সিডনী শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২২শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০২০ ২২:৪০

আপডেট:
২ জুলাই ২০২০ ২৩:৩১

 

বঙ্গবন্ধু সাধারণ বাঙ্গালীদের চেয়ে লম্বা- ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। তার ছিল মাথায় ধূসর রঙ্গের চুল। ঘন গোঁফ এবং তীক্ষ্ণ কালো চোখ। তিনি লক্ষ লোককে আকৃষ্ট করতে পারতেন তাঁর মিছিলে এবং তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন তার উত্তেজনাপূর্ণ বাগ্মীতায়, তার উত্তেচনাপূর্ণ বাগ্মীতায় দশ লক্ষ জনতাকে তাঁর মিছিলে আকৃষ্ট করতে পারতেন।

ব্যক্তিত্ব মানুষের একটি অমূল্য সম্পদ। এই ব্যক্তিত্ব প্রতিটি মানুষের নিজস্বতাকে বা অস্তিত্বকে প্রকাশ করে এবং পৃথক পৃথক ভাবে আলাদা করে পরিচয় প্রকাশ করতে সহায়তা করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব তেমন একটি সম্পদ ছিল তাঁর জীবনে। সে সম্পদটি সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল ও দ্বীপ্তমান। বাঙ্গালির রূপ ও অঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত ও স্থাপিত বাংলার সংস্কৃতির আবর্তে পরিবেষ্ঠিত হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্বকে প্রকাশ করতে গেলে তার ব্যক্তিত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে প্রথমে।

হিমালয়ের মত মন সমুদ্রের মত হৃদয়, বীরত্ব ও সাহস সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্বের জন্যই খুব অল্প বয়সে অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে বাংলার দুই মন্ত্রি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও এ.কে.এম ফজলুল হকের সংবর্ধনার দায়িত্ব পরেছিল তার ওপর। এই ব্যক্তিত্ব দিয়েই তিনি জয় করেছিলেন বাংলার মানুষের হৃদয়। বাংলার মানুষ ভালবেসে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেছিল তাকে। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের এই মানুষটি শুধু বাঙালিই ছিলেন না, সম্পূর্ণ বাঙালি জাতির অভিভাবক হয়ে যান অতি অল্প সময়ের মধ্যে। “জাতির পিতা” নামে সম্মানিত হলেন। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকলো বাংলা ও বাঙালির স্বপ্ন ও জীবনযাপন। একজন বিশ্ব বরেণ্য জননন্দিত নেতার ব্যক্তি চরিত্রে যে সব গুনাবলী থাকার প্রয়োজন তার সব কিছু নিয়েই যেন বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বক্তৃতার ইন্দ্রজালিক শক্তি দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।

অতি সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যখন প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন আধুনিক সাজ সজ্জার সরকারী বাসভবনের রাজকীয় জৌলস জীবন ত্যাগ করে নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেছিলেন ধানমন্ডীর ৩২ নম্বরের সাদামাটা নিজস্ব বাড়িতে। তার ঘরে ছিল অতি সাধারণ মানের আসবাবপত্র। পোষাকও ছিল খাটি বাঙালির। বাহিরে পায়জামা পাঞ্জাবি ও ঘরে তাতের লুঙ্গি পরতেন বঙ্গবন্ধু। কথাবার্তা চলনে বলনেও তিনি ছিলেন একজন সার্থক বাঙালি। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রবল ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ করতেন তার জীবন যাপনে। তিনি পছন্দ করতেন চিরায়িত বাঙালির খাদ্য ভাত ও মাছ (বিশেষ করে ছোট মাছ)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন যাপনও ছিল অতি সাধারণ। এই সাধারণত্ব এমনি তৈরী হয়নি। একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়ে জন্ম নেওয়াও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জন্য সৌভাগ্যের। বঙ্গবন্ধুর জীবনের এই সাধারণত্ব ও বাঙালিত্ব অর্জনের পেছনে তার পরিবারের অবদান ঊল্লেখযোগ্য ।

বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন সরকারী চাকুরীজীবী। আর মা সায়রা খাতুন ছিলেন অতি সাধারণ একজন গৃহিনী। চার মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে ছিলো শেখ লুৎফর রহমানের পরিবার। বড় মেয়ে ফাতেমা বেগম ছিলেন একজন সমাজ সেবক। দ্বিতীয় মেয়ে আছিয়া বেগম (শেখ মনির মা) স্বামীর চাকুরীসূত্রে কলকাতায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় থাকা কালীন সময়ে অধিকাংশ সময় এই বোনের বাড়িতে থাকতেন। কলকাতার বঙ্গবন্ধুর অভিভাবক হিসাবে ছিলেন এই আছিয়া বেগম এবং তার স্বামী। বঙ্গবন্ধু ছিলেন শেখ লুৎফর রহমানের তৃতীয় সন্তান। চতুর্থ হলেন আমেনা বেগম (ডাক নাম হেলেন)। খুবই সহজ সরল ছিলেন এই আমেনা বেগম। বঙ্গবন্ধু প্রায় সময় তার কাছ থেকে টাকা পয়সা ধার নিতেন। পঞ্চম হলেন খোদেজা (ডাক নাম লিলি)। তিনি ছিলেন খুবই সুন্দরী। ষষ্ট ও সবার ছোট ছেলে শেখ নাসের। শেখ লুৎফর রহমানের পরিবার থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবার। পারিবারিক আবহে একটি অন্যটির প্রতিচ্ছায়া। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকলে যেন একই বোধের মধ্যে দিয়ে বেড় উঠেছিলেন। পরিবারের প্রত্যেকটি সন্তান (শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহেনা) প্রত্যেকেই ছিলেন সংস্কৃতি ও খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে শেখ হাসিনা, শেখ কামাল ও শেখ রেহানা ছিলেন সংস্কৃতি সংগঠন ছায়ানটের সাথে যুক্ত। শেখ হাসিনা শিখতেন বেহেলা, শেখা কামাল শিখতেন সেতার আর শেখ রেহেনা শিখতেন গান। শেখ জামাল সংস্কৃতির সাথে সাথে খেলাধুলার চর্চার সাথে ছিল তার প্রত্যক্ষ সংযোগ। আরেক মহীয়সী নারীর নাম বেগম ফজিলাতুন নেছা রেনু, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনী। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের একমাত্র অভিবাভক। খুবই অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে রেনুর বিয়ে হয়। সম্পর্কে দু'জন চাচাতো ভাইবোন। অর্থ্যৎ রেনুর দাদা বঙ্গবন্ধুর বাবার চাচা হতেন। বেগম ফজিলাতুন নেছা রেনু শুধু মাত্র বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের এক নেপথ্যে সৈনিক। বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগীতা করেছেন।

সুষম দৈহিক গঠনে অশ্রুতপূর্ব কন্ঠ জ্যোতিময়ী অতিস্বাভাবিক হাবভাবে মুজিব ছিলেন প্রকৃতির এক নিখুঁত সৃষ্টি। কথাবার্তা চাল-চলন পোশাক-আশাকে, আহারে-বিহারে, চিন্তা ও চেতনায় মুজিব ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। এই বাঙালিদের গৌরবে তিনি ছিলেন মহিমান্বিত। তার হৃদয় ছিল সমুদ্রের মতো উদার। তার মন ছিল শিশুর মতো সরল। তার অনুভতি ছিল শিল্পীর মত আবেগপ্রবণ। তার নিবিড়তম সরলতার সাহচর্যে যিনি একবার এসেছেন তিনি মুজিবকে চিরদিনের মতো স্মরণ রেখেছেন।

শেখ মুজিবের সাহস, উদারতা ও ভালোবাসার প্রতি সবাই আকৃষ্ট হয় পড়ে। তিনি নেতাকর্মীর অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। সকলের কাছে তিনি হয় যান ‘মুজিব ভাই'। সকলের সাথে তিনিও ভাইয়ের মতই ব্যবহার করতেন। তাঁর স্মরণশক্তি এত প্রখর ছিল যে, তিনি কোন কর্মীকে দেখলে তার নাম ধরে ডেকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। কখনো পিঠ চাপড়ে, কখনো গলা টেনে।

শেখ মুজিবের ব্যক্তি চরিত্রের একটি প্রধান গুণ হলো, তিনি অন্যায়কে কখনও প্রশ্রয় দেননি। নীতির প্রশ্নে তিনি কখনও আপোস করেননি। তিনি গণতন্ত্রের আদর্শকে সমুন্নত রেখেছেন। সকল ধর্মের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খাঁটি মুসলমান ছিলেন। রোজা-নামাজ করতেন। তিনি ‘জয় বাংলা' স্লোগান ও ‘খোদা হাফেজ' উচ্চারণ করে জনসভা শেষ করতেন। অথচ ধর্মব্যবসায়ী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলো তাঁর বিরুদ্ধে কত মিথ্যা প্রচার করেছে তাঁর ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতির জন্য। ধর্ম নিরপেক্ষ ধর্মহীনতা নয়, যার যার ধর্ম তার তার কাছে। দেশে সকলে স্বধীনভাবে ধর্ম পালন করবে।

তাঁর বিদ্রেহী সত্তা বিদ্রেহী বাংলার বহির্প্রকাশ। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী এবং বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের চেতনার প্রতীক। তিনি এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার নির্যাতিত মানুষের একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন শ্রেণীহীন নেতা। শ্রেণীহীন নেতা হবার গুণাবলী তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তাঁকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কে অনেক মিথ্যা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। মৃত্যুর পর দেখা গেল তাঁর ব্যাংকের হিসাবে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে। তিনি একজন নিঃস্ব মানুষ হিসেবে বিদায় নিয়েছেন। সরকারী ভবনে তিনি থাকতেন না, থাকতেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজ ভবনে। তিনি সরকারী ভবনে বাস করলে হয়ত তার পরিবারকে এমনভাবে প্রাণ দিতে হতো না।

মুজিবের অন্তর ছিল আকাশের মত উদার। রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন বজ্রকঠোর এই লৌহ মানবটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের পর্যায় ছিলেন একবারে উদারপন্থী। রাজনৈতিক অঙ্গণে আদর্শের প্রশ্নে চিহ্নিত চরম শত্রুও যদি কোন প্রয়োজনে তার দ্বারস্থ হতেন, তিনি তাদের আশাতীতভাবে তুষ্ট করে দিতেন। রাজনৈতিক কারনে দলীয় সংঘাত ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ মুজিবের সামাজিক ও মানবিক আচরণকে কোনদিনই প্রভাবিত করতে পারেনি। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও সূর্যের মত জ্বলন্ত ব্যক্তিত্বের কাছে অনেক বিরোধীকেই হার মানতে হয়েছে। চাল-চলন, কথাবার্তা হাবভবে প্রকৃতির অদ্ভুত সৃষ্টি এই মানুষটি ছিলেন একজন সার্থক জন্মগত শিল্পী। অসাধারণ ব্যক্তিত্বই ছিল তাঁর সামগ্রিক সৌন্দর্য্যরে প্রকৃত উৎস।

শেখ মুজিবের ব্যক্তি চরিত্রে ছিল বিদ্রোহী সত্তা। তাঁর পূর্বপুরুষরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছেন। তাঁর মতো বিদ্রোহী বাঙালী এ ভ‚খন্ডে জন্মগ্রহণ করেনি। হাজার হাজার লোককে তিনি আপন করে নিতে পারতেন। তিনি অবলীলাক্রমে সকলকে মাতিয়ে রাখতে পারতেন। সিরাজউদ্দৌলা আলেয়াকে বলেছিলেন-বাঙালীরা হাসতে জানে না। কিন্তু সুখ-দুঃখে সকল সময় বাংলার এক বন্ধু বন্ধুদের ও কর্মীদের সাথে প্রাণখোলা হাসি দিয়ে কথা বলতেন। তাঁর ভক্তবৃন্দ তাঁকে ঘিরে থাকতেন। তিনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সকলকে আপন করে নিতেন। তাঁর ফুফাত ভাই মমিনুল হক, ভাই শেখ নাসের, ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মণি, মোল্লা জালালউদ্দিন, মইনুল হক, জহিরুল ইসলাম, কবি সুফিয়া কামাল, কবি জসিমইদ্দীন প্রমুখ ছিলেন তাঁর সুখ-দুঃখের সাথী।

