সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

আফগানিস্থান: বর্তমান সঙ্কট ও মানবিক বিপর্যয় : অন্জন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:০২

আপডেট:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:০৯

 

আফগানিস্থানে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো যে অভিযান শুরু করে শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে গেল। তাতে অবশ্য দু’দশক পার হয়ে গিয়েছে। ততদিনে আফগানদের ভাগ্যে অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে। কারো জীবন দুর্বিষহ অন্ধকারে থমকে আছে। কেউ কেউ বাস্তু হারা, কেউবা অচেনা ভিন দেশে মাথা গোজার ঠাঁই পাওয়ার নেশায় দিন পার করছে।
দুই দশকের চেনা আফগানিস্থান মাত্র কয়েক দিনেই অচেনা হয়ে উঠে। তালেবানদের হাতে দেশ দখল, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট গণির পলায়ন, সব কিছু গোলমেলে হয়ে যায়। তারপর হাজার হাজার মানুষ ঘর ছাড়া। কেউবা পাশের দেশে আশ্রয় পাওয়ার আশায় অপেক্ষায় আছে, কেউ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করছে। সব মিলিয়ে গোটা দেশে এখন অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, দেখা দিচ্ছে মানবিক বিপর্যয়। হঠাৎ করে দেশটির এমন পালা বদলে দেশের অর্থনৈতিক, মানবিক কিংবা মৌলিক পরিষেবা ভেঙ্গে পড়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।
এরই মধ্যে জাতিসংঘ সতর্কতা জারি করে বলেছে দেশটিতে প্রতি তিন জনে একজন ক্ষুধার্ত থাকতে হতে পারে। তবে শিশুদের জন্য আরো বেশি অশনি সংকেত দেখা দিতে পারে। যার ফলে, শিশুরা মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগবে। আল-জাজিরার খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি সেখানে খাবারের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। পেট্রোলের দাম বেড়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। পশ্চিমা সমর্থিত সরকার থাকা কালীন সময়ে আফগানরা বিদেশী সহায়তা পেয়েছিল। আফগানিস্থানের তালেবান সরকারকে এখনো বহুদেশ স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে যে মোটা অঙ্কের অর্থ বিদেশ থেকে সহায়তা আসতো তার সিংহ ভাগই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আফগানিস্থানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের প্রায় এক হাজার কোটি ডলার এবং জরুরী সহায়তা তহবিলের ৪৪ কোটি ডলার যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আটকে দেয়। আফগানিস্থান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার আগে থেকেই দেশটির প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল ছিল। তালেবানদের দখলে দেশটি যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে, সরকারি চাকরিজীবীরা বেতন পাচ্ছে না, ফলশ্রæতিতে সরকারি সেবা অকার্যকর হয়ে আছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, আফগানিস্থানের জন্য জাতিসংঘের ১৩০ কোটি ডলারের মানবিক সহায়তা আবেদনের মাত্র ৩৯ শতাংশ হাতে পেয়েছে।
অন্যদিকে, অর্থাভাবের কারণে হু (WHO) পরিচালিত কয়েকশ স্বাস্থ্য কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দেশটিতে প্রায় ২ হাজার ক্লিনিক দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। অর্থাভাবে এগুলো এখন বন্ধের সম্মুখীন। আফগানিস্থানে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত ক্লিনিকের প্রায় ৯০ শতাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা আসোলেশনের বেডের সামান্য অংশ চাল ুআছে। এছাড়া বোগীদের জরুরী ওষুধ ফুরিয়ে আসছে। যার ফলে স্বাস্থ্য খাতে চরম বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে এবং স্বাস্থ্য সেবা বিঘিœত হচ্ছে। তার উপর দেশটিতে দেখা দেয় প্রচণ্ড খরা। ফলে, খাদ্য অভাবের কারণে মানবিক সঙ্কটে পড়া মানুষদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি আরো নাজুক অবস্থায় পড়ে যাবে। মানব সেবায় কার্যক্রম পরিচালনার অংশ হিসেবে আফগানিস্থানে বিভিন্ন দেশের এনজিও (NGO)’র কর্মীরা কর্মরত ছিল। কিন্তু, দেশটির বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় ইতোমধ্যে অনেক এনজিও কার্যক্রম স্থগিত রাখে। ফলে মানব সেবার যে কার্যক্রম এনজিও ’র মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছিল তা ব্যহত হচ্ছে।
ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে আফগানিস্থান চরম মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। জাতিসংঘ শরনার্থী বিষয়ক সংস্থার এক হিসাব মতে, আফগানিস্থানে গত মে মাস থেকে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এদের ৮০ শতাংশ শিশু এবং নারী। গত দু’দশক ধরে আফগান মেয়েরা কর্মসংস্থান কিংবা আত্মমর্যাদার যে স্বপ্ন দেখেছিল তা নিমিষেই তলিয়ে যায়। এভাবে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিলে দেশের ভেতরে সহিংসতা এবং আরো বাস্তুচ্যুত হবার সম্ভাবনা দিন দিন বেড়ে যাবে।
বর্তমানে যাদের মাথা গোজার ঠাঁই মিলছে না তারা খোলা আকাশের নিচে, জন সমাগম জায়গায়, পার্ক কিংবা অন্য কোন জায়গা খোঁজে নিচ্ছে। এ মুহুর্তে তাদের একটি আশ্রয় খুঁজে বের করাই কঠিন বিষয়। তবে, এ সকল উদ্বাস্তু আফগানদের জন্য প্রতিবেশি দেশগুলোকে সীমান্ত খোলা রাখার আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এরই মধ্যে কাবুলের অস্থায়ী শিবির স্থাপন করা হয়েছে।
সঙ্কটময় মুহূর্তেও কয়েক দিন আগে বড় ধরণের বোমা হামলা হয়। আতঙ্কের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দেয়। একদিকে খাবারের সঙ্কট অন্যদিকে মাথা গোজার ঠাঁই, তার উপর বোমা হামলা সবই যেন আফগানদের নতুন করে ভাবতে শিখায়। বাস্তুহারা আফগানদের আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয় মানবিক বিপর্যয়ের ধারা। মানুষের ক্ষেত্রে মৌলিক চাহিদার পণ্য এবং সেবা হারাবে। প্রচণ্ড খরা এবং শীতে আশ্রয় না পেলে ভোগান্তি বাড়তে থাকবে। ফলে মানবিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসবে। যে সকর নাগরিক দেশে আছে তারা প্রতিনিয়ত উৎকন্ঠার মধ্যে দিন পার করছে। অনেকের জন্য অপেক্ষা করছে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট। যারা অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে মোকাবেলা করতে হবে শরণার্থী জীবনের কঠিন সংগ্রাম। এ সঙ্কট কখন শেষ হবে তা কেউ বলতে পারবে না। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা(UNHCR) মতে, মানবিক বিপর্যয় মাত্র শুরু!
জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (UFP)’র আগস্ট এবংসেপ্টেম্বর মাসে আফগানিস্থানের উপর পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯৩ শতাংশ আফগানদের কাছে খাবার কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। যার কারণে তারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। বিশেষ করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে টানা কয়েক দিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় মানবিক পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে উঠে। আর্থিক সঙ্কটের জন্য খাদ্যের হাহাকার বাড়তে থাকে। যদিও বর্তমানে দেশের নাগরিকরা এটিএম বুথ থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারছে। তবে তা খুবই অল্প পরিমাণ যা দিয়ে একটি পরিবারের পক্ষে এক সপ্তাহের বেশি চলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে আফগান শরণার্থীদের সঙ্কট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে পাশ্ববর্তী দেশসমুহ শরণার্থী ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী বছরের মাঝামাঝিতে প্রায় ৯৭ শতাংশ আফগানিস্থানের জনগণ দারিদ্র সীমার নিচে নেমে যেতে পারে। যার ফলে মানবিক বিপর্যয়ের বড় শঙ্কা দেখা দিতে পারে।
কিছু পরাজয় সাময়িক, কিন্তু মানবতার বিপর্যয় অসীম। আফগানিস্থানের ক্ষেত্রে কি সেটাই বুঝিয়ে দেয়? নাকি সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফ্ফার খাঁনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, “ভুলে যাও উজবেক, তাজিক, হাজারা বা পশতুন পরিচয়। যদি নিজেদের আফগান ভাবতে না পার আফগানিস্থান টিকবে না।” সেই আফগানিস্থানে মানবিক বিপর্যয় আজ আফগানদের প্রতিপদে শঙ্কিত করে তুলছে!

 

অন্জন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top