সিডনী রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কর্নেল ওসমানী কি ছিলেন গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার? : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার


প্রকাশিত:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৩০

আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:০৭

ছবিঃ কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী

 

পাকিস্তান আমলে কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করত সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে এমএনএ প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। একই ভাবে একই নির্বাচনে লেফ্টেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) এম এ রবও এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত ৪ এপ্রিলের ঐতিহাসিক সেনাবৈঠকে উভয়ে উপস্থিত ছিলেন।

বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনো কোনো সেনা কর্মকর্তা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইতঃপূর্বে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেও তেলিয়াপাড়ার সংশ্লিষ্ট সেনা বৈঠকে সকলে একক কমান্ডের অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু করেন। তখন পর্যন্ত স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা কোনো রাজনৈতিক সরকার না থাকায় ঐ সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই কর্নেল ওসমানীকে একাধারে এমএনএ ও সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ রবকে উপ-সর্বাধিনায়ক মনোনীত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সভা কর্নেল ওসমানীকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তাগিদ প্রদান করে।

এ সকল কারণে বিভিন্ন গ্রন্থে ‘জাতীয় পরিষদ সদস্য অবসর প্রাপ্ত কর্নেল এম. এ. জি ওসমানীকে স্বাধীন বাংলার সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কর্নেল ওসমানী সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব এইচ টি ইমাম জেনারেল মীর শওকত আলীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ‘ওসমানী ভারতীয় জেনারেলদের সমকক্ষ ছিলেন এবং কারো কারো সিনিয়র ছিলেন। জেনারেল অরোরা যিনি ইস্টার্ন কমান্ডের (ভারতীয় বাহিনী) সি.ইন.সি. ছিলেন, তার চাইতেও ওসমানী সিনিয়র ছিলেন এবং খুব সম্ভবত জেনারেল মানেকশ (ভারতীয় বাহিনীর তৎকালীন প্রধান) থেকে জুনিয়র ছিলেন। তিনি যদি না-থাকতেন, আমার মনে হয় না, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছেন, সেভাবে সাহায্য করতেন। কারণ আমরা অনেক জুনিয়র ছিলাম। আমরা ছিলাম মেজর, আর তাঁরা ছিলেন জেনারেল, লে. জেনারেল।’

পূর্বেই বলা হয়েছে, তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত সেনা সভার কালে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা কোনো রাজনৈতিক সরকার না থাকায় ঐ সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানীকে একাধারে এমএনএ ও সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম Commander-in-Chief  বা সর্বাধিনায়ক এবং লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ রবকে Deputy Commander-in-Chief বা উপ সর্বাধিনায়ক মনোনীত করা হয়। আগরতলায় অস্থায়ী সরকারের কাঠামো বিষয়ে সিদ্ধান্তকালে তাদের মনোনয়ন প্রাথমিকভাবে নিশ্চিৎ করা হয়। 

১৪ এপ্রিল ’৭১-এর ‘অস্থায়ী সরকার কর্তৃক মুক্তিবাহিনীর পুনর্গঠন : কর্নেল ওসমানীর নিয়োগ’ অদেশে বলা হয় : Col. Osmani of the Bengal Regiment, who had retired from active service some time before the flare-up in East Bengal, was appointed the General Officer Commanding-in-Chief of the ‘Mukti Fauj’.

২৯ এপ্রিল’৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভার সিদ্ধান্তানুযায়ী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কর্নেল ওসমানীর যে নিয়োগ অনুমোদন করেন তাতে বলা হয়েছে: The appointment of Colonel M. A. G. Osmany as the Commander-in-Chief of Bangladesh Forces with the status of a Cabinet Minister is hereby approved.

কোনো রাজনৈতিক সরকার না থাকায় ৪ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী গঠনপূর্বক আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম Commander-in-Chief (C-in-C) বা সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভায় তাঁকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় বাংলাদেশ বাহিনীর Commander-in-Chief হিসেবে আনুষ্ঠানিক নিয়োগ এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা অনুমোদিত হওয়ার কাল থেকে তিনি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাই বলা যায় যে, কর্নেল ওসমানী ৪ এপ্রিল থেকে স্বল্প দিনের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’ ছিলেন বটে কিন্তু বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর সেই সরকারের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ‘মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের ‘সর্বাধিনায়ক’ ছিলেন, নাকি মুক্তিবাহিনীর ‘সর্বাধিনায়ক’ ছিলেন এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বাংলা একাডেমির (Eng-Beng) অভিধানে Commander-এর বাংলা করা হয়েছে ‘সেনাপতি; আদেশপ্রদানকারী বা নিয়ন্ত্রণকারী অফিসার; অধিনায়ক। Commander-in-Chief সর্বাধিনায়ক’। সংশ্লিষ্ট (Beng-Eng) অভিধানেও সর্বাধিনায়ক-এর ইংরেজি হচ্ছে Commander-in-Chief । যুদ্ধকালীন সময়ে কর্নেল ওসমানী সকল ডকুমেন্টে Commander-in-Chief বা C-in-C হিসেবে স্বাক্ষর করেন।

মুক্তিযুদ্ধের কোনো কোনো ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায়, কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রধান সেনাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম কর্নেল ওসমানীকে Commander-in-Chief অর্থে ‘প্রধান সেনাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ‘প্রধান সেনাপতি’ নামে কোনো পদের কথা শুনা যায়নি। কর্নেল ওসমানীকে তখন সকলেই ‘সি-ইন-সি’ হিসেবে সম্বোধন করতেন। এর কারণ ছিল তৎকালে সেনাবাহিনীর সকল দাপ্তরিক আদেশ ইংরেজিতে লিখা হতো। তাই কর্নেল ওসমানী সকল দাপ্তরিক আদেশে Commander-in-Chief বা C-in-C হিসেবেই স্বাক্ষর করেছেন।

Commander-in-Chief-এর বাংলা ব্যাবহারের শুরু হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার বহু পর থেকে-- উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে। প্রথম দিকে বিভিন্ন লেখায় Commander-in-Chief অর্থে ‘সর্বাধিনায়ক’ বলা হলেও পরবর্তীতে অদৃশ্য মহলের প্ররোচণায় ‘প্রধান সেনাপতি’ পদবাচ্যের ব্যাপক ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, মেজর জেনারেল (অবঃ) কে এম সফিউল্লাহ ১৯৭৫ সালে যে সাক্ষাৎকার দেন তাতেও তিনি সুস্পষ্টভাবে ‘সর্বাধিনায়ক’ শব্দ ব্যাবহার করেছেন। তিনি ৪ এপ্রিলের সভা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আমরা কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করি। তিনি সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।’ কিন্তু ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে ‘সর্বাধিনায়ক’র স্থলে ‘প্রধান সেনাপতি’ ব্যাবহার শুরু করেন।

এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাঁর পূর্বের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বলেন: ‘জেনারেল ওসমানী কখনো সর্বাধিনায়ক ছিলেন না। সর্বাধিনায়ক হয় কে? সর্বাধিনায়ক হয় রাষ্ট্রপতি। জেনারেল ওসমানীকে আমরা করেছি প্রধান সেনাপতি। প্রধান সেনাপতি কিন্তু সর্বাধিনায়ক নয়-- কমান্ডার ইন চিফ। ঐ সময়ে যারা নাকি সরকার গঠন করেছিলেন সেই সরকারের মধ্যে তো রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। যিনি রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তিনি সর্বাধিনায়ক।’

কিন্তু তিনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, ৪ এপ্রিল যখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করা হয়, তখন কোনো রাজনৈতিক সরকার বা রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন না। ১৭ এপ্রিল সরকার গঠনের পর ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি তাঁকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্াদায় সম্মিলিত বাহিনীর (Bangladesh Forces) Commander-in-Chief নিয়োগ করেন।তিনি একবারও ভাবেননি যে, কমান্ডার ইন চিফ অর্থে সর্বাধিনায়কের পরিবর্তে প্রধান সেনাপতি বলতে হলে সেক্টর কমান্ডার অর্থেও আঞ্চলিক সেনাপতি বলা উচিত।প্রশাসনিক পরিভাষায় Commander-in-Chief এর বাংলা হচ্ছে ‘সর্বাধিনায়ক’ আর Chief of Staff এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘বাহিনী প্রধান’।

‘সর্বাধিনায়ক’ এবং ‘প্রধান সেনাপতি’ নিয়ে কোনো বিতর্কের উদয় হতো না যদিনা তদধীন কর্মকর্তাদের বেলায়ও Commander-এর বাংলা ‘সেনাপতি’ করা হতো। আমরা ‘সেক্টর কমান্ডার’দের বেলায় বাংলায় ‘সেক্টর সেনাপতি’ বা ‘আঞ্চলিক সেনাপতি’ না লিখে ‘সেক্টর অধিনায়ক’ বা ‘আঞ্চলিক অধিনায়ক’ বলতে অভ্যস্থ হলেও ‘সর্বাধিনায়ক’কে ‘প্রধান সেনাপতি’ বলতে ভুল করি না। প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিবাহিনী বা পরবর্তী কালের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ‘প্রধান সেনাপতি’ বা ‘সেনাপতি’ হিসেবে কোনো পদবী ছিল বা আছে কি?

যেখানে কমান্ডার অর্থে ‘সেনাপতি’ শব্দের প্রয়োগ নেই সেখানে তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাকে ‘প্রধান সেনাপতি’ বলা কেন? কেবলমাত্র ওসমানীর বেলায় ‘সর্বাধিনায়ক’ না লিখে ‘প্রধান সেনাপতি’ লিখার কারণ কি? এতে কি কোনো উদ্দেশ্যমূলক মানসিকতা বা সুক্ষ্ম বিকৃতির সংশ্রব আছে? এ বিষয়টি কিঞ্চিৎ আলোচনার দাবি রাখে।

মুক্তিযুদ্ধকে দিকভ্রান্ত করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বে যেমন ছিল অবিশ্বাস ও ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা তেমনি সামরিক নেতৃত্বেও ছিল ষড়যন্ত্রের রাহুগ্রাস। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যেমন শক্ত হাতে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেছেন, তেমনি কর্নেল ওসমানীও কঠোর এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকে দিকভ্রান্ত হতে দেননি।

মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বা যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এমনকি যুদ্ধকালে ৩ জনকে মেজর থেকে লে. কর্নেল পদোন্নতি দেওয়ার নজীর থাকলেও কর্নেল ওসমানী সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। যে কারণে ভারতীয় সেনা নেতৃত্বের সাথে কর্নেল ওসমানীর একটি স্নায়ুবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল কর্নেল ওসমানীর জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের কাছে। তার মতে, প্রটোকলগত ব্যবধানের কারণে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে. জেনারেল অরোরা ও বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীকে যুদ্ধ বিষয়ে কখনও একত্রে কথা বলতে দেখা যায়নি।

এ ব্যাপারে তিনি জনৈক ভারতীয় কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে এর সত্যতা পান। ঐ কর্মকর্তা তাকে জানান, ‘তোমাদের সরকার তোমাদের চিফকে প্রমোশন দিয়ে আমাদের জেনারেলের সমপর্যায়ে নিয়ে এলেইতো যৌথ-কমান্ডের দুই প্রধানের প্রটোকলগত দূরত্ব চুকে যেতে পারে।’    

মুক্তিযুদ্ধকালে বিশেষত যৌথ বাহিনী গঠনকালে কর্নেল ওসমানীর পদোন্নতির বিষয়টি ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি যে তখন প্রকৃত অর্থেই ষড়যন্ত্রের গেড়াকলে নিপতিত ছিল তা প্রমাণিত হয় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ কালে। স্বাধীনতা অর্জনের পরে কর্নেল থেকে এক লাফে তাঁকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজে তা প্রমাণ করেছেন। যদি তখন তাঁকে জেনারেল পদমর্যাদা দেওয়া হতো তবে আত্মসমর্পন পর্বের বিপত্তি ঘটতো না এবং ভারতও তাদের বিভিন্ন দলিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ বলার সুযোগ পেতো না।

সেক্টর কমান্ডারদের জুলাই সম্মেলনে কর্নেল ওসমানীর সঠিক নেতৃত্ব ধ্বংস করার লক্ষ্যে সেক্টর কমান্ডারগণকেও বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। তাদের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর প্রতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের যে আস্থা ছিল কর্নেল ওসমানীকে সরিয়ে তা নস্যাৎ করার চক্রান্ত করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, প্রবাসী সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের জুলাই সম্মেলনে এর প্রকাশ ঘটে। সম্মেলন শুরুর পূর্বেই কোনো কোনো সেক্টর কমান্ডার প্রচার করেন, তাঁরা যেভাবে যুদ্ধ চালাতে চান কর্নেল ওসমানীকে প্রধান রেখে সেভাবে মুক্তিযুদ্ধ চালানো সম্ভব নয়।

অথচ তখন পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারদের নিজ নিজ সুবিধা মতো যুদ্ধ পরিচালনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। তবু তাঁদের একটি অংশ কর্নেল ওসমানীর পরিবর্তে এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে ‘ওয়ার কাউন্সিল’ গঠনের জন্য তৎপরতা চালান। তবে মেজর খালেদ মোশাররফ জোরালোভাবে এর বিরোধিতা করেন। 

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর্নেল ওসমানী প্রথম দিনের অধিবেশনে যোগ না দিয়ে পদত্যাগের কথা জানান। এতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিচলিত হয়ে পড়েন। মাত্র ৩ মাসের মাথায় যদি মুক্তিবাহিনীর প্রধান পদত্যাগ করেন তবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে তা ভেবে তিনি বহু চেষ্ঠায় কর্নেল ওসমানীর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তেনে সক্ষম হন। 

কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থার কারণেই ‘র’-এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ‘মুজিব বাহিনী’ গঠিত হয়েছিল। যার সমন্বয়কারী ও প্রশিক্ষক ছিলেন ‘র’-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। তিনি এস এস উবান নামে পরিচিত ছিলেন। এই মুজিব বাহিনীর সদস্যরা কিছুতেই কর্নেল ওসমানীর কমান্ডে না আসাতে তখন প্রভূত সমস্যা হচ্ছিল। জেনারেল উবানের বর্ণনা অনুযায়ী ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ নাকি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেছিলেন যে তিনি মুজিব বাহিনী গঠন করেছিলেন তাঁর সেনাবাহিনীর হয়ে বিশেষ কিছু অভিযান পরিচালনার জন্য।  

কর্নেল ওসমানীকে হেয় করার অপপ্রয়াস থেকে কেউ কেউ এমনও বলার চেষ্ঠা করেছেন যে, ‘তেলিয়াপাড়ার সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করার সিদ্ধান্ত জুলাই সম্মেলনেও বহাল রাখা হয়।’ যেখানে এর অনেক পূর্বে ২৯ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সয়ং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে তা কার্যকর আছে এবং সেমতে কর্নেল ওসমানী কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সভায় সভাপতিত্ব করছেন সেখানে পুনরায় তাঁর নিয়োগ বহাল রাখার বিষয়টি হাস্যকর নয় কি?

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠান আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী বা চিফ অব স্টাফ লে. কর্নেল এম এ রব-এর অজ্ঞাতে সম্পন্ন হয় সেটা ঐতিহাসিক সত্য। তাদেরকে না জানিয়ে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকারকে উপস্থিত রাখা হয়। কিন্তু কেন? কর্নেল ওসমানীর পরিবর্তে এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে ‘ওয়ার কাউন্সিল’ গঠনের তৎপরতার সাথে এর কি কোনো যুগসূত্র ছিল? কিংবা এর সাথে কর্নেল ওসমানীর অবমূল্যায়ন ও যুদ্ধের পরিণতি সংক্রান্ত কোনো সুপ্ত অভিপ্রায়ের কি সংশ্রব ছিল? বিষয়টি স্পষ্ট করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন।

 

মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও সমন্বয়ক (হবিগঞ্জ জেলা)

এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন প্রকল্প, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top