সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

অসুস্থ প্রতিযোগিতা : কাজী খাদিজা আক্তার


প্রকাশিত:
৫ আগস্ট ২০২০ ২১:৩৯

আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ২১:৫০

 

পৃথিবী আগের মতোই আছে। গোলাকার। উত্তর ও দক্ষিণে কিছুটা চ্যাপ্টা, কমলালেবুর মতো। সৌরমণ্ডলী পরিবারে সূর্যই এখনও কর্তা। পৃথিবীর আয়তন একই আছে। প্রকৃতির সবকিছু তার নিজ নিজ দায়িত্ব ঠিকই পালন করে যাচ্ছে। কিচ্ছুটি বদলায়নি। বদলে গেছে শুধু আমাদের জীবন, জীবনের সময়। 

স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা আপনার জীবনকে বাঁচিয়ে রাখছে ঠিকই কিন্তু জীবন জমির কোথায় যেন উর্বরতা হারিয়ে ফেলছে। কতশত অংকের হিসেব মিলেনা, থমকে গেছে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, কল্পনার স্বপ্নপুরী এখন আর যখন তখন হাত বাড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়না ভালোলাগার শিহরণে। ভালোবাসা জলের মতন। ভালোবাসাই জল ঢেলে দিচ্ছে জীবনের গোড়ায়। তাই বেঁচে আছি সেইবা কম কিসে। তবেকি জানেন, একটা কথা ভেবে মাঝে মাঝে একটু স্বস্তি পাই। তাহলো "অসুস্থ প্রতিযোগিতা", যা অনেকটাই থেমে আছে। এই প্রতিযোগিতা সমাজে মহামারী আকার ধারণ করেছিলো করোনা মহামারীরও আগে। বেশ শক্তভাবে গেড়ে বসেছিলো আমাদের মস্তিষ্ক এবং মননে। এক শ্রেণির মানুষের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভাইরাস আক্রমণ করেছিলো প্রায় পুরো সমাজ, বিশ্বকে। কোথায় ছিলোনা এই প্রতিযোগিতা? ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, পরিবারের সাথে পরিবারের, পাড়া, মহল্লা, শহর, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের এবং আন্তর্জাতিক ভাবে পুরো বিশ্বই প্রতিযোগিতায় মত্ত ছিলো। এই যে অন্ধ প্রতিযোগিতা তা চিরকালই অকল্যাণকর। এই প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে আমরা এতোটাই উন্মাদ হয়েছিলাম যে জীবনের সূক্ষ্মতম সুন্দর সুখ গুলোও আমরা উপভোগ করার ফুরসত পাইনি। অতৃপ্তি, অতিআকাঙ্খা  আমাদের এভাবে গ্রাস করেছিলো। অর্থ উপার্জন এবং অর্থ ব্যয়ের দুটো দিকই আমরা প্রতিযোগিতার মানদন্ডে নিয়ে এসেছিলাম। যার জন্য আমাদের জীবনে আনন্দ ভোগের এবং ভাগের সময় ছিলো কম। আমরা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ক্লান্ত ছিলাম। অবসর উপভোগ করাও যে একটা শিল্প, জীবনের রস তা আমরা ভুলতে বসেছিলাম। এই প্রতিযোগিতা যে অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই বেশি ছিলো, সে কথা নিয়ে হয়তো কেউ আমার সাথে অমত হবেননা। তাই যদি মেনে নেই তাহলে ভেবে দেখুনতো একটি পরিবারে জনে জনে গাড়ি বাড়ি লাগে কেন? যেকোনো উৎসব অনুষ্ঠানে এনাদের আকাশপথ পাড়ি দিয়ে অন্য সীমান্তে গিয়ে শপিং করাটা এপার ওপার ঘুরে আসার মতো। তা নাহলে যে প্রেস্টিজ ফুটো হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। কি নির্বোধ অহমিকা। দেশের ভিতর ধানের শীষে যাদের একফোটা শিশির দেখার ইতিহাস নেই, তাঁরাই লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করে বছরে কয়েকবার বৈদেশ ভ্রমণ করেন শুধু প্রেস্টিজ প্রতিযোগিতায় অগ্রপথিক হওয়ার জন্যে। সন্তানদের পড়াশোনার ব্যপারেও তারা একটুখানি কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নয়। তাইতো দেশের ভিতর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড থাকলেও তাদের নজর নিবিষ্ট থাকে বিদেশের মাটিতে। তারপরতো সেই বিদেশের মাটিই  আবাস মাটি হয় মরনের আগ পর্যন্ত। 

সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা ব্যাংকে কাগজবস্তু সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। এ কার্য সম্পাদন করতে যদি এনাদের  সারাজীবনও লেগে যায় তাহলেও এনারা পিছপা হবেন না। এটা এক প্রকার প্রকট নেশা। আমাদের সমাজে, পরিবারে কিছু নির্বোধ, নিরর্থক প্রতিযোগিতাও আছে। সমাজে মনুষ্যত্ব ধ্বংসে এরাও কিন্তু কম দায়ী নয়। যেমন মনে করেন কার সন্তান কতো মেধাবী, কার বর কতো বেশি  উপার্জন করে, কে জীবনে কতোটা সুখী ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক অভিভাবককেই দেখেছি ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এতোবেশি চিন্তাগ্রস্থ যে পারলে বাচ্চার পরিবর্তে উনি নিজেই পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে দেখিয়ে দিতেন, " সবাই দেখো আমার সন্তানই সেরা। " এই যে সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতায় আমাদের বাচ্চারা সরল সুন্দর সময়গুলো হারিয়ে ফেলছে। নৈতিকতা কিংবা মনন গঠন করার আগেই এদেরকে কঠিন বাস্তবতা গোগ্রাসে গিলে ফেলছে। 

আমাদের এই জবরদস্ত জীবন  আমাদেরকে মেকি ভালোবাসার রুপ দেয়। তাই কখনও কখনও মনের অজান্তে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের সাথে অভিনয় করি। সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখবেন পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে অভিনেতার অভাব নেই। সে কারণেই সমাজে অদৃশ্য তৈলমর্দন একটি মারাত্মক ব্যধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে আপনার উপরস্থ এককাপ চা এর মতন এক চামচ তৈল মর্দনে চাঙা হয়ে পরেন। এতে করে এই তৈলমর্দনে আপনি পারদর্শী না হলে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক নয়কি? 

বার্ট্রান্ড রাসেলের" সুখ" বইটিতে আমেরিকানদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছে, "বাঁচার জন্য তারা অর্থ উপার্জন করেনা, অর্থ উপার্জনের জন্য বাঁচে।" আর এ বইয়ের অনুবাদক মোতাহের হোসেন চৌধুরী সে কথার সূত্র ধরেই বলেছিলেন, "জীবিকা অর্জনের চেয়ে বড় এবং জীবনার্জনের জন্যেই জীবিকা অর্জন, এই সত্যটা সর্বদা দেশবাসীর হৃদয়ে জাগরুক রাখার উদ্দেশ্যেই আমি এই নিবন্ধনটি তর্জমা করেছি।" অথচ এই তর্জমা বাস্তব জীবনে আমরা কজনা জীবনাদর্শ ভাবি। তা নাহলে যেখানে আমাদের সমাজে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও অনেক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না অর্থের অভাবে এবং পণের টাকা জোগাড় হচ্ছে না বলে অনেক মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে সেখানে এক শ্রেণির পিতামাতা কতোটা জাঁকজমক করে তাদের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে পারেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতেও কার্পণ্য করেননা। 

অভিজাত শ্রেণির এ প্রতিযোগিতার শেষ কোথায় তা আমি জানিনা, যেমন জানিনা মহামারী কাল শেষে তারা তাদের প্রতিযোগিতার গতি কমাবেন না বাড়াবেন। অসুস্থ  প্রতিযোগিতার নামে যে মহামারী যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তার প্রধান ক্ষতিকর দিক হচ্ছে সংক্রমণ। এই সংক্রমণ  আপনার আমার গন্ডি  ছাড়িয়ে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ে।  এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পরেননা শিল্পী গোষ্ঠীও। উপরের সিড়িতে উঠতে গিয়ে কেউ কেউ যে সামনের জনকে ল্যাং মেরে ফেলে দিন, সেরকম উদাহরণও যে সমাজে অনেক আছে তা বললে হয়তো ভুল বলা হবেনা। আজকাল ধর্ম কর্ম নিয়েও কিন্তু প্রতিযোগিতার শেষ নেই। কে কয়বার হজ্জ পালন করলো, কাশীতে গেলো, তীর্থস্থান ঘুরে এলো এর পরিসংখ্যান নিয়েও কিন্তু প্রতিযোগিতার শেষ নেই। কতোটা নির্বোধ আমরা। 

অর্থ উপার্জন কিংবা যেকোনো প্রতিযোগিতায় আমরা কিন্তু আমাদের পরম "আনন্দ"  কে ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই অর্থ আমাদের কিছুদূর পর্যন্ত সুখ দিতে পারে সম্পূর্ণটা নয়। অর্থ দিয়ে যদি সুখ কিনতে হয় তাহলে সে সুখের এতো বেশি দাম দিতে হয় যার মূল্য চোকাতে লাগে সারাটা জীবন এবং তা সাধারণের বাইরে চলে যায়। তাই বলছি প্রতিযোগিতা যেন আমাদের মজ্জাগত হয়ে না পরে। প্রতিযোগিতা যে আপনাকে পূর্ণাঙ্গ সুখ এনে দেবে সে কথা আপনি যেমন হলপ করে বলতে  পারেননা তেমনি আনন্দকে উপেক্ষা করে সংসার এবং কর্মজীবনে জয়ী হবেন তাও কিন্তু সম্পূর্ণ স্বীকার করতে পারছেননা। তাই বলছি আনন্দের সাথে বাঁচুন কারণ জীবন খুব সুন্দর। 

 

কাজী খাদিজা আক্তার
প্রভাষক (ইংরেজি) 
সরাইল সরকারি কলেজ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top