আনন্দের অশ্রু : ইলা সূত্রধর
প্রকাশিত:
১০ অক্টোবর ২০২০ ২১:৫১
আপডেট:
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:০৩
আমি কদিন যাবৎ বাপের বাড়িতে রয়েছি। হঠাৎ দেখি সেদিন সকালবেলা আমার শাশুড়িমা কাঁদতে কাঁদতে আমার বাপের বাড়ি ঢুকলেন। তাকে দেখে একেবারে অবাকই হয়ে গেলাম। কারন দু'দিন আগে আমি ওনার সাথে একটু রাগরাগি করেই এই বাড়িতে চলে এসেছি। আবার ঠিক এই সময়েই মাস্টার মশাই বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তখন বালুরঘাট থেকে নর্থ বেঙ্গলের আরেকটি জায়গায় MSC পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। ও হ্যাঁ এই সুযোগে একটা কথা বলেনি। মাস্টার মশাই মানে উনি আমার husband। পেশায় শিক্ষকতা করেন। তাই আমি ওনাকে এই সম্বধনে ডাকি।
যে কথা বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। সেকথায় আসা যাক। শাশুড়ি মার সঙ্গে আমার প্রায়ই ঝগড়াঝাটি ও খুনসুটি লেগে থাকত। তার অভিযোগ আমি রান্না করতে পারিনা, বাসন মাজা কাপড় কাচা কিছুই নাকি আমার দ্বারা হয় না। আমি কাপড় কাচলে নাকি সেকাপড় কেউ আর পড়তেই পারবে না। এ সব কথা কারবা সহ্য হয়। তাই আমি অভিমান বশত বাপের বাড়িতে চলে আসি। যাইহোক শাশুড়িমাকে কাঁদতে দেখে আমিও কেঁদে ফেললাম জড়িয়ে ধরে বললাম --- "মা কি হয়েছে বলুনতো ?" শাশুড়ি মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো --- "রাগ করে না সোনামা,তুমি বাড়ি ফিরে চল একটা সমস্যা হয়েছে ।"
সোনামা বলাতেই আমিও একেবারে গলে জল হয়ে গেলাম। শাশুড়িমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এসে জানতে পারলাম -- "পাশের বাড়ির ছেলেটা নেশা করে এসে আমাদের বাড়ির বাইরের লাইটগুলো ভেঙে দিয়েছে।" এসব দেখে ও শুনে মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে গেল। রাগ সামলাতে পারলাম না। আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ছেলেটার মাকে বললাম --- "কাকিমা এ কেমন কথা, আমার শাশুড়ি বয়স্কা মানুষ একা বাড়িতে আছে আর আপনার ছেলে নেশা করে এসে আমার বাড়ির লাইটগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে,আর আপনি কিচ্ছুটি বলেননি। কোথায় আপনার ছেলে ওকে ডাকুন,দেখি ওর কতো সাহস হয়েছে !" কাকিমা তখন মুখটা শুকনো করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার হাতদুটো ধরে বললেন --- "মা ও এখন বাড়িতে নেই। এলেই তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব, তুমি ওকে যা শাস্তি দিতে চাও দিও। আমি ওকে মানুষ করতে পারলাম না মা " --- বলেই কেঁদে ফেললন। আমি আবারও নরম হতে লাগলাম। কাকিমা কে আস্বস্ত করলাম --- "আপনি কাঁদবেন না। ঠিক আছে আমি চেষ্টা করে দেখবো ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ভালো করা যায় কিনা।"
ক'দিন বাদেই মাস্টার বাড়ি ফিরে এলেন। সকাল বেলায় বাস থেকে নেমেছে। বাড়িতে ঢুকতেই আমি তাড়াতাড়ি হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললাম --- "জানতো বাড়িতে একটা সমস্যা হয়েছে, তোমার পরীক্ষা ছিল তাই তোমাকে আগে বলিনি।" শুনেই চমকে উঠল উনি। "কি হয়েছে কি হয়েছে বলে ব্যস্ত হয়ে উঠল !" আমি বললাম --- "পরে বলবো।"
মাস্টার বলল --- "সিরিয়াস কোনো ব্যাপার নয়তো ?"
"আরে বাবা না না তেমন কিচ্ছু নয়। যাও তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে এসো, আজ তোমার পছন্দের লুচি আর আলুর দম রান্না করেছি।" শুনেই চমকে উঠল উনি --- "তুমি রান্না করেছ ! আজ খাওয়া হয়েছে তবে !"
