবে না। আসলে এই পথে ভ্রমণের ব‍্যবস্থা খুব বেশি দিনচালু হয়নি। ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বনবিবি সেতু চালু হওয়ায় একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেছে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে। কথা বলতে বলতে বারাসত, হাড়োয়া, মালতী পুর, ভ‍্যাবলা, বসিরহাট, টাকী হয়ে (সকাল ৮-১২তে) দু-ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ভারতের শেষ সীমান্ত রেল স্টেশন হাসনাবাদে। পথের দৃশ্য অনন্য। শুধু সবুজ আর সবুজ। রুপসী বাংলার উজাড় করা অবর্ণনীয় রূপ। নেমেই স্টেশন থেকে ৬০০ টাকায় একটি টাটাসুমু ভাড়াকরে যাত্রা করলাম লেবুখালির উদ্দেশ্যে।

মাত্র২৭ কিমি পথ। ইছামতীর নদীর উপর সদ‍্য নির্মিত বনবিবি সেতু দিয়ে আমাদের গাড়ি দূরন্ত গতিতে এগিয়ে যেতে লাগল। একে একে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা বরুণহাট, গৌড়েশ্বনদী, রামেশ্বরপুর, হিঙ্গলগঞ্জ নানা জনপদ পেরিয়ে মাত্র ৪০মিনিটে সকাল ৯ টায় পৌঁছে গেলাম লেবু খালিতে। যাত্রা পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। শীতের প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে এখানে রং মেলান্তি খেলা খেলে চলেছে। লেবু খালিতে নেমেই কচুড়ি সহমিষ্টি দিয়ে টিফিন সারলাম এবং তারপর সময় নষ্ট না করে ভেসেলে করে নদী পেরিয়ে দুলদুলিতে পৌঁছলাম। সময় লাগল মাত্র দশ মিনিট। দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটো ৩০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করে রায়মঙ্গল নদীর তীরে অবস্থিত হেমনগর ট‍্যুরিস্ট লজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ১৭ কিমি রাস্তা। চারদিকে সবুজ গাছগাছালি ও সবুজ ধান ক্ষেত। তার মধ্যে দিয়েছুটে চলছে আমাদের অটো। সে এক, অন‍্য রকম অনুভূতি। একে- একে সাহেবখালি, চাঁড়ালখালি যোগেশগঞ্জ ভারত -বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন জনপদ পেরিয়ে ১০-৩০ মিনিট নাগাদ আমরা পৌঁছলাম রায়মঙ্গল নদীর তীরবর্তী হেমনগর ট‍্যুরিস্ট লজে।

অসাধারণ মন ভালো করা মনোরম জায়গা। আগেই ফোনে আমি, তিনটি রুম ৩ হাজার টাকায় এক- দিনের জন‍্য‍ এবং সুন্দরবন ঘোরার জন্যে কেবিন যুক্ত যন্ত্রচালিত নৌকা ১২ হাজার টাকায় তিন দিনের জন‍্য ভাড়ার ব‍্যবস্থা করে রাখি, নৌকার মধ্যে রাত্রে থাকা, খাওয়া ও শোয়ার আরামদায়ক ব‍্যবস্থা ছিল। লজের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, লজের ম‍্যানেজার কাম কেয়ার টেকার প্রবীর গায়েন। স্থানীয় শিক্ষিত যুবক। গভীর আপ‍্যায়নে সবাইকে নিয়ে গেলেন লজের ভিতরে। রায়মঙ্গল নদীর তীর ঘেঁষে তিন তলা আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত হেমনগর ট‍্যুরিস্ট লজ।