শেখ মুজিবুর রহমান দয়ালু স্বভাবের ছিলেন। তিনি রূপসী বাংলার মুখ। বাংলার হাসি-কান্না-দুঃখ-বেদনার আশ্রয়ন্থল তাঁর হৃদয়। ভবিষ্যত তাঁর মধ্যে বাক্সময়। তিনি বাংলার মাটির সাধারণ মানুষ। তিনি বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। বাংলার মাটি, আলো-বাতাস আর মানুষ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল। গ্রামের মানুষের দুঃখ-কষ্টে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠতো। তিনি ছিলেন বিদ্রোহী বাংলার মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথ প্রদর্শক।

১৯৭১ সালের শহীদদের স্মরণ করতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য গভীর রাতে কেঁদেছেন। বাংলার হাজার সমস্যায় তাঁর হৃদয় ভারাক্রান্ত ছিল।

তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ। অসংখ্য লোককে তিনি অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালে দালালী মামলায় বন্দী নেতাদের পরিবারকে গোপনে অর্থ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। দাতা হিসেবে শেরে বাংলার পরেই তাঁর স্থান। অনেকের ব্যক্তিগত খেয়াল বা হবি থাকে। বঙ্গবন্ধুর হবি ছিল রাজনীতি ও মানুষকে ভালবাসা। রবীন্দনাথের কবিতা আবৃত্তি তাঁর অন্যতম হবি ছিল। শৈশব থেকে তিনি পশু-পাখি পছন্দ করতেন।

তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন ও সরল মনের অধিকারী। তাঁর হৃদয়ে ছিল দুর্জয় সাহস। দুর্জয় সাহস ছিল বলেই তিনি সহজ-সরল ছিলেন। গভীর  আত্মবিশ্বাস ও বিরাট ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর চরিত্রের মহান স্তম্ভ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। এ সম্পর্কে অনেক কাহিনী আছে। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের গুণাবলী বর্ণনা করে শেষ করা যায় না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনে একজন ভদ্র, নম্র, স্নেহময় ও সদালাপী ব্যক্তি ছিলেন। সারা জীবন তিনি পিতা, মাতা ও গুরুজনদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনকে তিনি খুব ভালবাসতেন। তিনি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান তখন তাঁর পিতা ও মাতা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী তাঁর টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। ঘরে আগুন দেয়ার আগে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। কিন্তু যদি তাঁরা ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বেঁচে থাকতেন তবে ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা পেতেন না।

লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মুকুটবিহীন সম্রাট বলেছে। যুদ্ধসঙ্কটে জর্জরিত ইংল্যান্ডবাসীর কাছে স্যার উইনস্টন চার্চিল, নেতাহীন ফরাসীদের কাছে দ্যগলে, ইন্দোনেশিয়ার কাছে সুকর্ন, কিউবার কাছে ক্যাস্ট্রো যেমন, তেমনি বাংলার শোষিত জনগণের নিকট ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের পটভুমিকায় শেখ মুজিব বাংলাদেশের মানুষের সমষ্টি। তিনি এ দেশের মুক্তির উজ্জ্বল প্রতীক। একটি জীবন্ত আদর্শ-সত্য, ন্যায়, সংগ্রামের অগ্নিশিখা-যা যুগ যুগ বাঙালী জাতিকে পথ পদর্শন করবে।

পৃথিবীর যেখানেই তিনি গেছেন বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে কথা বলেছেন। তিনি যে একটি ছোট গরিব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তা কখনো তাঁর চিন্তার মধ্যে ছিল না। তিনি মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন এবং বাঙালির সম্মান তিনি সব জায়গা থেকেই আদায় করেছেন। জাপানে সাধারণত প্রধানমন্ত্রী বিমান বন্দরে না এলেও তিনি যখন গেলেন তখন তানাকা এসে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। জোট নিরপক্ষে সম্মেলন জীবিত দুজন নেতার নামে তোরণ হয়েছিল-একজন মার্শাল টিটো, আরেকজন বাংলা নেতা শেখ মুজিব। আর মৃত চারজনের নামে তোরণ হয়েছিল নেহরু, নাসের, সুকার্নো, নক্রুমা যারা স্থপতি ছিলেন এই নন এলায়েন্স কনফারেন্সের। সেখানেই তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু'ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে'। জাতিসংঘে ভাষণ এরাবিক, স্প্যানিশ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান এই পাঁচ ভাষার দেয়ার রেওয়াজ। তিনি তা উপেক্ষা করে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিলেন দীর্ঘ ৪৫ মিনিট।

বক্তৃতা শেষে ১৫ মিনিট করতালি হলো। তখন তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ার এসে বললেন ‘তুমি শুধু তোমার বাঙালি জাতিরই নেতা নও। এমন দিন আসবে যেদিন তুমি তৃতীয় বিশ্বের সমগ্র নির্যাতিত শোষিত আর বঞ্চিত মানুষের নেতৃত্ব দিবে'। ইসলামিক সম্মেলনে যখন তিনি গেলেন পাকিস্তানের রাস্তার দু'পাশে হাজার হাজার লোক জীয়ে মুজিব জীয়ে মুজিব স্লোগান তাদের মুখে মুখে। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে নয়মাস জেলখানায় ছিলেন তখন জেলখানার ডিআইজি এসে আমাদের বললেন, তোমাদের গর্ব করা উচিত। এমন নেতা তোমাদের। জেলের মধ্যে কবর খুঁড়ে বলেছি যে আপনি কবরে যেতে চান, না প্রধানমন্ত্রী হতে চান। তিনি বলেছেন আপোস করে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই না। আমি জানি বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে। আমি কবরই বেছে নেব। কিন্তু আমাকে এই কবরে সমাধিস্থ না করে আমাকে ফাঁসি দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে দিও। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন  শ্রেষ্ঠ বাঙালি, একজন বিশ্ববিখ্যাত নেতা। তিনি তার মানুষকে হৃদয় দিয়ে  ভালোবসাতেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি।

 

বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য ঘটনা

 

১. মানুষের প্রতি খোকার ভালোবাসা

বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম ছিল খোকা। তাঁর দাদা ও নানার ঘর ছিল পাশাপাশি। বঙ্গবন্ধুর মেজো চাচার কোনো ছেলে- মেয়ে ছিল না। বংশের বড়ো ছেলে হিসেবে সমস্ত আদর সোহাগ তিনিই পেয়েছেন। টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করা হয় সাত বছর বয়সে। বাবা শেখ লুৎফর রহমান স্কুলে যাবার পথে খোকা যাতে বৃষ্টিতে না ভেজে তার জন্য ছাতা কিনে দিয়েছিলেন। খোকা তো আর নিজের কথা ভাবে না। সবার দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য তাঁর জন্ম হয়েছে। খোকা সেই ছাতাটা একদিন দিয়ে আসলো গরিব বন্ধুকে। বন্ধুটি চোখ উজ্জ্বল করে তাকিয়ে ছিল খোকার দিকে। বন্ধুর খুশিই যেন খোকার খুশি। আর একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে খোকা দেখতে পায় এক গাছের নীচে বসে একজন ভিখারি ভিক্ষে করছেন। বুড়ো মানুষ শীতে কাঁপছেন ঠকঠক করে। খোকা নিজের গায়ের চাদর বুড়োর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘চাদরটা আপনাকে দিলাম'। মানুষের প্রতি খোকার ভালোবাসা দেখে বাবা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর ছেলেটি সবার মতো না। ছেলেটি অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। এই ছেলেই একদিন দেশ গড়ে তুলবে, বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করবে।

 

২. ছেলেবেলার একটি ঘটনা

স্কুল ছুটি। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ থেকে বাড়ি এসেছেন। সে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভাল ফসল হয়নি। গ্রামে এসে তিনি দেখলেন অবাব-অনটন, চারদিকে দুর্ভিক্ষাবস্থা। মানুষের দুর্দশা দেখে শেখ মুজিব স্থির থাকতে পারলেন না। পিতা পাটগাঁও পোস্ট অফিসে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে। সেই সুযোগে গাঁয়ের সমস্ত অনাহারি মানুষকে ডেকে এনে নিজেদের গোলার ধান বিলিয়ে দিলেন। পিতা প্রথমে রেগে গেলেও ছেলের এই মহৎ প্রাণটাকে ক্ষমা করেছিলেন।

(ভবেশ রায়, বঙ্গবন্ধুর জীবন কথা, এশিয়া পাবলিকেশন্স, ১৯৯৪, পৃঃ ২২)

 

৩. প্রথম গ্রেফতার

দশ-এগারো বছর বয়সেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। জীবনের শুরুতেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বসুলভ মনোভাব গড়ে ওঠে। শেখ মুজিব তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র। স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। প্রতিপক্ষের চাপে মহকুমা প্রশাসক সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করেন। শেখ মুজিব তাঁর কৌশল পাল্টে এক মসজিদ প্রাঙ্গণে ধর্মসভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করলেন। পুলিশ সেখানে থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করল। তাঁকে ‘সেকেন্ড কোর্টে' হাজির করা হলো। সাথে সাথে ছেলেরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। তাদের শ্লোগান, ‘হয় আমাদের নেতাকে ছেড়ে দাও, আর নইলে সকলকে এক সাথে জেলে ঢোকাও'। ভাংচুর শুরু হয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে কোর্ট থেকেই দু'ঘণ্টা পরে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হলো।

 

৪. শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে শেখ মুজিবের পরিচয়

১৯৩৮ সাল। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এবং খাদ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে সভা শেষে মিশন স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিলাস বাবু। শেখ মুজিব সঙ্গীদের নিয়ে পথরোধ করলেন। নিজের বিপদ দেখে প্রধান শিক্ষক দ্রুত এগিয়ে গেলেন। কিন্তু ফল হলো না। শেরে বাংলা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলে, তুমি কি বলতে চাও?” শেখ মুজিব নির্ভীকভাবে বলতে লাগলেন “আমরা এই স্কুলের ছাত্র। হোস্টেলে থাকি। ছাদ ফেটে পানি পরে আমাদের বিছানাপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।” শেরে বাংলা হেসে বললেন, “তা আমি কি করব।”

“হোস্টেলের ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা না করে গেলে পথ ছেড়ে দেব না।”

“বেশ, কত টাকা লাগবে?”

“বারো শ'টাকা।”

শেরে বাংলা বালকটির সাহস দেখে মুগ্ধ হলেন। সেইখানে দাঁড়িয়েই সাথে সাথে তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১২শ' টাকা মঞ্জুর করে দিলেন।

(ভবেশ রায়, বঙ্গবন্ধুর জীবন কথা, এশিয়া পাবলিকেশন্স, ১৯৯৪, পৃঃ ২৬)।

 

বাংলোয় এসে সোহরাওয়ার্দী এই সাহসী বালকটির ব্যাপারে শেরেবাংলার সাথে আলাপ করলেন। তারপর নিজেই একটি স্লিপ লিখে শেখ মুজিবকে ডেকে পাঠালেন। শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে শেখ মুজিবের পরিচয় হলো। তারও পরে পরিচয় হয় মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে। এই তিন নেতার আদর্শে বেড়ে ওঠা শেখ মুজিব এক সময়ে তাঁদের সবাইকে ছাড়িয়ে যান। তাঁদের সকলের সদ্গুণ গ্রহণ করে স্বীয় সৃজনশীলতা ও সাহসে অবিস্মরণীয় এক নেতা হয়ে ওঠেন।

 

৫. শেখ মুজিবের প্রথম কারাবাস

স্থানীয় একটি মেলাকে কেন্দ্র কের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানিদাতা সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র ও সাজানো মামলায় মাত্র ১৯ বছর বয়সে শেখ মুজিব প্রথম ৭ দিনের কারাবরণ করে। এর আগেও কয়েকবার তাঁকে থানায় আটক কিংবা হাজতবাসে থাকতে হয়েছে। জীবনের প্রথম জেলে যাওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিব বলেন, “আমার যেদিন প্রথম জেল হয়, সেদিন হতেই আমার নাবালকত্ব ঘুচেছে  বোধ হয়।”

 

৬. বঙ্গবন্ধু উপাধি

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৯ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়।

সে সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেন। এ উপাধিতে তিনি সারা বিশ্বে বঙ্গবন্ধু নামে পরিচিত হন।

(জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর পরিবার-পরিজন ইসলামিক ফাউন্ডেশন ডিসেম্বর' ২০১৭- পৃষ্টা- ২৪)

 

