সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


অমর শিল্পী কিশোর কুমার : বানীব্রত


প্রকাশিত:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:২৪

আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২৩:২৯

শিল্পী কিশোর কুমার

 

"কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’  যার সুরেলা কন্ঠে ধ্বনিত  হয়েছিলো  তিনি সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমার।  যিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে বিবেচিত ।
এই মহান শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন আগস্ট ৪, ১৯২৯খান্দোওয়া, মধ্যপ্রদেশে। তিনি ছিলেন ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক। কিশোর কুমারের চার অদ্ভুত কাহিনী:- কিশোর কুমার ৪ই আগস্ট ৪টার সময় জন্ম গ্রহণ করেন এবং তিনি ৪র্থ সন্তান। তিনি জীবনে ৪ টি বিয়ে করেন, চলচ্চিত্র জীবনে ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

কিশোর কুমার বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালয়ালম, ওড়িয়া, এবং উর্দু।
তিনি তার ব্যক্তিগত গান সংকলনেও বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন, বিশেষত তার বাংলায় গাওয়া গানগুলি সর্বকালের ধ্রুপদী গান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তিনি ৮ বার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়কের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন এবং একই বিভাগে সর্বাধিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার বিজয়ের রেকর্ড করেছেন। তাকে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং তার নামে হিন্দি চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য কিশোর কুমার পুরস্কার প্রদান চালু করে।

সাধারণত গায়ক হিসাবে তাকে দেখা হলেও তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতাও ছিলেন। তার অভিনীত বিখ্যাত কয়েকটি হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে বাপ রে বাপ, চলতি কা নাম গাড়ি, হাফটিকিট, পড়োশন , হাঙ্গামা , পেয়ার দিবানা , বাড়তি কা নাম দাড়ি । এছাড়া অন্যান্য চলচ্চিত্রের ভিতর রয়েছে নোকরি, বন্দী, দূর গগন কি ছাঁও মে, দূর কা রাহি প্রভৃতি।


তিনি কুন্দন লাল সায়গলের নকল করে গাইতেন। পরে শচীন দেব বর্মনের পরমর্শে তিনি নিজের গাইবার কায়দা পাল্টান এবং এমন এক গাইবার কায়দা উদ্ভাবন করেন যা সেই সময়ের অপর প্রধান দুই গায়ক মহম্মদ রফি এবং মুকেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল গলাকে ভেঙে গান গাওয়া যা আগে কখনও শোনা যায়নি। তবে এই কায়দা খুবই জনপ্রিয় হয়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কমেডি নায়ক হিসাবে জনপ্রিয় হন। তার অভিনয়ের কায়দা ছিল অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই সময়ের প্রবল জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাশালী তিন নায়ক - রাজ কাপুর, দেব আনন্দ এবং দিলীপ কুমার বলিউড শাসন করা সত্ত্বেও কিশোর কুমার নিজের এক পৃথক জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তিনি ছিলেন এক প্রবল ব্যস্ত, সফল নায়ক এবং গায়ক। এছাড়াও তিনি সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করতে লাগেন। শচীনদেব বর্মন ছাড়াও আরেক সুরকার যিনি কিশোরের সঙ্গীত প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি হলেন খেমচাঁদ প্রকাশ। খেমচাঁদ প্রকাশের সুর জিদ্দি চলচ্চিত্রের গান গেয়ে কিশোর গায়ক হিসাবে পায়ের নিচে মাটি পান। এছাড়া অন্যান্য সুরকার যেমন রবি এবং দুই বিশিষ্ট গীতিকার - মজরু সুলতানপুরি ও শৈলেন্দ্র কিশোরের ভক্ত হয়ে ওঠেন। এই সময়ের তার গায়ক হিসাবে অন্যতম চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে আছে পেয়িং গেস্ট , চলতি কা নাম গাড়ি , তিন দেবিয়াঁ।
ষাটের দশকের পথ চলা সম্পাদনা, এই সময়কালে কিশোরকুমারের বেশকিছু চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে অসফল হয়ে পড়ে । এই সময় তিনি পাকাপাকিভাবে গানের জগতে নিজেকে যুক্ত করে ফেলেন । মনে রাখার মত মুনিমজি , গাইড এবং জুয়েল থিফ  চলচ্চিত্র তিনটিতে তার গাওয়া গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।
১৯৬৬ সালে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শচীন দেব বর্মনের পুত্র রাহুল দেব বর্মণের। তার প্রথম দর্শকপ্রিয়-ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র তিসরি মঞ্জিলে কিশোর কোন গান গাননি। কিন্তু ১৯৬৮ সালে 'পড়োশন' চলচ্চিত্রে রাহুল দেব বর্মণের সুরে কিশোর বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গান।

১৯৬৯ সালে শক্তি সামন্ত'র আরাধনা শুভমুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রের নায়ক ছিলেন রাজেশ খান্না। রাজেশ খান্নার জন্য এই চলচ্চিত্রে কিশোর তিনটি গান গেয়েছিলেন - ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে -আর দুটি হোলো- রূপ তেরা মস্তানা এবং ‘মেরে সপনো কি রানী’। তিনটি গানই বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং কিশোর কুমারের সঙ্গীত জীবনকে আবার উপরে উঠিয়ে দেয়। এই চলচ্চিত্রে রূপ তেরা মস্তানা গানের জন্য কিশোর প্রথম বার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান।
পরবর্তী বছরগুলোতে কিশোর গায়ক হিসাবে ব্যাপক সাফল্যতা লাভ করেন। সে সময়ে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত সব নায়ক যেমন রাজেশ খান্না, শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, রণধীর কাপুর, সঞ্জীব কুমার এবং দেব আনন্দের জন্য তিনি গান গেয়েছেন। এই সময়ে শচীন দেব বর্মণ এবং রাহুল দেব বর্মণের সুরে তিনি প্রচুর কালজয়ী গান গেয়েছেন। রাহুল দেব বর্মনের সুরে তিনি বোম্বে টু গোয়া চলচ্চিত্রতে প্রথমবারের জন্য অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের 'অভিমান' চলচ্চিত্রের জন্য তার গানগুলি জনপ্রিয় হয়। এরফলে পরবর্তী মেগাস্টার অমিতাভের নেপথ্য গায়ক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কিশোর কুমারের এই সাফল্যের পরে বম্বের  অন্য সুরকারেরাও তাকে নিজেদের প্রধান গায়ক হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হন। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল জুটি। গীতিকার আনন্দ বক্সী সুরকার লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল  এদের সাথে  কিশোরকুমার জুটি বেশ কিছু রাজেশ খান্নার চলচ্চিত্রের জন্য অনবদ্য সঙ্গীত দর্শকদের উপহার দেন।   লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলালের সুরেই কিশোর কুমার ও মোহাম্মদ রফি একসাথে গান করেন এবং কিশোর কুমার,  লতা মঙ্গেশকরের ও আশা ভোসলের সাথেও বেশ কিছু ভাল দ্বৈত গান উপহার দেন দর্শকদের।
কিশোর কুমার এবং সুরকার কল্যাণজী-আনন্দজী জুটিও বেশ কিছু হিট গান উপহার দেন।    সত্তর এবং আশির দশকে নতুন অল্পবয়েসি নায়ক ঋষি কাপুর এবং সঞ্জয় দত্তের জন্যও তিনি সফল গান উপহার দেন। রাহুলদেব বর্মনের সুরেই যে তিনি সবথেকে বেশি জনপ্রিয় গান গেয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। । নতুন সুরকার যেমন রাজেশ রোশন এবং বাপ্পী লাহিড়ী'র সুরেও তিনি বেশ কিছু হিট গান গেয়েছেন।


অক্টোবর ১৩, ১৯৮৭ সালে ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতের এই জনপ্রিয় শিল্পীর মৃত্যু ঘটে।


বানীব্রত
পশ্চিম বঙ্গ,  ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়: বানীব্রত


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top