আমরা প্রত‍্যেকে নিজ নিজ রুমে গিয়ে স্নান করলাম। তারপর ডাইনিংরুমে এলাম। দু পুরের মেনু দেখে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম--দামি চালের ভাত, স‍্যালড, ডাল, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, ভেটকিমাছের ঝাল, সুন্দরবনের কেওড়ার চাটনি, পাঁপড়। প্রতি প্লেট জনপ্রতি ২৫০ টাকা। স্বাদ অসাধারণ। খাওয়া শেষ করে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে, লজের চারিদিকে ঘুরতে লাগলাম। ১০বিঘে জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে লজ কাম রিসোর্ট। দুটি বিশাল পুকুর আর চারিদিকে প্রচুর ফুল, নানান সব্জির বাগান, ফলের গাছ। মাঝে মাঝে আড্ডা দেওয়ার সুন্দর আয়োজন। সেই সঙ্গে সুন্দর বনের নানা গাছপালা, শুধু সবুজ আর সবুজ। এ- যেন এক চিলতে মিনি সুন্দর বন। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জগতে সবাই বিচরণ করছি। এখানে আসা মানে শুধু সুন্দর বনকে দেখা নয়, নিজেদের হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলাকে খুঁজে পাওয়া, আর নির্মল প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া। শহরের কংক্রিটের জগৎ থেকে দূরে এক কল্পনার জগতে হাজির, মাত্র তিন দিনের হঠাৎ অতিথি রুপে। ঘন্টা দুই পর লজে ফিরে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, সময় নষ্ট না করে কাছাকাছি জায়গা গুলো ঘুরে নেব। কথা অনুযায়ী সবাই তৈরী হয়ে নিলাম।

দুটি অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ৬ কিমি দূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে "0" পয়েন্টের খোঁজে। সমসেরগঞ্জ, কালীতলাঘুমটের বাজার পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম-রাস্তার বাম পাশে লোকালয়, ডানপাশে কুরে নদী, তারপর-- দক্ষিণারায়ের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। মাত্র একশ ফুট দূরে ঘনগভীর জঙ্গল। মানুষ আর বাঘের এমন সহ অবস্থান পৃথিবীর কোথাও নেই। কুরেনদী পেরিয়ে বহু বার বাঘ এসে মানুষ ধরে খেয়েছে। এ-এক অনন‍্য মানুষের জীবন যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্র। সবাই ভয় পেয়ে গেল‌। এই ধরনের পরিবেশে আমার শৈশব ও যৌবন কেটেছে। তাই এটা আমার কাছে গুরুত্বহীন বিষয় ছিল। বর্তমানে জঙ্গল তারের জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সূর্য দেব তখন ও আছেন, আর একটু এগিয়ে পাখিরালয় তারপর ভারতবর্ষের শেষ বিন্দু।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি কালিন্দী নদীর তীরে, এর অপরপাড়ে বাংলাদেশ, অন্য দিকে রহস্য, রোমাঞ্চে ভরা সুন্দরবন। এ এক অন্য ভুবন।

কালিন্দীর রূপ এখানে অসামান্য। আলো আঁধারি পরিবেশের মধ্যে দিয়েই আমরা দেখলাম ঘন সবুজে মোড়া বাংলাদেশের সুন্দর বন। এ- এক অনবদ্য অনুভূতি। ৪টের সময় কালীতলাঘুমটের বাজারে এসে সবাই চা টিফিন খেয়ে আমাদের তিন দিনের ভাড়া করা যন্ত্র চালিত বোটে করে নদী বক্ষ ভ্রমণের সঙ্গে ঝিঙে খালির ফরেস্টের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এই প্রথম আমরা সুন্দরবনের ভিতরে পা রাখলাম। সহকর্মীদের মধ্যে একটা চাপা অজানা ভয়ের ছবি আমি উপলব্ধি করছিলাম। সবাই বাকরুদ্ধ, এরপর সবাই উঠলাম সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ারে।

পরিযায়ী পাখি দেল কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে গোটা অরণ্য। এই মূহুর্তে হৃদয় জুড়ে রূপসী বাংলার কবির চিরায়ত কালজয়ী কবিতার অনুরণন --"বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাইনা আর"। ধীরে -ধীরে সন্ধ্যা নামছে।ঝিঙাখালি নদীর বুকে সূর্যাস্তের ছবি বহু দিন ভোলা যাবেনা। এই আনন্দমুখর সময়, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। হাতে সময় না থাকায়, নিরাপদে আমরা বোটে করে লজের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। নদী পথে মুখোমুখি হলাম সাগরসম ভয়ঙ্কর রায়মঙ্গল নদীর সঙ্গে।

লজে ফিরে হালকা টিফিনের আয়োজন করলেন প্রবীরবাবু। দুপুরের ভূরিভোজের পরে, এমনকি কারোর খিদে নেই, তবুও সন্ধ্যায় কফি, বিস্কুট, গ্ৰামের মুড়ি আর গরম গরম বেগুনি দিল। খেতে খেতে লজের রাঁধুনি ভোলাদার কাছে সুন্দর বনের নানা অজানা গল্প শুনতে লাগলাম। লজের ব‍্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কৈশোরের ভালোলাগা অপরুপা, মোহময়ী রায়মঙ্গল নদীর পরতে পরতে সাজানো রূপ দর্শন করছি। চারটি নদীর সঙ্গম স্থলে আমরা অবস্থান করছি। সাগরের বিশালতা ও বৈভব নিয়ে রায়মঙ্গল বিরাজমান আমাদের হৃদয় জুড়ে। সীমাহীন অনন্ত জলরাশি নিয়ে আপন খেয়ালেই বয়ে চলেছে। শীতের সময় শান্ত, কিন্তু বর্ষা ও গ্ৰীষ্মকালে এর ভয়াল ভয়ঙ্কর রূপ‌। সবচেয়ে খরস্রোতা ও প্রচণ্ড তুফানের নদী। একে অনেকেই সুন্দরবনের হোয়াংহো বলে। এখানকার সাধারণ মানুষের জীবন, জীবিকা এবং জীবন সংগ্ৰামের কথা নিয়ে মনে নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। শারদীয়া ও লক্ষীপুজোর উৎসব যাদের কাছে বিলাসিতা। বেঁচে থাকা যাদের দুঃসাহসিক, যারা অনন্তকাল ভেসে চলেছে উত্তাল কাল তরঙ্গে। ভাটা থেকে জোয়ারে, জোয়ার থেকে ভাটায়। শুধু পেটের টানে তারা আজ উৎসব বিমুখ। এ-এক অন্য সুন্দর বন।

রাত তখন ৮টা। সবাই একজায়গায় বসে প্রথম দিনের ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করছি, হঠাৎ মাথায় একটা রোমাঞ্চকর আইডিয়া এলো। সবাই কে বললাম গভীর রাত্রে যদি আমরা সজনেখালি রিজার্ভ ফরেস্টের গিয়ে থাকি, তাহলে অনেক খানি ঘুরতে পারব। আমার প্রস্তাবে সবাই সম্মতি জানাল। আমি যন্ত্রচালিত নৌকার মাঝিকে ফোন করে বললাম, আজ রাত দুটোয় আমরা জঙ্গলে যাত্রা করব, আপনি রাঁধুনি, হেলপার, রান্নার সমস্ত জিনিস পত্র এবং মাছ,মাংস নিয়ে রাতে লজের ঘাটে আসুন। বনে প্রবেশের অনুমতি বাগনা ফরেস্ট অফিস থেকে আগেই আমার একবন্ধু শান্তুনু গায়েন করে রেখে ছিলেন।

রাত ৯টায় সময় ডিনার দেওয়া হল আমাদের। ভাত, ডাল, সব্জি, দেশি খাশির মাংস, চাটনি, পাঁপড়। রান্নার অসাধারণ স্বাদে আমরা অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শেষ করে, নিজেদের ঘরে চলে গিয়ে নৈশ অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। রাতে জঙ্গলে যাওয়ার ব‍্যাপারে কয়েক জন ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। আমি সবাইকে সাহস দিলাম, ভয়ের কিছু নেই, তিন ঘন্টায় আমরা সজনেখালি ওয়াইল্ড লাইফ স‍্যাংচুয়ারিতে নিরাপদে পৌঁছে যাব। তাছাড়া দিনটি ছিল কোজগরী লক্ষীপূজার। সারারাত চাঁদের আলো থাকবে ,সীমান্তবাহিনী নিরাপত্তায় আছে, কেউ কেউ জলদস্যুদের কথা তুলল। ভয় আর একরাশ রোমাঞ্চ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কারোর চোখে ঘুম নেই‌, তবু ক্লান্তি মোচনে একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। রাত বাড়তেই রায়মঙ্গলের বুকে জোয়ার এসেছে। নদীর জল বাড়ছে। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আছড়ে পড়ছে নদীর বাঁধে।সে এক অপরূপ দৃশ্য। এইভাবে সময় বয়ে চলল। রাত দেড়টার সময় মাঝি ভাইয়ের চিৎকারে সবাই উঠে পরলাম এবং তৈরি হয়ে নিলাম। একেএকে সবাই নৌকার কেবিনের মধ্যে ঢুকে গেল। আমরা কয়েকজন ডেকের উপরে চেয়ারে বসে রূপসী রায়মঙ্গলের অবর্ণনীয় রূপ অনুধাবনের চেষ্টা করছি, ঠিক রাত দুটোয় যাত্রা শুরু হল। আমাদের যাত্রা পথের শহুরে সভ‍্যতার শেষ বিন্দু এই হেমনগর-সমসেরগঞ্জ। এরপরেই শুরু হবে জল আর জঙ্গলের রাজত্ব। শুধু ভেসে চলা। বৃহৎ রায়মঙ্গল নদীর বুক চিরে চলেছে (ভটভটি) নৌকা। চাঁদনি রাত রূপোলি নরম আলো স্পর্শ করেছে রায়মঙ্গল নদীর শরীর। তিরতির করে কাঁপছে নদী। দুলেদুলে উঠছে আমাদের নৌকা। গন্তব্য সজনেখালি রিজার্ভ ফরেস্ট।

রোমান্টিক স্বপ্ন জালে বোনা সুন্দর বনের ভয়াল, ভয়ঙ্কর ম‍্যানগ্ৰোভ অরণ্য। বুক ছমছমে গভীর রাত। ভয়াল-রহস্যঘেরা অরণ্যের সামনে ছলাৎ ছলাৎনদী। পূর্ণিমা রাত- -মায়াবী আস্তরণ। সম্পূর্ণ আঁধার হলে দিগন্ত হয়ত চোখে পড়ত না সে ভাবে। কিন্ত্ত নিকষ কালো নয়, চারদিকের মায়াবী জ‍্যোৎস্নায় আকাশ -নদী-অরণ‍্য নীলের নানা ছায়ে যেন প্রকাণ্ড এক স্বপ্নময় ক‍্যানভাস। জীবন শিল্পীর তুলিতে আঁকা অপরূপ নিসর্গ। নদীর অন্য প্রান্তে চোখ মেলে তাকাতেই হিম হয়ে যায় হৃৎপিণ্ড। ঘন নীলের বিচিত্রতায় নিথর, নিশ্চুপ গভীর অরণ‍্য। গভীর অথচ ভয়ঙ্কর। মনের গোপন কুঠুরিতে যেন কেঁপে কেঁপে ওঠেন প্রাণের কবি, রবি ঠাকুর- --"আজ জ‍্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে"। যাত্রা পথে নৌকার মাঝি জানালেন -"এইনদীতে প্রচুর কুমির আছে" । এই কথা শোনা মাত্র, অমিতাভ, অনুভব, শুভেন্দু, কৌশিক, সুজিত, সংলাপ, প্রসেনজিৎ, দেবাশীষ, বিশ্বরূপ, সবাই অজানা ভয়ে ভীত হয়ে পড়ল। অবশেষে তিনঘন্টায় ভোর পাঁচটায় পৌঁছলাম সজনেখালিতে। মাঝনদীতে নোঙর করল আমাদের মাঝি ভাই সনাতন দা।

ভোরের অপেক্ষায় রইলাম। যারা কেবিনে ছিল, তারাও বেরিয়ে এলো ডেকের উপর। রাঁধুনিকে গরম কফি তৈরি করতে অনুরোধ করলাম। তখন সময় ৫-৪৫। ধীরে ধীরে সুন্দর বনের বুকে শীতের কুয়াশা ভেদ করে সূর্যোদয়। এক অপরূপ দৃষ্টি নন্দন ছবি, বহু দিন মনের মণিকোঠায় ভাস্বর হয়ে থাকবে‌। কফিতে চুমুক দিতে দিতে চারিদিকে দেখতে লাগলাম, নৌকা তখনও মাঝনদীতে।প্র চুর ট‍্যুরিস্ট লঞ্চ ও নৌকা রাত্রে এসে আছে। সকাল ৮টায় নৌকা ফরেস্ট ঘাটে আসল। সুন্দরবনের দ্বিতীয় দিন শুরু হল খেজুরের রস পান করা দিয়ে। আজ শুরু হবে প্রকৃত জঙ্গল দেখা। বনদপ্তের অনুমতি নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম সজনেখালি। উচুঁওয়াচ টাওয়ারে সবাই উঠলো, কিছু হরিণ ও বন‍্যশূকর দেখলাম। কিছুটা সময় 'ম‍্যানগ্ৰোভ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার', মিউজিয়াম ঘুরে দেখে বনবিবি মন্দির হয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ নৌকায় ফিরে ডেকের উপড়ে বসে জমিয়ে কচুড়ি, আলুরদম, মিষ্টি সহকারে টিফিন সারলাম।

নৌকার মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। বনবিবি, ভারানি হয়ে দীর্ঘ জলপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম সুধন‍্যখালি। শুধু জল আর গভীর অরণ‍্য‌। মাঝখানে ভেটকি মাছ ভাজা, কফি আর ডাবের জল খেলাম। জলপথের দুপাশে গভীর ম‍্যানগ্ৰোভের বন। মাঝে মাঝে জঙ্গলের দূরত্ব নৌকা থেকে ২০ ফুট। প্রচুর খাঁড়ি চোখে পড়ল। এখানে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে যায় জেলেরা‌‌। অনেক সময় বাঘের পেটে যায়। সুন্দর বন রয়েলবেঙ্গল টাইগারের আদর্শ বাসভূমি। সুধন‍্যখালিতেওয়াচ টাওয়ার থেকে অরণ্যে অপরূপ শোভাও হরিণ, বন‍্যশূকর দেখলাম। মনভরে গেল। এখানকার বন যেন এক বোটনিক‍্যাল গারডেন। অসংখ্য গাছগাছালিতে ভরাজঙ্গল। প্রতিটি গাছের গায়ে লেবেলিং করে লেখা আছে গাছের নাম। দেখা শেষ করে ফিরে এলাম নৌকায়।

এবার গন্তব্য মঙ্গলকাব‍্যে উল্লিখিত নেপাধোপানিঘাট। ওখানে পৌঁছে উচুঁ ওয়াচ টাওয়ারেউঠলাম। গভীর আরণ‍্যক শোভায় মুগ্ধ হলাম। দুপুরের খাওয়া সারা হলো। খাবার থালা আলো করে আত্মপ্রকাশ ঘটল বড়বড় বাগদা চিংড়ির সঙ্গে পেল্লাই সাইজের কাঁকড়া। খেয়ে সবাই পরম তৃপ্ত হলাম। বেলা তিনটের সময়ে যাত্রা শুরু হলো। বনবিবি, ভারানি, পীরখালি ১ ,২, ৩ হয়ে পৌঁছলাম সুন্দরবন ব‍্যাঘ্র প্রকল্পের দোবাঁকি ক‍্যাম্পে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে অজস্র বালিহাঁস, হরিণ, বন‍্যশূকর, বাঁদর দেখলাম। ঝাঁক বেঁধে তাদের জলকেলি মনকে মুগ্ধ করে দিল। সুরক্ষার উঁচু তারের ঘেরাটোপের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ নরম মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখার সৌভাগ্য হল। মনে হল কিছুক্ষন আগে এখান থেকেই হেঁটে গেছেন দক্ষিণারায়। এ অভিজ্ঞতা ঠিক লিখে প্রকাশ করা যাবে না।

নৌকায় সামান্য বিশ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু হল। গন্তব্য দয়াপুর ও পাখিদের আড্ডা ক্ষেত্র পাখিরালয়। রাত্রে ওখানে নৌকায় থাকব। শুধু জল আর গা-ছমছম করা গভীর ঘন জঙ্গল। শুধু ভেসে চলা।বারে বারে পালটে যাচ্ছে দু-পাশের চিত্র।সূর্য ঢলছে পুব থেকে পশ্চিমে। ক্রমশই ঘন হচ্ছে জঙ্গল। এ -যেন এক অনন্তযাত্রা। মাঝে মাঝে সঙ্গী হচ্ছে পরিযায়ীর দল। বোটের শব্দ ছাড়া চারপাশে জমাট বেঁধে আছে অস্বাভাবিক নীরবতা। এ-যেন আমার পৃথিবী নয়, এখানে আমরা অনুপ্রবেশ কারি। এ --জগৎ মনুষ‍্যতরদের। প্রতিটি মূহুর্তে বেঁচে থাকার লড়াই। সুন্দরবন আর জীবন সংগ্ৰাম যেন একে অন‍্যের প্রতিশব্দ। নৌকা এসে পৌঁছল দয়াপুরে। ঘড়িতে তখনরাত ৭টা। এখানে প্রচুর হোটেল ও রিসোর্ট আছে। জঙ্গলের পাশে এক টুকরো আলোকিত শহর।

বাজারে গিয়ে ঘুরলাম ও ডাবখেলাম, ঝুমুরগানের আসরে বেশকিছু সময় কাটল। রাতে নৌকায় রান্না হচ্ছে দেশি মুরগির ও ট‍্যাংরা মাছের ঝোল।রাতে শুনলাম, গতকালের গভীর রাতে জঙ্গল থেকে বাঘের ডাক অনেকেই শুনেছেন। এই সময় বাঘেদের মিলন কাল। নেশা ছড়িয়ে যায় অরণ্যে। একফালি চাঁদের আদরে ডুবে যেতে থাকে চরাচর। ১০টায় নৌকায় ফিরে রাতের খাওয়া সারলাম। তারপর গভীর ক্লান্তিতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। কাল তৃতীয় দিন তথা ভ্রমণের শেষ দিন ।

ভোর হল। চা, টিফিন খেয়ে সকাল ৮টায় যাত্রা শুরু। এবার ফিরে যাওয়ার পালা। সজনেখালি হয়ে, বুড়িরডাবড়ি, বাগনা, মরিচঝাঁপি, কুমিরমারি ঘুরে দুপুরে দুপুরে হেমনগরে পৌঁছলাম। নৌকায় দুপুরের খাওয়া সারা হল। সবারই মন একটু ভারি। আবার কেজো জীবনের প্রত‍্যাবর্তন। যে যার কাজে ফিরে যাব। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

গত তিন দিনের আরণ‍্যক স্মৃতি সবার চোখে মুখে লেগে। সত্যিই তো বাকি রয়ে গেল অনেক কিছুই। আবার আসিব ফিরে, এই রায়মঙ্গলের কূলে, কোন এক সময়ে, অন্য ভাবে। এবার ছুঁয়ে যাবো সেই জায়গা গুলো, যেখানে মানুষের পা বড় একটা পড়েনা। যেখানে পৃথিবী আরো আদিম।

কিভাবে যাবেনঃ

কোলকাতা থেকে হেমনগরের ও কালীতলাঘুমটের দূরত্ব ১১৫ কিমি। ট্রেনে হাসনাবাদ ৬৯ কিমি ভাড়া, ২০টাকা, তারপর ২৭ কিমি লেবু খালি (বাস, ট্যাকসি, অটোরিকশা, মারুতিভ্যান, জিপ)। নদী পেরিয়ে মাত্র ১৭ কিমি (ভ্যানরিক্সা, টোটো) হেমনগর লজ। কেউ চাইলে সরাসরি নিজস্ব গাড়ি নিয়ে হেমনগরে যেতে পারেন। ভেসেলে গাড়ি পারের ব‍্যবস্থা আছে। 'গ্ৰামের বাড়িনামে' একটি রিসোর্ট ও কয়েকটি হোমস্টে আছে। অনলাইন বুকিং হয়। এই পথে সবচেয়ে কম খরচে ভ্রমণ করা যেতে পারে। ক্রমশ হাসনাবাদ দিয়ে উত্তরের সুন্দরবন ভ্রমণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। সরকারি গাড়ি চালু হয়েছে কোলকাতা থেকেই হেমনগর পর্যন্ত। সঙ্গে পরিচয় পত্র থাকা দরকার, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা বলে। সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা বলয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারবেন। ভারতের শেষ ভূখণ্ড হেমনগর ও কালিতলাঘুমটে সমৃদ্ধ জনপদ ভূমি। সমস্ত মানুষের সহযোগিতা খুব সুন্দর, সেই সঙ্গে আন্তরিকতা ভালো। সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই পথ।

 

ডঃ সুবীর মন্ডল
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top