সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

সুন্দরবন : শাহানারা পারভীন শিখা 


প্রকাশিত:
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৩০

আপডেট:
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫৩


হঠাৎ করেই ঠিক হলো সুন্দরবন যাওয়ার। তড়িঘড়ি করে প্রস্তুতি নিতে হলো। দশ সিটের একটা মাইক্রো বাস ভাড়া নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে সদলবলে রওনা দিই খুব সকালে। গাড়ি ছুটে চলেছে। তেমন একটা জ্যাম পাইনি ঢাকার মধ্যে। শহর ছেড়ে মাওয়া রোডে গাড়ি চলছে। এক্সপ্রেস হাইওয়ে। কি অবাক ব্যাপার! এটা আমাদের দেশের রাস্তা। ভাবতেই ভালো লাগছে। ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। এপথের শেষেই আছে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম ঘাটে। সিরিয়ালে বসে আছি গাড়িতে। অধীর অপেক্ষা সবার। কখন ফেরিতে উঠবো! আর দুচোখ মেলে দেখবো পদ্মা নদীর রূপ আর স্বপ্নের সেতু। অপেক্ষা আর শেষ হয় না। ঢাকা থেকে মনে হলো উড়ে চলে আসলাম আধা ঘন্টার মধ্যে। আর ঘাটে এসে বসে আছি প্রায় ঘন্টা দেড়েক। ক্লান্তির শেষ পর্যায়ে ড্রাইভার জানালো ফেরির সিরিয়াল মিলেছে। এখনই আমরা ফেরিতে উঠবো। নিমিষেই সবার ক্লান্তি উধাও।
অবশেষে আমরা ফেরিতে। ভাগ্য হয়তো প্রশন্ন ছিল সেদিন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা শেষে আমরা একটা ভি আই পি ফেরি পেয়েছিলাম। অল্প কিছু ছোট গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। দূর থেকে দেখি পদ্মা সেতু। নদীর এপার থেকে ওপার ছুঁয়ে আছে সেতু। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি আমি। পেছনে ব্যস্ত ঘাট চোখে পড়ে। এঘাট ওঘাটে ছোট বড় ফেরি থেমে আছে। কোনটা চলছে। সীমাহীন ব্যস্ততা। সেদিকে তাকিয়ে মনে হলো এই ব্যস্ততা, কোলাহল সব থেমে যাবে একসময়। এপথের প্রয়োজন যখন আর থাকবে না তেমন। ভি আই কেবিনটা আমরা নিয়েছিলাম সেদিন। সবাই একটু ফ্রেশ হয়েই ফেরির ডেকে চলে আসি। দূর থেকেই দেখি স্বপ্নের সেতু।
নদীর চারপাশ ঘিরে ব্যপক কর্মজজ্ঞ চলছে। হঠাৎ বাচ্চাদের চিৎকার" পদ্মা সেতু"। চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পাই পদ্মা সেতু। একদম কাছে। যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যায়। ফেরি ঘাটে পৌঁছে যায়। নেমে আসি আমরা।



মাওয়া ঘাট পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। পেছনে পড়ে রইল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এপারেও ঝকঝকে তকতকে হাইওয়ে এক্সপ্রেস রাস্তা। রাস্তার দুপাশের চমৎকার প্রকৃতিতে চোখ ফেলার আগেই পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
এতো চমৎকার প্রকৃতি ক্যামেরা বন্দী করতে চাইলাম। ছুটে চলা গাড়িতে বসে সেটা বেশ কঠিন। বেশ ফুরফুরে মেজাজে চলেছি সবাই। খুলনা পার হয়ে বিকেলের আগেই আমরা মোংলা কোস্ট গার্ড পেরিয়ে ডিগরাজে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি আমাদের রেখে ফিরে যায়।
সামনে পশুর নদী। সবাই হৈ চৈ করতে করতে ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকায় চড়ে বসি। নদীর সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয়। অদূরেই মোংলা বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি জাহাজ চোখে পড়ে। ছোট বড় নৌকা ছুটে চলেছে এপথে। নদীর ওপারে পা রাখি। সুন্দরবন।

সাধারণত সবাই জাহাজে করে সুন্দর বনের যে দিকটায় ভ্রমণ করে। এটা সম্পূর্ণ অন্য সাইডে। এই এলাকার নদীর একপাশে বসতি আর অপর পাড়ে বন। সম্পূর্ণই আলাদা। ঘাটে পৌঁছেই একটু অবাক হলাম। আধুনিক জীবন যাপনের বহু আয়োজন চোখে পড়লো এবার। টিভি ফ্রীজের দোকান থেকে শুরু করে সবই আছে ঘাট সংলগ্ন বাজারে। ভেবেছিলাম গতবারের মতো খোলা ভ্যানে পা দুলিয়ে দুলিয়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাবো। তা আর হলো না। এবার চলছে ব্যাটারী চালিত অটো। অটোগুলো আমাদের নিয়ে শা শা করে উড়ে চলছে মনে হলো, চওড়া রাস্তা ধরে। বনের ধার দিয়ে যাচ্ছি। আর অবাক হচ্ছি। গহীন অরন্য সংলগ্ন এলাকায় মানুষের জীবন যাপন এখন বেশ সহজ। অবশেষে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।

'অনিন্দ্য এ্যাগ্রো ফার্ম '- বড় ভাইয়ের প্রোজেক্ট। এখানেই আছে ভাইয়ের দুতলা বাংলো বাড়ি। আছে শান বাঁধানো ঘাট। রাস্তার সাথে ছোট ভদ্রা নদী। নদীর একপাড়ে সুন্দরবন। অপর পাড়ে বাড়ি। নয়নাভিরাম দৃশ্য চারপাশে। দুতলার সুবিশাল বেলকনিতে বসেই দেখি পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। প্রথম যেবার এসেছিলাম তখন এই বারান্দায় বসেই দেখেছি বনের গাছে গাছে বানরের লাফালাফি। সবাই ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পুকুরের উপরে বানানো টি হাউজে যেয়ে বসি।

বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সারি সারি পুকুর। পানিতে অস্ত যাওয়া সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। অন্য এক আবেশ জাগানিয়া সে দৃশ্য। এখানে আসার পরই আমাদেরকে সতর্ক করা হলো যে, সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকাটা খুব বেশি নিরাপদ হবে না। কারণ এই এলাকার আশেপাশে এবার বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেছে।

ওপারে বন এপারে বসতি। বাঘের চলাচল এই এলাকায় এমনিতেই আছে। এই এলাকার প্রতিটি বাড়ির সাথেই বাঘের কোন না কোন ঘটনা আছেই। আমাদের যে রান্না করে ওখানে। তার বৌ কে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে ক বছর হয়। কারো ছাগল। কারো বাছুর। ভাইয়ের প্রোজেক্টেও এসেছে বেশ ক'বার। এমনিতেই এসব এলাকায় সন্ধ্যার পর সবার চলাচল মোটামুটি কম। তবে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে আসাতে মানুষের মাঝে সাহস একটু বেড়েছে। সন্ধ্যায় বাচ্চারা বাড়ির সামনে ব্যাডমিন্টন খেলে হৈ হল্লা করে। কিন্তু রাস্তায় উঠা বারণ।

সবাই ক্লান্ত। তাই একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পরি সবাই। পর দিন ভোর না হতেই ঘুম ভাঙলো বিদঘুটে স্বরে দুটো পাখির চিৎকারে। একটা ডাক শেষ হয় তো আরেকটা শুরু করে। চললো ভোর পর্যন্ত। সকালে জানলাম ওদুটো ঈগল পাখি। বাসা বেঁধেছে ঠিক বাড়ির সামনের বনের দুটো গাছের মগডালে। সারারাত গাছে থাকে। সকাল হতেই হাজির হয়ে যায় ভাইয়ের প্রোজেক্টের গাছে। উদ্দেশ্য মাছ চুরি। প্রজেক্টের সবাই খুব বিরক্ত। ঘেরের মাছ সাবাড় করে দিচ্ছে।



খুব সকালে উঠে আমি বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। সামনেই ভদ্রা নদী।ভাটা তখন। তারপরও দু'একটা খেয়া নৌকা চলছে জীবিকার প্রয়োজনে। ওপারে গহীন বন। চারদিকে পাখিদের কলতান। ছোট মোবাইলটা হাতে নিয়ে ছবি তুলি।

সাত সকালেই কর্মময় জীবন যাপনের চিত্র চোখে পড়ে।মহিলারা বেশ কর্মঠ। খালি পায়ে হালকা শীতের চাদর গায়ে চাপিয়ে মহিলারা তাদের গরু গুলোকে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে দল বেঁধে। চমৎকার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে থাকি আমি।এখানকার মানুষজন খুবই সহজ সরল। আমাকে ছবি উঠাতে দেখে বয়স্ক একজন পুরুষ অচেনা এই আমাকে ডেকে বলে, "আমার ও ছবি তোল। শুধু বনের ছবি তুললি কি হবি। আমরাও তো বনেরই মানুষ। কোথায় দাড়াতে হবি বলো।"
আমি হেসে কয়েকটি ছবি তুলি সেই কাকার। কি সারল্য এদের জীবনে!


প্রতিকূল পরিবেশে কষ্টকর জীবনের মধ্যেও এদের হাসিমুখ দেখে মনটাই ভরে যায়। অল্প চাওয়া পাওয়া নিয়েও এরা কত সুখী। যেটা হাজারো পাওয়াতেও মেলে না। এই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় প্রায় প্রতিটি পরিবারের আছে শিক্ষিত সন্তান। ছেলেমেয়েরা সবাই বেশ কষ্ট করই লেখাপড়া করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। চাকুরী করছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রথমবার যেয়েই খুব অবাক হয়েছিলাম। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এরা পরাজিত হয়নি। একটা এলাকার কিংবা পরিবারের উন্নতির জন্য এটা খুবই জরুরি।
সুন্দরবনে আমরা ছ' দিন ছিলাম। নিজেদের বাড়ি। শান বাঁধানো পুকুরে গোসল। বিশাল বিশাল পুকুরের মাছ ধরা দেখা।বিশাল সাইজের চিংড়ি মাছ। যাকে সাদা সোনা বলা হয়। বিকেলের সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য এসব দেখেই আমাদের দিনগুলো কেটে যায় মহা আনন্দে। আনন্দটা এবার একটু অন্য আঙ্গিকে এসেছিল। বড় ভাই ভাবীর তিরিশ তম বিবাহ বার্ষিকীটা এবার এখানে করা হলো। টি হাউজ টাকে বেলুনে সাজিয়ে, স্থানিয় বাজার থেকে কেনা সন্দেশকে কেকের মতো সাজিয়ে হৈ হুল্লোড় করে চললো উদযাপন। আমাদের সাথে সামিল ছিল এই প্রজেক্টে কর্মরত সকলে। ওদের নিরানন্দ জীবনে নিখাদ একটা আনন্দের সময় পেয়ে ওরাও খুব খুশি।
সবার জন্য ছিল বারবিকিউ পার্টি। প্রজেক্টের পুকুর থেকে জ্যান্ত মাছ ধরে রান্না হোত প্রতি বেলা। বিশাল বড় বড় গলদা চিংড়ি, বিশাল ভেটকি মাছ আরো আরো কত কত মাছ। ছিল রাজ হাঁস, দেশি হাঁস, দেশি মুরগী আরো নানা আয়োজন। দূর গ্রাম থেকে খুঁজে আনা টাটকা খেজুর রস ডায়াবেটিস ভুলে খেয়েছি কয়েক গ্লাস।
আনন্দের কোনই কমতি ছিল না।

এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ধানের এবার ব্যপক ফলন ওখানে। বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে শুধুই ধান কাটার চিহ্ন। প্রতিটি বাড়ির সাথেই খড়ের গাদা নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে রাখা চোখে পড়লো। বনবিবির পুজোটা দেখার ইচ্ছে ছিল এবারও। গতবার দেখেছিলাম। হিন্দু মুসলমান সবাই এই আনন্দ আয়োজনে অংশ নেয়। এই পূজোর মূল উদ্দেশ্য, সমস্ত অমঙ্গলের হাত থেকে যেন এই এই এলাকার মানুষ রক্ষা পায়। জমজমাট সেই পূজার উৎসব।
আমরা চলে আসার দিন চারেক পরেই এই পূজো হবে বললো। আফসোস হলো খুব। প্রতিবার যেয়ে আমরা নদীতে ছোট নৌকা নিয়ে সামনের নদীতে আর ছোট খাড়ি দিয়ে বনের ভিতরে ঘুরেতে যাই। এবার বাঘের ভয়ে এসব বন্ধ। সবারই মন বেশ খারাপ এজন্য।

শুধু ফিরে আসার আগের দিন কাছের ফরেস্ট অফিসে যাই আমরা। বনের সাথে অফিস। নৌকা দিয়ে পার হয়ে আমরা ওখানে যাই। সামান্য ভেতরে যেয়ে ছবি তুলে দ্রুতই ফিরে আসি। এপারে এখানকার পূজোর ঘরটা চোখে পড়ে। যেখানে বনবিবির পূজো দেখেছিলাম সেবার। এগিয়ে যেয়ে দেখি সেখানে চমৎকার রাধা কৃষ্ণের যুগলমূর্তী রাখা। কি নিখুঁত ভাবে তৈরি। ভক্তি ভালোবাসায় তৈরি সে প্রতিমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেই হয়।



এবার ফেরার পালা। মনটা সবারই খারাপ। মায়াময় প্রকৃতি ছেড়ে আবারও ফিরতে হবে কাঠখোট্টা শহুরে জীবনে। দ্রুত বেগে ছুটে চলা অটোতে বসেই মন ভরে দেখে নিচ্ছি হাত বাড়িয়েই ধরতে পারা সুন্দরনকে।প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় জবা আর হলুদ গাদা ফুলের সমারোহ। মুগ্ধ হয়ে দেখছি আমি। হঠাৎ বনের গোলপাতার ফাঁকে ফাঁকে রাখা বনবিবির পূজোর জন্য তৈরি সব মূর্তিগুলোর দিকে চোখ পড়ে। ইচ্ছে ছিল কাছে যেয়ে ছবি তুলে আনার। কিন্তু চলতে চলতে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
বিস্তীর্ণ মাঠ, বন, বসতি পেরিয়ে চলে আসি নদীর ঘাটে। পশুরনদী পেরিয়ে আবারও মাইক্রোবাসে চেপে বসা।
আবারও স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখতে দেখতে। হাইওয়ে এক্সপ্রেস ধরে দীর্ঘ যাত্রা শেষে ঢাকায় ফিরে আসা।
আবারও কর্মচাঞ্চল্য। ব্যস্ত জীবন। শুধু সাথে রইল সুন্দরবন ভ্রমনের আনন্দ। আবারো দুচোখে স্বপ্ন। এরপর কোন এক সময় আবারও আমরা আমাদের স্বপ্নসেতুর উপর দিয়ে যাবো অনেক প্রিয় জায়গা সুন্দরবন ভ্রমনে।



শাহানারা পারভীন শিখা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top