৭. বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য ঘটনা

ছোঁয়াচে রোগের মধ্যে বসন্ত ও কলেরা ছিল ভয়াবহ। সে সময় বসন্ত রোগ ও কলেরা হলে মানুষ ভয় পেয়ে যেত। ছোঁয়াচে রোগ হওয়াতে সেবাকারীরাও আক্রান্ত হয়ে তখন মারা যেত। তাই আপনজনেরাও রুগীকে এড়িয়ে চলত, সেবা করার জন্য বেশি কাছে যেত না। একবার কিশোর শেখ মুজিবের গৃহশিক্ষকের হল সেই বসন্ত রোগ। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বাড়ির কেউ শিক্ষকের ঘরে যেত না। কিন্তু সব ভয় ও ভাবনাকে পেছনে ফেলে কিশোর মুজিব গরম পানি করে নিজের হাতে শিক্ষককে সেবা করেন, বিছানার চাদর বদলে দেন, ওষুধ-পথ্যি খাওয়ান। এভাবে দিন রাত সেবা-যত্ন করে শিক্ষককে সুস্থ করেন তিনি।

(জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শিশু গ্রন্থমালা, ২০১৮।

সম্পাদনা- হাশেম খান ও মুনতাসির মামুন)

 

৮.  ডাকাত দলের কবলে বঙ্গবন্ধুর

তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনদরদি মানুষ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। একবার তিনি রাজনৈতিক কাজে গভীর রাতে নৌকা যোগে রওয়ানা দিয়েছেন। সেই সময় নদীতে প্রায়ই ডাকাতি ও লুটতরাজ হত। নদীপথে কিছুদূর গেলে সত্যি সত্যি তাঁর নৌকার পিছু নিল এক দল ডাকাত। তারা দূর থেকে হুঙ্কার দিয়ে বলল নৌকা থামাও। মাঝি ভয়ে কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করল  ‘হুজুর কী করব?’ শেখ মুজিব নির্ভয়ে বললেন ‘তুই ওদের কথায় কান না দিয়ে জোরে জোরে নৌকা চালিয়ে যা।‘ নৌকা না থামাতে ডাকাতরা ক্ষেপে গেল খুবই। অনেকক্ষণ নৌকা বেয়ে ডাকাতরা শেখ মুজিবের নৌকার কাছে এসে পড়লে শেখ মুজিব মাঝিকে বললেন, ‘এবার বল এটা শেখ মুজিবের নৌকা।‘ মাঝি সে কথা বলতেই সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতদের হুঙ্কার ও চোটপাট বন্ধ হয়ে গেল। নরম সুরে ডাকাতরা বলল ‘সে কথা আগে বলবি তো।‘

 

৯.  বাংলাদেশ নামকরণ

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয। অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে এক বৈঠকে বসলেন। বাঙালি যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন নিয়ে আজ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে এ দেশটির নাম কি হবে। অনেকেই অনেক প্রস্তাব রাখলেন। কেউ পূর্ব বাংলা রাখার প্রস্তাব দিলেন, কেউ দিলেন বঙ্গভূমি রাখার প্রস্তাব। বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দিয়ে সবার কথাই শুনলেন।

তারপর বললেন, আমি একটি নাম দিয়েছি কেমন হয় বলতো। আমাদের দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ'। সবাই বঙ্গবন্ধুর দেয়া এই নামটি ভীষণ পছন্দ করলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন “আমরা ১৯৫২ সালের সংগ্রামের মাধ্যমে নিয়েছি ভাষা, আর সে ভাষাটি হলো ‘বাংলা', আর এখন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করব ‘দেশ', এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে হবে ‘বাংলাদেশ'।” সাথে সাথে সবাই নামটা গ্রহণ করলেন।

 

১০. বঙ্গবন্ধু ও মুজিব কোট

শুরু করছি একটি ঘটনা দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্র একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনেক কাছ থেকে দেখলেন, কথাও বললেন দীর্ঘক্ষণ। কথা শেষে উঠে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন তার কালো কোটটি গায়ে জড়াচ্ছিলেন, তখন ওই ছাত্র লক্ষ্য করলেন কোটে ছয়টি বোতাম। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন, আপনার কোটের বোতাম ছয়টি কেন? বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন প্রশ্ন এর আগে আমাকে কেউ করেনি। তুই প্রথম। এই ছয়টি বোতাম আমার ঘোষিত ছয় দফার প্রতীক।' বঙ্গবন্ধু ঠিক কত সাল থেকে হাতাবিহীন এই কালো কোট পরা শুরু করেছিলেন সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক যখন আওয়ামী মুসলীম লীগের নেতা, তখন বঙ্গবন্ধু সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে এই কোট পরতে দেখা গেছে বেশি। তবে এ কোটের প্রচলন ‘নেহেরু কোট' থেকে। ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় জওহরলাল নেহেরুর (স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী) ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে নেহেরু কোটের প্রচলন শুরু হয়। পরে বঙ্গবন্ধু এমন কোট পরতেন বলে এর নাম দেয়া হয় ‘মুজিব কোট'।  বঙ্গবন্ধু স্বভাবতই তার পছন্দের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির মতোই কোটটি ব্যবহার করতেন।

 

১১. বঙ্গবন্ধুর চশমা

বোনদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যশিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন পণ্ডিত সাখাওয়াতুললাহ। শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা ও টুঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। গিমাডাঙ্গা বিদ্যালয়ে তিনি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর দেওয়ানী আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মাদারীপুর নিয়ে যান এবং ১৯৩৪ সালে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। মাদারীপুরে থাকাকালে শেখ মুজিবুর রহমান বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন এবং চোখে ছানি পড়ে। ১৯৩৫ সালে শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জে বদলি হন। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। চোখের অসুখের জন্য তিন বছর তাঁকে পড়া বন্ধ রাখতে হবে। পিতা তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাঃ টি আহম্মদ চোখে অস্ত্রোপচার করেন এবং চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তখন থেকে তিনি চশমা পরা শুরু করেন।

 

১২. বঙ্গবন্ধুকে Poet of Politics আখ্যা প্রদান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, ভারতের  মহাত্মা গান্ধী ও পাকিস্তানের কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে তুলনা করা হয়।

১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর পাঞ্জাবের হিন্দু, মুসলমান ও শিখরা যে জঘন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, তার উপর গান্ধী ও জিন্নাহর কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলা এবং ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় যে হানাহানি হয়েছিল, সেখানেও প্ররোচনা ছিল হিন্দু ও মুসলমান মৌলবাদী নেতাদের। বঙ্গবন্ধু এই দুটি বিভক্ত সম্প্রদায়কে একত্রিত করেছিলেন।

১৯৪৭-এ সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বোস অবিভক্ত বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বাধা দিয়েছিলেন। প্রফেসর জয়া চ্যাটার্জী তাঁর Bengal Divided গ্রন্থে বলেছেন, হিন্দু বাবুদের অনীহার কারণেই ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয়েছিল। আসলে সে সময়ে বাংলা বিভক্ত হয়েছিল মুসলমান ও হিন্দু মৌলবাদী নেতাদের কারণে। এই বিভক্ত বাঙালি জাতিকেই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু একত্রিত করেছিলেন। এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই তাঁর অবর্তমানে তাঁরই সুযোগ্য সহচর তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী নামে পরিচিত এক লক্ষ সৈন্যকে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেছিল।

মহাত্মা গান্ধী ভারতবাসীকে অনেকদিন ধরে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করে ১৯১৯ সালের ১ আগস্ট ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্র“য়ারি সেই অসহযোগ আন্দোলন চরম ব্যর্থতায় পরিণত হয়। সেই দিন সে সময়ের ভারতের যুক্তপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরিচওরা গ্রামের থানায় আগুন ধরিয়ে দেয় নিয়ন্ত্রণহীন বিক্ষুব্ধ জনতা। সে আগুনে পুড়ে মরলো আটজন ভারতীয় কনস্টেবল। তখন বিক্ষুব্ধ জনতার উপর স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। গান্ধী স্বীকার করেন, তাঁর অসহযোগ আন্দোলন চরম ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমগ্র বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ) অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। তখন সমগ্র পাকিস্তানে সমারিক আইন ( মার্শাল ল') বলবৎ ছিল। কিন্তু সমগ্র বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিল। পাকিস্তানের সামরিক শাসন বিকল হয়ে গেল। সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থা প্রায় তিন সপ্তাহ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। ইতিহাসের অসাধারণ এই অসহযোগ আন্দোরন চরম সফলতা লাভ করলো বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। এই সময়ে জনতার উপর বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং কোথাও কোন অঘটন ঘটেনি। আমেরিকার Newsweek পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে সে সময় Poet of Politics আখ্যা দিয়েছিল।

চলবে

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top