সিডনী রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঘুরে এলাম বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মাসেতু : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২২ ০২:৫৮

আপডেট:
৩১ আগস্ট ২০২২ ০২:৫৯

 


বেশ কিছু দিন হলো গরমের ছুটিতে উড়িষ্যার চাঁদিপুর, কুলডিহার জঙ্গল ঘুরে এসেছি। তবুও মন, কোথাও যাই যাই করছে। সামনে রথের ছুটি ছিল শুক্রবারে, শনিবার একটা সি, এল নিলে তিন দিনের এক মুক্ত জীবনের সফর। হঠাৎ ঠিক করলাম, রথের দিন কোলকাতার একেবারেই কাছে বাংলাদেশে খুলনা শহরে তিন দিনের জন্যে যাব। অল্প খরচে, আট থেকে আশির বিদেশ ভ্রমণের একমাত্র স্বপ্নপূরণের আদর্শ ঠিকানা, বাংলাদেশের রূপসা নদীর তীরে খুলনা শহর। যেমন ভাবা, তেমনিই কাজ। যাওয়ার দিন ঠিক হল রথের দিন। অবশেষে রথের উৎসবে সবাই যখন মেতে উঠেছে, তখন কাকভোরে কিছু হালকা পোশাক ও সামান‍্য‍ লাগেজ সহ শিয়ালদহ থেকে ভোর ৪-১৫ এর শিয়ালদহ-বনগাঁ লোকালে চেপে দুজন রওনা দিলাম, বনগাঁ সীমান্ত-এর পেট্র্রোপোলের দিকে। বারাসাত, হাবড়া, ঠাকুর নগর, চাঁদপাড়া হয়ে আমরা সকাল ৬-৩০ এ বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছলাম। সময় লাগল ১ ঘন্টা ৫৬ মিনিট। দূরত্ব ৭৭কি, মি। ভাড়া প্রতি জনে ২০টাকা। এরপর চারজনে একটি অটো রিকশা নিয়ে রওনা দিলাম পেট্র্রোপোলে।

অপরূপ বনগাঁ শহরের যশোর রোডের হৃদয় ছুঁয়ে নানান বর্ণময় প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মিনিট কুড়ির মধ‍্য‍ পৌঁছে গেলাম এপার বাংলার সীমান্ত‌ শহর বনগাঁর পেট্র্রোপোলে। দুই দেশের চেক পোস্টে ইমিগ্রেশনের দরকারি সমস্ত কাজ সেরে বাংলাদেশে প্রবেশ করার জন‍্য, জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছি ।কয়েক মিনিট পরে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ও কবি জীবনানন্দের রূপসী বাংলার দেশে পা রাখব। এ এক অন‍্য অনুভূতি। সীমান্ত রেখার দুইপারে দাঁড়িয়ে আছে দুই দেশ। একভাষা ও সংস্কৃতি। সীমান্ত বিভাজনে শুধু কাঁটা তাঁরের বেড়া‌। সীমান্তের দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা বলছে, দু'দেশের মানুষের মনে ও হৃদয়ে কোন বেড়াজাল দেখলাম না।

সকাল ৯টায় প্রবেশ করলাম বাংলাদেশের সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ পৌর ও বাণিজ‍্য‍ শহর বেনোপলে। এখান থেকে খুলনা জেলার দূরত্ব ১৬০ কিমি। টিফিন সেরে একটি বাসে উঠে পড়লাম। আমাদের গন্তব্যস্হল যশোর শহর, দূরত্ব মাত্র ৩৮ কিলোমিটার জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। বাংলাদেশের বাসের ভাড়া খুব বেশি বলে মনে হল‌। যাত্রা শুরু হল। বাসে খুলনার শিক্ষিত এক তরুণের কাছে খুলনার ভূগোল ও প্রশাসনিক বিষয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করলাম। বেনোপোল সীমান্তে -এ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দৃষ্টিনন্দন বড় বড় ছবি শোভা পেতে দেখলাম। হঠাৎ অসাধারণ একটি বাংলাদেশের ব্র্যাণ্ডের ক্যাপশান চোখে পড়লো। 'নানা রঙের ফুলের মেলা, খেজুর গুড়ে যশোর জেলা'। পড়ে মুগ্ধ হলাম। শুনেছিলাম যশোর খেজুর গুড়, কৈ মাছ আর ফুলের শহর। প্রকৃতি দু'হাত ভরে এই জেলাকে সাজিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। সামনে বাংলাদেশের জাতীয় সড়ক যশোর রোড। ১৯৭১ এর মুক্তি যুদ্ধের নীরব সাক্ষী।
যশোর রোডের দুই দিকের সুপ্রাচীন গাছ গুলো দু'বাহু জড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। যাত্রা পথের বাংলাদেশের গ্ৰামীন প্রকৃতির রূপ, এক কথায় অনুপম। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সত্যিই রূপসী বাংলার দেশ যশোর-খুলনা।


কোন পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎই বাংলাদেশে চলে এসেছিলাম। আসলে মনজুড়ে ছিল সদ্য উদ্বোধন হওয়া পদ্মা সেতুর টাটকা ছবি আর পদ্মার টাটকা ইলিশের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। রূপসী বাংলার দেশের প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করতাম। সতেরো কোটির দেশ। ৬৪টি জেলা। বর্ষায় রূপসী বাংলাদেশ বেশ আকর্ষণীয়। এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছলাম যশোর শহরে। দুপুরের খাবার পর্ব সারলাম। ভৈরবী নদীর তীরে যশোর শহর। সারাদিন যশোর ঘুরে মহানন্দ এক্সপ্রেসে খুলনা পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা নামতে চলেছে। খুলনার রেল স্টেশনের নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম। যাত্রাপথে ট্রেনের জানলা দিয়ে বাংলাদেশের পল্লীপ্রকৃতির রূপ উপভোগ করলাম।

যশোর-খুলনার ট্রেনে লাইনের দুপাশের সৌন্দর্য অসাধারণ। ধান, আম, জাম, কাঁঠাল, শিরিষ, খেজুর, তাল, শিমুল, নারকেল, কলাগাছ দিয়ে পরপর সাজানো ক্ষেত ও বাহারি দেশি বিদেশি ফুলের বাগান দেখে মনে হল, প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে এখানে রংমেলান্তি খেলা খেলছে। খুলনার শহরের রতন কুমার নাথের কাছে জেনেছিলাম, রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের বহু বর্ণময় স্মৃতির সাক্ষী খুলনা। এটি সাহিত্য, শিল্প -সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ‍্যের সুপ্রাচীন বর্ণময় শহর।
বাংলাদেশের শিল্পনগরী খুলনা বাংলাদেশের তৃতীয় মেগাসিটি। আগামীকাল কাকভোরেই বাংলাদেশের গর্ব পদ্মানদীর সেতু দেখতে যাব। গত ২৬শে জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। টিফিন পর্ব সারলাম। বাগেরহাটের অমিত হালদার আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলল রূপসা নদীর বিখ্যাত সেতুর দিকে।

সন্ধ্যায় এসে পৌঁছলাম রূপসা নদীর তীরে একটি অসাধারণ বিনোদন কেন্দ্রে। সূর্য ডুবতে চলেছে, ধীরে ধীরে চাঁদের আলোয় অপরূপা হয়ে উঠছে রূপসার বুক। জ‍্যোৎস্নায় মায়াবী লাগছিল। শুভ্র জ‍্যোৎস্না যেন নদীর বুকে আল্পনা এঁকে এঁকে চলেছে‌। ছোট্ট ডিঙ্গিনৌকা গুলো হাওয়ায় দুলছে। শহর থেকে নদীর তীর ধরে একটু এগিয়ে গেলাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রূপসা। তীরের গা ঘেঁষে সবাই বসলাম। নির্বাক। দূরে নির্জন প্রকৃতি আর জনমানুষ, পাখপাখালির আনাগোনা যেন রঙতুলি দিয়ে ক‍্যানভাসে কেউ ছবি এঁকে চলেছে। তিরতির করে বয়ে চলেছে নদী আপন খেয়ালেই। আলোর বন‍্যায় তখন গোটা শহর ভাসছে। এ এক অন‍্যভুবন। মজে যাওয়া রূপসা বর্ষায় নতুন করে, নব জীবন লাভ করেছে। সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। আমরা এখানে টিফিন খেলাম স্থানীয় মিষ্টি, রসগোল্লা ও খেজুর গুড়ের পেড়া দিয়ে। পরম তৃপ্তিতে মন ভরে গেল। খুলনায় সারাদিন ঘুরে কখনও একবারও আমাদের মনে হয়নি‌, আমরা অন‍্য দেশের মানুষ, শুধু তিনদিনের ক্ষণিকের অতিথি। এ যেন নিজের দেশ‌। দুই দেশ, কিন্ত একভাষা ও সংস্কৃতি। আসলে দুই বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে কোন বেড়াজাল নেই। এখানকার মানুষের অমায়িক ব‍্য‍বহার ও আথিথেয়তায় আমরা আপ্লুত হলাম। আনন্দমুখর রূপসা সেতুতে অনেক সময় কাটিয়ে রাত ১২ টায় ফিরলাম হোটেলে। রাতের খাওয়া সেরে তিনতলার রুমের ব্যালকনি থেকে রাতের অপরূপা, মায়াবী খুলনা শহর দেখছি।

বাংলাদেশের শিল্পনগরী খুলনা জেলার একটি বিখ্যাত নদী রূপসা। বাংলাদেশের রূপসার তীরে আমি ক্ষণিকের অতিথি ছিলাম। আমার শৈশব কেটেছে সুন্দরবনের রায়মঙ্গল- বিদ্যাধরীর তীরে। তাই নদীর প্রতি আকর্ষণ ও মাদকতা আর অপার ভালোবাসা ছিল। সময় সুযোগ পেলেই আমি নদীর তীরে সময় কাটাতাম।

বাংলাদেশের পল্লীপ্রকৃতির রূপ একবারেই অনিন্দ্যসুন্দর। শুধুই মুগ্ধতার আবেশ। আসার সময় ট্রেনের জানলা দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদগুলির অন্দরমহলের রূপ উপভোগ করার আনন্দ বহুদিন মনে অমলিন থাকবে হয়ত! যেন জীবনশিল্পীর আঁকা গ্রাম। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের পসরা নিয়ে অপেক্ষারত। দেহ-মন ভরে গেল। আহা! কি দেখিলাম জন্ম জন্মান্তরে ভুলব না হয়ত ! রাত বাড়ছে ক্রমশ। রাতের রূপসী রূপসার রূপ একবারেই মোহনীয়। শুনেছিলাম রূপসা সেতু, খুলনা জেলার দর্শনীয় স্থানগুলির অন্যতম। রাতের রূপসা এক কথায় অনিন্দ্যসুন্দর। রূপসা গঙ্গার একটি শাখা নদী। নদীটি প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। নদীটি ভৈরব নদ থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং পরবর্তিতে পশুর নামে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের দিকে গেছে। রূপসা নদীটি খুলনা শহরের জেলখানা ঘাট এলাকায় প্রবহমান ভৈরব নদ হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। তারপর এই নদীর জলধারা একই উপজেলার জলমা ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে কাজিবাছা নদীতে পড়ছে। নদীটি প্রায় সারা বছরই জল থাকে এবং ছোটবড় নৌযান চলাচল করে। বর্ষায় রূপসার রূপের মধ্যেই একটা বাড়তি লাবণ্য থাকে। রূপসা মূলত বর্ষার জলে যুবতী হয়ে ওঠে।

বর্ষায় জলে প্রবাহ বেড়ে যায়, যার ফলস্বরূপ নদী তীরবর্তী এলাকা বন্যার জলে প্লাবিত হয়। এই নদীটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রথম শ্রেণীর নৌপথ হিসেবে স্বীকৃত। রূপসা নদীটি জোয়ার ভাটার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এই নদীর উৎপত্তির ব্যাপারে একটা জনশ্রতি আছে যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে নড়াইল জেলার ধোন্দা গ্রামের রূপচাঁদ সাহা নামের এক লবণ ব্যবসায়ী নৌকায় যাতায়াতের সুবিধার জন্য ভৈরব নদের সঙ্গে কাজীবাছা নদীর সংযোগ করার জন্য একটি খাল খনন করেছিলেন। আর সেই রূপচাঁদ সাহার নাম অনুযায়ীই ওই খালের নাম হয়েছিল রূপসা খাল। যা পরবর্তীকালে ভৈরব নদের প্রচন্ড প্লাবনের কবলে পরে ছোট খাল থেকে অনেক বড় ও ভয়ংকর নদীতে পরিণত হয়।

তবে এই রূপসা নদী যে শুধু নিজে নদীতে পরিণত হয়েছে তা কিন্তু নয়; বরং কাজীবাছা নদী এর জন্য প্রচণ্ড ভাঙনের মুখে পড়েছে। রূপসা নদীর তীরে গিলাতলা, ফুলতলা বাজার, দৌলতপুর অবস্থিত। আর রূপসা ও ভৈরব নদীর মিলনস্থলেই খুলনা শহর অবস্থিত। রূপসা বাংলাদেশের যশোর-খুলনার জনজীবনের প্রাণের নদী। তিনদিনের ক্ষণিকের সফরে মনে হয়েছে বাংলাদেশে অসংখ্য নদী জালের মত ছড়িয়়ে আছে। তিনটি নদীর কাছে থাকার ও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, যশোরের ভৈরবী, খুলনার রূপসী, আর সকলের স্বপ্নের নদী পদ্মা। নদীর সঙ্গে আমার পরিচয় শৈশব থেকে। রূপে, বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশের নদী গুলো একটু আলাদা মনে হল। নদী গুলো অনেক বেশি ঘরোয়া। জনজীবনের নদী। নানান ঋতুতে রূপসার রূপ বদলে যায়। রাতের রূপসা অনন্য। আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়ছে রূপসার জলে। মায়াবী লাগছিল। রাতের জ্যোস্নার আলোয় রূপসার রূপ একবারেই অনিন্দ্যসুন্দর। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। রাতে হাজার হাজার মানুষ রূপসা সেতুতে উপস্থিত হয়। এ এক অন্যভুবন। দুই বাংলার কাব্য-সাহিত্যে রূপসা অমরত্ব লাভ করেছে। আধুনিক কবিদের কবিতায় রূপসার রূপের বর্ণিল দৃশ্য আমরা পাই।


সাহিত্যের নানা শাখায় রূপসা নদীর প্রসঙ্গ এসেছে। জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায়ও রূপসার কথা বলেছেন-
“হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়; রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে
ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে-।"

৩০০ বছর আগে রূপসা নদী ছিল না। এমনকি আড়াই শ বছর আগে মেজর রেনেলের তৈরি গাঙ্গেয় উপদ্বীপের মানচিত্রেও অনুপস্থিত রূপসা। তবে বর্তমান খুলনার জেলখানা ঘাটটি ভৈরব-রূপসার সংযোগ স্থানে। প্রায় ৩০০ বছর আগে এ পথ দিয়ে লবণ নিয়ে যাতায়াত করতেন নড়াইলের লবণ ব্যবসায়ী রূপচাঁদ সাহা। কাঁচিপাতা আর ভৈরবের মাঝে সামান্য একটু স্থলভাগ বলে ঘুরে যেতে হতো অনেকটা জলপথ। আপাত প্রয়োজন মেটাতে তিনি খাল কেটে সংযোগ তৈরি করলেন ভৈরব-কাঁচিপাতার। নাম হলো রূপ সাহার খাল। আর সেই কাঁচিপাতাই এখন পরিচিত কাজিবাছা নামে। সেই খাল এখন ভৈরবের মূল স্রোত রূপসা নদী। ভৈরবের এক অংশ হরণ করা দাপুটে রূপসাকে সাহিত্যে এনেছেন জীবনানন্দ দাশ। ঘোলা জলে এক কিশোরের সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বেয়ে আসাকে বাংলার প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি হিসেবে কল্পনা করেছিলেন তিনি। যেখানে অন্ধকারে রাঙা মেঘ সাঁতরে তীরে আসে ধবল বক। এই প্রতাপশালী রূপসার পারে থাকতেন অসামান্য এক মানুষ। যিনি হারানো বাঙালি সংস্কৃতির এক বিশাল অধ্যায় উদ্ধার করেছেন। ঐতিহাসিক তথ্যের মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছেন, এ সংস্কৃতির মূলস্রোত হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মীয় ভাবধারাতেই পুষ্ট। ইতিহাসকে চর্চাযোগ্য ও প্রয়োজনীয় করেছেন শত বছর আগে। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণবিহীন সে কাজে ছিল না কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। যা ছিল তা নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন।তিনি খুলনা জেলার ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র।

পরেরদিন খুব সকালেই বেরোলাম পদ্মা সেতুর দেখার জন্য। সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়ি ধরলাম। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদগুলি। কিছুক্ষণ পরেই গোপালগঞ্জ জেলায় পৌঁছলাম। বঙ্গবন্ধু নিজে জন্মগ্রহণ করেন এই জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। গাড়ি দুরন্ত গতিতে চলছে। মন জুড়েই শুধুই পদ্মা নদীর সেতু। সকাল দশটায় পৌঁছলাম পদ্মা সেতুর অপরপারে। বাংলাদেশের স্বপ্নের ও গর্বের আর এক আকাশ অহংকার পদ্মানদীর সেতু। সমগ্র বিশ্বের আলোচনার বিষয়। ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবেই। মোট দৈর্ঘ্য দশ কিলোমিটার। নদীর উপরের সেতু ৬ কিমি-এর বেশি। এই মুহূর্তে বিশ্বে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ সেতু। ইতিহাসের। নিজের চোখেই দেখার সৌভাগ্য হল--প্রমত্তা পদ্মার বুকে থৈ থৈ জল। স্রোতের গর্জন আর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তেই মৃদু অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করে পদ্মার বুকে। অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই জ্বলে উঠল আলো! স্বপ্নের পদ্মাসেতুতে সংযোজন করা বাতি জ্বলে উঠতেই বর্ণিল রেখার মতো পদ্মার বুকে যেন সৃষ্টি হল আকাশের 'ছায়াপথ'! যে 'পথ' পথ দেখাবে, যে পথ স্বপ্ন জয়ের; বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি (জেলার খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, বরিশাল) দক্ষিণাঞ্চলবাসীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির !

 


পদ্মাসেতুতে জ্বলে উঠা আলোর মুগ্ধতা সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে। আমার মনে হল এ যেন পদ্মার বুকে স্বপ্ন জয়ের প্রদীপ !

সরেজমিনে পদ্মাসেতুর জাজিরা প্রান্তের পদ্মার নদীশাসন বাঁধ, টোলপ্লাজাসহ আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম। শিমুলিয়া নদী বন্দরে আয়েস করে বেগুন ভাজা আর পদ্মার ভাজা ইলিশ খেলাম। অসাধারণ স্বাদ। বহুদিন মনে অমলিন হয়ে থাকবে হয়ত। সামনে স্বপ্নের পদ্মানদী বয়ে চলেছে। স্টিমার ছাড়ছে জেটি ঘাট থেকেই। মানুষের ব্যস্ততা। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়়ে আছি পদ্মার নদীর দিকে। পদ্মানদীর চরে বসতি লক্ষ করলাম। জেলেদের ইলিশ মাছ ধরা দেখলাম।সেতু নিয়ে সাধারণ মানুষের অপরিসীম উচ্ছ্বাস- উন্মাদনা। গত জুনের ২৫ তারিখ সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতুর দ্বার। বেশ কয়েক ঘন্টা কাটালাম পদ্মার কাছে। এবার ফেরার পালা।
সন্ধ্যা নামছে, পদ্মার বুকে সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ কোন দিন ভুলতে পারব না। আমরা ফিরে চলেছি খুলনা শহরে। শহরে পৌঁছলাম রাত আটটা। তারপর খুলনা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্হান গুলো ঘুরলাম। হাতে সময়ের অভাব তাই মেগাসিটি খুলনা ভালভাবে ঘোরার সুযোগ ছিল না। তবু যা দেখলাম তিনদিনে, তাতে মুগ্ধ হলাম। বাংলাদেশ ছেড়ে ফিরব কলকাতায়। খুলনা-কলকাতা বন্ধন এক্সপ্রেসে ফিরব। টিকিট কাটলাম। রাতের খুলনা শহর ঘুরে দেখলাম। সঙ্গে কিছু অমলিন স্মৃতি- কিছু এদেশের বই সংগ্রহ করলাম। এখানকার মানুষের আতিথেয়তা অসাধারণ। আবার আসার ইচ্ছা -হয়তো অন্যভাবে। মাত্র কয়েকদিনের অতিথি ছিলাম বাংলাদেশের। কখনও মনে হয়নি অন্য দেশে এসেছি। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা অসাধারণ। পরেরদিন দুপুরের ট্রেনে কলকাতায় পৌঁছলাম।

কোথায় থাকবেনঃ খুলনা ও যশোরে প্রচুর হোটেল ও গেস্টহাউস আছে।

যাবেন কিভাবেঃ কলকাতা থেকে ট্রেনে-বাসে যশোর-খুলনা।

 


ডঃ সুবীর মণ্ডল
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top