"ওমন আঁতকে ওঠার কি হলো৷? আমি বুঝি রাঁধতে পারি না !"
মাস্টার হেঁসে উঠে বলল --- "না না আমি কি আর তাই বলেছি ? পাগলী, রাগ করে না সোনা।" ওমনি আমিও মিষ্টি হাঁসি হেঁসে বললাম --- "ভেবেছিলাম আমি রান্না করবো, কিন্তু রান্নার জিনিস সব গুছিয়ে নিতেই মা এসে বলল আমিই করে দিচ্ছি তাই ,,,,, ভাবছি এরপর থেকে মাকে আর রান্না করতে দেবো না। আমি নিজেই রান্নাটা করে নেবো।"
শুনেই মাস্টার বলল -- "সর্বনাশ!"
"কেন সর্বনাশ কেন ? আমি কি কিছু পারিনা না কি ?" রাগে আমার মুখটা লাল হয়ে গেল। মাস্টার বলল--- "না না রাগ করোনা সোনা, বলছি তোমরা হাত পুড়ে যাবে, গায়ের রং কালো হয়ে যাবে। আমি তোমার এ দশা একদম সহ্য করতে পারব না ।"
মিচকে হাঁসি নিয়ে বললাম--- "আর ন্যাকামি করতে হবে না। যাও যাও ফ্রেস হয়ে এসে খেয়ে নাও।"
একটু পরে খেতে এসে মাস্টার বলল --- "এবার বল কি সমস্যা হয়েছে ?" আমি বললাম --- "শোন না, ঐ যে পাশের বাড়ির কাকিমার মাতাল ছেলেটা আমাদের বারান্দার লাইটগুলো ভেঙে ফেলছে।" সঙ্গে সঙ্গে মাস্টার চিৎকার করে উঠল --- " কি বললে ? এতবড় সাহস !"
আমি বললাম --- "কুল ডাউন! এই শোনো না, তুমি রাগ করোনা। কাকিমা আমার হাত ধরে খুব কান্নাকাটি করছিল আর বলছিল, ছেলেটা মানুষ হলো না বৌমা। অভাবের সংসার। ওর বাবা নেই , ছেলেটা ও অমানুষ। আমার মরনটা হলে বাঁচি। তখন আমারও খুব কষ্ট হয়েছিল জান,আমি কাকিমাকে কথা দিয়েছি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নেশা ছাড়ানোর চেষ্টা করবো। তুমি আর কিছু বোলোনা প্লিজ।"
শুনেই মাস্টার বলল,"এই রে হয়েছে ! মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। এবার বুঝি আমারও কপালটা পুড়লো।"
বললাম --- "তার মানে ? কি বলতে চাইছো তুমি ?" মাস্টার বলল --- "না ধরো ওকে সারাদিন আদোর করে বুঝিয়ে শুনিয়ে ভালো করতে গিয়ে যদি তুমি ঐ ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাও !"
সঙ্গে সঙ্গে আমি তো চিৎকার করে উঠলাম --- "কি বললে! তুমি কি বললে ? বাজে কথা বলার যায়গা পায়না। একদম বকবক করোনা। চুপ কর। এই রকম সস্তা রসিকতা একদম করবে না। বলে দিচ্ছি কিন্তু।
কাকিমার ঐ মাতাল ছেলে, সবসময় নেশা করে থাকে, গায়ে মুখে দুর্গন্ধ। আর আমি পড়ব তার প্রেমে ? আমাকে ভাবো কি ? "
একটু পরে কাকিমা ছেলেকে নিয়ে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম --- "কেন এমন করলে ? আমাদের সঙ্গে তো তোমাদের কোনো শত্রুতা নেই।" ও আমার কথার উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল --- "বৌদি আমার অন্যায় হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর কোনদিন এরকম করবো না।" বুঝলাম ভেতরে ভেতরে চাপা একটা দুঃখ আর হিংসা থেকেই এটা করে ফেলেছে। কারণ ওরা এত অভাবী আর আমরা ,,,,,,,,,,,,,,,,। আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম --- "ঠিক আছে বসো।" ওকেও লুচি, আলুর দম খেতে দিলাম। আর কাছে বসে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বললাম --- "কেন এরকম কাজ করো ? এতে কি লোকে ভালো বলে ? আর ওইসব ছাইপাঁশ খেয়ো না। একেবারে ছোঁবে না বলো, কথা দাও !" অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল শুভ। আমরাও বাড়ির সকলে চুপচাপ। দুচোখ গড়িয়ে ওর গাল বেয়ে জল পড়তে লাগলো। সেই চোখের জল যেন বড় পবিত্র হয়ে উঠল এ সুন্দর সকালে। এই মূহুর্তটায় সবাই যেন এক বিপন্ন মানুষের পাশে থেকে আলোর পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তাই মাস্টারও বলে ফেললো --- "আরে আরে কাঁদছো কেন ? দেখো ভালোভাবে চললে সকলেই তোমাকে ভালো বলবে।"
ছেলেটা বলল --- "আমি সত্যি সত্যিই এ সমাজের একেবারে অযোগ্য একটা মানুষ। লেখাপড়া শিখিনি। আয় করে বৃদ্ধা মায়ের ভরণপোষণ নিতে পারিনি। সবাই আমাকে ঘেন্না করে। সব্বাই ! আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না দাদা।" মাস্টার তার স্নেহের হাতটা প্রতিবেশী ভাই শুভ'র মাথায় রাখল। সকালটা ভাতৃত্ব বোধে আরো সুন্দর হয়ে উঠল। আত্রেয়ী নদীর ওপার থেকে একটি হলুদ পাখি শিষ দিতে দিতে উড়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ আমরা আর কথা বলতে পারলাম না। অবশেষে মৌনতা ভেঙে বললাম --- "আচ্ছা তোমার নামতো শুভ ! যার প্রতিটা মূহুর্তেই ভালো চিন্তাভাবনার প্রকাশ পায়, শুভবুদ্ধির উদয় হয়। যা সমাজ ও প্রতিবেশীর জন্য ভালো কাজ করে --- সেইতো শুভ। তবে তুমি কেন অশুভ কাজ করবে ?" শুভ চোখের জল মুছতে মুছতে বলে ফেললো --- "জীবনটা যে এত সুন্দর তাতো আগে বুঝতে পারিনি বৌদি। তুমি নতুন করে জীবনের মানে বুঝিয়ে দিলে। বৌদি যে মায়ের আরেকটা রূপ সেটা সত্যি সত্যিই আজ জানলাম।"
শুভকে কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম ন। তবুও এই সন্ধিক্ষণে এসে মনে হল ওর জন্য কিছু একটা করা দরকার। বললাম --- "আজ থেকে আমাদের বাড়িতে, দুবেলা এখানেই খাওয়া দাওয়া করবে আর আমাদের একটা ফার্নিচারের দোকান আছে ওখানেই কাজ করবে।" মাস্টারকে বলে ঐ দোকানে ওর কাজের ব্যবস্থা করা হলো। সপ্তাহের শেষে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।
তারপর বহুবছর কেটে গেছে। শুভ এখন সত্যি শুভ হয়ে উঠেছে। নতুন দোকান দিয়েছে। বিয়ে করেছে। একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। সেই ছেলে দীপ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। কোলকাতা থেকে লকডাউনের মধ্যেও বাধ্য হয়ে বালুরঘাটে নিজের বাড়িতে এসে রয়েছি। বহুদিন ওদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। এখন আর আমাদের বাড়ির পাশে থাকে না। কাকিমাও অনেকদিন হয়েছে গত হয়েছে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে কে যেন ডাক দিল --- " বৌদি ! ও বৌদি৷! দরজা খোল। আমি তোমার ভাই এসেছি।" দরজা খুলে দেখি অবাক কান্ড।
শুভ স্বপরিবারে আমাদের বাসায় এসেছে। হাতে একটা মস্তবড় ফুলের ঝাড়। বললাম --- "কি ব্যাপার শুভ ? এতবড় ফুলের বোকে নিয়ে এসেছো !" সাথে দেখলাম আরো কিছু উপহার সামগ্রী।
"হ্যাঁ ! আমার জীবনের পথিকৃৎ, আমার আরেক মা; আমার বৌদির আজ শুভ জন্মদিন।" আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। শুভ বললো --- "বৌদি তুমি কাঁদছো !" আবেগে বলে উঠলাম --- "নাগো ভাই এটা আনন্দের অশ্রু
ইলা সূত্রধর
দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
বিষয়: ইলা সূত্রধর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: