অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি
 প্রকাশিত: 
 ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:০২
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১০:৩৮
                                
বাণিজ্য ঘাটতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১২৭ শতাংশ। এত বেশি বাণিজ্য ঘাটতি এর আগে আর কখনো হয়নি। অস্বাভাবিক হারে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে জিনিসপত্রের আমদানি ব্যাপক হারে বাড়ছে; কিন্তু আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রফতানি আয় সেভাবে বাড়ছে না। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেভাবে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে, এর বিপরীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়লে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঋণাত্মকের প্রভাব আরো বেড়ে যাবে।
আমদানি-রফতানির হালনাগাদ তথ্য নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬৮৭ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৫৬১ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে বাণিজ্য ঘাাটতি বেড়েছে ১২৭ দশমিক ২১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল তিন হাজার ৮৯৭ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল দুই হাজার ৫২২ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ে পণ্য আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৫৪ শতাংশ। কিন্তু যে হারে পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে, সেই হারে রফতানিতে আয় হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পণ্য রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছে দুই হাজার ৩৩৫ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৮৩৫ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ে পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ২৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যও ঋণাত্মক হয়ে গেছে। কারণ, আমদানির তুলনায় রফতানি আয় কমে গেলে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে যায়। চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার অর্থই হলো বিদেশী বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি হলে আর সেই সাথে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। এতে তাদের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সেবা আয়েও ঘাটতি বেড়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেবা ঘাটতিও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, বিদেশী নাগরিকদের বেতনভাতাসহ বিভিন্ন সার্ভিসের জন্য বিদেশে অর্থ চলে গেছে ৬৩৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৬৬ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ে সার্ভিস খাতে ব্যয় বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। কিন্তু বিপরীতে বিদেশ থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সেবা বাবদ আয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সেবা খাতে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।
ধারাবাহিকভাবে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ 
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি ও সেবা ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ২০ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ধনাত্মক ২০ শতাংশের মতো।
চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে পড়ছে 
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে এক দিকে পণ্য বাণিজ্য ও সেবা আয়ে ঘাটতি বাড়ছে অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবের ভারসাম্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চলতি হিসেবের ভারসাম্য যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৫১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ঋণাত্মক হয়েছে ৮১৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। সবমিলে আলোচ্য সময়ে চলতি হিসাবের ভারসাম্য কমেছে ১ হাজার ১৬৯ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বাড়ছে 
চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার অর্থই হলো বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাবসহ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়া। বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক দায় মেটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করতে পারছে না। এর ফলে বাধ্য হয়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। একই সাথে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি যেখানে প্রতি ডলার পেতে ব্যাংকগুলোকে ব্যয় করতে হতো ৮৪ টাকা, চলতি সালের একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোর ব্যয় করতে হচ্ছে ৮৬ টাকা। তবে পণ্য আমদানির জন্য ব্যয় মেটাতে ব্যবসায়ীদের তার চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে ডলার পাওয়ার জন্য। সংশ্লিষ্ট আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতি উন্নতি না হলে সামনে ডলারের দাম আরো বেড়ে যাবে। এতে পণ্য আমদানির ব্যয় বাড়বে, আর তাতে মূল্যস্ফীতিও আরো বেড়ে যাবে।
বিষয়:

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: