সরকার পরিবর্তনের হাওয়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে
প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:৩০
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:০৮
গত ১৫ বছরে দেশে উন্নয়নের স্লোগানে অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন হয়েছে, সমানভাবে চলেছে দুর্নীতিও। বাংলাদেশে আর্থিক খাতে লুটপাটের কারণে ব্যবসা-পরিবেশ পাওয়া যায়নি আওয়ামী লীগ শাসনামলে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও প্রকারান্তরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তবে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশে বাড়তে শুরু করেছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই।
সংকটের মধ্যে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে। জুলাই-আগস্ট সময়ে মোট ৬৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে দেশে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ৬০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।
আঙ্কটাডের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ এলেও বাংলাদেশে বছর শেষে মোট বিদেশি বিনিয়োগ থাকার পরিমাণ বা স্থিতি কমে গেছে। ২০২২ সালেও আগের বছরের চেয়ে এফডিআই স্থিতি কমে যায়। এর মানে বাংলাদেশ থেকে গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ যেখানে জিডিপির দেড় শতাংশের কম, সেখানে মালদ্বীপে বিদেশি বিনিয়োগ ১২ শতাংশের বেশি আর অর্থনৈতিক সংকট পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক বিনিয়োগও ২০ শতাংশের বেশি। যেখানে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা বিদেশি বিনিয়োগে এত এগিয়ে আছে, সেখানে বাংলাদেশ কেন পারছে না এটি বড় প্রশ্ন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যবসা সহজীকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে আগামী ২০২৪-২৫ থেকে ২০২৬-২৭ পর্যন্ত অর্থবছরে ১১০টি সংস্কার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সহায়ক অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পদ সঞ্চালনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বাজেটে। এসব উদ্যোগের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশে এবং মধ্য মেয়াদে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। তা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের হিসাব বলছে, বিদেশি বিনিয়োগ ২০২২ সালের তুলনায় আরও কমেছিল।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরু হয়েছে। আমদানি কমায় পণ্য-বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ কমেছে।
ডলারসংকটের কারণে আমদানিব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারও সেই পথ অনুসরণ করে চলেছে। তার সুফলও মিলছে। আমদানিব্যয় কমছেই। আর তাতে বাণিজ্য ঘাটতিতে নিম্নমুখী প্রবণতা নিয়েই শুরু হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছর।
বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট সময়ে পণ্য-বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭৫ কোটি ৪০ লাখ (২.৭৫ বিলিয়ন) ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩০৪ কোটি ৪০ লাখ (৩.০৪ বিলিয়ন) ডলার।
জুলাই-আগস্ট সময়ে ৯৯১ কোটি ৪০ লাখ (৯.৯১ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ কম।
বাংলাদেশের টানা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও প্রকট হয়েছে। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) শুরু থেকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতিও সংস্কারের মুখে পড়ে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের গড় দেশজ উৎপাদন তথা, জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৪ শতাংশে। যেটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। একই সময়ে বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির ওপরে থাকবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দক্ষিণ এশিয়ার আপডেট প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এতে দু-একটি দেশ ছাড়া পুরো অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা চেয়েও বেশি হয়েছে বলে মত দিয়েছে সংস্থাটি। তবে অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে নারীদের কর্মসংস্থান আরও বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করছে তারা।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ধীর গতির কারণ উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে, উৎপাদন প্রবৃদ্ধি সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-২৪-এ ৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থবছরে ৩ দশমিক ২ থেকে ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংস্থাটি বলছে, প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কিছু কারণ দায়ী। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় নির্ভরযোগ্য তথ্য বা পরিসংখ্যানের অভাব এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার পরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কারণে অনিশ্চয়তা এসেছে। স্বল্প মেয়াদে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ এবং শিল্প প্রবৃদ্ধিকে স্তব্ধ রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা ছাড়া সাম্প্রতিক বন্যা কৃষি উৎপাদনকে আরও পিছিয়ে দেবে। মাঝারি থেকে দীর্ঘ মেয়াদে, আর্থিক খাতে সমালোচনামূলক সংস্কার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বৃদ্ধি, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে প্রবৃদ্ধি ধীরে ধীরে বাড়বে বলে আশা করছে বিশ্বব্যাংক।
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে দু-একটি ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক দিক দেখা গেলেও পুরো অর্থনীতিই এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা করছে সংস্থাটি। এ অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে করা বিশ্বব্যাংকের আগের পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই অঞ্চলটিকে বিশে^র সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ার পথে রাখা হয়েছে।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: