নায়করাজ রাজ্জাকের প্রস্থানের দুই বছর আজ
প্রকাশিত:
২১ আগস্ট ২০১৯ ২৩:১০
আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪০

প্রভাত ফেরী, বিনোদন ডেস্ক: পশ্চিম বাংলার এক যুবক ১৯৬৪ সালে ঢাকায় পা রেখেছিলেন পরিবারের হাত ধরে। কে জানতো ভাগ্য তার জন্য এখানে এত সাফল্যের গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। ক্যারিয়ার শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। সেই তিনি হুট করেই হাজির হন নায়ক হয়ে। অধ্যাবসায় আর ভাগ্যদেবী তাকে দু হাত উজাড় করে দিয়েছে। একের পর এক উপহার দেন সুপারহিট সব সিনেমা। বলছি বাংলার চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি নায়করাজ রাজ্জাকের কথা।
একবার বিবিসি বাংলাকে নায়করাজ বলেছিলেন, আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা, আমার সবকিছু অভিনয় আর চলচ্চিত্র। এ ছাড়া আমি আর কিছু জানি না, পারি না। আল্লাহ আমাকে অনেক সুযোগ দিয়েছেন। অনেক কিছু করতে পারতাম। করিনি।
১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি টালিগঞ্জের নাগতলাপাড়ার ৮ নম্বর বাড়িতে তাঁর জন্ম। তখন কে জানত, জাপানি বোমারু বিমানের বোমা আক্রমণের আশঙ্কার মুখে জন্ম নেওয়া ছেলেটি হবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রবাদপ্রতিম পুরুষ? এটা হয়তো রাজ্জাক নিজেও জানতেন না। আর জানলে হয়তো প্রথম জীবনে ফুটবল খেলাকে আপন করে না নিয়ে চলচ্চিত্রকে আপন করে নিতেন। যদিও ফুটবল খেলার মাঠই তাকে অভিনয় করার পথ দেখিয়েছে।
বিবিসি বাংলার আরও এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এই শহরে আমি রিফিউজি হয়ে এসেছিলাম। স্ট্রাগল করেছি। না খেয়ে থেকেছি।’
বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা রাজ্জাক পরবর্তীকালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অংশ হলেন কীভাবে? এমন প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাজ্জাক জীবনে স্ট্রাগল বা সংগ্রামের কথা বলেছেন। সেটাই তার জীবনে সুফল এনে দিয়েছে। আরও একটু বিস্তারিত আলোকপাত করা যাক।
বন্ধু বদরুদ্দিনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে রাজ্জাক ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় পা রাখেন। সঙ্গে স্ত্রী খায়রুন নাহার লক্ষ্মী আর কোলে বাপ্পারাজ। শুরু তার নতুন এক জীবন। যে জীবনে দুবেলা খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার জন্য তাকে কাজ খুঁজতে হয় পথে পথে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাকের শুরুটা হয়েছিল সহকারী পরিচালক হিসেবে। পরিচালনা থেকে তাকে বেশি টানত অভিনয়। একবার আনিস নামের অন্য এক সহকারী পরিচালক পরিচালনায় সহকারী করা ছেড়ে অভিনয় করার কথা বলেন। তিনি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। ঢাকায়ও তিনি কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট ছবিতে অভিনয় করা আরম্ভ করলেন। পাশপাশি মঞ্চনাটকে যোগ দিলেন। নাট্যকার আবদুল সাত্তারের নির্দেশিত ‘পাত্রী হরণ’ নাটকের মাধ্যমে ঢাকায় তিনি প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। মাঝেমধ্যে তিনি এখানে–ওখানে অভিনয়ের জন্য অডিশন দিতে যেতেন। ছোট ছোট টেলিভিশন নাটিকাতেও অভিনয় করার সুযোগ পান।
পর পর দুটি ছবিতে সহকারী পরিচালনা করার পর সহকারী পরিচালনার কাজ ছেড়ে জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা করেন। জহির রায়হান তাকে ভালোভাবে পরখ করে নিজের লেখা ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য নির্বাচিত করেন। পরে কোনো এক কারণে ছবিটি হয়নি। পরবর্তীতে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবি দিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সফল হন। ছবিটি ব্যবসায়িক সফলতা পাওয়ায় তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রীতিমতো রিফিউজি থেকে নায়ক বনে গেলেন তিনি। একে একে ‘নিশি হল ভোর’, ‘বাঁশরী’, ‘ময়নামতি’, ‘মনের মত বউ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘আলোর মিছিল’সহ বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করে নিজের জাত চেনান। ক্রমান্বয়ে তিনি নির্মাতা ও প্রযোজকদের ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠেন। এসব ছবি বর্তমানে এসে কালজয়ী ছবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজ্জাক স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে কিছু উর্দু ছবিতেও অভিনয় করেন, ‘আখেরী স্টেশন’ (১৯৬৪), ‘উজালা’ (১৯৬৪), ‘গৌরি’ (১৯৯৮), ‘মেহেরবান’ (১৯৬৯), ‘পায়েল’ (১৯৭০) অন্যতম। এর মধ্যে ‘উজালা’ ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালকের কাজ করেন।
যে রাজ্জাক চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেই তিনি পরে কলকাতায় অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাই বলে তিনি নিজের মাতৃভূমি কলকাতায় ফিরে যাননি। পরম যত্নে বাংলাদেশকে ভালোবেসে থেকে গিয়েছেন লাল–সবুজ পতাকার তলে। নিজের অভিনয়গুণে রাজ্জাক ‘নায়করাজ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। আহমদ জামান চৌধুরী তাকে এই উপাধি দিয়েছিলেন।
রাজ্জাক সর্বমোট পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন : ‘কি যে করি’ (১৯৭৬), ‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮), ‘বড় ভাল লোক ছিল’ (১৯৮২), ‘চন্দ্রনাথ’ (১৯৮৪) ও ‘যোগাযোগ’ (১৯৮৮) এই ছবিগুলোতে অভিনয়ের জন্য। এ ছাড়া তিনি ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পান।
রাজ্জাক প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন। তার প্রথম প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবিটির নাম ‘অনন্ত প্রেম’। তারপর ‘মৌ চোর’, ‘বদনাম’, ‘অভিযান’, ‘সৎ ভাই’, ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘বাবা কেন চাকর’ এগুলো অন্যতম।
ব্যক্তিজীবনে রাজলক্ষীর সঙ্গে সুখের দাম্পত্যে রাজ্জাক ছিলেন তিন পুত্র ও দুই কন্যার জনক। তার দুই পুত্র বাপ্পারাজ ও সম্রাটও বাবার মতোই নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত৷
শেষ জীবনে নানা অসুখে আক্রান্ত ছিলেন নায়করাজ। আজ বাংলা সিনেমার এই কিংবদন্তির চলে যাওয়ার দুই বছর পূর্ণ হলো। তবুও আজও তিনি ভক্তদের মনে অমর হয়ে আছেন। মৃত্যুর পর তাকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। বাপ্পারাজ, সম্রাট, জায়েদ খান ও শাকিব খান- এই চার নায়কের কাঁধে চড়ে শেষ নিদ্রায় যান ঢাকাই সিনেমার রাজা রাজ্জাক।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: