বুমেরাং : আবু সেলিম রেজা
প্রকাশিত:
২০ জুন ২০২০ ২২:২৪
আপডেট:
২৮ জুন ২০২০ ২১:২৮

দ্রুত পায়ে হাঁটছে- না বলে -বলতে হয়, ছুটছে লায়েক শেখ।
হাতের রিচার্জেবল টর্চলাইটটার চার্জ বোধ হয় শেষ হয়ে এলো। এশার নামাজের পর থেকে শুরু করে এখন প্রায় মাঝরাত। থেকে থেকে ফোকাস, কমপক্ষে একহাজার বার তো হবেই ! মাঝে ঘন্টাখানেক তুমুল বৃষ্টির সময় বানেছার ঘরে কাটানো সময়টায় শুধু লাইটটা জ্বলেনি। যেমন জ্বলেনি ঘরের কোন আলো। হয়নি কোন শব্দ। শুধু টিনের চালায় বৃষ্টির মাতাল করা ছন্দময় শব্দ আর দু'টো দেহের ফোঁসফোঁসানি যা বৃষ্টিপতনের শব্দের কাছে আস্কারা পেয়ে বাঁধনহারা হয়ে চলেছে ঘন্টাব্যাপী।
বৃষ্টি কিঞ্চিত থাকতেই বের হয়েছে লায়েক শেখ।
বানেছা দোর দিয়েছে কিনা-সে ফিরে তাকিয়ে দেখেনি। হন্ হন্ করে হেঁটে নিরাপদ দূরত্বে এসে হাটখোলার হারুমিয়ার বেড়াখোলা ছাপড়ার নিচে পলো'র ওপর বসে প্যান্টের পকেট থেকে পলিথিনে মোড়ানো বিড়ি- ম্যাচ বের করে ফস করে আগুন জ্বালিয়ে বিড়ি ধরায়। সমস্ত শরীরে অনাস্বাদিতপূর্ব এক ভালো লাগা, এক শিহরণ দিয়ে যাচ্ছিল, ক্লান্ত শরীরটায় বর্ষণ শেষের স্নিগ্ধ হাওয়া লেগে এক ফুরফুরে ধরনের ভাললাগার অনুভূতি খেলা করছিল। যদিও ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে তবুও বিড়ির ঝাঁঝালো ধোঁয়ার স্বাদ যেন অমৃতের মত লাগছে। আবেশে গা', পা' ভেঙ্গে আসছে। এখন চাই আরামের একখানি বিছানা, একটু বিশ্রাম।
শ্রাবণের কৃষ্ণপক্ষের শেষের দিকের রাত। কালিয়াবিল গ্রামটি নিচু এলাকায়।বর্ষাকালের চার মাস এখানকার ফসলের জমি, রাস্তা-ঘাট সবকিছুই জলমগ্ন থাকে। পাকিস্তান আমলে এসময়ে দ্রুতবর্ধনশীল বুনো আমন ধানের চাষ করা হতো। তারপর ফারাক্কা বাঁধের দরজা আটকে দেয়ার ফলে এখন আর তেমন বর্ষা হয়না। তাই এ সময় এখানে রোপা আমন ধান চাষ করা হয়। আমন ধানের কচি চারার মধ্যে ছিপছিপে পানি থাকে। তার মধ্যে টাকি, কই, মাগুর, শিং পুঁটি ইত্যাদি মাছ রাতে খাবারের জন্য ছুটোছুটি করে। আলো ফেললে স্বচ্ছ স্বল্প পানিতে চলাচলকারী মাছেদের সহজেই স্পষ্ট দেখা যায়।
লোকে পলো দিয়ে চাপ দিয়ে বা কাস্তে দিয়ে কোপ দিয়ে সেই মাছ ধরে। আমাদের আজকের গল্পের লায়েক শেখ সেই মাছ শিকারীদের একজন।
লায়েক শেখ এর আজ কোন মাছ ধরা হয়নি। মাছ ধরার জন্য বের হলেও তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তাছাড়া প্রকৃতির বিরূপতাও তার সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে সহযোগিতা করেছে।
ঘর হতে বের হওয়ার সময়ে বানেছার স্বামী তৈয়ব আলী ঘরে আছে, না মাছ ধরতে বের হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজেদের নির্ধারিত সাংকেতিক ভাষায় মোবাইল ফোনে জিজ্ঞেস করেছিল- বানু পান সুপারি আছে ?
- কে খায় !
-রাতের পেঁচায়।
- লক্ষ্মী পেঁচা, আয় আয় !
- তুলে রাখ্ সোনার বাটায় !
সবুজ সংকেত পেয়ে লায়েক শেখ স্ত্রী আলেয়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
'সোনা বউ বিদায় দাও মাছ ধরতে যাই, কই মাগুর যা পাই তোর কপালে পাই !'
আলেয়া খুশিতে গদগদ হয়ে লাইটটা, গামছাটা মাছ রাখার জালিটা হাতে তুলে দিয়ে বলে,
- আন্ধার রাইত, সাপ পোকার ডর দেখে শুনে যেও, আর কখন আসবা ?
- কেন তোর কি ডর লাগে নাকি !
- হ', লাগেই তো ! তুমি কতক্ষনে ফিরবা ? তোমারে ছাড়া আমার ঘুম হয় না তো !
-ওরে লক্ষী বউ আমার ! দুই ঘন্টার ভিতরেই ফিরবো।
লায়েক বউয়ের কপালে চুমু দিয়ে বের হয়ে যায়। আলেয়া আলগোছে ঘরের দোর লাগায়। ঘরের মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে।
লায়েক শেখের আজ মাছ ধরা হলো না। একদিন মাছ ধরা না হলে এমন কিছু এসে যায় না। তাছাড়া আজ তুমুল বৃষ্টি হয়েছে, হচ্ছে আলেয়া এটা জানে, তাই মাছ না পাওয়াতে বকা খাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নাই। অবশ্য গায়ে কেমন যেন একটা টকটক কটু গন্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মিয়া সাহেবের জলাতে এসে লায়েক সারা গা' দলাই-মলাই করে ধুয়ে নিলে উত্তমরূপে।
নাহ্ আর কোন গন্ধ নেই !
মনে দারুন ফুর্তি ! ঘরে ফিরে বউকে আজ মন ভরে আদর করবে ! মোবাইলের চার্জ শেষ হলেও মনের ভালোবাসা পুরোপুরি রিচার্জ হয়েছে !
মিয়া সাহেবের জলার পাড়ের মাটি খুবই পিচ্ছিল। অন্ধকারে লায়েক শেখ পা পিছল ধপাস করে পড়ে যায়।
কিসের আঁচড়ে যেন পা কেটে রক্ত বের হতে থাকে। কাটুক, পা কাটুক -ঘরেতো সোহাগী বউ আছে,
সে মলম লাগিয়ে দেবে, স্বামীর সেবা করা স্ত্রীর কর্তব্য, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত !
লাইক শেখ বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। জাম কাঁঠালের পাতার মিতালিতে তার বাড়িটি আচ্ছাদিত।
নামলা জাতের ক্ষুদি জামগাছের পাকা জাম খেতে রাতে তার বাড়িতে বাদুরের আনাগোনা লেগেই থাকে, ওদের ডানা ঝাপটানিতে আর কিচিরমিচির শব্দে রাতের স্তব্ধতা বারবার ভেঙে যায়।
লায়েক শেখ বাড়িতে ঢুকে বারান্দায় উঠে টিউবয়েলের লাইট জ্বালে, টিউবওয়েল পাড়ে গিয়ে পায়ের কাদা ছাড়ায়, গলা ছেড়ে ডাকে,
-বউরে, ওঠ পা কেটে গেছে !
হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে যায়,
বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে সে দেখে, তৈয়ব আলী ঘর থেকে ভোঁ দৌড়ে বের হচ্ছে ! তার একহাতে লুঙ্গি, অন্যহাতে মাছের জালি, অবশ্য তা'তে কয়েকটি মাছও ছিলো, যার কয়েকটি উঠোনে ছিটকে পড়ে কাদা-মাটিতে লাফাচ্ছে !
বিষয়: আবু সেলিম রেজা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: