সিডনী বুধবার, ১৭ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১


আশুরার যেসব করণীয় বর্জনীয়! : মুফতী মাহমুদ হাসান


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২০ ০০:২৩

আপডেট:
৩০ আগস্ট ২০২০ ০০:২৪


আশুরা আরবী শব্দ। ‘আশারাতুন’ শব্দমূল থেকে নির্গত। এর শাব্দিক অর্থ দশম। আরবী ক্যালেন্ডারের হিজরী বর্ষের প্রথম মাস মুহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা।
ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে আশুরা অনন্য।কিন্তু আমাদের সমাজে এ দিবসকে কেন্দ্র করে ঘটে যাচ্ছে ইসলাম সমর্থন করে না এমন অনেক কাজ।বিভিন্ন মিথ্যা ঘটনাবলীর বর্ণনা ও মানবরচিত কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালিত হয় এ দিবস। 
আমরা অধিকাংশ মানুষই জানি না, এ দিবসের পালনীয় এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো কী? জানি না, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে এ দিবস কীভাবে পালিত হতো? তাই আজ আমার গুরুত্বপূর্ণ এ প্রবন্ধে কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর আলোকে আশুরা দিবসের পালনীয় এবং বর্জণীয় বিষয়গুলো উপস্থাপনের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

আশুরার তাৎপর্য:
মহান আল্লাহ বছরের যে কয়েকটি দিনকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, তার মধ্যে আশুরা বা মহররমের ১০ তারিখ অন্যতম। 
আশুরার অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। তাৎপর্য সম্পর্কে একটি হাদীস উল্লেখ করছি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার পর দেখলেন, ইহুদীরা আশুরার দিন রোযা রাখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে রোযার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তারা বলেছিল, এটি মহিমান্বিত একটি দিন। এই দিনে মুসা আ. ও তার কওম নিস্তার পান। আর ফেরআউন ও তার দল ডুবে মারা যায়। সেই থেকে মুসা আ. শুকরিয়াস্বরূপ এই দিনে রোযা রাখতেন। সে হিসেবে আমরাও রোযা রাখি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুসা আ.-এর ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমরা অধিক হকদার। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও রোযা রাখলেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখার নির্দেশ করলেন।’
- (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৩৯০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৬৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১২৫)

 

আশুরা মানে কারবালা নয়:
অনেকেই না বুঝে অথবা ভ্রান্ত প্ররোচনায় পড়ে আশুরার মূল বিষয় কারবালার ঘটনাকেই মনে করে। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক নয়। ইসলামের আগমনের পূর্বে আশুরা ছিল। যেমন 
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সা.)-এর কাছে আশুরার দিবস সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন, এই দিন জাহেলি যুগের লোকেরা রোজা রাখত...। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৪২)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসুল (সা.)-ও আশুরার রোজা রাখতেন। (সহিহ মুসলিম : ২৬৩২)।
ইহুদীরা মুছা আ. এর বিজয়ের স্মরণে আশুরার সওম পালন করত। আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশুরার সওম পালন করেছেন জীবনের প্রতিটি বছর। তার ইন্তেকালের পর তার সাহাবায়ে কেরাম রা. আশুরা পালন করেছেন। রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হিজরী ৬১ সালে ১০ ই মুহররম কারবালার ময়দানে জান্নাতী যুবকদের নেতা, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রিয় নাতী সাইয়েদুনা হুসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা একটা হৃদয় বিদারক ঘটনা। ঘটনাক্রমে এ মর্মান্তিক ইতিহাস এ আশুরার দিনে সংঘঠিত হয়েছিল। 
আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা) ও তার সাহাবায়ে কেরাম যে আশুরা পালন করেছেন ও যে আশুরা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য রেখে গেছেন তাতে কারবালার ঘটনার কোন ভূমিকা ছিলনা। থাকার প্রশ্নই আসতে পারেনা। 
কাজেই আশুরার সুমহান ঐতিহ্যকে ‘কারবালা দিবসে’র ফ্রেমে বন্দি করা শুধুই সত্যের অপলাপ নয়; একই সঙ্গে দুরভিসন্ধিমূলকও!

আশুরার দিন করণীয়:

১.আশুরার দিন রোজা রাখা।এর ফজিলত সম্পর্কে রসুল সা বলেছেন:

عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ ‏”‏ ‏

আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আশূরার দিনের রোযার দ্বারা আমি আল্লাহর নিকট বিগত বছরের গুনাহ মাফের আশা রাখি।
সহিহ মুসলিম হাদিস নং ১১৬২
জামে তিরমিজি হাদিস নং৭৫১

আশুরার রোজার পদ্ধতি:

আশুরার দু'টা রোজা রাখবে।রোযা, ৯ ও ১০ ই মুহররম রাখবে অথবা ১০ ও ১১ তারিখে রাখবে।
হাদীসে এসেছে,

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا، أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরার রোযা রাখ ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২১৫৪, ১/২৪১]
২. এই দিন  বেশী বেশী তাওবা-ইস্তিগফার করা। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুহাররম হলো আল্লাহ তা‘আলার (নিকট একটি মর্যাদাবান) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন। (তিরমিযীঃ নং ৭৪১)
৩. দীনের খাতিরে এই দিনে হযরত হুসাইন রাযি. যে ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রদর্শন করেছেন তা থেকে সকল মুসলমানের দীনের জন্য যে কোন ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী পেশ করার শিক্ষা গ্রহণ করা।
৪.সম্ভব হলে উক্ত দিনে যারা রোজা রাখবে তাদের এক বা একাধিকজনকে ইফতার করানো। সাধ্যমত দান-সাদাকাহ করা। গরিবদেরকে পানাহার করানো। ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলানো ও তাদের ও সহযোগীতায় পাশে এসে দাঁড়ানো।

আশুরাই যা বর্জনীয়:

১. তা’যিয়া বানানো অর্থাৎ, হযরত হুসাইন রাযি. এর নকল কবর বানানো। এটা বস্তুত এক ধরণের ফাসেকী শিরকী কাজ। কারণ মূর্খ লোকেরা ‘হযরত হুসাইন রাযি. এতে সমাসীন হন’ এই বিশ্বাসে এর পাদদেশে নযর-নিয়ায পেশ করে, এর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায়, এর দিকে পিঠ প্রদর্শন করাকে বেয়াদবী মনে করে, তা’যিয়ার দর্শনকে ‘যিয়ারত’ বলে আখ্যা দেয় এবং এতে নানা রকমের পতাকা ও ব্যানার টাঙ্গিয়ে মিছিল করে; যা সম্পূর্ণ নাজায়িয ও হারাম। এছাড়াও আরো বহুবিধ কুপ্রথা ও গর্হিত কাজের সমষ্টি হচ্ছে এ তা’যিয়া। (ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৫/২৯৪,৩৩৫, কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৩২, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৩)
স্মর্তব্য: তা’যিয়ার সামনে যে সমস্ত নযর-নিয়ায পেশ করা হয় তা গাইরুল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয় বিধায় তা খাওয়া হারাম। (সূরা মাইদাহঃ ৩)
২. মর্সিয়া বা শোকগাঁথা পাঠ করা, এর জন্য মজলিস করা এবং তাতে অংশগ্রহণ করা সবই নাজায়িয। (ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৫/২৯৪, কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৩২, ৪২)
৩. ‘হায় হুসেন’, ‘হায় আলী’ ইত্যাদি বলে বলে বিলাপ ও মাতম করা এবং ছুরি মেরে নিজের বুক ও পিঠ থেকে রক্ত বের করা। এগুলো করনেওয়ালা, দর্শক ও শ্রোতা উভয়ের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। (আবূ দাউদ, হাঃ নং ৩১২, ইবনে মাজাহঃ হাঃ নং ১৫৮৪)
৪. কারবালার শহীদগণ পিপাসার্ত অবস্থায় শাহাদতবরণ করেছেন তাই তাদের পিপাসা নিবারণের জন্য বা অন্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এই দিনে লোকদেরকে পানি ও শরবত পান করানো। (ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৫/২৮৯, কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৪০)
৫. হযরত হুসাইন রাযি. ও তাঁর স্বজনদের উদ্দেশ্যে ঈছালে সাওয়াবের জন্য বিশেষ করে এই দিনে খিচুড়ি পাকিয়ে তা আত্মীয়-স্বজন ও গরীব মিসকীনকে খাওয়ানো ও বিলানো। একে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ যেহেতু নানাবিধ কু-প্রথায় জড়িয়ে পড়েছে তাই তাও নিষিদ্ধ ও না-জায়িয। (কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৪০)
৬. হযরত হুসাইন রাযি.-এর নামে ছোট বাচ্চাদেরকে ভিক্ষুক বানিয়ে ভিক্ষা করানো। এটা করিয়ে মনে করা যে, ঐ বাচ্চা দীর্ঘায়ু হবে। এটাও মুহাররম বিষয়ক কু-প্রথা ও বিদ‘আত। (ইসলাহুর রুসূম)
৭. তা’যিয়ার সাথে ঢাক-ঢোল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো।(সূরায়ে লুকমানঃ ৬)
৮. আশুরার দিনে শোক পালন করা; চাই তা যে কোন সূরতেই হোক। কারণ শরীয়ত শুধুমাত্র স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীর জন্য ৪ মাস ১০ দিন আর বিধবা গর্ভবতীর জন্য সন্তান প্রসব পর্যন্ত এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতে সর্বোচ্চ ৩ দিন শোক পালনের অনুমতি দিয়েছে। এই সময়ের পর শোক পালন করা জায়িয নেই। আর উল্লেখিত শোক পালন এগুলোর কোনটার মধ্যে পড়ে না। (বুখারীঃ হাঃ নং ৫৩৩৪, ৫৩৩৫, ৫৩৩৬, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৪)
উল্লেখ্য যে শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত শোক পালনের অর্থ হলো শুধুমাত্র সাজ সজ্জা বর্জন করা। শোক পালনের নাম যাচ্ছেতাই করার অনুমতি শরী‘আতে নেই। (দুররে মুখতারঃ২/৫৩০)
৯. শোক প্রকাশ করার জন্য কালো ও সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক পরিধান করা। (ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৪, মুফতী মানসুরুল হক।)
১০. এই দিনের গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করার জন্য মিথ্যা ও জা‘ল হাদীস বর্ণনা করা। কারণ হাদীসে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীকে জাহান্নামে ঠিকানা বানিয়ে নিতে বলা হয়েছে। (বুখারীঃ হাঃ নং ১০৭)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সমস্ত সকল প্রকার শিরক,বিদ'আত ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থেকে রসুল সা যেভাবে আশুরা পালন করেছেন সেভাবে পালন করার তাওফীক দান করুক। আমীন।

 

মুফতী মাহমুদ হাসান। 
দারুল হাদীস (এম.এ,ইসলামিক স্টাডিস)
জামিয়াতুল আবরার বসুন্ধরা ঢাকা।
আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ(অনার্স) ঢাকা।
দারুল ইফতা (ইসলামিক আইন ও গবেষণা বিভাগ) ঢাকা।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top