ভারত ভ্রমণ: সোহানা হোসেন স্বাতী


প্রকাশিত:
২ এপ্রিল ২০২০ ০৫:২৪

আপডেট:
৮ জুলাই ২০২০ ২২:২৭

মানালীতে লেখক সোহানা হোসেন স্বাতী

২০১৫ , নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ, ঢাকায় তখনও শীত পড়েনি। দোকানিরা শীতের কাপড়ের পশরা খুলে বসেনি তখনও। তবুও খুঁজে খুঁজে প্রচুর গরম কাপড় কালেক্ট করলাম। সেবার যাওয়ার আগে এতো শপিং করেছিলাম যে ৪ সেট পোশাক untouched ফেরত এসেছিল। যাই হোক মিঠু অনেক ঘুরে আমার জন্য এক জোরা গ্লভস এনে দিল । pink color , দেখলেই মনটা ভরে যায় ,হাতে পরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। আমার তো ' A Mother in Mannville' এর Jerry র সেই imaginary gloves এর কথা মনে পড়ে যায়। জীবনের প্রথন স্নো দেখব, আনন্দে আহ্লাদিত আমি।

দু'দিন ছিলাম আমরা মানালি। ১ম দিনের ট্যুর প্ল্যান পুরো ভেস্তে গেল বৃষ্টির কারণে। মল রোড এবং আশে পাশেই ঘুরে দেখলাম বৃষ্টিতে । দেখলাম হিরম্ব মাতার মন্দির। রোযা ছবিতে এই মন্দিরেই রোযা নারকেল ভাঙতে এসেছিল, যার সামনে থেকে অরবিন্দ স্বামীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরদিন আমাদের দিল্লী রওনা দেবার কথা সকালে। বৈরি আবহাওয়ার কারণে রোটাংপাস বন্ধ করে দিয়েছে। কাল যদি বৃষ্টি না থাকে তবেই দেখা যাবে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্নো। এখন একটাই প্রার্থনা কাল যেন বৃষ্টি না হয় । প্রচণ্ড শীত সাথে বৃষ্টি। পাহাড়ের উপর কাঠের দোতলা হোটেল, দুই কম্বলেও শীত যায় না, সাথে শরীরের ওম দরকার হয়।

সোনাঝরা রোদের মিষ্টি হাসি নিয়ে সকাল শুরু হল ।


গন্তব্য কোঠি, গুলাবা , সোলাং ভ্যালী । কোঠি আসতেই পথের দু'ধারে অ্যাপেল গাছের সারি, ঘাসে সার্ফের ফেনার মত থোকা থোকা সদ্য পড়া স্নো । যত আগাচ্ছি ততই সাদা... মুগ্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে মন। গত রাতে পড়েছে নতুন তুষার, গুলাবা সেজেছে 'তুষার রাণী'।

 

জীবনে প্রথম তুষার, অদ্ভুত এক অনুভূতি। কোন কথা বলতে পারছি না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মুখ খুললেই দাঁতের মাড়িতেও সূচের মত বিঁধছে ঠাণ্ডার সুঁই। একদম নতুন তুষারপাত, পা দিলেই গর্ত হয়ে যাচ্ছে , ধুপধাপ পড়েও যাচ্ছি। সাদা সাদা বরফের চাক ... ধরে, ছুঁয়ে, হাতে নিয়ে, গোলা বানিয়ে, গায়ে মেখে , গড়াগড়ি করে , সব স্বাদ আহ্লাদ মিটিয়ে একসময় নেমে এলাম উঁচু থেকে মেইন রোডে, যেখানে আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছে। চলে আসতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু এখান থেকে সোলাং ভ্যালী তারপর সরাসরি দিল্লী ... ১৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা লাগবে দিল্লী যেতে। মোহগ্রস্ত হয়ে দুজনেই যার যার মত ছবি তুলছি প্রকৃতির। মোবাইল স্ক্রিনে টাচ করতে অসুবিধা হচ্ছে , ভাবলাম ডান হাতের গ্লভটা খুলে নেই। খুলে পকেটে রাখতে যাবো, ওমনি হঠাত এলোমেলো বাতাসের তোরে দৌড় দিল আমার শখের গোলাপি গ্লভটা। এই এই এই যাহ ...

 

 

আমার চিৎকারে মিঠু ফিরে তাকাল আমার দিকে , আর আমি চেয়ে আছি উড়ে যাওয়া গোলাপি রঙের গতিবিধির দিকে। গোলাপি গিয়ে পড়ল বেশ খানিকটা ঢালে, একটা কালভার্ট এর নিচে। নিচে একটা খালের মত যেটা পুরো বরফে ঢাকা। রোড থেকে নেমে ওটা তোলা যাবে কিন্তু খাড়া ঢাল। নামা সহজ হলেও, ওঠা কঠিন হবে। আমি অসহায়ের মত তাকালাম মিঠুর দিকে। আমার ইচ্ছে কিছু একটা করুক সে। হায় ! আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী মুখটা কঠিন করে আরও মনোযোগ দিল ছবি তোলায়। আমি একবার পড়ে থাকা গোলাপির দিকে তাকাই, একবার পতিদেবের দিকে তাকাই। তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। যে কিনা আমার একটু অসুবিধায় বুক পেতে দেয় তার এমন আচরণে খুব কষ্ট পেলাম। তার ভাবখানা এমন যে ভালবেসে একটা জিনিস দিলাম সেটাও যত্নে রাখাতে পারলা না ...

বাম হাতের গ্লভটার দিকে আমার করুণ দৃষ্টি, ওহহ ! একটা বিনে আরেকটা দিয়েও তো কোন কাজ হবে না ... যা করার দ্রুত করতে হবে এবং আমাকেই। আরেক দফা বাতাস বইলেই ওটা আরও নিচে উড়ে যাবে ... আমি নামার উপক্রম হলাম, মিঠু ফিরেও তাকাল না। ' হেই ... স্টপ ...'


সামনে তাকালাম, কালভার্ট এর ওপারে ৩ টা ছেলে হেঁটে আসছে। প্রচণ্ড শীতে সবাই ফুল প্যাক, মুখটুকু কোন মতে দেখা যায়। ইয়াং তিন জন ছেলে। তাদেরই একজন আমাকে হাত ইশারায় থামতে বলছে। ততক্ষণে আমার পতির সম্বিৎ ফিরেছে । ছেলে তিনজন এগিয়ে এলো। যে ইশারায় থামিয়েছিল আমাকে, সে এক লাফে নেমে গেল নিচে , তুলে নিল আমার কাঙ্খিত জিনিস। এবার উঠে আসার পালা। পুরো পিচ্ছিল ঢাল, পা দিতেই পিছলে যাচ্ছে। তার দু'জন সঙ্গী হাত বাড়িয়ে সাহায্য করল তাকে, ওঠে এলো সে উপরে। আমার হাতে তুলে দিল গ্লভটা , আমার কাছে মনে হল যেন একটা গোলাপি হাওয়াই মিঠা ...

 

ছেলেটাকে এবার কাছে থেকে দেখলাম। শ্যামলা চেহারার লম্বা এক যুবক , বয়স ২৮/৩০ হবে , ওরাও টুরিস্ট, সম্ভবত ইন্ডিয়ান।
" Thanx , thanx a lot ,"
বীর শুধু হাসল , শ্যামলা মুখের মিষ্টি এক হাসি।
আমার পতি তখন আমার পাশে। হাসিমুখে ওদেরকে মৌন সৌজন্যতা জানাল ।আমি তাকে না দেখার ভান করলাম।
আমি ইচ্ছে করেই আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম, সে ও সৌজন্যতায় হাত বাড়াল, মিলে গেল ভিনদেশী অচেনা দুই হাত , উপকারী হাত এবং কৃতজ্ঞতার হাত।
" good bye ."

পতিদেব তখন আমার পাশে , আমি আমার খালি হাতটায় পড়ে নিলাম গ্লভটা , তারদিকে তাকালাম না একবারও। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। যেতে হবে অনেকদূর ...

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top