সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায় : রীনা ঘোষ


প্রকাশিত:
১৮ মে ২০২১ ১৯:৫৫

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০১:০৬

ছবিঃ রীনা ঘোষ

 

বাংলার এই প্রচলিত প্রবাদটি সেই আদিকাল থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক। রাজার কথা আমরা মনে রাখি, তার জন্ম - মৃত্যু ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে কিন্তু এজন সাধারণ সৈনিক? যে হয়তো দেশের জন্য লড়ছে বা অর্থের জন্য বা রাজার রক্ত চক্ষুর ভয়ে - তার কথা কোথাও কি লেখা হয়? খুব সহজ উত্তর - "হয় না,” এবং এই কথাটি সাধারণ জনগন খুব ভালোভাবে জানার পরও ক্ষণিকের লাভের আশায় দীর্ঘমেয়াদি শাস্তির শিকার হয়।

আমার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আমার রাজ্য সোনার বাংলা। এই সোনার বাংলার খ্যাতি অনেক আগেই অস্তমিত হয়েছে, তাই নতুন করে সোনার বাংলা গড়ার উদ্যোগ এগিয়ে আসেন আমাদের রাষ্ট্র প্রধান এবং আমাদের রাজ্য প্রধান। বলাই বাহুল্য দুজনেই বিপরীত দল ও বিপরীত মতের লোক। কিন্তু সোনার বাংলা গড়ার উদ্যোগে তাদের পথটা একই। সেই পথ নিয়ে যায় ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের দিকে। এক দল চায় নতুন করে ক্ষমতা দখল করতে আর এক দল চায় পুরনো ক্ষমতা একটু ঝালাই করে নিতে। আর সেই জন্যই শুরু হয় ভোট - যুদ্ধ।

 

২০১৯ - এ চীনের হুহান (Wuhan) শহর থেকে ছড়ানো মানবজাতি ধ্বংসকারী করোনা ভাইরাস ২০২০ গোটা সালটায় গোটা বিশ্বকে ঘরে বসিয়ে রেখেছিল সেই মহামারী। সেই মহাব্যাধির প্রভাব একটু কমতেই সমস্ত নিয়ম কানুন শিকেয় তুলে আমার রুপোর বাংলাকে সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে শুরু হয় ভোট উৎসবের প্রস্তুতি।

২৩ টি জেলার ২৯৪ টি আসন। তার মধ্যে কোন দল অধিক আসন দখল করবে, সেই নিয়েই প্রতিযোগিতা।উভয় দলই প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিল। এর মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বেশ জাকিয়ে বসেছিল। কিন্তু আমাদের রাজ্য তখনও নিরাপদ ছিল অর্থাৎ সংক্রমণ হচ্ছিল কিন্তু পরিসংখ্যান সামান্য। তবে এই পোড়া দেশে ভোটের জন্য হয়না এমন কোনো কাজ নেই বা বলা যায় ভোটের জন্য আটকায়না এমন কোনো কাজ নেই। গত এক বছর ধরে যখন সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, সমস্ত স্কুল - কলেজ - টিউশন বন্ধ, চাকরির পরীক্ষাগুলো বন্ধ - তখন করোনা মানে মৃত্যু ভয় কিন্তু যেই ভোট এলো তখন সব করোনা উধাও।

একদল অন্য দলের সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য শুরু করলো জমায়েত করা। কার মিটিংয়ে বেশি লোক হবে, কার সভায় উপচে পড়বে ভিড়, কার পদযাত্রায় সাক্ষী হবে হাজার হাজার মানুষ - এই হল প্রতিযোগিতা। আমার রাজ্যের মানুষ কেউ স্বইচ্ছায় আবার কেউ মাত্র দু' পাঁচশো টাকার জন্য ভরাতে লাগল রাজা রানীদের শুন্য সভা। লোক জমায়েত হল, সভা হল, মিটিং - মিছিল - খুন সবই হল। অন্য রাজ্য থেকে একদলের নেতা এল, মন্ত্রী এলো। অন্য দল বলল আমিই বা কম কিসে? নিয়ে এলো নামী দামী সিনেমা আর্টিস্ট। তখন কিন্তু সেই রাজ্য করোনা র দ্বিতীয় ঢেউয়ে রীতিমত জর্জরিত। তারপরেও রাজ্যের বা দেশের কোনো মন্ত্রীই কিছু বলল না। আর লকডাউনের কথা তখন তো মুখে আনাও পাপ।

জনে জনে তখন 'খেলা হবে' বার্তায় ভরে উঠেছে আকাশ বাতাস। কিন্তু সেই বাতাসে যে বিষ মিশে ছিল - সেই বিষ পান করবে কে? সাধারণ মানুষ? কারণ আমাদের দেবতাদের তো অমৃত দেওয়ার সামর্থ্য নেই - না আমার রাজ্যের দেবীর আর না আমার দেশের দেবতার। হাসপাতালে বেড নেই, অক্সিজেন নেই, উভয় সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের মত কিছু চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মী যুদ্ধ করে চলেছে দিনরাত।

এই আমার রাজ্যের মানুষ - রাজায় রাজায় খেলা হবে, গদি নিয়ে খেলা হবে বলতে বলতে কখন যে নিজের জীবন নিয়ে খেলার অধিকার অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে, এরা ভাবতেও পারেনি।

তবু প্রচার তুঙ্গে। আটদফা ভোট। পুলিশের আনাগোনা, মন্ত্রীদের হাতজোড়, পাড়ার মস্তান নেতাদের চোখ রাঙানি। মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার দিন তো এমন উল্লাস যেন ভোটে জিতে বিজয় মিছিল বার করেছে। আগামী পাঁচ বছরে আর মুখ দেখাবে না বলে ভোটের আগে প্রার্থী এতবার নিজের হাতজোড় করা মুখটা দেখায় যে - ঐ পাঁচ বছরের অসাক্ষ্যাত ও মাফ করে দেওয়া যায় আরকি। আমার রাজ্যের মানুষ একথা জানার পরও দলে দলে অনুসরণ করে এদের। ওই যে বললাম - কেউ যায় দুশো টাকার আশায় , তো কেউ যায় সিনেমার আর্টিস্ট দেখতে , আর কোনো কোনো চুনোপুটি যায় নিজেকে মস্ত বড়ো হনু মনে করে নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু এরা যে নলখাগড়ার থেকেও তুচ্ছ , এই সত্যি কথাটা ভোটের আগে এদের মুখের উপর কেউ বলতে আসে না। তখন দোকানের খরিদ্দারের মত জনগণও ভগবান হয়ে যায়, কারণ এদের ভোটেই তো হবে মসনদ হাসিল। হায়রে মানুষ! তুই মানুষ চিনলি না। 

আর আমাদের সংবাদ মাধ্যম - গণতন্ত্রের চার নম্বর স্তম্ভ , তারা তখন সত্যের খোঁজ আর সেই সত্যের উপস্থাপন বাদ দিয়ে ভোট উৎসবে সামিল হয়েছিল। আর করোনা নামে এক ব্যাধি যে গোটা বিশ্বকে গ্রাস করে আছে - এই সত্যটা মানুষের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন ও মনে করে নি। প্রত্যেকটি খবরের চ্যানেলে তখন ভোট - নামচা। কতো দফায় ভোট, কোন জেলায় কত তারিখে পড়ল, কোন প্রার্থী টিকিট পেল আর কোন প্রার্থী পেলো না, টিকিট না পাওয়ার ফলে কার মনের অবস্থা কি রকম, গরমে প্রচার করতে কোন প্রার্থীর অসুবিধা হচ্ছে, কোন প্রার্থী ORS নিয়ে প্রচারে যাচ্ছে, দুপুরে তাদের খাওয়ার মেনুতে কি কি আছে - এসবেই ছিল তাদের ধ্যান জ্ঞান। করোনা তখন এদের কাছে লুপ্তপ্রায়। কেউ একবারও বলল না যে , ভার্চুয়াল প্রচার হোক। কারণ তখন তো সংবাদ মাধ্যম বিভিন্ন পার্টির আশীর্বাদ ধন্য এবং এই আশীর্বাদ পাওয়ার ফল স্বরূপ ভগবানের স্তুত্তিতে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় আশীর্বাদের পরিবর্তে যদি সত্যের অঙ্গীকার করত তাহলে আজ অন্তত এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না। প্রযুক্তির দুনিয়ায় আর প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় আমার রাজ্যে একজন ভিখারীর কাছেও ফোন আছে, তাহলে সেটাকে কেনো কাজে লাগানো হলো না প্রচারের জন্য? কেনো লোক দেখানোর এই প্রতিযোগিতায় হারতে হলো আমাদের?

যথারীতি ভোট হল এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফলাফল ও প্রকাশ হল। এবার এখানে বলি - এটা যদি কোনো পরীক্ষা হত, কোনো সরকারি পরীক্ষা - যে চাকরিটা পেলে হয়তো গোটা পরিবারটা বেচেঁ যাবে, সেই চাকরির পরীক্ষা কিন্তু হতে দিত না এই রাজনৈতিক নেতা - মন্ত্রীরা। কারণ পরীক্ষা হলে অনেক লোকের সমাগমে করোনা ছড়ানোর ভয় বেশি কিন্তু ভোট পরীক্ষা হলে সেই ভয় নেই। আবার ফলাফলের ক্ষেত্রেও এদের একই নিয়ম। একটা পরীক্ষার রেজাল্ট বের করতে এদের ছয় বছর লেগে যায় তবুও নিয়োগ হয়না কিন্তু দেখুন ভোট হল , তার একমাসের মধ্যেই রেজাল্ট বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ হয়ে গেলো, নিয়োগ হয়ে গেলো সব মন্ত্রী আমাত্য । শুধু সাধারণ মানুষই বানের জলে ভেসে এসেছে , বা সাধারণ মানুষ এদের বৈমাত্রেয় ভাই বা বোন তাই এতো অবিচার।

এখন প্রশ্ন ভোটের আগে যে সব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেগুলো পূরণ হবে তো? করোনার প্রথম ঢেউ এ চুনোপুটি নেতা থেকে রাঘব বোয়াল সবার মনই কেঁদেছিল মানুষের জন্যে। দুটাকার চাল দিয়ে অন্তত দশটা ছবি তুলেছিল বিজ্ঞাপনের জন্য। কারণ সামনে তো ভোট ছিল। কিন্তু এখন কে হাত বাড়িয়ে দেবে সেই খেটে খাওয়া মানুষ গুলোর সামনে? ট্রেনের হকার থেকে শুরু করে রিক্সাচালক, ফুচকা বিক্রেতা ও দিন মজুরদের?

 

রীনা ঘোষ
নদিয়া, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়: রীনা ঘোষ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top